জলছবি
– রাখী চক্রবর্তী
তোরঙ্গটা ভালো করে দেখে আবার তালাচাবি দিয়ে রেখে দিল ময়না। যৌতুক হিসাবে দিয়েছিল ময়নাকে ওর বাবা। জামাই বাবা-জীবনকে তোরঙ্গ ছাড়া আর কিছু দেওয়ার মতো সাধ্য তার ছিল না।তবে জামাই সুলোচন ময়নাকে তার জন্য কোনো খোঁটা দিয়ে কথা বলেনি। বলা যায় সুলোচনের যৌতুকের প্রতি কোন আগ্রহ ছিল না।
সুলোচন অন্যের জমিতে চাষ করে সংসার চালায়।দুই পিসি ও বিধবা মা এবার ময়না। ময়না সুলোচনের সংসার অভাবের। তবে ভালোবাসার কোনও কমতি নেই।
একবছর হল ওদের বিয়ে হয়েছে। ময়না আবদার করেছে সুলোচনের কাছে, কলকাতায় ঘুরতে নিয়ে যাওয়ার জন্য। সুলোচন ঠিক করেছে যেদিন ভালবাসার দিন সেদিনই ময়নাকে নিয়ে কলকাতার কোন এক পার্কে ঘুরতে যাবে। খাওয়া দাওয়া করবে হোটেলে। অনেক কিছু খাওয়াবে ময়নাকে। বিয়ের পর হানিমুনেও নিয়ে যেতে পারেনি। তবে একটা দিন ময়নাকে খুশি করতে পারবে, এটাই বা কম কিসের।
সেদিন বিকেল বেলায় কাজ থেকে ফিরে সুলোচন ময়নাকে বলল, “কাল আমরা কলকাতায় যাবো।সকাল সকাল রওনা দেবো তা না হলে বাড়ি ফিরতে অনেক রাত হয়ে যাবে।”
ময়না সব শুনে ছুটটে দুই পিসি ও শাশুড়িকে গিয়ে বলল, “কাল আমরা সবাই কলকাতা যাব বেড়াতে। অনেক আনন্দ করবো।”
ময়নার শাশুড়ি বললো, “বৌমা তোমরা ঘুরে এসো।আমরা না হয় অন্য দিন যাবো।”
ময়না মুখ ফুলিয়ে ঘরে চলে গেল।
রাত্রি বেলায় তোরঙ্গ খোলার ক্যাঁচ ক্যাঁচ শব্দে সুলোচনের ঘুম ভেঙে গেল। চোখ রগরাতে রগরাতে সুলোচন দেখল ময়না তোরঙ্গটা তাড়াহুড়ো করে বন্ধ করছে।
-” ময়না এতো রাতে তক্তপোশের নিচে কি করছো?”
ময়না তোরঙ্গটা ঠেলে দিয়ে বললো, “কিছু করছি না তো। ভোর বেলায় উঠতে হবে তো তাই আর ঘুমাচ্ছি না।”
সুলোচন কথা না বাড়িয়ে ঘুমিয়ে পড়লো।
সকাল বেলায় ময়না হলুদ রঙের বেনারসি শাড়ি পড়ে সেজে গুজে সুলোচনের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। সুলোচন তো হেসেই খুন।
হাসতে হাসতে বললো, “বিয়ের পিড়ীতে এই শাড়িটা পড়ে বসেছিলে, বাসের ভিড়, ট্রেনের ভিড় তোমার বেনারসি আস্ত থাকবে তো!
একটাই তো ভালো শাড়ি । যাও গোলাপি তাঁতের শাড়িরটা পড়ে নাও। এখুনি রওনা দেবো।”
গোলাপি তাঁতের শাড়িটা হাট থেকে সুলোচন কিনেছিল। ময়না যত্ন করে তুলে রেখেছে। কিছুতেই শাড়িটা ভাঙবে না, যদি নষ্ট হয়ে যায়। এই সুযোগ তাই সুলোচন এই শাড়িটাই পড়তে বলেছে।
তবে বেনারসি শাড়িটা পড়ে ময়নাকে কনে বৌয়ের মতোই লাগছে, সুলোচন চোখ ফেরাতে পারছে না, উপায় নেই বেনারসি শাড়িটা যদি লাট হয়ে যায়।
সুলোচন ময়নাকে কলকাতার ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে ঘুরতে নিয়ে গেল। ছেলে মেয়ে, স্বামী স্ত্রী ওদের বসার ভঙ্গী কথা বার্তার ভঙ্গী দেখে শুনে তো ময়না লজ্জায় অস্থির হয়ে গেল। কি জায়গায় আনলে আমাকে। ছিঃ ছিঃ!
সুলোচন বললো, আজ তো ভালবাসার দিন। সবাই আনন্দ করতে এসেছে তুমিও আনন্দ করো।
– ভাগ্যিস পিসিমা, মা আসেনি। তাহলে কি হতো?
