গল্প- ঈশীর ইচ্ছা

ঈশীর ইচ্ছা
– দেবস্মিতা ঘোষ

 

 

নীল ডেনিম, সাদা শার্ট। কফি শপের দরজা খুলে ঢুকল মেয়েটা। মনে হচ্ছে আমার দিকেই আসছে। মুখ দেখে তো চেনা মনে হচ্ছে না। অবশ্য মুখ না দেখেও বলা যায় যে মেয়েটি আমার চেনা নয়। কারণ কলকাতাতে আমার কোনও আত্মীয় নেই।ছেলেবেলা দিল্লিতে কাটিয়েছি নিজের মায়ের সাথে। মা বাবার বিচ্ছেদের পর থেকে বাবা কলকাতায় থাকতে শুরু করেন ব্যবসার জন্য। ক্লাস ইলেভেন চলাকালীন মা মারা যান। তারপর থেকে বাবার সাথে কলকাতায়। বাবার বেশীর ভাগ সময় এখানে থাকলেও ব্যবসার কাজে প্রায়ই বাইরে যান। তাই একই শহরে থাকলেও আমি হস্টেলেই থাকতাম। কলেজে ভর্তি হওয়ার পর মেস। থার্ড ইয়ার চলছে। আমি একা থাকতে ভালবাসি। কলেজ ম্যাগাজিনে আমার আঁকা ছবি বের হয় মাঝেমাঝে তাই কিছু ছেলে আছে যারা আমাকে চেনে। কিন্তু বন্ধু নেই, বান্ধবীও নেই। তাই এই রকম একটা মেয়েকে এগিয়ে আসতে দেখে অবাক হলাম।
‘’এক্সকিউজ মি, আপনি আদিত্য ত্রিপাঠী?’’ মেয়েটি বললো। তার চোখে কৌতুহল।
‘’হ্যাঁ। আমিই আদিত্য। আপনি?’’ সে আমার নাম জানে দেখে আমিও অবাক হলাম।
‘’ঈশী সেন, প্রিয়মের দিদি।‘’ হাসিমুখে নিজের পরিচয় দিল সে।
‘’ওহ, আচ্ছা’’ প্রিয়ম আমার কলেজের চেনা জানা লোকেদের মধ্যে একজন। কিন্তু ওর দিদি আমাকে কিভাবে চিনতে পারে সেটা আমার মাথায় আসছিল না। আমি কি ভাবছি সেটা মনে হয় বুঝতে পেরেছিল ঈশী।
‘’প্রিয়মের থেকে তোদের কলেজ ম্যাগাজিন দেখেছি বেশ কিছুবার। তোর আঁকা ল্যান্ডস্কেপগুলো আমার খুব ভাল লেগেছে। প্রিয়ম আমাকে তোর ছবি দেখিয়েছে তাই তো আজ চিনতে পারলাম। ইচ্ছা ছিল তোর সাথে আলাপ করে তোর হাতের আরও কাজ দেখার। তাইতো চিনতে পেরে এগিয়ে এলাম। তুই বললাম বলে খারাপ ভাবিস না, আমি বয়সে তোর থেকে তিন চার বছরের বড় হব’’ সাবলীল ভাবেই বলল ঈশী।
‘’ না না, খারাপ কেন ভাবব। আপনি প্রিয়মকে বলতে পারতেন আমাকে বলার জন্য … ওই ছবি দেখার কথাটা।‘’ যদিও প্রিয়মের সাথে বন্ধুত্ব নেই আমার তাও সেটা ওর দিদির সামনে স্বীকার করতে পারলাম না।
‘’আমি মুম্বাইতে জব করি। কলকাতা আসি খুব কম আসি। তাই আর… বলা হয়নি ’’ ওয়েটার ঈশীকে কফি দিয়ে গেল।
‘’ওহ্। অবশ্য আমি এমন কিছু ভাল ছবি আঁকিনা’’ এ কথাটা বনিয়ে বললাম না। একদম সাধারন ছবি আঁকি। কলেজ ম্যাগাজিন বলেই বের করে। ঈশী আমার কথাকে আমল দিলনা।
‘’যা আঁকিস তাই আমার বেশ ভাল লাগে। পরশু আমার মুম্বাইয়ের ফ্লাইট। কাল যদি আমরা একবার দেখা করি তোর আপত্তি আছে কি?’’ ও বলল। এবার আমি একটু ইতস্তত করলাম। বন্ধু বান্ধব না থাকার জন্য এরকম ভাবে আমি কখনো কারুর সাথে দেখা করিনি। একটু ভেবে বললাম,
‘’আমি যতদূর জানি প্রিয়মের বাড়ি মানে আপনার বাড়ি ভবানিপুরের দিকে’’
ঈশী কিছুক্ষণের জন্য চুপ করে গেল। তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,’’দেখ তোকে সত্যিটাই বলি, মা বাবার সাথে আমার সম্পর্ক ভালো না। কিছু বাক্তিগত কারণে। প্রিয়মের সাথে কোনও সমস্যা নেই। ওর জন্যই মাঝেমাঝে কলকাতা আসা। আমার এপার্টমেন্ট যাদবপুরের কাছাকাছি। কাল ওখানে আসতে পারিস। তুই চাইলে অন্য কোথাও …’’
‘’ না ঠিক আছে। আমার অসুবিধা নেই কারণ আমার মেসও ওখানেই। এবার আমাকে যেতে হবে।‘’ ঈশীর সঙ্গ আমার খারাপ লাগেনি তাই দেখা করব বলেই ঠিক করলাম। আর প্রিয়মের বাড়িতে দেখা হলে সেটা আমার পক্ষে বেশি অস্বস্তিকর হত। ঈশীর সাথে একা দেখা করলে অতটা খারাপ ব্যাপার হবে না।
‘’মেসে ফিরবি তো। তোকে ড্রপ করে দিতে পারি, আমিও বাড়ি যাব।‘’ ঈশী অল্প হাসল। হাসলে ওকে বেশ সুন্দর লাগে।
‘’না ঠিক আছে, আমার একটু অন্য কাজ আছে।‘’ বলে আমি বেরিয়ে এলাম। ঈশীকে আমার ভাল লেগেছে। যদিও আমার নিজের মনে হয় না আমার ছবিতে এমন আগ্রহ নিয়ে দেখার মতো কিছু আছে । আমি কলকাতার রাস্তায় হাঁটতে ভালবাসি। রবীন্দ্র সরোবর যাব বলেই ঠিক করলাম। বন্ধু বান্ধব না থাকার এই সুবিধা নিজের সাথে অনেক সময় কাটানও যায়। একা থাকা কিছুটা নেশার মতো। একবার অভ্যাস হয়ে গেলে আর ছাড়া যায় না।
পরের দিন অনেকটা সময় কাটিয়ে ঈশীর বাড়ি থেকে যখন ফিরলাম তখন আমার মনের অনেকটাই ওর দখলে। ওর তাকানো, ওর হাসি প্রতিটা জিনিসের নিখুঁত বর্ণনা করতে পারি আমি। সবথেকে অন্যরকম ওর সোজাসাপটা কথা বলার ধরণ। নিজের মনের ভাব প্রকাশ করার জন্য এতটুকু দ্বিধা নেই। এরকম মনোভাব আর একজন মহিলার মধ্যে দেখেছিলাম আমি। আজ ঈশী আমার মার কথা আমাকে সবচেয়ে বেশি মনে করিয়েছে।

