নয়নমনি
– রাখী চক্রবর্তী
ডাক্তার ও ডাক্তার, গত মাসে চোখ পরীক্ষা করলে তো। তাও ঝাপসা দেখছি, সব কিছু কেন?
– ও, কাকাবাবু আসুন আসুন। কি হল আবার?
– ঝাপসা দেখছি চোখে। একবার চশমার পাওয়ারটা দেখো তো।
– কাকাবাবু, চশমার পাওয়ার ঠিকই আছে। চোখে জল থাকলে চশমা তো ঝাপসাই লাগবে। অনুরাগ এ মাসেও আসেনি না?
– না না ডাক্তার, তিন মাস হয়ে গেল ছেলে আমার ফোন পর্যন্ত করে না। খাওয়ার টাকা, ওসব তো বাদ দাও। সৃষ্টি কর্তা শেষ জীবনেও পরীক্ষা নিয়ে যাচ্ছে। জন্ম থেকে পরীক্ষা দিতে দিতে আমি ক্লান্ত ডাক্তার। কবে যে এই জীবন থেকে ছুটি পাবো। কবে যে পরীক্ষা শেষ হবে আমার..
– কাকাবাবু এতটা অধৈর্য্য হবেন না। অনুরাগ নিশ্চয়ই ফিরবে। দেখি আমি একটা ব্যাবস্থা করতে পারি কিনা। আমাদের একটা সম্মেলন আছে চেন্নাইয়ে। আমিও যাব। যদি সম্ভব হয় অনুরাগের সঙ্গে যোগাযোগ করব।
আপনি বেশি চিন্তা করবেন না। কাকিমার দিকে খেয়াল রাখবেন।
বাবা বলটা ঠিক করে মারো ব্যাটে লাগছে না তো।এই ম্যাচটা খুব ভাইটাল। আমাকে বেস্টটা দিতেই হবে, তা নাহলে সিলেকশনে আমার নাম উঠবে না।
আমি জাস্ট মরে যাব। বন্ধুদের কাছে হাসির খোরাক হয়ে বাঁচতে পারব না। বাবা ও বাবা কি ভাবছো?
– না না কিছু না। তোর জন্য নিউ জার্সি, ব্যাট সব কিনতে হবে তো। তাই ভাবছি।
– সে তুমি ভাবো। কিন্তু সব দামি হতে হবে কিন্তু।আমার মান থাকে যেন। এমনিতেই গ্রাউন্ডে আমাকে সবাই কেরানির ছেলে বলে ডাকে। আমি ওদের উচিত শিক্ষা দেবো।
– নে, নে প্র্যাকটিস কর। খেল ভালো করে।
– বাবা মা এখন কোথায় যাচ্ছে ?
– তোর নামে পুজো দিতে যাচ্ছে। আজ বাদে কাল তোর যে খেলার পরীক্ষা। জীবনের চরম পরীক্ষা তোর। মা কালী যদি আমাদের মুখ রাখেন।
কি গো চুপচাপ বসে আছো! কি এতো ভাবছো?অনিল চোখ দেখে কি বললো?
– কে, কে? ও তুমি..
– ছেলের কথা ভাবছো, তাই না?
– না না তা না। আমাদের চলবে কি করে তাই ভাবছি। যেটুকু সঞ্চয় ছিল তিন মাস ধরে তুলে তো হাত এখন প্রায় ফাঁকা হতে চললো। পথে নামতে হবে আমায় এখন। তোমাকে তো ওষুধ দিতে হবে।সুগার প্রেসার…
– কিছু হবে না। মনি ঠিক টাকা পাঠাবে। ও আমাদের পথে নামতে দেবে না। দেখো তুমি।
কতো কষ্ট করে মনিকে মানুষ করেছি, ও কি সব ভুলে যাবে। কিচ্ছু মনে রাখবে না?
তোমার চোখের ছানি অপারেশনের আগের দিন মনি এসে বলল, ‘বাবা কুড়ি হাজার টাকা জমা দিতে হবে ফার্স্ট সেমিস্টারে।’ তুমি ছানি অপারেশনের টাকা মনিকে দিয়ে দিলে। মনি কি ভুলে যাবে এ সব কথা?
