বড়দিনের ভোজ
-মারিও দে আন্দ্রেদ
অনুবাদ- বর্ণালী জানা সেন
বাবা মারা যাওয়ার পরে প্রথম বড়দিন। বাবা চলে গেছেন পাঁচ মাস আগে। ঘরের আনাচে-কানাচে এখনও তাঁর কত স্মৃতি! তিনি চলে যাওয়ার পরে আমাদের সব সুখ, শান্তি চলে গেছে। তথাকথিত সুখী পরিবার বলতে যা বোঝায় আমরা তা কোনোদিন ছিলাম না। এমনিতে সবাই ভালো মানুষ, কেউ চুরি-ডাকাতি করেনি, নিজেদের মধ্যে কোনো ঝগড়া বিবাদ নেই, টাকাকড়ির টান নেই…তাও আমরা পুরোপুরি সুখী ছিলাম না । তার অন্যতম কারণ বাবা। নেহাতই ছাপোষা অতিসাধারণ, একটা মানুষ। কোন রসকষ নেই। কোনো মহৎ চিন্তা নেই। চাল, ডাল, তেল, নুনের বাইরে বড় কিছু তিনি ভাবতেই পারলেন না সারাজীবন। বাবার জন্যই জীবনটাকে আমরা কোনোদিন পুরোপুরি উপভোগই করতে পারিনি। আমরা কনোদিন কোন ঝাঁ-চকচকে রিসর্টে বেড়াতে যাইনি। ভালো মদের স্বাদ পাইনি। কাজের সুবিধার জন্য রেফ্রিজারেটর বা হেনা তেনা যা থাকা দরকার মা তার কোনটাই পাননি। বাবার সব চিন্তাভাবনাই যে কী উদ্ভট ছিল! নিজের নাক কেটে পরের যাত্রাভঙ্গ করতে বাবার জুড়ি ছিল না।
বাবা চলে গেছেন। সবার মন ভারী। বড়দিন চলে এল। তাও মুখে কারো হাসি নেই। আমিও মানুষটার কথা ভুলতে পারছি না। খাওয়ার টেবিলে…সংসারের তুচ্ছাতিতুচ্ছ কাজেকর্মে অবধারিতভাবে বাবার কথা উঠবে। এটা একদম রুটিন হয়ে গেছে আমাদের জীবনে। একদিন সিনেমায় যাওয়ার কথা বলতেই মা এমন আঁতকে উঠল যেন ভীষণ একটা পাপ করে ফেলেছি আমি! এই শোকের সময়ে অর্বাচীনের মতো এমন একখানা কথা বললাম কী করে! শোকটা যেন সবাইকে দেখিয়ে বেড়াতে হবে! সব ছেলেদের মতো আমিও বাবাকে ভালোবাসতাম। তবে সে ভালোবাসার মধ্যে কর্তব্য ছিল বেশি, মনের টান ছিল কম। পরিবারের সুখের মুহূর্তগুলোকে বাবার স্মৃতি এমনভাবে গ্রাস করে নিয়েছে যে মনে মনে লোকটাকে গালাগাল দিতে ইচ্ছে করছে। মরেও কাউকে দু দণ্ড শান্তি দিচ্ছে না।