ঈশী আজকাল মাসে দু’ তিন বার কলকাতায় আসে। আমার সাথে দেখা করার জন্য। এর মধ্যে একদিনই অনেক সাহস করে আমি ওকে জানিয়েছিলাম আমার অনুভুতির কথা। আমার ভালবাসার কথা। ও বলেছিল ওর মনেও একই অনুভুতি আছে আমার জন্য। দু’জনের ইচ্ছায় আমরা আরও কাছাকাছি এসেছি। একে অপরকে আরও ভাল করে জেনেছি। তবে ও আমাকে অনেকবার বলেছে যে আমাদের সম্পর্কটা খুব একটা সাধারণ‌ হবে না। অনেক দিক থেকে অনেক বাঁধাও আসতে পারে। কারণ ঈশী আমার থেকে বয়সে বড়, ও চাকরি করে। আমি যা করছি সব কিছু জেনে বুঝেই করছি । ওর বয়স নিয়ে আমার কিছু সমস্যা নেই।
ঈশীর সাথে দেখা করার পর থেকে এখন মাস ছয়েক কেটে গেছে। আমার ফাইনাল পরীক্ষার রেজাল্ট ভালই হয়েছে। ঈশী জানে। তাই ও এসেছে দেখা করার জন্য। কিন্তু ও আমার জব অফারের ব্যাপারে কিছুই জানে না। ওটা সারপ্রাইজ। সন্ধ্যায় দেখা করব আমরা। জব অফারের ব্যাপারটা ছাড়াও কিছু দরকারি কথা ছিল । ও সবুজ আর কালো ভালবাসে। অবশ্য সেটা শুধু আমার ক্ষেত্রেই। ঈশী নিজে যদিও নীল ছাড়া অন্য রঙ খুব একটা বেশি পরেনা। কিন্তু আমাকে ও সবুজ আর কালোতেই পছন্দ করে।অন্য রঙ পড়লে ও রেগে যায় । তাই আমি ওর সাথে দেখা করতে গেলে সবুজই পরি। আজও তাই করলাম।

