এক না পুরুষের কাহিনী
– প্রলয় কুমার নাথ
সুশীলের জন্ম হওয়ার আগে তার মা প্রভাদেবী ভগবানের কাছে বার বার মানত করতেন যেন এবার তার একটা মেয়ে হয়। বড় ছেলে কুশলের বয়স তখন আট, তাই পুত্রসন্তানের বাসনা তখন তার পূর্ণ। তিনি এবার চাইতেন তাদের পরিবারে আসুক একটি ঘর আলো করা লক্ষীমন্ত মেয়ে। অবশ্য ওনার স্বামী অতুল বাবু এই বিষয়ে কিছুই বলতেন না, তিনি যে কি চান তা বোঝাই যেত না। কিন্তু তবুও যখন প্রভাদেবীর কোলে জন্ম নিল একটি ফুটফুটে ছেলে, তখন একটু হলেও বিষণ্ণ হয়েছিলো তার মন। আত্মীয় স্বজনদের কাছে সেই দুঃখ ব্যক্ত করলে তারা পেছন থেকে মুখ বেঁকিয়ে বলতো, “মরণ দশা!…লোকে ছেলে ছেলে করে পাগল হয়ে যাচ্ছে, আর এই মাগীর কিনা মেয়ের জন্য দরদ উথলে উঠছে!…মেয়ে হলে ওর ওই কেরানী স্বামী তাকে বিয়ে দিতে পারতো শুনি?”
মনের দুঃখ মনে রেখেই প্রভাদেবী বড়ো করে তুলতে লাগলেন তার দুই ছেলেকে। তবে ঈশ্বরের কাছে কন্যাসন্তানের জন্য তার এত প্রার্থনা যেন বিফলে গেল না…কিন্তু এই ক্ষেত্রে ভগবান যেন একটু ভুল করে ফেললেন হিসেব নিকেশ কষতে! শৈশব থেকে একটু বড় হয়ে ওঠার পরই সবার চোখে পড়লো ব্যাপারটা…সুশীলের আচার আচরণ কেমন যেন মেয়েলি ধরণের, তা আর পাঁচটা স্বাভাবিক ছেলেদের মত নয়! বিশেষ করে তার হাঁটাচলা এবং কথা বলার ধরণ এমন কি তার গলার আওয়াজটাও ভীষণ ভাবে নারীসুলভ। ওর ইচ্ছা অনিচ্ছাগুলোও কেমন যেন মেয়ে ঘেষা…কিভাবে কাউকে বোঝাবে সে, যখন ওর সমবয়সী ছেলেরা স্কুলের মাঠে ফুটবল বা ক্রিকেট খেলায় মত্ত, ওর শুধু মন চলে যায় ওর সমবয়সী ছাত্রীদের রান্না-বাটি, লুকোচুরি বা কিত-কিত খেলার দিকে!
যদিও বা সুশীল পড়াশোনায় যথেষ্ট ভালো, প্রতিবারেই স্কুলের পরীক্ষায় ওর রেজাল্ট ক্লাসের সেরা দশজনের মধ্যেই থাকে, তবুও এই একটা বিষয়ের জন্য তার কোন গুরুত্ব নেই বন্ধুদের কাছে। সবার কাছেই সে যেন একটি হাসির পাত্র। আরেকটু উঁচু ক্লাসে উঠে সে বুঝতে পেরেছিল যে শুধুমাত্র তার বন্ধুরা নয়…তার পাড়া প্রতিবেশী, গুরুজনেরা এমনকি তার স্কুলের শিক্ষক শিক্ষিকাদের কাছেও সে বিনোদনের একটি উৎস। প্রথম প্রথম ব্যাপারটা খুব অপমান জনক লাগতো সুশীলের। সে ঘন্টার পর ঘন্টা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের অঙ্গভঙ্গীগুলো পর্যবেক্ষণ করতো, মায়ের মোবাইল ফোনে গোপনে নিজের কথা বলা রেকর্ড করে শুনতো তা কতখানি ‘মেয়েলি’ না ‘পুরুষালি’…কখনো কখনো নিজেই নিজের নারীসুলভ আচরণ উপলব্ধি করে লজ্জায় ঝাপসা হয়ে উঠতো তার চোখের দৃষ্টি…কিন্তু কিছুতেই, কিছুতেই সে বদলাতে পারতো না নিজেকে…যেন তার বন্ধুদের কথামত সত্যিই ঈশ্বর তাকে একটা ‘ডিফেক্টিভ মাল’ তৈরি করে এই পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন! নিজের ওপর রাগে ঘৃণায় কখনো কখনো ওর মনে হত ওই যে ওদের বাড়ির পেছনে মস্ত বড় কুয়োটা আছে…তার মধ্যে ঝাঁপ দিতে! কিন্তু সেটাও যেন তার সাহসে কুলিয়ে উঠতো না!
