Site icon আলাপী মন

অনুবাদ- সাদা হেরন

সাদা হেরন
-সারা ওর্ন জুয়েট
অনুবাদে- বর্ণালী জানা সেন

 

 

বেলা পড়ে আসছে। তবে গ্রীষ্মের শেষ বিকেলের এই মরা আলোয়এখনও বনের গাছ-গাছালি, লতা-পাতা রাঙা হয়ে রয়েছে। নয় নয় করে আটটা বাজতে চলল। ছোট্ট ঐ মেয়েটা বনের পথ ধরে চলেছে। সঙ্গে একটা গরু। গরুটাকে সে হ্যাট হুট করতে করতে বাড়ি নিয়ে যাচ্ছে। গরুটা চলে দুলকি চালে, একবার একবার এখানে দাঁড়ায়, একবার ওখানে। গরুর সঙ্গে তাল রাখতে গিয়ে মেয়েটাও পিছিয়ে পড়ে। তবে সে রাগ করেনা মোটেও। গরুটা যে তার সঙ্গী। সূর্যাস্তের আলো গায়ে মেখে তারা গভীর জঙ্গলে ঢোকে। তাদের কোনও ভয়ডর নেই। এ পথ যে তাদের হাতের তালুর মতো চেনা। চোখ বন্ধ করেও তারা দিব্যি চলে যেতে পারে।
গরমের এই দিনগুলোতে গরুটার দস্যিপনা বাড়ে। যে মাঠে মেয়েটা তাকে চরতে দিয়ে আসে সেখান থেকে পালিয়ে ঝোপ-ঝাড়ের আড়া্লে লুকিয়ে থাকে। মেয়েটা তাকে খুঁজতে গিয়ে গলদঘর্ম হয়। গলায় একটা ঘন্টি আছে বটে গরুটার। কিন্তু সে যদি দুষ্টুমি করে এক জায়গায় গ্যাঁট হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে তবে কি ঘণ্টি বাজবে! না কেউ নাগাল পাবে! তাই তাকে খুঁজতে গিয়ে সিলভিয়া একেবারে নাস্তানাবুদ। বাচ্চা মেয়ে সে। কাঁহাতক কতক্ষণ আর ধৈর্য থাকে। নেহাত গরুটা মনিবদের রসে বশে রাখে…গামলা ভর্তি দুধ দেয়! নাহলে ওর কপালে দুঃখ ছিল। সিলভিয়ার হাতে অবশ্য প্রচুর সময়। কী করবে না করবে সে নিজেও বুঝে পায় না। তবে যেদিন আকাশ পরিষ্কার থাকে…আবহাওয়া ভালো থাকে সেদিন অবলা এই প্রাণীটার সঙ্গে লুকোচুরি খেলতে ভালোই লাগে। ও ছাড়া তার খেলার সঙ্গীই বা আর কে আছে! খেলতে খেলতে গরুটা নিজেই হাঁপিয়ে পরে ধরা দিয়ে দেয়। তার আবার কত গালভরা নাম মিস্ট্রেস মলি। গরুর সাড়া পেয়ে মুচকি হাসে সিলভিয়া। বাছাধন পথে এসো এবার! বিলের ধার থেকে মলি-কে ধরে বাড়ির দিকে হাঁটা দেয় সিলভিয়া। যেতে যেতে আদর করে গরুটার মুখে খানিকটা ঘাস-পাতা গুঁজে দেয়। মলি এবার আর আর দুষ্টুমি করে না। সুবোধ বালিকার মতো হেঁটে চলে। এবার সে বাড়ি যাবে। গামলা উপচে দুধ দেবে। সিলভিয়ার ভয় তো দিদিমা-কে। বাড়ি ফিরলেই তো সে বুড়ি খ্যাঁক করে এসে ধরবে… ‘এত দেরি যে! তা ছুঁড়ির কোথায় বেড়ানো হচ্ছিল?’ ঘর থেকে সে বেরিয়েছে সাড়ে পাঁচটায়। এই দস্যি গরুটাকে খুঁজে খুঁজে বাড়ি আনা তো আর চাট্টিখানি কথা নয়! মিসেস টিলিরও এই অভিজ্ঞতা আছে। সিলভিয়া আসার আগে তাঁকেই তো গরু খুঁজতে যেতে হত। সে যে কী ঝামেলার! এই ছোট্ট মেয়েটাকে দোষ দিয়ে আর লাভ কী! সিলভিয়া আসার পর তাঁর ঝামেলাঅনেক কমেছে। তবে এমন পাড়াবেড়ানি মেয়েও তিনি জীবনে দেখেননি। সারাক্ষণ শুধু বনে-বাদাড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। পাড়াপড়শিরা বলে… ‘আহারে কচি মেয়ে! জন্ম ইস্তক নোংরা ঐ ঘিঞ্জি শহরে বন্দী হয়ে কাটিয়েছে! এই আট বছর বয়সে এই খোলামেলা জায়গায় এসে একটু হাঁপ ছেড়ে বেঁচেছে’। সে যে ছিন্নমূলের মতো এখানে এসে পড়েছে সিলভিয়ার তা মনেই হয়না…যেন জন্মজন্মান্তর ধরে তার এখানেই বাস। ঘিঞ্জি ঐ শহরটার কথা মনে পড়ে গেলে তার ঐ শুকনো জেরানিয়াম ফুলের ছবিটাই ভেসে ওঠে। কত অযত্নে…অনাদরে পাশের বাড়ির টবে নেতিয়ে পড়েছিল গাছটা।