‘’কংগ্রাচুলেশনস… রেজাল্ট তো ভালই হয়েছে। এই নে তোর গিফট’’ হাসিমুখে একটা ফ্রেঞ্চ পারফিউমের বোতল এগিয়ে দিল ঈশী।
‘’এটার দরকার ছিল না। যাইহোক, তোর জন্য একটা ভালো খবর আছে আর একটা খারাপ খবর। কোনটা আগে শুনবি বল’’ ঈশীকে তুই বলতে আমার প্রথমদিকে অনেক আপত্তি ছিল। তবে ওর জেদের কাছে আমাকে হার মানতে হয়েছে।
‘’খারাপটাই আগে বল’’ ঈশী একটা কফির কাপ এগিয়ে দিয়ে বলল।
‘’তুই চাইছিলিস না যে আমাদের ব্যাপারটা আমাদের পরিবারের কেউ জানুক। গত সপ্তাহে প্রিয়ম আমাকে তোদের বাড়িতে নিয়ে যায়। ও শুধু আমাকে বলেছিল যে তোর বাবা মা কথা বলতে চায় আমার সাথে। আমি না গেলে ওরা মেসে আসবে। তাই আমি গেছিলাম।‘’ আমি ওর দিকে তাকালাম।
‘’কি প্রশ্ন করেছে সে আমি বুঝে গেছি। তুই কি বললি সেটা বল’’ওর মুখ দেখে বোঝা গেল না ও কি ভাবছে।
‘’ আমি কি আর বলব। বললাম তুই কলকাতায় এলে তোর সাথে ঘুরে বেড়াই আর তোর এপার্টমেন্টে রাত কাটাই তোর সাথে। শুনে কাকিমা আমকে বেরিয়ে যেতে বললেন, আমি মেসে চলে এলাম।‘’ আমি কফিতে চুমুক দিলাম।ঈশী হাসতে হাসতে আমার পিঠে চাপড় মারল। “কিন্তু এই শেষ নয়। তোর মা বাবা মনে হয় আমার বাবার সাথেও যোগাযোগ করেছিল।‘’
‘’এতটা তো আশা করিনি… তারপর?’’ এবার ও একটু চমকাল।
‘’তারপর আর কি… বাবা ফোন করেছিলো আমাকে। জানতে চাইলো আমাদের ব্যাপারে। তোর বয়স জানলো। আর জানিয়ে দিল যে পরের মাস থেকে আমার পকেটমানি বন্ধ।‘’ আমি থামলাম। ঈশীকে খুব একটা চিন্তিত মনে হল না। ও বলল, ‘’টাকার চিন্তা করিস না তুই।‘’
‘’ না টাকার চিন্তা আমি করছিও না,’’ আমি জবের কথাটা জানালাম ওকে। যতটা খুশি হবে আশা করেছিলাম ততটা খুশি কিন্তু ও হল না। অন্তত ওর মুখ দেখে আমার তাই মনে হল।
‘’খুবই ভাল ব্যাপার। কিন্তু তুই আজকাল ফোনে কিছুই জানাস না। যাইহোক তোর জন্য মুম্বাই থেকে আমিও একটা খবর এনেছি। তবে সেটা ভাল না খারাপ খবর সেটা নির্ভর করবে তোর ওপর।’’ ঈশী বলতে থাকলো। ও যা বললো তাতে আমি সত্যি ভীষণ অবাক হলাম। মুম্বাইয়ের ওর কোনও এক বন্ধু আমার কিছু ছবি ওখানকার এক আর্ট গ্যালারীতে দেখাতে চায়। ঈশীর ফোনে সে আমার আঁকা কিছু ল্যান্ডস্কেপ দেখেছে, সে চায় আমি ছবি নিয়ে মুম্বাই যাই। এখন ঈশী আমার জবের ব্যাপারে জানত না তাই ও ওর বন্ধুকে বলে এসেছে যে ও আমাকে নিয়ে যাবে। এখন ছবির জন্য মুম্বাই গেলে চাকরির জয়েনিং ডেট মিস হয়ে যাবে। চাকরিই চলে যাবে। সত্যি বলতে আমি কখনো নিজের ছবি নিয়ে এত সিরিয়াস ভাবিনি। গর্বও হচ্ছে অল্প অল্প। ঈশীর ইচ্ছাও জানতে হবে। তাই বললাম,’’তুই কি চাস বলতো?’’
‘’দেখ আদি, এটা তোর ক্যারিয়ার তুই যা করবি আমি মেনে নেব। আমার কিছু বলার নেই। তুই আমার মতামত জানতে চাইলি তাই বলছি। তুই জানিস আমি ঘুরিয়ে কথা বলতে ভালবাসি না। আমি চাই তুই মুম্বাই আয়। অনেকদিন হল এই সম্পর্কের, এবার তুই মুম্বাই আয়। আমার সাথে থাকবি। আমি মনে করি তোর দ্বারা আঁকার কাজ হবে। তুই ওখানে জায়গা পাবি, সময় পাবি সবচেয়ে বড় কথা সুযোগ পাবি। টাকা নিয়ে ভাবার কোনও দরকার নেই‘’ ঈশী থামল। ঈশীর এই সহজ ভাবে নিজের চিন্তা ভাবনা প্রকাশ করার ব্যাপারটা আমি বরাবর ভালবাসি। কিন্তু আজকের ব্যাপারটা অনেকটা বেশি সিরিয়াস।
‘’আমাকে একটু ভাবার সময় দে’’ আমার মুখের হাসি উধাও হয়ে গেছে।

পরের দিন সকালে ঈশী চলে গেল। আমি কখনো ওকে এয়ারপোর্টে ছাড়তে যাইনা। ও পছন্দ করেনা। অতগুলো ছবি নিয়ে মুম্বাই যেতে আমার সমস্যা কম হয়নি। ঈশী মুম্বাইতে কোথায় থাকে সেটা অনেক দিন আগে ও আমাকে বলেছিল। নতুন শহরে ঠিকানা অনুযায়ী পৌঁছাতেও অনেক কষ্ট ভোগ করতে হয়েছিল। হঠাৎ দরজার ওপারে আমাকে একটা এতগুলো ছবি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ঈশীর মুখের অবস্থা যা হয়েছিল তা দেখার জন্য এতটা কষ্ট করাই যায়।