এবারে যা করার আমাকেই করতে হবে। একটু পাগলামি করতে হলে হবে। ছোটবেলা থেকেই সবাই আমাকে বলে পাগল। তবে এই পাগলামির দোহাই দিয়ে কত অপকম্ম করেও আমি ছাড় পেয়ে গেছি। ছোটবেলায় স্কুলে যখন প্রতি ক্লাশে গাড্ডু মারতাম তখনও কেউ কিছু বলেনি। দশ বছর বয়সে এক খুড়তুতো বোনকে লুকিয়ে চুমু খাওয়ার সময় আমার ঐ ভয়ানক পিসি ভেলহার কাছে হাতেনাতে ধরা পড়েও দিব্যি পার পেয়ে গেছি। তারপর কোন কাজের মেয়ে বা তুতো বোনদের কাছে এমন কিছু একটা বলেছিলাম যাতে সব আত্মীয়-স্বজন হাঁ হাঁ বাড়িতে চলে এসেছিল। ‘ছেলেটা তো দেখছি একদম পাগল’! এসব কথা শুনতে কোন বাবা-মার ভালো লাগে! ওরা শুধু বলেন… ‘আহা, পাগল একখানা, ওর কথা কি ধরতে আছে?’ আত্মীয়-স্বজনদের চোখে মুখে প্রচ্ছন্ন গর্ব…‘যাক, বাবা বাঁচা গেছে…আমাদের ছেলেপিলেরা তো আর ওর মতো হয়নি’! তবে আর যাইহোক…ওরা যাকে পাগলামি বলে তার মধ্যেই ছিল আমার মুক্তি। আমার যা ইচ্ছে তাই করতাম। তবে যা করতাম খুব মন দিয়ে করতাম। আমায় কেউ কিছু বলতে আসত না। পাগল বলে কেউ ধর্তব্যের মধ্যেও আনত না। তাই বাঁচার আনন্দকে একেবারে চেটে পুটে নিয়েছি। আমার মধ্যে কোন হীনমন্যতা আসেনি। জীবন সম্বন্ধে আমার কোন অভিযোগও নেই।
প্রতি বছর আমাদের ক্রিসমাস ডিনার হত। প্রার্থনার পর সবাই একসঙ্গে খেতে বসতাম। তবে এলাহী কোন আয়োজন হতনা…যতটা সস্তায় সারা যার আরকি…ঐ কিসমিস, আখরোট, কাজু এইসব। থোড়-বড়ি-খাড়া আর খাড়া-বড়ি-থোড়(আমারা বাচ্চারা অবশ্য এক বাদাম নিয়েই কাড়াকাড়ি করতাম) । ফি বছর সেই একঘেয়ে রুটিন…একসঙ্গে খাওয়া দাওয়া…তারপর কোলাকুলি করে শুতে যাওয়া। এইসব কথা মনে পড়তেই মনটা বিদ্রোহ করে উঠল। না এবার একটা পাগলামি করতেই হবে… ‘এবার বড়দিনে টার্কি হবে’। আমার কথা শুনে সবার তো ভিরমি খাওয়ার জোগাড়। বড়দিনে টার্কি! অসম্ভব! আমার পিসি তো সাফ জানিয়ে দিলেন এই শোকের সময়ে কাউকে নেমন্তন্ন করা যাবে না।
‘কে বলেছে নেমন্তন্ন করতে? তোমাদের স্বভাব আর গেল না…বিশেষ কোনও অনুষ্ঠান ছাড়া আর কবে টার্কি হয়েছে আমাদের বাড়িতে? আর যখনই হয়েছে ঐ যতসব হ্যাংলা আত্মীয়স্বজন এসে জুটে গেছে…’
‘এমন করে বলে না বাবা’।
‘ আমি এমন করেই বলি। মাথায় ঢুকেছে সবার?’