মিসেস টিলি মনে মনে বলেন… ‘মেয়েটা লোকজনকে খুব ভয় পায়’। তাই তো মেয়ের বাড়িতে একপাল ছেলেমেয়ের মধ্যে সিলভিয়াকেই এনে নিজের কাছে রেখেছেন। মেয়ের কাছ থেকে বাড়ি ফেরার সময় তিনি ভাবেন… ‘ওরা বলে মেয়েটা নাকি বাইরের লোককে খুব ভয় পায়। তা আমার ওখানেই ও ভালো থাকবে’। নাতনি নিয়ে দিদা যখন বাড়ি ফিরে তালাটা খোলেন তখন কোত্থেকে একটা বেড়াল এসে মিঁউ মিঁঊ ডাক জুড়ে দেয়। আদুরে মেয়ের মতো দিদার গায়ে মাথা ঘসে। সব ভয় কেটে যায় নাতনির। সে ভাবে… ‘এত সুন্দর জায়গা তো পৃথিবীতে আর একটাও নেই’। আর কক্ষনো ঐ ঘিঞ্জি নোংরা শহরটায় সে আর ফিরবে না।
মলিকে নিয়ে ছায়াঘেরা বনপথে হেঁটে যায় বাচ্চা মেয়েটা। গরুটা বার বার পিছিয়ে পড়ে। তাড়াতাড়ি পা চালায় সিলভিয়া। জল খাবে বলে গরুটা আবার একটা জলার সামনে দাঁড়িয়ে পড়ে। সিলভিয়াও দাঁড়িয়ে পড়ে। ঠান্ডা জলে পা ডুবিয়ে দেয়। তা গা ঘেঁসে কত প্রজাপতি উড়ে যায়। গরুটাকে নিয়ে আবার সে হাঁটা সেয়। পাখিরা সব বাসার ফিরছে। তাদের কলকাকলি এক সুরেলা রেশ রেখে যায় তার মনে। গাছেদের ডালপালাগুলো হাওয়ায় দোলে। পশু-পাখিরা যে যার ঘরে ফিরছে…ফিরতে ফিরতে তারা একে-অপরকে যেন বলছে… ‘বন্ধুগণ শুভরাত্রি’। হাঁটতে হাটঁতে সিলভিয়ারো বড় ঘুম পায়। আর বেশি দূর নয়, কাছেই বাড়ি। বুনো ফুলের গন্ধে বাতাস আজ মাতাল হয়েছে। আজ বড্ড বেশি দেরি হয়ে গেছে। এতক্ষণ সে কখনও বাইরে থাকেনি। এই ঘন জঙ্গল…এখানকার গাছ-গাছালি, পশু-পাখির সঙ্গে সে একাত্ম হয়ে গেছে। সে এই মাটিরই কন্যা। এক বছর হল সে দিদার বাড়ি চলে এসেছে। আচ্ছা ঐ ঘিঞ্জি শহরটায় সবকিছু কি আগের মতোই চলছে! ঐ লালমুখো ছেলেটাকি এখনও সবাইকে বিরক্ত করে বেড়াচ্ছে! ছেলেটাকে দেখলেই ভয়ে কুঁকড়ে যেত সে। কী পাজি ছেলে! সবসময় তাকে ভয় দেখাত! ছেলেটার কথা মনে পড়তেই সে প্রায় দৌড় লাগায়। এখানেও সে এসে পড়বে না তো!
বনের নীরবতা চিরে হঠাৎ করে এক শিসের আওয়াজ! কে হতে পারে! ভয়ে সাদা হয়ে যায় মেয়েটা। এ তো কোনও পাখির ডাক নয়। এখানকার সব পাখি তার চেনা। তাদের ডাক অনেক পেলব…আদুরে। এ যেন কোনও বখাটে ছোঁড়ার শিস মনে হচ্ছে। গরুটার যা হয় হোক…সে এখন একটা ঝোপের আড়ালে লুকোতে পারলে বাঁচে। কিন্তু লুকোতে যে তার একটু দেরি হয়ে যায়! তার আগেই শত্রু এসে তাকে পাকড়াও করে। একগাল হেসে শত্রু বলে… ‘ও খুকি বড় রাস্তাটা আর কতদূর’। ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে সিলভিয়া জবাব দেয়… ‘অনেকটা দূর’। কিন্তু তার ঐ মিনমিন গলা আগন্তুকের কানে গেল কিনা কে জানে!
