গল্প- সেরা ভ্যালেন্টাইন

সেরা ভ্যালেন্টাইন
– লোপামুদ্রা ব্যানার্জী

 

– বৌদি আজ কী দিন গো? এই যে হাবুলের দোকানের পাশে যে লতুন ফ্যালাট হইছে না, সে টো তে যে লতুন দাদা বৌদি এসেছে সেই বৌদি সুকালে ফুন করে বললো ‘লক্ষ্মী আজ তোমাকে কাজে আসতে হবে না। আজ ভলনটাইন ডে । আমরা এক্ষুনি বের হবো।

‘হ্যা গো বৌদি, ‘তোমাদের বাড়িতে এত বছর কাজ করছি কই তুমি আর দাদা তো কুথাও যাও না কোনদিনই।’

লক্ষ্মীর কথায় মুচকি হাসি দিয়ে সুনেত্রা বলে, ‘কুড়ি বছর বিয়ে হয়ে গেল। এখন আবার ভ্যালেন্টাইন ডে! অনেক হয়েছে। তাড়াতাড়ি ঘরটা মুছে ফেল। দাদা একটু পরেই বের হবে।’

ঘর মোছার বালতিতে কয়েক ফোঁটা ফিনাইল ফেলে কাপড়টা ভালো করে ধুয়ে নিংড়াতে নিংড়াতে লক্ষ্মী আবার শুরু করলো,

-‘বৌদি সাধীনতা দিবস, পেজাতন্ত্র দিবস এইসব তো কেন হয় জানি কিন্তু ভলনটাইন ডে,উটা আবার কি?’
-ওরে ভলনটাইন নয় রে ভ্যালেন্টাইন ডে।মানে ভালোবাসার দিন। যে যাকে ভালোবাসে তাকে নিয়ে সারাটা দিন আনন্দে কাটাতে চায়।আর একে অপরকে উপহার দেয় এই আর কী।’
-‘তাই বলো। বৌদি তোমাকে দাদা কী দিলো গো?’
-‘লক্ষ্মী একটু বেশি হয়ে যাচ্ছে না। দাদা বাজারে গেছে। এক্ষুনি ফিরবে। এইসব কথা শুনলে খুব রাগ করবে কিন্তু।’
-‘এই আমি চুপ করলুম। আর একটা কথা বলবো?’
-‘একদম না। বাথরুমের লাল বালতিতে কাপড় জামা ভেজানো আছে কিছু। ভালো করে কেচে মেলে দিস।এবেলা আর কড়াইটা মাজতে হবে না। বিকেল এসে মেজে দিস।’

লক্ষ্মী বাকী কাজগুলো চুপচাপ কমপ্লিট করে সুনেত্রার হাতে তৈরী গরম দু’খানা পরোটা, আলুর চচ্চড়ি ও এক গ্লাস জল খেয়ে প্লেট আর গ্লাসটা ধুয়ে রেখে সুনেত্রাকে আসছি বলে তখনকার মতো বিদায় নেয়। লক্ষ্মী চলে যাওয়ার পর সুনেত্রা ভাবতে থাকে – ‘সত্যি তো। সবাই কী সুন্দর ভ্যালেন্টাইন ডে সেলিব্রেট করে। অমরেশের কী কোনদিন মনে হয় না এই দিনে সুনেত্রার জন্য কিছু উপহার কিনে নিয়ে আসতে। সুনেত্রার মেয়ে সিমি সেবার জোর করেই অমরেশের জন্য একটি রিস্ট ওয়াচ কেনে। ঘড়িটা দেখে অমরেশ খুশি হলেও রাতে শোয়ার সময় সুনেত্রাকে বলেছিল ‘ফালতু ছয় হাজার টাকা দিয়ে ঘড়ি কেনার কোন মানে হয় না।গিফট দেওয়ার সৌজন্য না করলেও চলতো। আমার জীবনের সেরা উপহারই তো তুমি। যে বিশ্বাস, যে ভালোবাসা, যে শ্রদ্ধা তুমি এতো বছর ধরে আমাকে দিয়ে চলেছো তা যে কোন বহু মূল্যবান জিনিসের থেকে অনেক অনেক বেশি দামী আমার কাছে।’