আমাদের রাবনের গুষ্টির ওপর আমার যত রাগ সব উগরে দিই । সাধুপুরুষ সব! আমি ওদের থোড়াই কেয়ার করি! যা পাগলামি করার আমাকে এখনই করতে হবে। এ সুযোগ হাতছাড়া করলে চলবে না। মা তো রয়েইছে। আমার পিসি আর বোনও আমার কাছে মায়েরই মতো। এই তিন মায়ের প্রশ্রয়েই তো আমার জীবনটা এত সুন্দর! বাড়িতে কারো জন্মদিনের পার্টি হলে তবেই টার্কি রান্না হয়। আর টার্কি হলেই পঙ্গপালের মতো যত আত্মীয় জুটে যায়। পার্টির তিন দিন আগে থেকেই আমার তিন মা-কে কাজে লেগে পড়তে হয়। খাবার বানাতে হয়…কেক, পেস্ট্রি, মিষ্টি। আমার তিন-মা সারা জীবন খেটেই গেল। আর কোনোদিকে তাকানোর ফুরসৎ পেলনা। তারপর পার্টির দিন আত্মীয় স্বজনেরা আসবে…রাক্ষসের মতো গিলবে… ছেলেমেয়ের জন্য ছাঁদা বেঁধে বাড়িতে নিয়ে যাবে। এঁটো-কাঁটা যা পড়ে থাকবে পরেরদিন মায়েদের ভাগে তাই জুটবে। সবাই খেয়ে চলে গেলে তবে মা ছোট্ট এক টুকরো মাংশ পাবে…এতই ছোট যে সাদা ভাতের থালায় সেটা চোখেই পড়বে না। মা-ই সবসময় আমাদের খাবার পরিবেশন করে। ছেলে বুড়ো সবাইকে দিয়ে থুয়ে যেটুকু পড়ে থাকে তাই খেয়েই মা খুশি। টার্কির স্বাদ কেমন মায়েরা কেউ জানে না। লোকজন খাওয়ার পর যে হাড়গোড় বেঁচে থাকে সেটা দিয়েই ওরা দুধের স্বাদ ঘোলে মেটায়।
না, এবার আর কোন আত্মীয় স্বজন থাকবেনা। টার্কি রান্না হবে শুধু আমাদের জন্য…আমাদের পাঁচজনের জন্য। টার্কি থাকবে…তারসঙ্গে কাসাভা আলুর দু-রকম স্টাফিং থাকবে। একটা হবে তুলতুলে…তাতে থাকবে টার্কির চর্বি আর মেটে। আরেকটা হবে একটু শক্ত… প্রচুর মাখন থাকবে তাতে। আমার কিন্তু মেটেটাই চাই। আমি কিসমিস আর আখরোট দিয়ে খাব। ও…আর সঙ্গে আমার শেরিও চাই। এই রেসিপিটা আমি রোজের কাছ থেকে শিখেছি যদি বাড়িতে ওর নামটা উহ্যই রাখি। আমরা যে প্রায়ই একসঙ্গে ঘুরতে বেরই… বাড়িতে কেউ জানে না। তবে ওরা কিছু একটা সন্দেহ তো করেই। আমার কথা শুনে কেউ রা কাড়ে না। সবাই গম্ভীর মুখে বসে থাকে…যেন সব শয়তানেরই কীর্তি। এত খাবার-দাবারের লোভ দেখিয়ে শয়তান সেন তাঁদের বিপথে নিয়ে যাচ্ছে! ‘আর সঙ্গে বরফ ঠান্ডা বিয়ারও থাকবে’…কারো দিকে না তাকিয়েই ঘোষণা করে দিই আমি। বাড়ির বাইরে থেকে আমি অনেক নতুন নতুন জিনিস খাওয়া শিখেছি। আমার পছন্দ খাঁটি ফরাসি ওয়াইন। কিন্তু মা-যে বিয়ার খেতে খুব ভালোবাসে!
আমাদের বড়দিনের ভোজের বিস্তারিত প্ল্যান, প্রোগ্রাম হল। সবার মুখে, চোখে চাপা উত্তেজনা। সবাইকেই এখন পাগলামিতে পেয়ে বসেছে। তবে সবাই কিন্তু আমার কোর্টেই বল ঠেলে দিয়েছে। আমার পাগলামিতেই যেন সবকিছু হচ্ছে। এতে তাদের অপরাধবোধ একটু কমে। সবাই এ ওর দিকে মুখ চাওয়াচাওয়ি করে। শেষ পর্যন্ত আমার বোনই সবার মনের কথাটা ঘোষণা করে দেয়… ‘দাদা না এক্কেবারে পাগল!’