আগন্তুকের চেহারা লম্বা-চওড়া। কাঁধে একটা বন্দুক। সেদিকে না তাকিয়ে ঝোপ থেকে বেরিয়ে গরুটাকে নিয়ে হেঁটে চলে সিলভিয়া। অবাক হয়ে দেখে সে লোকটিও চলেছে তার পাশে পাশে। লোকটাই প্রথম আলাপ জমায়… ‘বুঝলে খুকি আমি এখানে পাখি শিকারে এসেছিলাম। তারপর বনের মধ্যে ঢুকে পথ হারিয়ে ফেলেছি। আমার এখন একজন বন্ধু খুব দরকার। না না, আমাকে ভয় পেয়োনা…তোমার নাম কী? আমি কি তোমাদের বাড়িতে আজ রাতটা কাটাতে পারি। কাল সকালেই আবার শিকারে বেরিয়ে পড়ব’।
ভয়ে বুক দুরুদুরু করে সিলভিয়ার। দিদা তো আর কিছু বুঝবে না…শুধু তাকেই দোষ দেবে। এমনটা যে ঘটবে সে কি আগে থেকে জানত নাকি? তার কোনও দোষ নেই। আগন্তুক আবার তার নাম জিগ্যেস করে। কাটা গাছের মতো মাথাটা হেলিয়ে সে কোনওরকমে বলে ‘সিলভি’।
ওদিকে বাড়ির গেটের সামনে দাঁড়িয়ে তিন মূর্তিকে দেখতে পান মিসেস টিলি। গরুটা তাঁকে দেখেই হাম্বা করে ডেকে ওঠে। দিদা একেবারে রেগে লাল… ‘এবার কী বাহানা আছে শুনি তোর? এবারও কি গরুটা তোকে ছুটিয়ে নিয়ে বেড়িয়েছে নাকি?’ সিলভিয়া চুপ। সে যে কত বিপদে পড়েছিল দিদাকে কিছুতেই বোঝানো যাবে না। লোকটাকে দেখে দিদা নিশ্চয়ই ভেবেছে এখানকার চাষি-বাসির ছেলে হয়তো জুটেছে তার সঙ্গে!
লোকটা এবার তার বন্দুকটাকে দরজার পাশে রেখে কাঁধ থেকে মস্ত বোঝটা নামায়। তারপর মিসেস টিলির কাছে গিয়ে তার পথ হারিয়ে ফেলার কাহিনি শোনায়… ‘আজ রাতের জন্য কি এখানে আশ্রয় নিতে পারি? না না আমার জন্য চিন্তা করবেন না। যেখানে থাকতে দেবেন সেখানেই থাকব। কাল ভোরেই বেরিয়ে পড়ব। এখন খুব খিদে পেয়েছে। যদি এক গেলাস দুধ দিতে পারেন…
‘হ্যাঁ হ্যাঁ নিশ্চয়ই’… নতুন লোককে পেয়ে অতিথি বৎসল মনটা আবার জেগে উঠেছে মিসেস টিলির… ‘তা বাবা বড় রাস্তায় গিয়ে পড়লে তুমি হয়তো অনেক ভালো জিনিস পেতে। তা মাইল খানেক হবে। তবে তুমি এখানেও স্বচ্ছন্দে থাকতে পারো। আমরা যা খাই তাই কষ্ট করে তাই নাহয় খেয়ো। তুমি আরাম করে বসো। আমি এক্ষুনি দুধ দোয়াব। তুমি খড়ের বিছানাতে শুতে পারো আবার পালকের বিছানাতেও পারো। তোমার যা ইচ্ছে’। অতিথিকে এত আদর যত্ন করে পেরে তিনি খুব খুশি… ‘হাঁসগুলোকে নিজের হাতেই পেলেছি। ঐ যে জলায় হাঁসগুলো চরে বেড়ায়। সিলভি এবার অতিথির জন্য খাবার বাড়ো’। সিলভিয়া এক পায়ে খাড়া। দিদার কাজে লাগতে পেরে খুব খুশি। তাছাড়া তারও যে খুব খিদে পেয়েছে!
নিউ-ইংল্যান্ডের এই গভীর জঙ্গলে এমন একটা ঝকঝকে তকতকে বাড়ি পাওয়া যাবে আগন্তুক তা স্বপ্নেও ভাবেনি। এখানকার বাড়িগুলো যে কতটা নোংরা…অগোছালো সে ভালো করেই থাকে। এখানে হাঁস-মুরগির সঙ্গে গাদাগাদি করে মানুষ থাকে। কিন্তু এই বাড়িটা একদম অন্য রকম। একটু ছোট এই যা। সে মন দিয়ে বুড়ির বকবক শোনে…সিলভিয়ার ডাগর বাদামি চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে। আগ্রহের আতিশয্যে সে বলেই বসে এমন ভালো খাবার নাকি তার গত একমাসে জোটেনি। খাওয়া-দাওয়ার পর তারা দাওয়ায় এসে বসে। রুপোর থালার মতো চাঁদ ওঠে। চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়ে রুপোলি আলো। মিসেস টিলি তাঁর ঘরকন্নার গল্প শুরু করেন। এই তো বেরি তোলার সময় হয়ে এল। সিলভি আছে বলেই রক্ষে। গরুটা ভালোই দুধ দেয় বটে কিন্তু বড্ড জ্বালায়। বুড়ির গল্প আর ফুরোয় না… ‘বুঝলে বাবা নিজের হাতে চার ছেলেমেয়েকে গোর দিয়েছি। এখন পড়ে রয়েছে শুধু দুজন। সিলভির মা আর এক ছেলে। ক্যালিফোর্নিয়া থেকে তার খবরও অনেক দিন পাইনি। বেঁচে আছে কিনা কেজানে! আমার ছেলে ড্যান…সে খুব ভালো বন্দুক চালাতে পারত। কী টিপ ছিল হাতে! যত রাজ্যের টিয়া পাখি, কাঠবেড়ালি শিকার করে আনত। খুব রাগ করতাম আমি। তাও শুনতো না। কত দূরে যে চলে গেল! আমার মনে হয় চিঠিপত্র লেখার ইচ্ছেও ওর হয় না। আমি অবশ্য ওকে দোষ দিই না। দুনিয়াটাকে অনেক দেখলাম তো!’
