গল্প- মৃত্তিকা

মৃত্তিকা
– শচীদুলাল পাল

 

 

কোলকাতার গড়িয়া। ছোট্টো দু’ কামরার ফ্ল্যাটে আমি বাবা ও মা থাকি। আমার নাম মৃত্তিকা, বয়স
ষোলো, ক্লাস নাইনে এক ইংরেজি মিডিয়ামে পড়ি। আমার জীবন অনান্যদের থেকে আলাদা।জ্ঞান হতেই দেখি বাবা মায়ের ঝগড়াঝাঁটি। সকাল থেকে রাত্রি। ঝগড়াঝাঁটি থেকেই আমি অনেক কিছু জেনেছি শিখেছি। আমাদের সংসারে প্রেম বলে কিছুই নেই। সবই দেহগত। আমার বাপের কোনো ঠিক নেই। জন্মদাতা বাপ তার সাথে বেশি দিন আমার মা থাকেনি।
এখন যে আমার বাবা, যার সাথে থাকি তার নাম মদন রায়। তার সাথে আমার মা লুকিয়ে বিভিন্ন স্থানে মিলিত হতো। কখনো আমি মায়ের সাথে থাকতাম কখনো বা মা একেলা। বিলাসী মায়ের অনেক বাসনা। তাই একদিন আমাকে নিয়ে মহারাষ্ট্রের এক অজানা গঞ্জে এক কাপড়ে মা মদন রায়ের বাড়ীতে চলে আসে। কোনো আনুষ্ঠানিক বা রেজেষ্ট্রি বিয়ে হয়নি। এমনি থাকতো। লিভ টুগেদার।
সেখানে বেশ ভালোই ছিলাম। আমার বালিকাবেলা যেখানে কেটেছিল সেখানে বাবা একটা ভালো চাকরি করতো। ভালো বেতন, সচ্ছল অবস্থা। আমি স্কুলে যেতাম। বাবা ডিউটিতে। মাঝে মাঝে স্কুল থেকে এসে দেখতাম মা অন্য পুরুষের সাথে বেডরুমে। শীৎকার।
এগুলিকে স্বাভাবিক বলেই মনে হতো। ভালোই কাটছিল দিনগুলি। একদিন বাবা কোনো কারণে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে এসে দেখে ফেলেছিল। যা হবার তাই হলো। বাবা বললো “তোমার লজ্জা করেনা, এরূপ এক জঘন্য কাজ করতে।”
মা বললো “তা কেন লজ্জা করবে। তুমিও ত কর”
-আমি করি কারণ আমি তোমাকে আশ্রয় দিয়েছি।সমাজে তোমাকে ও তোমার মেয়েকে স্বীকৃতি দিয়েছি।
– তা বলে আমি তো তোমার বিয়ে করা বউ নই।কেনা গোলামও নই।
– আমি তোমাকে ভালোবাসি।
– যেখানে টান শুধু দেহগত সেখানে ভালোবাসা থাকতে পারেনা।
– তুমি বিলাসিনী। তোমার সবকিছু চাহিদা আমি মিটিয়েছি। যখন যা চেয়েছো দিয়েছি। তা সত্ত্বেও তুমি বেইমানি করবে এটা মেনে নেওয়া যায় না। এটা অপরাধ।
– এতে অপরাধ কোথায়? এখন তো সুপ্রিম কোর্ট রায় দিয়েছে পরকীয়া বৈধ।
– তুমি একটা জানোয়ার।
– তুমিও তো লম্পট। শুধু মেয়েদের শরীর ছাড়া আর কিছু থাকতে পারে সেটা কখনো ভেবেছো। তাই যদি ভাবতে তাহলে তোমার আগের পক্ষের বিয়ে করা বউ দুই ছেলে ও মেয়েকে ছেড়ে তাদের ঠকিয়ে এখানে গোপন আস্তানায় আমাকে নিয়ে থাকতে না।”
– যাই হোক তুমি কিন্তু আমার আগের বউয়ের কথা মৃত্তিকাকে বলো না এবং তারা যেন এই ঠিকানার কথা জানতেও না পারে। প্রথম পক্ষের বৌ কোর্টে ডিভোর্সের কেস করেছে সে খোর-পোষ তো পাবেই তার সাথে এই ফ্ল্যাটে বাস করার অধিকারও পেয়ে যাবে। তখন আমরা একেবারে গৃহহীন হয়ে যাবো।
– মৃত্তিকা সব জানে। ওর সাথে তোমার আগের পক্ষের ছেলে মেয়েরা যোগাযোগ রেখেছে।
– কি করে সন্ধান পেল? ওরা সব মহারাষ্ট্রে থাকে। এটা তো কলকাতা।
এই ঘটনার কিছুদিন পরই একদিন আগের পক্ষের বউ তার দুই সাবালক ছেলে এক মেয়ে এসে হাজির। সাথে কোর্টের নোটিশ।
এবার মদন রায় পড়লো বেশ বেকায়দায়। একে চাকরি নেই। কর্মহীন। এতজনকে কী করে ভরণপোষণ করবে।
মায়ের টিউশানির টাকায় কোনোরকমে শুধু খাওয়া দাওয়া সাধারণ ভাবেই চলছে। খবর পেলাম আমার জন্মদাতা বাবা কঠিন অসুখে মারা গেছে মহারাষ্ট্রের এক অজ গাঁয়ে।
মদন রায় আগের পক্ষের পরিবারকে বলল “তোমরা সবাই মহারাষ্ট্র চলে যাও। সেখানে আমার বিষয় সম্পত্তি যা আছে সব বেচে এই ফ্ল্যাট বেচে যা পাবো সব ৫০% ভাগ তোমাদের দিয়ে দেব।” এইভাবে চতুর মদন রায়ের কথায় বিশ্বাস করে আগের পক্ষের সবাই চলে গেলো।
একদিন পুলিশ এসে ঘরের যাবতীয় ফার্নিচার- ফ্রীজ,আলমারি, ওয়াশিং মেশিন, এমনকি রান্নার গ্যাস ওভেনও সবকিছু লরিতে লোড করে নিয়ে চলে গেলো।