টার্কি কেনা হল। রান্না হল। মাঝরাতে প্রার্থনা সেরে আমরা এলাম খাবার টেবিলে। আমাদের বড় সাধের দিন! বড় আনন্দের দিন! একটা খুশিয়াল হাওয়া। আমারও ভারি মজা লাগছে। মা-কে শেষ পর্যন্ত টার্কি খাওয়াতে পারব। মায়ের জন্য এতদিন কিছুই করতে পারিনি। মনের সবটুকু আবেগ দিয়ে মায়ের কথা ভেবেছি। আমাদের জন্য শুধু প্রাণপাত করে গেল মানুষটা। ভাই, বোনের মুখও আনন্দে ঝলমল। সব এই টার্কির জন্য। এই টার্কির জন্যই আমরা সুখের মর্ম বুঝেছি। মা ছুরি দিয়ে টার্কির পুরো ব্রেস্ট পিসটা কাটতে গিয়ে কাটতে পারল না। ব্রেস্ট পিস থেকে ছোট একটা ফালি কেটে নিল। কৃচ্ছ্রসাধনের অভ্যাসটা এখনও গেল না দেখছি!
‘না মা, আমায় পুরো পিসটাই দাও। আমি পুরোটাই খাব’।
ডাহা মিথ্যে। আমার মনে তখন আনন্দে উপচে পড়ছে। আজ আমার কিচ্ছু না খেলেও চলবে। বাকিরা যদি পেটপুরে খায় তবে আমি উপোস দিতেও রাজি। বাকি সবাইও মনে মনে ঠিক একইকথা ভাবছে। প্রতিদিন শুধু কর্তব্যের মজা নদীতে যে আনন্দ, যে ভালোবাসা আটকে পড়েছিল আজ তা আবার প্লাবন নামিয়েছে। মায়ের ভালোবাসা, সন্তানের ভালোবাসা…কী স্বর্গীয় এই অনুভূতি ! আমার হঠাৎ যীশুর কথা পড়ল। যীশুর আবির্ভাবের দিব্য মুহূর্তকে আমাদের মতো একটা মধ্যবিত্ত পরিবার আর কত ভালোভাবে উদযাপন করতে পারে! টার্কির ব্রেস্ট পিসটা চওড়া, চওড়া টুকরোয় কাটা হল।
‘মা, আমি আজ পরিবেশন করব’।
‘পাগল একটা’! মায়ের কাজে আমি ভাগ বসাতে চাই কোন সাহসে! যাই হোক শেষ পর্যন্ত আমার কথা মেনে নিয়ে প্লেটগুলো সব আমার দিকে এগিয়ে দেয় মা। আমি খাবার ভাগ করতে বসি। ভাইকে বলি গেলাসে বিয়ার ঢালতে। নরম তুলতুলে একটা চর্বির টুকরো দেখে আমি প্লেটে তুললাম। তারপর কয়েক টুকরো সাদা মাংস। সবার চোখ এই মাংশের দিকেই। হাঁ হাঁ করে উঠল মা… ‘একা সব খেয়ে নিস না জুকা। ভাই-বোনের জন্যও কিছু রাখ’।
মাকে বললাম ‘এটা তোমার’। চোখ ছলছল করে উঠল মায়ের। আমার বেচারি মা! সারা জীবন শুধু কষ্টই দিয়েছি মাকে। রোজের কথা জেনে…আমার সব কুকীর্তির জেনেও কোনদিন কিছু বলেনি আমায়।
‘না, মা এটা তোমায় খেতেই হবে…অন্য কাউকে দিতে পারবে না’।