একটু থেমে আবার শুরু করে বুড়ি… ‘বুঝলে বাবা, সিলভিয়াকে দেখতে একদম মামার মতো। পাগলি মেয়ে একটা! সারাক্ষণ বনেবাদাড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। বনের পশু-পাখিরা সব ওর বন্ধু। বন থেকে কাঠবেড়ালি ধরে আনে…নিজের হাতে খাওয়ায়। আর পাখিদের যে কী ভালোবাসে! গত শীতে কয়েকটা নীলকণ্ঠ পাখি এসেছিল এখানে…আমি যদি নজর না রাখতাম তাহলে সিলভি যে কী করত! নিজে না খেয়ে বোধহয় সব খাবার পাখিদের খাইয়ে দিত! আমি কাক ছাড়া আর সবাইকে সহ্য করতে পারি। ড্যান তাও একটা কাক এনে পুষেছিল। ও চলে যাওয়ার পরেও কাকটা এখানে অনেকদিন রয়ে গিয়েছিল। ড্যানের সঙ্গে তার বাপের একদম বনত না। তাও ছেলে চলে যাওয়ার পর সে একেবারে শয্যাশায়ী হয়ে পড়ল’।
পরিবারের এই দুঃখের কিস্‌সা আর শুনতে ভালো লাগছিল না অতিথির। তার মন এখন অন্যদিকে। বুড়ির একটা কথাই তার মনে একেবারে গেঁথে গেছে… ‘তাহলে সিলভি নিশ্চয়ই এখানকার সব পাখি চেনে’! চাঁদের নরম আলোয় ছোট্ট মেয়েটা ঘুমে ঢুলছে।
‘আসলে পাখিদের একটা মিউজিয়াম করছি আমি। ছোটবেলা থেকেই পাখি শিকারের খুব সখ… দু-একটা খুব বিরল গোছের পাখি আমি এখনও ধরতে পারিনি। পাঁচ বছর ধরে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। এই পাখিগুলোকে পাওয়ার জন্য আমি সব কিছু করতে পারি’।
নিজেকে আর সামলাতে পারেন না মিসেস টিলি… ‘ তা বাবা তুমি কি পাখিগুলোকে খাঁচায় ভরে রাখো?’
না না ওগুলোকে মেয়ে তার ভেতর খড় ঢুকিয়ে সাজিয়ে রাখি। ঐ মিউজিয়ামের মতো। শত শত পাখি আছে আমার সংগ্রহে। সবকটা আমিই শিকার করেছি। গত শনিবার এখান থেকে প্রায় মাইল তিনেক দূর থেকে একটা সাদা হেরন দেখেছি। সেটা খুঁজতে খুঁজতেই এখানে এসে পড়েছি। এমনিতে এসব জায়গায় তো সাদা হেরনের দেখা মেলে না…কী সুন্দর ছোট্ট সাদা হেরন…এই বলে সে চায় সিলভিয়ার দিকে। এ মেয়ে তো এ তল্লাটের নাড়ি-নক্ষত্র জানে…ও কি পারবে দিতে ঐ পাখির খোঁজ!
কোনও কথাই কানে ঢুকছে না সিলিভিয়ার। পাশের সরু গলিতে একটা ব্যাঙ লাফাতে লাফাতে চলেছে। সিলভিয়ার চোখ এখন সেদিকে।
‘ কি খুকি! দেখলে নিশ্চয়ই তুমি হেরনকে চিনতে পারবে তাই না? ঐ যে লম্বা মতো সাদা পাখি…তুলোর মতো নরম পালক…ঢ্যাঙ্গা দুটো পা…কোনো উঁচু গাছের মগডালে ওরা বাসা বাঁধে… খড়কুটো দিয়ে তৈরি বাসা…একদম বাজ পাখির মতো…
বুকের ভেতরটা ধড়াস করে ওঠে সিলভিয়ার। লম্বামতো সাদা পাখিটাকে সেদিন তো সে দেখেছে। জঙ্গলের ঠিক অন্য প্রান্তে একটা জলার পাশে সবুজ ঘাসের মধ্যে দাঁড়িয়ে ছিল পাখিটা। ভারি অদ্ভুত জায়গাটা। সেখানে হলদে রোদ এসে তার উষ্ণ স্পর্শ দিয়ে যায়। ইতি উতি ঘন নলখাগড়ার বন। দিদা তাকে বার বার সাবধান করে করে দিয়েছ… ‘ওরে ওদিকে যাসনি। চোরাবালি আছে। একদম তলিয়ে যাবি…কেউ আর খুঁজে পাবে না’। জলাভূমি ছাড়িয়ে ঐ অনেক দূরে সমুদ্র। সমুদ্র সে নিজের চোখে দেখেনি…তাও সে সমুদ্রের স্বপ্ন দেখে। ঝড়-ঝঞ্ঝার রাতে বাতাসে সমুদ্রের গর্জন ভেসে আসে…শিউরে ওঠে সে।
আগন্তুক এখনও তার পাখির গল্পেই মশগুল… ‘ঐ পাখির বাসাটা খুঁজে পাওয়ার জন্য আমি সবকিছু করতে রাজি। যে এর সন্ধান দিতে পারবে তাকেই আমি দশ ডলার দেব…দরকার হলে সারা ছুটিটাই জঙ্গল চষে বেড়াব। পাখিটা হয়তো এমনিই এদিক-ওদিক ঘুরে বেড়াচ্ছে…আবার এমনটাও হতে পারে কোনও শিকারি পাখির ভয়ে এখানে এসে আশ্রয় নিয়েছে।