সময়ের সাথে সকলের হাসির পাত্র হয়ে একদিন দশম শ্রেণীর উঠলো সুশীল। সামনেই মাধ্যমিক পরীক্ষা, প্রচুর পড়াশোনার চাপ…কিন্তু এই পরিস্থিতিতেও রাতে বিছানায় গিয়ে কেমন যেন আনচান করে উঠতো তার শরীর। নিঃশ্বাসের গতিবেগ বেড়ে যেত, বুকের ভেতর যেন আছড়ে পড়তো উথাল পাথাল সমুদ্রের ঢেউ…আর তখনই একটা অদ্ভুত পরিবর্তন দেখা দিত তার শরীরের একটি ক্ষুদ্র অঙ্গে! সুশীল জীববিদ্যার বইয়ের পাতায় পড়েছে যে এই সময় যে কোন ছেলে বা মেয়ের শরীরে হরমোনাল পরিবর্তন ঘটে যাকে বিজ্ঞানের পরিভাষায় বলা হয় ‘পিউবার্টি’…এই সময়ই নাকি মানুষের মনে বিপরীত লিঙ্গের প্রতি যৌন আকর্ষণের সূচনা হয়! কিন্তু সত্যিই কি বিপরীত লিঙ্গের প্রতি? কই, তার তো সবসময় পাড়ার রকে বসে আড্ডা দেওয়া সুবলদার কথা মনে পড়লেই লিঙ্গ জেগে ওঠে…হ্যাঁ, সুবলদা, মানে ওই ফর্সা সিক্স-প্যাকওয়ালা লম্বা সুদর্শন ছেলেটা যার হালকা দাড়ি এবং তরোয়াল-কাট জুলফির প্রতি পাড়ার সব মেয়েরাই পাগল! ওর সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় ওকে দেখেই কেমন যেন ধক করে ওঠে সুশীলের বুক…তখন যেন ওর উপেক্ষা করতে ইচ্ছা করে সুবলদারই বন্ধুদের মাঝে দূর থেকে ওর প্রতি ইঙ্গিত করে বলা মন্তব্যটি, “ওই দেখ দেখ…লেডিজ মালটা যাচ্ছে…বৌদি, ভালো আছো..ও বৌদি…”
ও যে ‘সমকামী’, সেটা বুঝতে ওর আরো বেশ কয়েক বছর লেগেছিলো!
তখন সুশীল কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্র। তারও ইচ্ছা ছিলো দাদার মত ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার, কিন্তু সেই কথা বাবাকে জানাতে তিনি বিরক্ত হয়ে বলেছিলেন, “তোকে তো লোক সমাজে আমার ছেলে হিসাবে পরিচয় দেওয়াই দায়!…তাই তোর পেছনে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার পয়সা ঢালার কোন মানে হয় কী?”
আর কথা বাড়ায়নি সুশীল, তবে একেবারও কাঁদেনি সে। সকলের কাছ থেকে এমন ভৎর্সনা শুনে তা গা-সওয়া হয়ে গিয়েছে তার। কলেজের পড়ার সাথে সাথেই একটা কল-সেন্টারে পার্ট-টাইম কাজ জুটিয়ে নিয়েছিলো সে। তারপর পয়সা জমিয়ে একদিন গিয়েছিলো তাদের শহরের বিখ্যাত মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডা: অম্লান বাগচীর চেম্বারে। অনেকদিন পর, একমাত্র সেদিনই যেন ডাক্তারবাবুর সামনে প্রাণ খুলে কেঁদেছিলো সুশীল…এক এক করে তাকে বলেছিলো সকলের কাছে হেনস্তা হওয়ার প্রতিটা যন্ত্রণাদায়ক ঘটনার কথা! তিনি সময় নিয়ে শুনেছিলেন ওর সকল বক্তব্য!