আর থাকতে না পেরে ডুকরে কেঁদে উঠল মা। মায়ের দেখাদেখি পিসিও ফোঁপাতে শুরু করল। কারণ এর পরের প্লেটটাই যাবে তাঁর হাতে। বোনের কথা আর কী বলব! ওর চোখে তো কল লাগানোই আছে। খুললেই জল। মা কাঁদে, পিসি কাঁদে, বোন কাঁদে। এই ছোঁয়াচে রোগ যাতে আমাকে না ধরে সেইজন্য আগদুম-বাগডুম বকতে শুরু করলাম। আমার এখন মাত্র উনিশ। যাচ্ছেতাই সব ব্যাপার। সবার মাথাই দেখছি গেছে। নাহলে টার্কির মাংশ দেখে বাড়িসুদ্ধ কেউ কেঁদে ভাসায়! সবাই একটু হাসার চেষ্টা করে বটে…এই পরিবেশে আর হাসি ফোটে না। এখন যে হাসা অসম্ভব! কাঁদতে কাঁদতেই অবধারিত ভাবেই বাবার কথা মনে পড়ে গেল সবার। বাবার ঐ বিষণ্ণ মুখের লম্বা ছায়াটা বড়দিনের সব আনন্দ মাটি করে দিচ্ছে। ঐ মৃত মানুষটার ওপর খুব রাগ হল আমার।
আমরা খাওয়া শুরু করলাম। কারো মুখে কোন কথা নেই। অতীতের স্মৃতি এসে ভিড় করছে মনে। তবে রান্নাটা কিন্তু হয়েছে খাসা। কী নরম মাংশ…মুখে দিলেই মিলিয়ে যায়। তার ওপর হ্যামের স্টাফিং! কিসমিস আর আখরোটের নরম আদর! উহহ এই স্বাদ একেবারে জিভে…টাগরায় লেগে থাকে। কিন্তু এর মাঝেও বাবার সেই লম্বা ছায়া। ফোটোফ্রেমের মধ্যে বাবার ঐ ছবিটা যেন আমাদের তিরস্কার করছে… ব্যঙ্গ করছে। টার্কির স্বাদ জিভে মেখে মায়ের শেষ পর্যন্ত বোধোদয় হল…ভগবানের আবির্ভাবকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য টার্কির মতো আর কিছু হয় না।
অতীতের স্মৃতি নাকি বর্তমানের এক টুকরো আনন্দ। একদিকে বাবা আরেক দিকে এই টার্কি। দুজনের দড়ি টানাটানিতে কে জিতবে! আমি ভাবলাম যুদ্ধে টার্কির পক্ষ নেব। আমি শুধু টার্কিরই গুণগান গাইব। কিন্তু মৃত মানুষের ক্ষমতা অনেক বেশি। মনের কোনো সুড়ঙ্গ পথ দিয়ে অতর্কিতে আবির্ভাব হয়ে শত্রুপক্ষকে একেবারে মাত দিয়ে দেয়। আমি টার্কির কথা শুরু করতেই মা ফুঁপিয়ে উঠল…. ‘আজ যদি তোর বাবা বেঁচে থাকতেন’! বাবাই জিতে গেলেন।
এত সুস্বাদু খাবার আর আমার মুখে রুচছে না। বাবা নাকি টার্কি? দুই মৃত প্রানীর এই লড়াই দেখে মনটা আমার তিতকুটে হয়ে গেছে। লোকটার ওপর ঘেন্না হচ্ছে আমার। কিন্তু আজকের দিনের আনন্দটা আমি মাটি হতে দেবনা। কিছুতেই না। তার জন্য একটু অভিনয় করতে হলে হবে। জানিনা কীকরে মাথায় এমন দুষ্টূবুদ্ধি গজালো! আমি এবার বাবার পক্ষ নিলাম। করুণ স্বরে বললাম… ‘মা তুমি ঠিকই বলছ…বাবা তো আমাদের খুব ভালোবাসতেন…আমাদের জন্য প্রাণপাত করেছেন। এখন স্বর্গে গিয়ে উনি নিশ্চয়ই সুখে আছেন! (একটু দোনামনা করলেও টার্কির নাম পর্যন্ত উচ্চারণ করলাম না)…আজ আমাদের সবাইকে একসঙ্গে দেখে বাবাও নিশ্চয়ই খুব আনন্দ পাচ্ছেন’!