সব শুনে একেবারে অবাক হয়ে যান মিসেস টিলি। কিন্তু সিলভিয়া এখনও একদৃষ্টিতে ব্যাঙটাকেই দেখে চলেছে। অন্য সময় হলে একমনে সে কতকিছু ভাবত! আজ তার মনেও একটা উত্তেজনা। ব্যাঙটা দরজার পাশে গর্তটায় ঢোকার চেষ্টা করছে…কিন্তু এই এত রাতে ঘরের দাওয়ায় লোকজনকে দেখে সে মনে হয় একটু ঘাবড়ে গেছে। সেদিন রাতে ছোট্ট মেয়েটার চোখে ঘুম আসে না। দশ ডলার! এ দিয়ে যে রাজার সম্পত্তিও কিনে নেওয়া যায়।
পরের দিন সকালে উঠেই জঙ্গলে বেরিয়ে পড়ে আগন্তুক। সঙ্গী সিলভিয়া। নতুন লোকটাকে এখন আর ভয় লাগছে না তার। লোকটা খুব ভালো। কেমন সুন্দর সবার সঙ্গে মিশে যেতে পারে। পাখিদের নিয়ে কত মজার মজার গল্প বলে লোকটা…কোন পাখি কোথায় থাকে…কী খায়…কোথায় ডিম পাড়ে…
লোকটা তাকে একটা নানচাকু দেয়। সে তো আনন্দে একেবারে ডগমগ। লোকটা একবারও তাকে বিরক্ত করেনি…তাকে ভয় দেখায়নি। কিন্তু লোকটা যখন অকারণে এক এক করে পাখি মারছিল তখন সিলভিয়ার খুব কান্না পাচ্ছিল। লোকটার কাঁধে যদি ঐ বন্দুকটা না থাকত তবে কত ভালো হত! লোকটা যদি পাখিদের এতই ভালোবাসে তবে সে তাদের মারে কেন! নিজের সরল বুদ্ধিতে বুঝতে পারে না সিলভিয়া। বেলা গড়ায়। সিলভিয়া অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে আগন্তুকের দিকে। এত সুন্দর…এত দিলদরিয়া মানুষ সে আগে কখনও দেখেনি। হতে পারে সে ছোট…কিন্তু তার মধ্যেও তো এক নারীমন লুকিয়ে রয়েছে যে শুধু ভালোবাসা চায়। পা টিপে টিপে তারা জঙ্গলে হাঁটে। জঙ্গলের রহস্য…জঙ্গলের বিশালত্ব তাদের আচ্ছন্ন করে রাখে। মাঝে মাঝে তারা থমকে দাঁড়ায়। জিরোতে জিরোতে পাখির গান শোনে। তারপর ঝোপ ঝাড় ঠেলে আবার হাঁটে। কেউ কথা বলেনা। মাঝে মধ্যে ফিসফিসিয়ে শুধু ‘হ্যাঁ’ আর ‘না’। অতিথি চলে আগে আগে…তার পেছনে মন্ত্রমুগ্ধের মতো হাঁতে সিলভিয়া। উত্তেজনায় বাদামি চোখদুটো তার চকচক করে ওঠে।
এখনও পর্যন্ত সাদা হেরনের কোনও চিহ্ন পর্যন্ত নেই। অতিথির কথা ভেবে একটু খারাপ লাগে সিলভিয়ার। তবুও সে পথ দেখাতে এগিয়ে যায়না…পিছে পিছেই চলে। আর কথা বলার তো প্রশ্নই নেই। এই নিঝুম পুরীতে যেন সে নিজের গলা শুনলেও চমকে যাবে! কথার যখন কোনও প্রয়োজন নেই তখন শুধু শুধু বলে লাভ কী! গুটি গুটি পায়ে সন্ধে নামে চরাচর জুড়ে। তারা একসঙ্গে গরুটাকে নিয়ে বাড়ির পথ ধরে। হাঁটতে হাঁটতে তারা ঠিক সেই জায়গায় চলে আসে যেখানে ঠিক আগের দিন আগন্তুকের শিস শুনে ভয়ে কুঁকড়ে গিয়েছিল সিলভিয়া।
২।
জঙ্গলের ঐ শেষ প্রান্তে যেখানে জমিটা যেখানে খাড়াই হয়ে উঠে গেছে সেখানেই রয়েছে ঐ পাইন গাছটা। বাড়ি থেকে প্রায় আধ মাইলের পথ তো হবেই। বুড়ো, প্রাচীন এই পাইন গাছটা দাঁড়িয়ে রয়েছে রাজার মতো। তার বয়সি আর একটাও গাছ নেই এ তল্লাটে। কাঠুরেরা কেন যে গাছটাকে ছেড়ে দিয়েছিল তা কেউ জানে না… হতে পারে বনের সীমানার একটা গণ্ডি কেটে দেওয়ার জন্য। কাঠুরের দল এ মুলুক ছেড়ে চলে যাওয়ার পর বন আবার ভরে উঠল বনস্পতিতে। নতুন নতুন পাইন, ওকে, মেপল গাছ গজালো। কিন্তু কেউ আর ঐ পাইন গাছের মাথা ছুঁতে পারল না। বন আর ঐ দূরের সমুদ্রের মধ্যে যেন প্রাচীর হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে গাছটা। সিলভিয়া সব জানে। সে ভাবে, এই গাছটার