-“আমাকে ঠিক করে দিন, ডাক্তারবাবু…যেভাবেই হোক, যে ওষুধ দিয়েই হোক আমাকে অন্যান্য ছেলেদের মত স্বাভাবিক করে তুলুন!”
-“কে বললো তুমি স্বাভাবিক নও?”
ডাক্তারবাবুর এই কথা শুনে চমকে উঠেছিলো সুশীল।
-“না মানে…আমার এই মেয়েলি চালচলন…ছেলেদের দেখে আকর্ষিত হওয়া…এগুলো তো মানসিক রোগের পর্যায়েই…”
-“একেবারেই নয়…’সমকামীতা’ কোন মানসিক রোগ নয়, অন্তত চিকিৎসা শাস্ত্র তাই বলে!”
অবাক হয়ে ডাক্তারবাবুর দিকে তাকালো সুশীল। তিনি বলেই চললেন, “দেখো সুশীল, আমাদের সমাজের দৃষ্টিভঙ্গীই হচ্ছে এটা মেনে নেওয়া যে প্রতিটা মানুষই যেন বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকর্ষিত হয়, পুরুষেরা যেন ‘পুরুষালি’ হয় আর মেয়েরা ‘মেয়েলি’…এর অন্যথা হলে সমাজ তাকে হেয় করে চলে। যেমন ধরো কারোর গায়ের রঙ কালো হলে সমাজ তাকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে…তার মানে কি মেনে নেবো যে কালো রঙটা চামড়ার কোন অসুখ?”
কোন উত্তর দিতে পারলো না সুশীল, শুধু মুগ্ধ হয়ে শুনতে লাগলো ডাক্তারবাবুর কথা।
-“আমাদের সকলের ব্যবহার, যৌন চাহিদা ইত্যাদি নির্ভর করে আমাদের মস্তিষ্কের ওপর…মস্তিষ্কের কোন রোগ হলে ওষুধ দিয়ে তা সারানো সম্ভব…কিন্তু কোনো পুরুষের সুস্থ মস্তিস্ক যদি নারীর অনুরূপ ক্রিয়াকলাপ করে, তাহলে তাকে বদলানো অসম্ভব।”
-“তাহলে সত্যিই কি কোন উপায় নেই সমকামীতা থেকে মুক্তি পাওয়ার?”
-“অবশ্যই উপায় আছে সুশীল…এবং তা হল নিজেকে নিজের মতই মেনে নেওয়া…নিজেকে বোঝানো যে তুমি অসুস্থ নও, তাই আরোগ্য লাভের কোন প্রশ্নই উঠছে না…সমাজ কি বলছে তার তোয়াক্কা না করে নিজের ইচ্ছা নিজের স্বাধীনতাকে অগ্রাধিকার দেওয়া!…সমাজ তাদেরকেই মনে রেখেছে যারা কোনো দৃষ্টান্তমূলক কাজ করেছে, মনে রাখেনি তাদের যৌন চাহিদা পুরুষের প্রতি ছিল না নারীর প্রতি!…বি ইওরসেলফ, কারোর মতো হতে হবে না তোমাকে। সমাজে পুরুষ বা নারী নয়…শুধুমাত্র মানুষ হয়ে বাঁচো সুশীল, সেটাই যথেষ্ট বেঁচে থাকার জন্য!”
এরপর কেটে গিয়েছে বেশ কিছু বছর, এর মধ্যেই যেন আমূল পরিবর্তন ঘটেছে সুশীলের মানসিকতার। সে যেন বিকশিত করতে চায় নিজের নারী সত্তাকে, সেটাকে লুকিয়ে কোনো কৃত্রিমতার আশ্রয় নিয়ে বাঁচতে চায় না সে। একদিন কী মনে হতে, মায়ের একটা দামী শাড়ি আলমারি থেকে বার করে, সেটা মাথায় এবং কাঁধে জড়িয়ে আয়নার সামনে দাঁড়ালো সে। মায়ের লিপস্টিকটা হালকা করে ঘষে নিলো ঠোঁটে, চোখের কোণে লাগালো কাজলের প্রলেপ, কপালে ছোট্ট একটা টিপ…নিজেকে দেখেই একটা অদ্ভুত মুগ্ধতায় ভরে উঠলো তার মন! নাহ, এবার থেকেই এই বেশেই সাজাবে সে নিজেকে…মনে মনে সংকল্প দৃঢ় করলো সুশীল!