গ্রিন শার্ট, ব্ল্যাক ডেনিম, চোখে সানগ্লাস। নিজেকে আয়নায় দেখে কেমন অচেনা লাগে আমার আজকাল। এই কি সেই ক্যাজুয়াল ড্রেসে কলকাতার রাস্তায় একা একা ঘুরে বেড়ানো আদি। ঈশীর চাপে আমার আলমারিটাও সবুজ কালোতেই ভর্তি। আমার মতো ওর আলমারিটাও নীলে ভর্তি। যদিও আমার প্রিয় রঙ হলুদ । আমি বললেও ও অন্য রঙ পড়ে না। কাউকে জোর করা আমার স্বভাব না। আমার জামা কাপড় জুতো সব ঈশী কেনে। মুম্বাই আসার পর থেকে পুমা ছাড়া অন্য কোনও জুতো আমি পরিনি। আমার অনেক ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও তিনটের বেশি ট্যাটু করাতে দেয়নি ও আমাকে। সবগুলোই ওর পছন্দের। মাঝেমাঝে নিজেকে বন্দি মনে হয়। কিন্তু পরের মুহূর্তে ঈশীর ভালোবাসা আমাকে সব ভুলিয়ে দেয়। মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করি। আমার ছবিগুলো খুব ভাল দামে না হলেও বিক্রি হয়। তাই মোটামুটি টাকা কিছু পাই আমি। ঈশী আর ওর বন্ধুর আপত্তির জন্য আমি প্রদর্শনীতে যাইনি কখনো। অবশ্য প্রদর্শনীর জন্য খুব একটা উৎসাহী আমি কোনোদিন ছিলাম না। আমি ছবি ওকে পৌঁছে দিলে ও টাকা পাঠিয়ে দেয়, মাঝেমাঝে ওর অফিস থেকে নিয়ে আসতে হয়। আমার ইচ্ছা থাকলেও ঈশী চায় না আমি চাকরি করি। ঈশীর বিরোধিতা করতে ভাল লাগে না আমার।