মাথায় উঠতে পারলেই বুঝি সমুদ্র দেখা যাবে। কতদিন সে গাছটার কাছে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। গাছটার গুঁড়িতে হাত বোলাতে বোলাতে সমুদ্রের স্বপ্ন দেখেছে। আজ তার আবার গাছটার কথা মনে পড়ল। যে গাছের মাথা থেকে সমুদ্র দেখা যায় সেখান থেকে কি হেরনের দেখা মিলবে না ! দিনের আলো ফোটার আগেই সে যদি গাছটায় উঠে পড়তে পারে তাহলে পাখির বাসাটারও খোঁজ পেয়ে যেতে পারে। রোমাঞ্চে তার গা শির শির করে ওঠে। একবার হেরনের বাসাটা দেখে সে যখন বাড়িতে এসে খবর দেবে তখন অতিথি যে তাকে কীভাবে ধন্য ধন্য করবে সেকথা ভেবেই এখন থেকেই মনে আনন্দের বান ডাকে। এই ছোট্ট মেয়েটা অত আনন্দের ভার কি বইতে পারবে!
রাতভর ঘুম এলনা চোখে। ঘরের দরজাটা খোলা। কোথা থেকে একদল রাতচরা পাখি কিঁচিরমিঁচির জুড়ে দিল। সিলভিয়া প্রহর গোনে। নতুন অতিথি…দিদা…সব তো ঘুমেই কাদা। আনন্দে…উত্তেজনায় তার দু-চোখের পাতা এক হয় না। কখন যে ভোর হবে। গ্রীষ্মের এই রাতটা যেন শীতের লম্বা রাতের মতো হয়ে গেছে…ফুরোতেই চায় না। একসময় রাতচরা পাখিদের ডাক থামে। এই ভোর হল বলে! আবার ভোর হতেই মনে হয় রাতটা কি বড় তাড়াতাড়ি ফুরিয়ে গেল? পা টিপে টিপে ঘরের বাইরে বেরোয় সিলভিয়া। দিদা জানতে পারলে সব মাটি। ঘর থেকে বেরিয়েই সে লাগায় একছুট। তাকে এখন বনের ঐ প্রান্তে ফাঁকা জায়গাটায় যেতে হবে। ঘাস…লতা-পাতা মাড়িয়ে সে ছোটে। পাখিদেরও ঘুম ভাঙছে। পাখিদের অস্ফুট কলতানকে সঙ্গী করে সে ছুটেই যায়। বাইরের দুনিয়ার মানুষের ছোঁয়া লেগে প্রকৃতির কোলে বেড়ে ওঠা…মাটির গন্ধ মাখা মেয়েটা কি বদলে যাবে তবে!
আকাশের তখনও জেগে রয়েছে চাঁদ। চাঁদের মরা আলোয় বিশাল গাছটা দাঁড়িয়ে রয়েছে অশরীরীর মতো। এই গাছের চূড়ায় উঠতে হবে তাকে। শিহরণ খেলে যায় তার শরীরে। শিরার ভেতরের রক্তকণারা দামাল হয়ে ওঠে। গাছের এই শক্ত গুঁড়ি বেয়ে উঠে আকাশটা ছুঁতে হবে। কিন্তু এত উঁচু গাছে সে উঠবে কীভাবে! যদি আগে পাশের ওক গাছটায় ওঠা যায় তাহলে কেমন হবে! ঐ ওক আর পাইন গাছটার ডালপালা উপরে গিয়ে সব একসঙ্গে মিশেছে। সে প্রথমে ওক গাছে উঠবে… তারপর ডাল বেয়ে পাইন গাছটায় উঠে পড়বে। বুদ্ধিটা ভালোই। ওক গাছে সে আগেও চড়েছে। ওক গাছের ঘন ডালপালার মাঝে সে অদৃশ্য হয়ে যায়…পাতা থেকে টুপটাপ শিশির ঝরে পড়ে…তার আওয়াজ পেয়ে পাখিগুলো ডানা ঝাপটে উড়ে যায়। একটা লালমুখো কাঠবেড়ালি বেরিয়ে আসে…এত ভোরে ঘুম ভাঙ্গানোর জন্য সে যেন নালিশ জানাতে চায়। এইবার পাইনের ডালগুলোর নাগাল সে পেয়েছে। এবার এই ডাল ধরে এক লাফে ঐ পাইন গাছে যেতে হবে।
শেষ পর্যন্ত বিপজ্জনক কাজটা সে করেই ফেলে। কাজটা সে যতটা কঠিন মনে করেছিল তার চেয়ে অনেক বেশি কঠিন। একটু অন্যমনস্ক হলে শরীরের আর একটা হাড়ও আস্ত থাকত না। এবার পাইনের ডাল বেয়ে সে ওঠে। তাকে একেবারে মগডালে যেতে হবে। কাঁটায় সারা গা ছড়ে যায়…হাতদুটো জ্বালা করে। ভোরের আলো ফুটছে। বনের চড়াই…রবিন…সব কলতান জোড়ে। আরো যে কতটা উঠতে হবে! গাছ বেয়ে সিলভিয়া যত ওপরে ওঠে গাছটা তত লম্বা হয়ে যায়। সে জানে তাকে যত তাড়াতাড়ি কাজ হাসিল করে ফিরে যেতে হবে। তানাহলে সব পরিশ্রম বৃথা।
