রম্য- পূণ্য পূণ্যি

পূণ্য পূণ্যি
সুজিত চট্টোপাধ্যায়

 

 

পুণ্যি চাই হে বন্ধু, পুণ্যি চাই। যেনতেন প্রকারেণ পুণ্যি চাই। পাপময় অন্ধকার জীবনে আরও অনেক কিছুর সাথে পুণ্যিও চাই।কিন্তু কীভাবে পাই , কোথায় পাই ? যাই , কুম্ভ মেলায় যাই । পূর্ণকুম্ভ। তিথি নক্ষত্র মিলিয়ে সঙ্গমে গোটাকয়েক ডুব মারলেই , পুণ্যির কুম্ভ কানায় কানায় পূর্ণ।

কানাইদা মনস্থির করেই ফেলেছেন, এবার পূর্ণকুম্ভ যোগ। সুতরাং এলাহাবাদের কুম্ভমেলা কিছুতেই মিস করা যাবে না। কিন্তু সবকিছু, ইচ্ছের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলে না। তালভঙ্গ হলো।
কানাই দার জাগরী দোস্ত বাদু দা বললেন- দুর বোকা , অতদূর যাবার কী দরকার ? আমাদের গঙ্গাসাগর আছে না, তবে ? পৌষসংক্রান্তি তে গিয়ে একটা ডুব দিয়ে আয়। একই ফল রে বাবা। শুধুশুধু অত খাটাখাটুনি করে কী হবে। কমখরচে ঝামেলা মিটে যাবে।
ঝামেলা। পুণ্যি অর্জনের বাসনায় , ঝামেলার অনুপ্রবেশ। আরে ভাই জীবনটাকে ঘষেমেজে চকচকে করতেই তো পুণ্যির পিছনে ছোটা। একটু আধটু ভোগান্তির কাঁটা দলতে না পারলে , পুণ্যি আসবে কেমন করে? ঘন্টার পর ঘন্টা উপোস দাও, ভরা কলসি বাঁক কাঁধে নগ্নপদব্রজে, মাইলের পর মাইলের পথ পাড়ি দিয়ে বাবা ভোলানাথের মাথায় জল ঢালো , ভিজে কাপড়ে রাস্তার ওপর সাষ্টাঙ্গপ্রণাম করতে করতে ডন্ডি কাটো । মোদ্দা কথা যে ভাবে পারো শরীর কে শাস্তি দাও। দেবতা তুষ্ট হয়ে আশীর্বাদ করবেন , হবে পুণ্যি লাভ।

ধর্না দাও, অনশন করো, বহুজন সমাবেশ ঘটাও তবে না দাবি আদায়।
আসলে আদায়। এমনি এমনি হবে না বাপু। ঝামেলা চাই। হরতাল চাই , অগ্নিসংযোগ চাই , যে ভাবেই হোক টনক নাড়াও।
এতো গেল মর্তলোকের ফর্মুলা। ঊর্ধলোকের বেলাতেও মোটামুটি ব্যাপারটা একইরকম। দাবি আদায়ের মতো পুণ্যি আদায়।
চাইলেই যদি পাওয়া যেত, তাহলে তো মিটেই গেল। কিন্তু তা তো হবার নয়। সাধ্যি সাধনা চাই।

কানাইদার পুণ্যি চাই। একটু কষ্ট করে, ভীড় , হোগলার ঘর, টয়লেটের ঝক্কি সামলে , ঠিক সময়ে হাড়কাঁপানো হাওয়ায় একটা ডুব দিলেই যদি পুণ্যিলাভ হয়ে যায় , মন্দ কী? তারপরেই একশ এক টাকার চুক্তিতে বেঁটে গরুর ল্যাজ ধরে বৈতরণী পার। আর কি চাই । হয়ে গেল মোক্ষলাভ। গঙ্গা মাতা কি…জয়।

দেবতারা কম চালাক নয়। তারাও কায়দা জানেন।কেমন করে সাধনা চটকে দিতে হয়। তারাও অনেক ঘাটের জল খেয়েছেন।

ঋষি বসেছেন সাধনায়। সিদ্ধিলাভ হয়হয় অবস্থা , ঠিক এই ক্লাইম্যাক্স এ, উর্বশী কে ফিল্ডে নামিয়ে দিলেন দেবতা । যাও, ঋষির ধ্যান ভঙ্গ করো। শুরু হয়ে গেল ক্যাটরিনা ডান্স। ঋষি প্রথমে একচক্ষু , পরক্ষণেই দুইচক্ষু খুলে , চক্ষুছানাবড়া। ধড়মড় করে উঠে পড়লেন। বাঘছাল, কমন্ডুল, ত্রিশূল , সাধনা , সব রইল। তিনি চললেন গহীন জঙ্গলের নিভৃতে। সঙ্গে স্বর্গসুন্দরী উর্বশী । দেবতা মুচকি হেসে , পুনরায় নিশ্চিন্তে ধ্যানমগ্ন হলেন।

কানাইদার , আর এক পরম মিত্র, গঙ্গাসাগরের কথা শুনে বললেন-  ক্ষেপেছো , ওই মেলা তে গিয়ে তুমি আর ফিরতে পারবে ভেবেছ। নোংরা, ভীড়, ইনফেকশন , না না, ওসব মতলব ছাড়ো। নন্দকে চেনো তো? ওর কী অভিজ্ঞতা হয়ে ছিল জানো ?
কানাই দা, মাথা নেড়ে জানালো, না ভাই , জানিনা।
শোনো , সে দারুণ মজার ব্যাপার ভাই ।