আজ আমাদের লিভ ইনের একবছর পূর্তি। ছবি বিক্রির টাকা আনতে যাচ্ছিলাম। ঈশীকে গিফট দিতে হবে। রবিবার তাই অফিস বন্ধ, অগত্যা বাড়িতেই যেতে হল। ভদ্রলোকের নাম আয়ান দত্ত। বাঙালি। ওনার বাড়ির লোক আমাকে বসতে বললেন। ভদ্রলোক আসতে সময় নিচ্ছিলেন বলে আমি ঘরটা একটু ঘুরে দেখছিলাম। বেশ বড় ঘর, একপাশে ডেস্ক চেয়ার রাখা। একটা সোফাও আছে । একপাশে ছোট একটা টেবিলের উপর মনে হল কিছু ছবি একসাথে করে রাখা। কাপড় দিয়ে ঢাকা। অনাদরে ছবি পড়ে থাকতে দেখে আমার কৌতূহল হল। কাপড় সরিয়ে দেখি প্রথমটাই আমার আঁকা ছবি। দু’মাস আগে বিক্রি হয়েছিল। আয়ান আমাকে টাকাও দিয়েছে। কোনও কারণে কি ফেরৎ এসেছে! আয়ান আমাকে জানায়নি কেন। হাল্কা ধুলোর স্তর পরে গেছে। ছবিটা তুলে নিলাম ভাল করে দেখব বলে। কিন্তু নিচের ছবিটা দেখে আমি আকাশ থেকে পড়লাম। গভীর অবিশ্বাসের সাথে আমি একটার পর একটা ছবি দেখতে লাগলাম। সবকটাই আমার ছবি, যেগুলো নাকি বিক্রি হয়ে গেছিল। অন্তত সেটা বলেই আয়ান আমাকে টাকা অবধি দিয়ে গেছে এই এক বছর। ঈশীর বন্ধু বলে আমি শুধু ছবিগুলো ওকে দিতাম, আর টাকা নিতাম। প্রদর্শনীতে যেতে চাইলেও নানাভাবে আমাকে আটকেছে আয়ান আর ঈশী। আয়ানকে ঘরে ঢুকতে দেখেও নড়লাম না আমি। আমার হাতে ছবিগুলো দেখেই ঘাবড়ে গেল ও । আমি যে ওর বাড়ি আসতে পারি সেটা ও ভাবেনি। ঈশীও হয়তো ভেবেছিল গিফট কিনতে যাচ্ছি, আয়ানের কাছে আসবো ভাবেনি। জানলে হয়ত ফোন করে দিত। আমি কোনও কথা না বলে আয়ানের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। ঠাণ্ডা গলায় বললাম,’’টাকা কে দিত?’’
‘’ঈশী… দেখ আমার কোনও দোষ নেই। সবকিছু ঈশীর কথাতেই করেছি। ও চায়নি তোমার স্বপ্ন ভেঙ্গে দিতে। ঈশী আমকে প্রতি মাসে টাকা দিত। তোমার ছবিগুলোর একটাও প্রদর্শনীতে যাওয়ার মতই না। ঈশীর জন্য আমি এসব করেছি। ও তোমার স্বপ্ন ভেঙ্গে দিতে চায়নি’’ আয়ান আমতা আমতা করতে থাকল। আমি আর কিছু না বলে বেড়িয়ে পড়লাম। আয়ানকে আমি কিভাবে বোঝাব, যে স্বপ্ন ভাঙ্গার কথা ও বলছে সেই স্বপ্ন আমার কোনদিন ছিলই না। সারদিন এদিক ওদিক ঘুরে মন শান্ত করে বাড়ি ফিরতে দেরি হল।
‘’হ্যাপি অ্যানিভারসারি আদি।‘’ ফিরতেই উষ্ণ অভ্যর্থনা জানাল ঈশী। ঈশীর মুখ দেখে মনে হল আয়ান ওকে কিছু জানায়নি। সাহস পায়নি হয়তো। ভেবেছে হয়ত আমি জানাবো। দেখলাম ঈশী ওর কিছু বান্ধবীকে নিমন্ত্রণ করেছে। ও নিজেই ডিনার বানিয়েছে। আয়ানের বাড়ির ব্যাপারে আমি কিছু জানালাম না ঈশীকে। খেতে বসে হঠাৎ ওর এক বান্ধবী আমাকে বলল,’’তো আপনিও আনির মতো ছবি আঁকেন’’ আমি কিছু বলার আগেই ঈশী বলে উঠল,’’ তানিয়া তোকে আমি বারণ করেছি না আনির কথা না তুলতে’’ এইবার সেই বান্ধবী চুপ করে গেল। আনি বা আনিস নামে একজনের সাথে আমার আগে ঈশীর সম্পর্ক ছিল। আমি শুধু এইটুকুই জানি। এর বেশি ও কখনো বলেনি। আমারও বেশি আগ্রহ ছিল না। সেই মেয়েটি বিদায় নেবার সময় আমাকে আবার বলল,’’সরি। তখন আনিস মেহরার কথাটা তোলার জন্য। আসলে আপনাদের দু’জনের মধ্যে এত মিল। যাইহোক সরি’’ ঈশী কিচেনে ছিল তাই হয়তো ও আবার আনির কথা বলার সাহস পেল।
‘’আনিস মেহরাটা কে?’’ আমি থতমত খেয়ে গেলাম।
তানিয়ার মুখ দেখে মনে হল ও খুব অবাক হয়েছে। নিজের ভুল শুধরে আমি বললাম,’’আনির ভাল নাম আনিস মেহরা সেটা ভুলে গেছিলাম আরকি।‘’ তানিয়ার সামনে স্বীকার করতে পারলাম না যে আমি আনির ভাল নাম জানতাম না।
‘’শুধু কি আনিস মেহরা এখন তো ও শিল্পী আনিস মেহরা। যাইহোক আমি আসি।‘’ বলে তানিয়া চলে গেল আমাকে আরও একটা উত্তর না জানা ধাঁধাঁর মধ্যে রেখে। বিখ্যাত শিল্পী আনিস মেহরা যদি ঈশীর প্রাক্তন হয়ে থাকে তাহলে ও সেটা আমার থেকে আড়াল করল কেন? কেন জানিনা সবকিছু সোজাসুজি প্রশ্ন করে জানবার ইচ্ছা ছিল না আমার আর। আমার কেন জানিনা মনে হচ্ছিল ঈশী আমাকে সত্যি বলবে না। আর তানিয়ার কথায় পুরো বিশ্বাস ছিল না তাই অনেক ভেবে অন্য উপায় বের করতে হলো। পরের দিন ঈশী অফিস যাওয়ার পর আমি খুঁজে বের করলাম ওর পুরনো ডায়েরি। ও নিজেই আমাকে বলেছিল যে ও একসময় লিখতো, এখন আর লেখে না। অথবা লিখলেও আমার আড়ালে। আমি জানতাম ঈশীর ডায়েরি কোথায় থাকে, কিন্তু আজকের আগে কখনও ওর ডায়েরি চুরি করে পড়ার প্রয়োজন পরেনি। বেশ কিছু বছরের পুরনো দুঊটো ডায়েরি পেলাম। তার একটার মধ্যে আনিস আর ঈশীর একসাথে একটা ফোটো পেলাম। ঈশীর আনি যে বিখ্যাত শিল্পী আনিস মেহরা তাতে আর সন্দেহ রইলো না। ডায়েরিগুলোতে আনির সাথে ঈশীর সম্পর্কের কথা লেখা আছে। যে সন্দেহটা কাল থেকে আমার মনে আসছে ডায়েরি পরার পর সেটা আমার বিশ্বাসে পরিণত হয়েছে। কিন্তু সব কিছু না জেনে বুঝে আমি কিছু করবো না। কারণ সবকিছু বুঝলেও আমার মন ধীরে ধীরে খারাপ হয়ে যাচ্ছে। ঈশীকে আমি সত্যি ভালবাসি। ডায়েরিটা ঠিক জায়গায় রেখে দিলাম।
‘’আদি আমার একটা অফিস ট্যুর আছে। পরশু বেরবো। এক সপ্তাহ মতো। একা থাকতে প্রবলেম হবে না তো তোর?” অফিস থেকে ফিরে বললো ও। আমার পরিকল্পনাকে কাজ করানোর জন্য এর থেকে ভাল সুযোগ আর হবে না।” না তেমন অসুবিধা হবে না’’ মনে-মনে ভাবলাম বরং সুবিধাই হবে।