গাছটা যে এত লম্বা আগে সে বুঝতেই পারেনি। নিজের রাজকীয় চেহারা নিয়ে গাছটা যেন ছোট্ট মেয়েটার মনের জোর পরীক্ষা করতে চাইছে। কিন্তু শেষে এসে কাজটা অনেক সহজ হয়ে গেল সিলভিয়ার। গাছের ডালপালাগুলো যেন তাকেই সাহায্য করার জন্য হাতে এসে যেন ধরা দেয়। বুড়ো গাছটাও বোধহয় ছোট্ট মেয়েটাকে ভালোবেসে ফেলেছে। বনের যত বাজপাখি, বাদুড়, মথ আর এমনকি মিষ্টি গলার কোকিলগুলোর চেয়েও অনেক বেশি সাহস ধরে বাদামি ডাগর চোখের এই ছোট্ট মেয়েটা। গাছটা দাঁড়িয়ে থাকে নিথর নিশ্চল। এমনকি মেয়েটার কথা ভেবে সে যেন এই গ্রীষ্মের সকালের পূবালি দামাল বাতাসকেও ঠেকিয়ে রাখে।
সিলভিয়ার চোখমুখ যেন নিভে যাওয়া তারার মত…ফ্যাকাশে হলেও…একটা একটা দীপ্তি রয়েছে আলাদা। কাঁটায় ভরা ডাল-পালার শেষ বাধা টপকে সে এখন গাছের মগডালে। এত পরিশ্রমে একটু ক্লান্ত হলেও তার উৎসাহ বিন্দুমাত্র কমেনি। ঐ দূরের সমুদ্রটা ভোরের রাঙা আলোয় মাখামাখি। দুটো বাজপাখি ভোরের নরম আলো গায়ে মেখে উড়ে যায় পুবপানে।তাদের পালকগুলো কী নরম! একেবারে প্রজাপতির ডানার মতো। এতদিন সে এদের দেখছে নীচ থেকে…আজ যেন সে হাত বাড়ালেই তাদের ধরতে পারে। এদের সঙ্গে সেও মেঘেদের রাজ্যে উড়ে বেড়াতে পারে। কেমন যেন একটা ঘোর লেগে যায় তার মনে। পশ্চিম দিকে চাইলে মাইলের পর মাইল জুড়ে শুধু বন আর বাদা জমি। গ্রামগুলোকে সব সাদা দেখায়…মাঝে মাঝে দু-একটা গির্জার চূড়া চোখে পড়ে।
পাখিরা এবার গলা ছেড়ে গান ধরে। সকাল আসে। নরম রোদ ছড়িয়ে পড়ে বনে-বনান্তরে। ঐ যে সমুদ্রের বুকে দেখা যায় পালতোলা নৌকা। আকাশের ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘে কত রং ধরেছে…বেগুনি, গোলাপি…হলুদ। সবুজের এই সমুদ্রে সাদা হেরনের বাসাটা তাহলে কোথায়? সে কি খুঁজে পাবে? নাকি বনের এই অপূর্ব শোভা দেখেই তাকে সন্তুষ্ট থাকতে হবে! সিলভিয়া হাল ছেড়োনা। একবার নীচে তাকাও তো দেখি…ঐ যেখানে আলো ঝলমল বার্চ আর ছায়াঘেরা হেমলক গাছগুলো মিশেছে…ঐ যে ঐ যেখানে সে সবুজ জলাটা রয়েছে…সেদিকে একবার ভালো করে তাকাও…ওখানেই তো তুমি সেদিন ঐ লম্বা-সাদা পাখিটাকে দেখেছিলে। ওখানে তুমি আবার ওকে দেখতে পাবে। ঐ দেখো… মরা কালো হেমলক গাছগুলোর পাশে একটা সাদা বিন্দু…বিন্দুটা বড় হতে হতে একটা পাখি হয়ে এই দেখো পাইন গাছটার কাছেই কেমন চলে এসেছে। ঐ সেই পাখি। লম্বা…সরু গলা। নরম সাদা পালক। ও খুকি এখন একটুও নড়োনা…তোমার বাদামি চোখের আলোর তিরটা ওর গায়ে বিঁধিয়ে দিয়োনা। ঐ দেখো…ও তোমার ঐ পাইন গাছের ডালে গিয়েই বসেছে। তোমার একেবারে হাতের নাগালে। ওখানেই ওর বাসা। সকালের আলো গায়ে মেখে ওখান থেকেই ও নতুন এই দিনটা শুরু করবে।
সিলভিয়ার চোখে ঘোর। মন অবশ। একটু পরেই…কতগুলো দাঁড়কাকের কর্কশ ডাকে স্বপ্নের ঘোর কেটে যায়। ঝগড়াটে পাখিগুলোর ক্যাঁচক্যাঁচানিতে বিরক্ত হয়ে আবার উড়ে যায় সেই আলোর পাখি…সোনালি ডানার হেরন। পাখিটা আবার ফিরে যায় নিচের সবুজ দুনিয়ায়…সেই জলাজমিটার পাশে। সিলভিয়া জেনে ফেলেছে এ পাখির সব রহস্য। এবার তাকে ফিরতে হবে। যেমন ভাবে সে উঠেছিল তেমনি বিপজ্জনক ভাবেই সে এবার নীচে নামতে থাকে। হাত-পা কেটে রক্ত পড়ে। জামা ছিঁড়ে যায়…পা-টা হড়কে যায়। খুব কাঁদতে ইচ্ছে করে সিলভিয়ার। আবার মনে একটা চোরা আনন্দও উঁকি দিয়ে যায়। সে যখন বাড়ি গিয়ে পুরো ঘটনাটা বলবে তখন অতিথির চোখ-মুখ কি আলোয় ভেসে যাবে!