এটা যেসময়ের ঘটনা , তখন , এতো আলোর রোশনাই , জমাটি সাজানো, এতো আড়ম্বরপূর্ণ পরিবেশ ছিল না ওখানে । যাইহোক,, তিথি নক্ষত্র অনুযায়ী, মোক্ষম পুণ্যস্নান সময় ছিল ভোররাতে। নন্দ, নিয়ম নিষ্ঠার সঙ্গে তৈরি হয়ে সাগর তীরে এলো।কিন্তু একটা দৃশ্য দেখে দাঁড়িয়ে পড়লো।
একজন নাগা সন্যাসী , একাকী , একেবারে উলঙ্গ অবস্থায় বুকের কাছে হাত জড়ো করে দাঁড়িয়ে আছে।
নন্দ, সেই মায়াময় আধ্যাত্মিক পরিবেশে, উলঙ্গ নাগা সন্যাসীদেখে, ভক্তি উথলে উঠলো। ধরাস করে তার পায়ের ওপর সাষ্টাঙ্গপ্রণাম ঠুকে দিলো।
নাগাবাবা বিরক্ত হয়ে বললেন-  কী হচ্ছেটা কী , প্রণাম করছেন কেন। একি অসভ্যতা। উঠুন , উঠুন .. সাষ্টাঙ্গ প্রণাম করবার আর লোক পেলেন না…?
-না মানে , আপনি সন্ন্যাসী মানুষ , তাই…
-দুরমশাই , আমি সন্ন্যাসী টন্ন্যসী কিচ্ছু নই। দুঃখের কথা কী বলব , জামাকাপড় খুলে এই এখানে , ঠিক এইখানে বালির ওপর রেখে , একটা ডুব দিয়ে, ফিরে এসে দেখি, আমার জামা কাপড় সব উধাও। কোন হারামজাদা সেগুলো নিয়ে পালালো বলুন তো ভাই আমার । চারিদিকে চোর , গাঁজাখোর আর ধান্দাবাজ গিজগিজ করছে।

তারপরেই ভদ্রলোক করুণ স্বরে বললেন-  একটা এক্সট্রা পরিধান কী আপনার কাছে আশাকরা যায় ? নইলে বড্ড আতান্তরে পড়ব।
ভাগ্যিশ নন্দর সঙ্গে এক্সট্রা ধুতি ছিল , তাই রক্ষে।
লজ্জার একশেষ।

তাই বলছি , সাগর পেড়িয়ে লঞ্চে চেপে অতদূর শুধুশুধু না গিয়ে , আমাদের কলকাতার বুকেই মিনি গঙ্গাসাগর বসে, জানা আছে কী?
কানাইদা করুণ ভাবে তাকিয়ে থেকে , বললো-  তাই নাকি , কোথায় রে?
ময়দানে… বাবুঘাটের কাছেই। এলাহি আয়োজন। খাওয়া থাকা একদম ফ্রী। দলেদলে গঙ্গাসাগর যাত্রী সাধুবাবারা এইখানে জমায়েত হয়। চলে যা। দেখে আয়, কতরকম বাবা। বাইক বাবা, মোবাইল বাবা, না দেখলে কিসসু বুঝতে পারবি না।ধুনি জ্বালিয়ে নাগা সন্যাসীর খেল, দেখে আয়। ঘরের পাশে নিখরচায় জব্বর পুণ্যি।

কানাইদা , নেহাৎ কৌতুহল বশে সত্যিই চলে গেল বাবুঘাটের সেই টেকে। আশ্চর্য , বন্ধু একটুও বাড়িয়ে বলেনি। চমৎকার আয়োজন। নানান প্রদেশের তাঁবু। শুধু সাধু নয়, বহু পূণ্যার্থীর বিপুল সমাবেশ। খাওয়া থাকার এমনকি সাগরে যাওয়ার ব্যবস্থার বিশাল আয়োজন।
কানাইদা ভাবতে লাগলো , কারা পুণ্যবান ? যারা সাগরে কপিল মুনির মন্দিরে বা সঙ্গমে স্নান করবেন তারা , নাকি, যারা তথাকথিত পূণ্য অর্জনের জন্য এমন প্রশস্ত ব্যবস্থা করে দিয়েছেন তারা?

কানাইদা রাতে , অন্ধকার ঘরে শুয়ে মানসতীর্থ ভ্রমণ করতে করতে, এলাহাবাদ ত্রিবেণী সঙ্গম , গঙ্গাসাগর থেকে বাবুঘাট পর্যন্ত ঘুরে এলেন। নাঃ, কোথাও পূণ্যি নেই। পূণ্যি মনে , পবিত্রতায়, সেবায়। যার হদিস, কানাই দা, মনে মনে পেয়েই গেছেন।
কে যেন বলেছিলেন , সেই অনেকদিন আগে – তীর্থ নয়, তীর্থ নয়, তীর্থপথ আমাদের , মনে যেন রয়।

Loading

One thought on “রম্য- পূণ্য পূণ্যি

  1. আলাপী মন এর সকল শুভানুধ্যায়ী বন্ধুদের জানাই আমার আন্তরিক ভালবাসা শুভকামনা

Leave A Comment