ঈশী চলে যাওয়ার পর আমি আমার পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ শুরু করলাম। এই মুহূর্তে তানিয়া একমাত্র মেয়ে যে আমাকে সাহায্য করতে পারে।
আমাকে যেভাবে হোক আনিস অবধি পৌঁছাতে হবে। খোঁজ নিয়ে দেখেছি সে এখন দিল্লিতে আছে। কিন্তু অত বড় শিল্পীর সাথে দেখা করা সমস্যার ব্যাপার। তানিয়ার সাথে হয়ত ওনার যোগাযোগ থাকতে পারে। ঈশী বেরোবার কিছুক্ষণের মধ্যে আমি তানিয়ার বাড়ির উদ্যেশে বেড়িয়ে পড়লাম। বাড়িতে আমার জিনিসপত্র গোছান আছে কিছুটা। তানিয়ার কাছ থেকে কতটা সাহায্য জানিনা। সাহায্য না করলেও আমি দিল্লি যাব।
হঠাৎ আমাকে সকাল সকাল ওর বাড়িতে দেখে তানিয়া একটু অবাক হল। ওর ফোন নাম্বার ছিল না আমার কাছে তবে কৌশলে ঈশীর থেকে জেনে নিয়েছিলাম ও কোথায় থাকে।
‘’আরে আদিত্য যে, ভেতরে আসো। এত সকাল সকাল কি ব্যাপার’’ তানিয়া ঘুম থেকে উঠে দরজা খুললো মনে হলো।
‘’বেশীক্ষণ সময় নষ্ট করব না, ছোট একটা দরকার ছিল’’ আমি একটু হেসে বললাম। আমি চাইনা কোনোভাবে ও আমাকে সন্দেহ করুক বা ঈশীকে কিছু জানাক।
‘’আচ্ছা বলো, দেখি যদি সাহায্য করতে পারি’’
‘’দেখো তানিয়া আমার মনে হয় তোমার সাথে আনিস মেহরার যোগাযোগ আছে এখন। আমি ওনার সাথে একটু কথা বলতে চাই, একটু যদি ব্যবস্থা করে দাও।‘’ সরাসরি দরকারি কথাই বললাম, নষ্ট করার মত সময় নেই। মনে হল ও খুবই অবাক হয়েছে। বুঝতে পারছে না কি বলবে।
‘’আমার সত্যি খুব দরকার আছে। জানোই তো আমাদের লাইনে ওনার কত দাপট। আমি শুধু আমার পেশার সুত্রে দেখা করতে চাই। ঈশীর সাথে এর কোনও সম্পর্ক নেই। ঈশী জানলে খারাপ ভাববে তাই ও না থাকাকালীন কাজটা করতে চাইছি।‘’ এই সাজানো গোছান মিথ্যেটা আমি বাড়ি থেকে ভেবে গিয়েছিলাম। কারণ সত্যি কথা বলে আমার মনের অবস্থা তানিয়াকে বোঝাতে আমি পারতাম না। তানিয়া আনিসকে ফোন করে দু’দিন পর সকাল বেলা একঘণ্টার জন্য একটা সাক্ষাৎকারের ব্যবস্থা করলো।
দিল্লিতে আনিসের বাড়িটা একটু ফাঁকা জায়গায়। ছোট সুন্দর সাজান বাড়ি, শিল্পীর জন্য আদর্শ। বাড়ির সামনে ছোট বাগানটাও সুন্দর করে সাজানো। ফুলগাছগুলো নিয়মিত যত্ন পায়। মাঝখানে একটি ফোয়ারা, তার একপাশে টেবিল চেয়ার রাখা। আমি ওখানে বসেই অপেক্ষা করছিলাম আনিসের। আর ভাবছিলাম কিভাবে কি বলব ওকে। যদিও আমি ঠিক করেছি আনিসকে সব সত্যি বলব, ওকে মিথ্যে বলে আমার কোনও লাভ নেই। যদিও জানিনা উনি আমার বক্তব্য বুঝবেন কিনা তবে চেষ্টা করতেই হবে। ও ভাবছে তানিয়ার কোনও ছোট পেইন্টার বন্ধু ওর সাথে দেখা করতে এসেছে। সেরকম যে নয় সেটা ওকে বুঝিয়ে বলতে হবে।