সুলোচন তো হেসেই মরছে। আজ ভ্যালেন্টাইন ডে ময়না তো এর মানে জানে না। দু’বছর আগে অবশ্য সুলোচনও জানত না। গাছের সার কিনতে কোলকাতায় এসেছিল সেদিন। সেই দিন ও জেনেছিল ভ্যালেলটাইন ডে-তে কলকাতা শহর পুরুষ নারী আলিঙ্গনে মত্ত থাকে, ভালোবাসা উপচে পড়ে পার্কের আনাচে কানাচে,
সেদিন সুলোচনের হারিয়ে যেতে ইচ্ছে করছিল এক অজানা ভালবাসার রাজ্যে, কোনো নারীর আলতো হাতের ছোঁওয়াতে সাগরের আতলে তলিয়ে যেতে যেতে বলতে চাইছিল “ভালোবাসি ভালোবাসি দিবস রজনী, মোর প্রিয়া,
আজ ভালবাসা সার্থক হল সুলোচনের, ময়নাকে তো চোখে হারায় সে। তাকে নিয়ে ভালবাসার রাজ্যে পৌছে গেল শেষ অব্দি।
ময়না বলছে সুলোচনকে, “ভালবাসার আলাদা দিন হয় বুঝি, আগে তো শুনিনি,”
– “হয় গো হয়, একান্ত ভাবে প্রিয়াকে কাছে পাওয়ার দিন যে আজ। তুমি খুশি তো ময়না?”
ময়না মাথা নিচু করে সম্মতি জানালো।
ভিক্টোরিয়ায় ঝালমুড়ি, বাদাম টুকটাক খেয়ে ময়নার আবদার রাখতে সুলোচন বড় হোটেলে ময়নাকে নিয়ে গেল দুপুরের খাবার খেতে। হোটেলের সাজসজ্জা দেখে ময়না খেই হারিয়ে ফেললো, হাততালি দিয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করতে থাকল ময়না। আনন্দে আত্মহারা, যেন কত দিনের স্বপ্ন পূর্ণ হলো।
ময়নার উল্লাস প্রকাশ দেখে হোটেলে খেতে আসা বাচ্চা থেকে শুরু করে ছেলেমেয়েদের হাসি আর ধরে না, সুলোচন আর চুপ করে থাকতে না পেরে ময়নাকে বলল, “চলো টেবিলে বসি তারপর খাবার অর্ডার দেবো,”
ময়না একের পর খাবার টেবিলে দিতে বলছে, খাবারের দাম যে প্রচুর তা শুধু সুলোচনই জানে, ময়নার তো জানার কথাও না।
এদিকে সুলোচনের ইতস্ততঃ ভাব দেখে হোটেল মালিক বেশ বুঝতে পারছে কিছু তো গণ্ডগোল আছে,কতো এরকম দেখলাম গাঁইয়াগুলো পেট পুরে খেয়ে বলে টাকা দেওয়ার সামর্থ্য নেই, এবার আর ছাড়নছুড়ন নেই, প্রথমেই ব্যাপারটা মিটিয়ে নেওয়া ভালো।
-“শুনুন মশাই, আপনারা যে সমস্ত খাবারগুলোর অর্ডার দিলেন সব মিলিয়ে বিল এক হাজার টাকা হবে, অসুবিধে নেই তো, আগেই বলে দিন।”
সুলোচন মাথা নিচু করে বসে আছে,পারবে না হাজার টাকা বিল মেটাতে, কিছুতেই সম্ভব না,
-“জানতাম,বলে মুচকি হাসলেন হোটেলের মালিক,
এর মধ্যে ময়না কাপড়ের গিট থেকে অনেকগুলো টাকা বের করে সুলোচনের হাতে দিয়ে বললো,”বিয়েতে পেয়েছিলাম টাকাগুলো খরচ করিনি, তোরঙ্গতে রেখে দিয়েছিলাম, কাল রাতের বেলায় গুছিয়ে নিয়েছিলাম, তোমাকে বলিনি, তোমায় চমকে দেবো বলে। এখান থেকে চলো, রাস্তার ওপারের হোটেল থেকে খাবার কিনে নিয়ে বাড়ি ফিরে যাই। সবাই একসাথে খাবার খাব, ময়না সুলোচনের হাত ধরে হোটেলের বাইরে বেরিয়ে এলো, সুলোচনের হাতে এক ফোঁটা শিশির কনার মতো জল পড়তেই সুলোচন ময়নার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো বেশ কিছুক্ষণ, ময়নার দু’চোখে জলছবি মতো ভাসছে একটা সুখের সংসার, যেখানে ভালবাসা উপচে পড়ছে, মা অন্নপূর্ণা যেন দু’হাত বাড়িয়ে সুলোচনের সংসার ভরিয়ে দিচ্ছে। ভালবাসার দিনে ময়নার চোখে চোখ রেখে সুলোচন উপলব্ধি করছে ভালবাসার কোনো দিন হয় না, রোজ বলি ময়না তোমাকে ভালবাসি ভালবাসি,
আসলে টাকা পয়সার বিনিময়ে ভালোবাসা থাকে কিছু দিন, অন্তরের ভালোবাসা থাকে জন্ম জন্মান্তরের..যেমন ময়না সুলোচনের ভালবাসা।