মৃত্তিকা সব জানে। মহারাষ্ট্রে মদন রায়ের কিছুই নেই। ভাগ দিতে হবে বলে আগেই সব বেচে খুচে কলকাতা এসে আত্মগোপন করে আছে। কিন্তু এভাবে কতদিন চলবে।
মৃত্তিকা বয়স কম হলে কি হয় সে ভালোই বুঝতে পারছিল তার ভবিষ্যৎ অন্ধকার। মা’টা আবার অন্য এক জনের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করেছে। যেকোনো দিন পালাবে। তাদের হোয়াটসঅ্যাপ চ্যাটিং থেকে জেনেছে। মৃত্তিকাকে মায়ের নতুন প্রেমিক গ্রহণ করবে না।
আর বাপ মদন রায় সেটা তো মহা লম্পট। একদিন মায়ের অনুপস্থিতির সুযোগে তাকে সম্ভোগও করেছে।
মা যদি না থাকে মৃত্তিকার জীবন ভেসে যাবে।
এদিকে টিউশানি টীচার বারীদ মন্ডল কয়েক মাসের বেতন পায়নি। মৃত্তিকা পড়তেও যাচ্ছে না।রেজাল্ট যে কী হবে কে জানে!
একদিন মৃত্তিকা স্কুল থেকে বাড়ি ফিরছে হঠাৎ মৃত্তিকা দেখল স্যার রাস্তায় তার সাথে দেখা করার জন্য অপেক্ষা করছে। বলল “তুমি পড়তে আসোনা কেন এ বছরটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।”
মৃত্তিকা অকপটে তার মনের কথা, আর্থিক অসঙ্গতির কথা বলে ফেললো।
বারীদ মণ্ডল বললো, “ও এই ব্যাপার, সেকথা আগে বলনি কেন? টাকা পয়সাটাই সব কিছু নয়। আমি অনেক উপার্জন করেছি। তোমার মতো ইনটেলিজেন্ট মেয়েকে যদি আমি বিনা বেতনেও পড়াই তাতে তো আমারই লাভ। তুমি অনেক ভালো রেজাল্ট করবে। তোমার আমার দু’জনেরই সুনাম বাড়বে। তুমি কাল থেকে আমার ঘরে একাই একটা সিটিং এ আসবে। স্পেশাল ক্লাস নিয়ে তোমাকে পড়াবো।তাছাড়া একটা কথা আমার বলি বলি করে বলা হয়নি। আমি তোমাকে ভালবাসি।”
বারীদ স্যারের কথা শুনে আনন্দে মৃত্তিকার হৃদয়ে এক আলোড়ন খেলে গেলো। ভাসমান নদী জলে যেমন একটুকরো কাঠ। যেটাকে অবলম্বন করে ভেসে থাকা যায়। মৃত্তিকার কাছে সেইরকম অবলম্বন মনে হলো। আনন্দে মৃত্তিকার দু’চোখ জলে ভরে গেলো। বারীদ স্যার দু’হাত জড়িয়ে ধরে মৃত্তিকাকে চুম্বন করলো। মৃত্তিকার সর্বাঙ্গে শিহরণ খেলে গেলো।
আমি নিয়মিত বারিদ স্যারের বাড়ি টিউশন পড়তে যাওয়া শুরু করলাম। স্যারের বদান্যতায় ও ব্যবহারে মুগ্ধ হয়ে আমার ভালো লাগতে লাগলো। ভালো লাগা থেকেই অজান্তে ভালোবাসায় পরিনত হলো।
একদিন বাইরে তুমুল ঝড় জল বৃষ্টি। বৃষ্টিতে ভিজে টিউশানি পড়তে গেছি। স্যার আমার ভেজা জামাকাপড় ছেড়ে তার দেওয়া কাপড় পরতে বললো। আমার অনিচ্ছা সত্ত্বেও স্যার এসে চুল মুছে দিল। কাপড় বদলে দিল। এই আদর ও ভালোবাসায় আমি অভিভূত হয়ে গেলাম। ঘটনা প্রবাহে নিজেকে সমর্পণ করলাম।