এইসময় আনিস মেহরা এল। সে হঠাৎ আমাকে দেখে একটু অবাক হয়ে গেল। সেরকমটাই আশা করেছিলাম আমি। আমি ওনাকে চিনতাম তাই আমার অবাক হওয়ার কিছু ছিল না। আনিসের অবাক হওয়ার কারণ আমি আর ও একই উচ্চতার, আমাদের গায়ের রঙও এক। এরকম তো অনেক মানুষই হয় যাদের উচ্চতা আর গায়ের রঙ এক হয়, তাতে সমস্যার কিছু নেই। কিন্তু আনিস যখন একটু খেয়াল করে দেখল ওর টি শার্টের রঙ, ওর পুমা সু, ওর কবজিতে থাকা ঘড়ির ব্র্যান্ডও আমার সাথে মিলে যাচ্ছে তখন ও অস্বস্তিতে পড়ে গেল। আমি জানতাম এরকম একটা পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে, তাই আমি আগে মুখ খুললাম, “গুড মর্নিং মিস্টার মেহরা। আমি আদিত্য ত্রিপাঠী, তানিয়ার বন্ধু।‘’
‘’গুড মর্নিং আদিত্য। আমি ভেবেছিলাম তুমি তোমার হাতের কাজ কিছু আনবে’’ ভদ্রলোক ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হচ্ছেন।
‘’ না। তানিয়াকে একটু মিথ্যে বলেই আপনার সাথে দেখা করার সুযোগটা নিতে হয়েছে। তার জন্য আমি দুঃখিত। তবে আপনার সাথে আমার একটু বিশেষ দরকার আছে। তানিয়া আপনাকে আমার আসল পরিচয় গোপন করেছে। আমি ঈশীকে ভালবাসি। প্রায় একবছর হয়ে গেল আমরা একসাথে থাকি।‘’
ঈশীর নাম শুনে ভদ্রলোক সোজা হয়ে বসলেন। একটু ইতস্তত করে বললেন,’’ঈশীর সাথে আমার সম্পর্ক ছিল। কিন্তু সেটা ভেঙ্গেও গেছে বেশ কিছু বছর আগে। আমি তো এখন শুধু এটা জানতাম যে ঈশী মুম্বাইতে থাকে। তানিয়া জানিয়েছিল, আর সত্যি বলতে ওর ব্যাপারে তেমন উৎসাহ আমার আর নেই। ওকে নিয়ে আমার সাথে কথা বলার মত কি আছে আমি বুঝলাম না।‘’
‘’সেটা আপনাকে বোঝাতেই তো আমি দিল্লি এসেছি মিস্টার মেহরা। বেশি সময় আমার লাগবেনা। তার আগে বলুন তো আমাকে প্রথম দেখে আপনার কি মনে হয়েছিল।‘’ প্রশ্ন শুনে উনি খানিকক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থাকলেন। তারপর বললেন, ‘’মনে হয়েছিল আমি আজ সকালে কিভাবে ড্রেস করব সেটা আপনি আগে থেকে জেনে গেছেন, তাই একই জামাকাপড় ঘড়ি, জুতো পড়ে এসেছেন।‘’ ভদ্রলোক হাসলেন ব্যাপারটার গুরুত্ব না বুঝেই। আমি গম্ভীর ভাবেই বললাম,’’শুধু তাই নয় মিস্টার মেহরা, একটু খেয়াল করলে বুঝতে পারবেন আপনার পারফিউম আর আমার পারফিউমও সমান। আমি জানি আপনার শরীরে মোট তিনটে ট্যাটু আছে। পিঠে একটি ঈগল, বাঁ পায়ে রোমান হরফ আর ডান হাতের ওপরের দিকে একটি গোলাপ।‘’ ভদ্রলোকের মুখ দেখে মনে হল উনি আমাকে অশরীরী জাতীয় কিছু ভাবছেন হয়তো।
আমি থামলাম না,’’আমি জানি কারণ আমার শরীরের একই অংশে একই ট্যাটু রয়েছে। আর এই পোশাক জুতো পারফিউম ট্যাটু সবই ঈশীর ইচ্ছায়। শুধু তাই না, আমাদের পেশাও এক” এরপর আমি ওনাকে সব কিছু খুলে বললাম।
সব শুনে উনি কিছুক্ষণ চুপ করে বসে রইলেন। তারপর শান্ত কণ্ঠে বললেন,’’তোমার সাথে যা হয়েছে তার জন্য আমাকে দোষারোপ করতে তুমি আসোনি তা আমি বুঝলাম। বয়সে বড় হিসাবে আমি তোমাকে একটাই কথা বলবো তোমার কাছে এখন সবচেয়ে জরুরি নিজেকে খুঁজে পাওয়া, নিজের সাথে সময় কাটানো। তুমি কলকাতা বা মুম্বাই যেখানেই ফিরে যাও আমি ব্যবস্থা করে দেব। চলে যাওয়ার আগের কিছুদিন তুমি আমার বাড়িতে থেকে যাও, এটাই অনুরোধ।‘’
‘’আমি কলকাতা ফিরতে চাই। সেই পরিকল্পনা করেই আমি এসেছি। আপনার এখানে থাকতে দিলে সেটা আমার সৌভাগ্য।‘’ আমার কথা শুনে ভদ্রলোক হাসলেন।