বাড়িতে দিদার ঘুম ভেঙ্গেছে। উঠে ইস্তকই চেঁচিয়ে যাচ্ছেন… ‘সিলভি, সিলভি’। কোনও সাড়া নেই। ঘরে খড়ের বিছানাটাও তো খালি। এত সকালে মেয়েটা গেল কোথায়? অতিথিরও ঘুম ভেঙে যায়। আজ নিশ্চয়ই তার সব মনস্কামনা পূর্ণ হবে! চটপট করে সে তৈরি হয়ে নেয়। পুঁচকি মেয়েটার চোখ মুখ দেখেই কাল সে যা বোঝার বুঝে গেছে। মেয়েটার কাছে নিশ্চয়ই ঐ পাখির খোঁজ রয়েছে। এবার একটু বাবা-বাছা করে পেট থেকে কথাটা বের করে নিতে হবে। ঐ তো ফিরে এসেছে মেয়েটা। মুখখানা একেবারে ফ্যাকাশে। জামা কাপড় ছেঁড়া…গায়ে পাইন আঠার গন্ধ। হাঁ হাঁ করে ছুটে আসে দিদা। দিদা আর অতিথি মিলে একে একে প্রশ্নবান ছুঁড়ে যায়। হ্যাঁ এটাই সময়, এখনই তাকে সবটা খুলে বলতে হবে।
সে বলতে চায়, কিন্তু গলা দিয়ে কোনও স্বর বেরোয় না। গলার মধ্যে কী যেন একটা দলা আটকে আসে। দিদা বকাবকি করে। অতিথি সোজা তাকিয়ে আছে তার চোখের দিকে। তার ঐ দৃষ্টিতে অনুনয়। হ্যাঁ এই লোকটা তাদের জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারে। এই লোকটা তাদের রাতারাতি বড়লোক করে দিতে পারে। একে তো সবটা খুলে বলতেই হবে।
তারআর কথা ফোটেনা… যেন জন্ম-জমান্তর এমন বোবা হয়েই ছিল সে। এই কুয়োর ব্যাং হয়েই জীবনের ন’টা বছর কাটিয়ে দিয়েছে সে। আজ যখন তার কাছে মহাসাগরের ডাক এল তখন একটা পাখির জন্য সে কি তা ফিরিয়ে দেবে? তার কানে ভেসে আসছে পাইন পাতার শনশন। তারপর চোখের সামনে সেই আলোমাখা…সোনালি ডানার পাখি। এই অলৌকিক সকালটা সেই ঐ পাখির সঙ্গে কাটিয়েছে…একসঙ্গে তারা সমুদ্র দেখেছে। কী করে এমন এক সঙ্গীকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়! না, সে কিছুতেই মুখ খুলবে না।
নিরাশ হয়ে ফিরে যায় শিকারি। সিলভিয়ার বুকে যেন একটা তীর এসে বেঁধে। কুকুর যেমন তার মনিবকে ভালোবাসে তেমনিভাবে সেও তো লোকটাকে ভালবাসতে পারত! গরু নিয়ে ঘরে ফেরার সময় কতদিন সিলভিয়া ঐ শিস শুনে চঞ্চল হয়েছে। পর মুহূর্তেই ভুল ভেঙ্গেছে। লোকটার গুলিতে ছোট ছোট পাখিগুলোকে রক্তাক্ত হয়ে তার মন একদিন কেঁদে উঠেছিল। সে কষ্টও আজ ফিকে হয়ে এসেছে। লোকটা তো তার ভালো বন্ধু হতে পারত। কিন্তু এই পাখিরা কি তার চেয়েও ভালো বন্ধু হয়ে উঠতে পারবে! মেয়েটা অনেক কিছু হারিয়ে ফেলেছে…হে বনদেবী তুমি তোমার অপার সৌন্দর্যের মায়া-কাজল সাথীহারা এই সরল মেয়েটার চোখে পরিয়ে দিয়ো।

Exit mobile version