অমরেশ খাওয়া দাওয়া করে অফিসে বেরিয়ে গেল। মোটামুটিভাবে সকালের কাজ প্রায় শেষ। স্নান সেরে ঠাকুরের সিংহাসনকে ফুল দিয়ে সুন্দর করে সাজালো সুনেত্রা। ঈশ্বরের প্রতি অগাধ ভক্তি তার। জীবনের যত কষ্ট, যত আনন্দ সবই সে ভাগ করে ঈশ্বরের সাথে। আজ ভ্যালেন্টাইন ডে তাই গোপালকে নতুন পোশাকে সাজালো সে। ভক্তির সাথে কয়েক ফোঁটা চোখের জল ও নিবেদন করলো ঈশ্বরের পায়ে। সিমি এই বছর ইঞ্জিনিয়ারিং-এ চান্স পেয়েছে। হোস্টেলেই থাকে। সারা বাড়িটায় সারাদিন বড় একা একা লাগে সুনেত্রার। লক্ষ্মী বিকেলে কাজে এলে দু’জনে একসঙ্গে চা খায়। লক্ষ্মী তো এপাড়া ওপাড়ার ভিন্ন স্বাদের নানা চটপটা খবরও পরিবেশন করে গরম চায়ের সাথে।

দুপুরে খেয়ে দেয়ে উঠে মোবাইলে ফেসবুকটা খুলে দেখে কত ভ্যালেন্টাইন পোস্ট। কিছুক্ষণ ফোনটা ঘাঁটার পর সেটা বন্ধ করে ঘুমাতে যাবে হঠাৎ ডোর বেলটা বেজে উঠলো। এ সময় আবার কে? আলস্য শরীরটাকে বিছানা থেকে তুলে হাউস কোটটা গায়ে চাপিয়ে আইহোলে চোখ রেখে দেখে লক্ষ্মীর ছেলে। দরজা খুলতেই প্রিন্স বলে ওঠে ‘মা পাঠিয়েছে আন্টি। খুব গরম। তাড়াতাড়ি ধরো।’

সুনেত্রা টিফিন বক্সটা খুলে অবাক। লক্ষ্মী মাটন পাঠিয়েছে। এই দুর্মূল্যের বাজারে মাটন! তাও আবার লক্ষ্মী। টিফিন বক্সটা ডাইনিং টেবিলে রেখে মাসিক পত্রিকাটা ওল্টাতে ওল্টাতে কখন যে সে ঘুমিয়ে পড়েছিল টেরও পায় নি।

ডোর বেলের পাখীর কিচকিচ শব্দে ঘুম ভাঙ্গলো সুনেত্রার। দরজা খুলে দেখে এক মুখ হাসি নিয়ে দাঁড়িয়ে লক্ষ্মী। ‘ও বৌদি, মাংস খেয়েছিলে। নুন একটু কম হয়েছে বলছিল প্রিন্সের বাপ। কি গো! ওমন করে কি দেখছো?’
-:লক্ষ্মী তুই হঠাৎ মাটন পাঠাতে গেলি কেন? আজকাল মাটনের যা দাম। তোরা নিজেরা পেটভরে খেতে পারতিস।’
-‘ও বৌদি,আজ যে ভলনটাইন ডে। তুমি যে বললে যে যাকে ভালোবাসে তার সাথে এই দিনটা আনন্দ করে কাটায়। আমিও যে তোমায় খুব ভালোবাসি গো।’ এই কথা বলতে বলতে লক্ষ্মী তার ঝোলা থেকে একটা ছোট্ট স্টিলের সিঁদুর কৌটো বের করে সুনেত্রার হাতে দিয়ে বললো- ‘বৌদি এটা তোমার ভলনটাইন উপহার।’ সুনেত্রার তো বিশ্বাসই হচ্ছে না। লক্ষ্মী তাকে এত ভালোবাসে।
সুনেত্রা লক্ষ্মীকে জিজ্ঞেস করে ‘তুই কি নিবি আমার কাছ থেকে?’
-‘ লক্ষ্মী বলে কি আর দেবে বৌদি। এক কাপ গরম চা আর ঝাল ঝাল করে পিঁয়াজি করো দেখি।’

সন্ধ্যার দিকে সুনেত্রা ফেসবুকের পেজে পোস্ট দিল ।আর ক্যাপশন ছিল ‘অবিশ্বাস্য ভ্যালেন্টাইন ডে’। এক টিফিন বক্স মাটন, একটা সুন্দর সিঁদুর কৌটো আর লক্ষ্মীর প্রাণবন্ত হাসি মুখের একখানি ছবি।

সমাপ্ত

Loading

12 thoughts on “গল্প- সেরা ভ্যালেন্টাইন

  1. অনবদ্য লাগল গো। ছক ভাঙ্গা গল্প। প্লট ও উপস্থাপনা অসাধারণ। ভালোবাসার উপহার অমূল্য।তোমার পাঠক পাঠিকাদের জন্য এ এক অনন্য উপহার।

  2. অসাধারন লাগল লোপাদি। এক্কেবারে ভিন্নস্বাদের মিষ্টি একটা গল্প পড়লাম।

Leave A Comment