এভাবে একদিন বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিল আমার প্রিয় বারিদ স্যার, আমার থেকে প্রায় বারো বছরের বড়ো। আমার হৃদয় তন্ত্রীতে আলোড়ন খেলে গেলো। বাবা মায়ের কলহ আরো দিন দিন বাড়তে লাগলো।আমার অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ ভেবে আমি নিজেকে নিরাশ্রয়া ভাবতে ভাবতে বারিদ স্যারকেই আমার দেহ মন দান করলাম।
তার বিশাল বুকে আমাকে সমর্পণ করে নিশ্চিত হলাম।
প্রাকৃতিক নিয়মানুসারে একদিন আমি অন্তঃসত্ত্বা হলাম। স্যারকে বললাম। স্যার নিঃশ্চুপ হয়ে গেলো। শারীরিক অসুস্থতার কারণে কদিন আমি যেতে পারলাম না। সপ্তাহ দুয়েক পরে একদিন গিয়ে দেখলাম বারিদ মন্ডলের বাড়ি তালা মারা।পাশের বাড়িতে জিজ্ঞেস করে জানলাম দিন দশেক হলো বারিদ মন্ডল এই ভাড়া বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে। তাদের কাছ থেকে জানতে পারলাম বিবাহিত বারিদ মন্ডল এক লম্পট। বহু কম বয়সী মেয়েকে প্রেম জালে ফাঁসিয়ে তাদের সর্বশান্ত করেছে। মোবাইলে ফোন করলে অপরপ্রান্ত থেকে বারবার ভেসে আসতে লাগলো এই নম্বরটির কোনো অস্তিত্ব নেই। আমার চোখে অন্ধকার নেমে এলো। আমি প্রতারিতা। ভালোবাসার ছলনার শিকার। আমার অসহায়তার সুযোগে আমাকে সম্ভোগ করা তার উদ্যেশ্য ছিল। ভাবতে ভাবতে সংজ্ঞা হারালাম।
সম্বলহীনা আশ্রয় হীনা আমি মৃত্তিকা এই পৃথিবীতে বড়োই একাকী এক জঞ্জাল মনে হলো। মা ঘর ছেড়ে পালিয়েছে। বাবাও নিরুদ্দেশ। আমি অসহায় বালিকা অসুস্থ শরীরে তিন দিন অভুক্তা। অনন্যোপায় হয়ে দক্ষিণেশ্বরে গঙ্গায় দিলাম ঝাঁপ।মা গঙ্গার কোলে আশ্র‍য় নিলাম। আমার জীবন কাহিনী এখানেই শেষ হয়ে যাবার কথা।
কিন্তু মা ভবতারিণীর কৃপায় আমি চোখ মেলে চেয়ে দেখলাম আমি হাসপাতালের বিছানায়। সামনে ডাক্তার নার্স ও এক দম্পতি।
দিনকয়েক পরে সুস্থ হলে জানলাম। ডুবন্ত মৃত্তিকাকে মাছধরা নৌকার মাঝিরা উদ্ধার করেছে। সহৃদয় ব্যাক্তিদের সাহায্যে আমি হাসপাতালে। আমার গর্ভস্থ সন্তান মিস ক্যারেজ হয়ে গেছে।
বিভিন্ন প্রচার মাধ্যম থেকে এই সংবাদ জেনে এক নিঃসন্তান দম্পতি আমাকে দত্তক নেবার জন্য হাসপাতাল ও প্রসাশনে যোগাযোগ করছে।
দিন কয়েক পর আমি সুস্থ হয়ে অনাবাসী ভারতীয় নিঃসন্তান দম্পতির হাত ধরে তাদের বাসস্থানে গেলাম। তারপর আইনি সমস্ত ব্যাবস্থা হয়ে গেলে দম্পতির সাথে কানাডা রওনা হয়ে গেলাম।

Loading

Leave A Comment