বাঁধের মুখ খুলে গেল। এখন সবাই বাবার কথা বলছে। তারপর বাবার ছায়াটা ছোট হতে হতে আকাশের তারা হয়ে গেল। এখন সবাই চেটেপুটে খাচ্ছে। কারণ বাবার কোনও তুলনা হয় না। আমাদের জন্য বাবা শুধুই আত্মত্যাগ করেছেন। বাবা রাতারাতি সাধু-মহাত্মা বনে গেছেন। মা বলে… ‘দেখো বাবা, তোমরা আজ যা হয়েছ সবই কিন্তু বাবার জন্য। বাবার ঋণ কোনোদিনও শোধ করতে পারবে না’। বাবা আজ আকাশের তারা। বাবার সঙ্গে কাটানো ভালো মুহূর্তগুলোই শুধু আজ সবার মনে পড়ছে। কারো মনে কোনও তিক্ততা নেই। বাবা আজ আমাদের ধরাছোঁয়ার বাইরে। বাবা আর কাউকে কষ্ট দিতে পারবে না। শুধু সুখস্মৃতি হয়েই রয়ে যাবে। শেষ পর্যন্ত তাহলে মরা টার্কিরই জয় হল।
মা, পিসি… আনন্দে উপচে পড়ছে সবাই। এটা কি তাহলে ‘রসনা তৃপ্তির আনন্দ’! না না শুধু রসনা নয়। এটাই বোধহয় প্রকৃত সুখ। আলগা হয়ে যাওয়া সম্পর্কগুলো আবার জোড়া লাগছে। দৈনন্দিন তুচ্ছতার স্রোতে যারা একে অপরের কাছ থেকে দূরে সরে যাচ্ছিল…তারা আজ আবার কাছাকাছি চলে এসেছে। আমি জানি এর একমাত্র কারণ টার্কি। এই টার্কিই আজ আমাদের ভালোবাসার নতুন বাঁধনে বেঁধে দিল। এ ভালোবাসা অক্ষয়…এ ভালোবাসা চিরন্তন। এই মুহূর্তটাকে আমি চিরকাল মনের মধ্যে বাঁধিয়ে রাখতে চাই। আমাদের মতো এত সুখী আর কি কেউ এই জগতে আছে!
মা পেটপুরে খেল। মায়ের খাওয়া দেখে মাঝে তো আমার ভয়ই হচ্ছিল…মায়ের না আবার পেটে ব্যথা শুরু হয়ে যায়। তারপর ভাবলাম যা হয় হোক…মা মরলে মরুক। কিন্তু তার আগে আসল টার্কির স্বাদটা নিয়ে যাক। নিজের ক্ষুদ্র স্বার্থের ওপর উঠতে পেরে আমিও আজ খুব খুশি! আত্মত্যাগের যে কত সুখ!
টার্কির পর শেষপাতে আমরা আঙুর আর একটু কুকিজ খেলাম। এই কুকিজকে আমাদের দেশে বেম-কাসাডোস বলে। মানে হল সুখী বিবাহিত জীবন। মুহূর্তের জন্য বাবার মুখটা মনে পড়ে গেল। টার্কি আজ বাবাকে মাহাত্ম্য দিয়েছে…আমাদের মনে তাঁকে অমর করে দিয়েছে। বাবা আজ ভগবানের আসনে।
খাওয়া শেষ। এবার ওঠার পালা। দু-বোতল বিয়ার গিলে সবার পা টলছে। আমরা যে যার ঘরে শুতে চলে গেলাম। আজ আর ঘুম আসবে না। বিছানায় এপাশ-ওপাশ করাই সার হবে। তবে এই নিদ্রাহীন রাতেরও আনন্দ আলাদা। সারা রাত জেগে থাকাও যে কত আনন্দের! কিন্তু রোজ যে আমায় দেখা করতে বলেছিল। ও গোঁড়া ক্যাথলিক। ও বলেছে শ্যাম্পেন সাজিয়ে আমার জন্য অপেক্ষা করবে। আমাকে তো যেতেই হয়। মাকে আবার মিথ্যে বললাম… ‘বন্ধুর বাড়ি পার্টিতে যাচ্ছি’। মাকে কপালে চুমু দিতে দিতে চোখ টিপে একটু মুচকি হাসলাম। মায়ের আর বুঝতে বাকি রইল না যে ছেলে কোথায় যাচ্ছে। যাক, একটু নাহয় কষ্টই পাক। পিসি আর বোনকে চুমু দিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। ‘রোজ আমি তোমার কাছে আসছি!’