প্রিয় ঈশী,
প্রথমেই বলছি যে তোকে কিছু না বলে চলে আসার জন্য স্যরি। এছাড়া কোনও রাস্তাও ছিল না সেই মুহূর্তে। আমি জানতাম যেভাবে হোক তুই সব কিছু জেনে যাবি। তানিয়া না বলুক আয়ান বলবে অবশ্যই। তুই আমার সাথে অনেক ভাবে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা সত্ত্বেও আমি দেখা করিনি তোর সাথে। আসলে তোর মুখ দেখার মানসিকতা ছিল না আমার। তুই ভাবছিস হয়তো যে এতদিন পর আমি কেন এই চিঠি লিখছি। কারণটা তুই পুরো চিঠি পড়লেই বুঝবি।
কলকাতায় তোকে প্রথম দেখেই আমার খুব ভাল লেগেছিল, তোর চলা ফেরা কথাবার্তা আমার মৃত মায়ের কথা মনে করিয়ে দিয়েছিল। তাই জন্যেই হয়ত আমি তোর কাছাকাছি এসে ছিলাম। নয়ত বন্ধুবান্ধব আমার কোনদিনই ভাল লাগতো না। কলকাতায় আমরা কত সুখে ছিলাম। মুম্বাই যাওয়ার পর থেকেই সম্পর্কটা ভালবাসা থেকে অধিকারের দিকে চলে গেল। সত্যি বলতে আমার সব জিনিসে তোর আধিপত্য আমার ভাল না লাগলেও, মেনে নিয়েছিলাম। সমস্ত ছোট ছোট পরিবর্তন যে কখন আমাকে একটা অন্য মানুষ বানিয়ে দিয়েছিল বুঝতেই পারিনি। আয়ানের বাড়িতে যখন নিজের ছবিগুলোর আসল মর্যাদা বুঝতে পারি তখন থেকেই তোর প্রতি সন্দেহ জাগে। ছবি আঁকাকে আমি কখনই তেমন ভালবাসিনি। তাই ছবিগুলো ভালো নয়, এটা শুনে কষ্ট হয়নি। তবে সবকিছুর পিছনে তুই আছিস জেনে আমি কষ্টে সারাদিন রাস্তায় ঘুরে ছিলাম। ছবি আঁকা আমার অবসর সময়ের অভ্যাস ছিল। কিন্তু তোর জন্য সেটা বুঝতেও আমি ভুল করেছিলাম।
তানিয়াকে বাড়িতে আনা তোর খুব বড় ভুল হয়েছিল জানিস। হয়ত তুই জানতিস না যে মিস্টার মেহরার সাথে ওর এখন যোগাযোগ আছে, জানলে তুই নিশ্চয়ই ওকে ডাকতিস না। ওর কাছ থেকেই আমি প্রথম জানতে পারি তোর ‘’আনি’’ র আসল পরিচয়। তারপরের ঘটনাগুলো বুঝে নেওয়া কঠিন না। দিল্লিতে এসে আনিস দাদার সাথে দেখা করতে তানিয়া আমাকে সাহায্য করেছিল। হা, আনিস মেহরাকে আমি আনিস দাদাই বলি আজকাল। ভদ্রলোক সত্যি খুব ভাল। আমাকে প্রথম দেখে উনি ঘাবড়ে গেছিলেন। হঠাৎ সকাল বেলা উঠে কেউ যদি আর একজন মানুষকে দেখে যে তার মতই পোশাক পড়ে, একই ব্র্যান্ডের জুতো ঘড়ি এমনকি পারফিউম অবধি ব্যবহার করে , তার পক্ষে ঘাবড়ে যাওয়া তাই স্বাভাবিক । আমার ট্যাটুগুলোর সাথে ওনার নিজের ট্যাটু মেলানোর পড়ে উনি বুঝতে পেরেছিলেন আমার বক্তব্য। সব ঘটনা আমিই ওকে জানাই আগে। নিজের স্বার্থ না থাকলেও উনি আমকে সাহায্য করেছেন অনেক। আমার কলকাতা ফেরার ব্যাবস্থা এমনকি চাকরির ব্যবস্থা অবধি করে দিয়েছেন। এত ভাল মানুষের সাথে তুই কেন বিচ্ছেদ করেছিলিস তুই জানিস।
কলকাতা ফিরে নিজেকে গুছিয়ে নিতে অনেকটা সময় লেগেছিল। নিজেকে ফিরে পেতে অনেক সময় লেগেছিল। তবে এখানকার চেনা জানা পরিবেশে কাজটা একটু সহজ হয়েছিল। তোকে নিয়েও অনেক ভেবেছি, তুই ঠিক কি করতে চেয়েছিলিস সেসব নিয়েও ভেবেছি। আমি তোকে ভালবেসেছিলাম। তাই তোর অন্যায় অধিকারগুলো ভালবাসার অত্যাচার বলে ভুল করেছিলাম। তোর ভালবাসায় অন্ধ হয়ে গেছিলাম। তুই কোনদিনই আমাকে ভালবাসিসনি। তুই আমাকে আনিসদা বানাতে চেয়েছিলিস। আমার গায়ের রঙ আর হাইটটা ওর সমান বলে তুই সম্পর্কটা তৈরি করেছিলিস। তুই আমাকে খুঁজে পেলি কিভাবে সেটা আমার কাছে এখন রহস্য। ছবি আঁকাটা ছাড়তে না দেয়ার জন্য তুই আয়ানের সাথে মিলে প্রদর্শনীর ব্যাপারটা সাজাস। বাইরে থেকে তুই আমাকে পুরোপুরি আনিস মেহরা বানাতে চেয়েছিলিস। তাই তুই চেয়েছিলিস আমাদের পেশাটাও এক হোক। একবছরে আমি বাইরে থেকে এতটাই আনিস হয়ে গেছিলাম যে স্বয়ং আনিসদা আমাকে দেখে ঘাবড়ে গেছিল। কিন্তু এত করেও তুই শুধু আমার শরীরটা বদলাতে পেরেছিলিস, সত্তাকে নয়। কলকাতায় আসার পর আমি অনেক ভেবেছি। মাঝেমাঝে মনে হয়েছে তুই মানসিক ভাবে অসুস্থ। তুই আমাকে আনিস বানিয়ে ভালবাসতে চেয়েছিলিস। মাঝে মাঝে আমার মনে হয়েছে তুই অসুস্থ না, এত নিখুঁত পরিকল্পনা করে কাজ করা অসুস্থ মানুষের পক্ষে সম্ভব না। কিন্তু আমার জীবনের এতগুলো দিন নষ্ট করার জন্য আমার সত্যি খারাপ লাগে। তোর ওপর রাগ হত। এখন আর হয়ই না, ক্ষমা করে দিয়েছি তোকে। শুধু এটুকু বলতে চাই এরকম আর কারুর সাথে করিস না।
যদিও আমি জানি তুই এখন একাই আছিস। তানিয়া মাঝেমাঝে বলে তোর কথা, ওর সাথে ভালো বন্ধুত্ব আছে তোর আমি জানি। আনিসদার অনুরোধে ও তোকে আমার চিঠিটা পৌঁছে দিয়েছে। তোর কথা আমি আর ভাবি না। ওই একবছর আমি দুঃস্বপ্ন ভেবে ভুলে যেতে চাই। অন্য কারুর জীবনে বাঁচার মত বন্দিদশা আর হয়না। এই চিঠি লিখে আমি তোকে আমার তরফের সব কথা জানিয়ে দিলাম। যেহেতু একসময় ভালবাসতাম তাই খারাপ কিছু আশা করতে পারবনা তোর জন্য। ভাল থাকিস। ঈশী তোর ইচ্ছার জন্য আমাকে অনেক দাম দিতে হল রে।
ইতি
‘আনি’ না হতে চাওয়া ‘আদি’

Loading

8 thoughts on “গল্প- ঈশীর ইচ্ছা

  1. আবার একটা দারুণ গল্প উপহার দিলি…এবারের গল্পের বিষয়বস্তুটা একদম অন্যরকম…অনেককিছু শেখাল এই গল্পটা…আবার একটা নতুন গল্পের অপেক্ষায় রইলাম।।

Leave A Comment