আমাদের মনি কখনওই তেমন ছেলে না। ও যে আমাদের বুড়ো বুড়ির নয়নের মনি।
আমি অনুরাগের প্রিয় বন্ধু অনিল। ও ক্রিকেটপ্রেমী। ওর ভাব গতি সব সময় আমাকে ভাবাতো। আমি চোখের ডাক্তার হলাম আর ও মাল্টি ন্যাশনাল কোম্পানিতে চাকরি পেয়ে দুবাই চলে গেল।
কাকাবাবু কাকিমার পরিশ্রমের ফসল যেন বৃথাই মাঠে মারা গেল। মা বাবার কোন খোঁজ রাখেনা।দায়সারা হয়ে মাসে মাসে কিছু টাকা পাঠায়। কাকাবাবু ওর ক্রিকেটের পেছনে যে পরিমাণ টাকা ঢেলেছেন তারপরেও ও ভারতীয় ক্রিকেট দলে চান্স পায় নি। অগত্যা ও কাজ নিয়ে দেশের বাইরে চলে গেল, ও নাকি জীবনের পরীক্ষায় হেরে যাওয়া একটা ফালতু ছেলে। দুবাই যাওয়ার আগের দিন আমাকে এই কথাগুলো বলেছিল অনুরাগ।
যেদিন অনুরাগ দুবাই চলে গেল সেদিনের কাকাবাবু কাকিমার করুণ মুখ আজও আমার চোখের সামনে ভেসে ওঠে।
এই ভাবে তিন বছর কাটল। আমি কাকাবাবুর চোখ পরীক্ষা করে চোখের ছানি অপারেশন করলাম।
একবছর হল অনুরাগ চেন্নাইতে শিফট করেছে।শুনলাম ও বিয়ে করেছে, তবে কাকাবাবু জানেন না। গত তিন মাস হল কাকাবাবু খাওয়া খরচ বাবদ যে টাকা পেতেন সেটাও অনুরাগ আর পাঠায় না।
আমি চেন্নাই যাচ্ছি আজ, দেখি অনুরাগের খবর পাই কিনা।পরের দিন আমার কাজ সেরে অনুরাগের ফ্ল্যাটে এলাম ওর সাথে দেখা করতে। আমাকে দেখে ও হাউ হাউ করে কাঁদতে লাগল, ওর জীবন এক অনিশ্চিয়তার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে।ব্যবসা করতে গিয়ে লোকসান হয়ে গেছে। ওর সংসার ওলটপালট হয়ে গেছে। ও এখন খুব একা, মা বাবার কাছে যাওয়ার মুখ নেই ওর।ডিভোর্সের মামলা করছে ওর বৌ, ফ্ল্যাটটাও বিক্রির মুখে।
আমি আশ্বাস দিয়ে বললাম, কলকাতায় চল আমার সাথে। একটা ব্যাবস্থা ঠিক হবে। কাকাবাবু, কাকিমার কথা ভাব একবার।
অনুরাগকে নিয়ে এলাম কলকাতায়। কাকাবাবু কাকিমার নয়নমনিকে ওনাদের কাছে দিয়ে আমি নিশ্চিন্ত হলাম।
কাকাবাবু আমার মুখ থেকে সব কথা শুনে অনুরাগকে বললেন, জীবন কত রকমের পরীক্ষা নেবে তাতে কখনও জিত হবে কখনও হার হবে।
মনকে সর্বদা শান্ত রেখে লড়াই করে যেতে হবে মনি।
তুমিই তো আমাদের বাঁচার শক্তি জোগাবে বাবা।আমি এখনও সন্তানের মুখে অন্ন দিতে পারব মনি।তুমি শুধু হাসি মুখে থেকো। আমরা এমনিতেই ভালো থাকব। আমি এই বয়সেও জীবন যুদ্ধে লড়াই করে চলেছি আর তুমি হেরে যাওয়ার ভয়ে জীবন যুদ্ধ থেকে নিজেকে সরিয়ে নিচ্ছো।
কাকাবাবুর লড়াই করে বাঁচার ইচ্ছে শক্তিকে আমি স্যালুট জানাই। পরের দিন অনুরাগকে আমার আই হসপিটালে ম্যানেজারের পদে নিয়োগ করলাম।
কাকাবাবু কাকিমার দীর্ঘ অথচ স্বস্তির নিঃশ্বাস আমাকে এক পরম তৃপ্তি প্রদান করলো। অনুরাগ আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলল,”খুব অহংকার ছিল আমার, তুই তো সব তছনছ করে দিলি, তোকে ছাড়ব না, দেখিস তোকে ছাড়ব না”
আমি ছলছল চোখে বললাম, ‘আমি তোকে ছাড়ব না..’
আমার চোখের জল, অনুরাগ হাতে নিয়ে বলল, আমি জিতে গেছি রে বন্ধু, জীবন যুদ্ধের পরীক্ষায় আমি জিতে গেছি।