কিন্তু পরিবারের লোকজনদের তার এই মতিভ্রমের কথা জানতে দেরী হল না…কলহের আগুনে তপ্ত হয়ে উঠলো ওর বাড়ির চার দেওয়াল! সেই সময় তার দাদা কুশল ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে চাকরি পেয়েছে কলকাতার একটি নামী সংস্থায়। নিজের সুন্দর চেহারা, এবং পুরুষালি ‘মাচো’ পার্সোনালিটির গুণে সে মন জয় করে নিয়েছে সেই কোম্পানীর মালিকের মেয়ের। কিছুদিনের মধ্যেই হাতে চাঁদ পেতে চলেছে কুশল…ধনী পরিবারের একমাত্র মেয়েটির সাথে সুসম্পন্ন হতে চলেছে তার বিবাহ!…আর এই সময় কি না ভাই-এর এই সব বেয়াদবি!
-“বেরিয়ে যা, বেরিয়ে যা এই বাড়ি থেকে…লোক সমাজে পরিচয় দেওয়ার অযোগ্য তুই…যা গিয়ে হিজরাদের মত রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে তালি বাজিয়ে পয়সা ইনকাম কর গে যা…এই বাড়িতে তোর কোনো জায়গা নেই আর!” বাবা আর দাদা সমস্বরে বলে উঠেছিলো তাকে।
আগের মতই এবারও আর কথা বাড়ায়নি সুশীল, এক কাপড়ে ত্যাগ করেছিল বাড়ি। শুধু যাওয়ার পথে ঘর থেকে মায়ের ডুকরে কেঁদে ওঠার শব্দটা তীরের মত এসে বিঁধেছিলো ওর বুকে।
এরপর কেটে গিয়েছে আরো সাতটা বছর। একটা ফ্যাশন-ডিজাইনিং এর কোর্স আগেই করা ছিলো সুশীলের, তাই আরেকটা চাকরিও সে জুটিয়ে ফেলে কলকাতার একটি নামী সংস্থায়। সেখানে কাজ করতে শুরু করে নিজের সকল হীনমন্যতা, সকল গ্লানি যেন ভুলে গিয়েছে সুশীল। সেখানে নিজের মতই আরো অনেক মানুষের সান্নিধ্যে এসে সে তৈরি করে নিয়েছে নিজের একটি আলাদা জগৎ, যেখানে সে নিজেই নিজের চোখে সেরা! ধীরে ধীরে নিজের কর্মদক্ষতার গুণে সে পৌঁছে গিয়েছে বেশ উঁচু পদে। ভাড়া বাড়ি ছেড়ে থাকতে শুরু করেছে সদ্য কেনা নতুন ফ্ল্যাটে। সে বুঝেছে যে কলকাতা শহরের সকল অপরিচিত লোকেরা এতটাই ব্যস্ত যে তার বেশভূষা বা চালচলন নিয়ে মন্তব্য করার কোন সময় তাদের নেই! এই সাত বছর ধরে তার আর কোন যোগাযোগ নেই নিজের পরিবারের সাথে।
কলকাতার যান-জট ভরা রাস্তা দিয়ে ক্যাবে করে অফিসের উদ্দেশ্যে চলেছিলো সুশীল…না সুশীল নয়, এখন নারীর মেক-আপ এবং পোষাকে আবৃত এই ‘মানুষটার’ সংক্ষিপ্ত নাম হল ‘সুশ’…এই নামেই তাকে অফিসের সকলে ডাকে। এখন তার জীবনে একটাই স্বপ্ন, মনের মত নিজের শারীরিক গঠনটিকেও নারীতে রূপান্তরিত করা! সেই খরচ সাপেক্ষ সার্জারির জন্যই প্রতিদিন একটা একটা করে পয়সা জমাচ্ছে সুশ, এই কদিনে জমিয়েও ফেলেছে কিছুটা। এমন সময় হঠাৎ চিন্তার ঘোর কেটে গেল সুশের…পাশের রাস্তায় কেমন যেন একটা জটলা বেঁধেছে, বেশ কিছু পথচারী যেন কিছু একটাকে ঘিরে গোল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কৌতূহলী হলে সে ক্যাব থামিয়ে নেমে পড়লো রাস্তায়, তারপর ভিড় ঠেলে এগিয়ে গিয়ে দেখলো একটি ময়লা পোশাক পরা পাগলাটে চেহারার শীর্নকায় ব্যক্তি ওপর হয়ে রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে আছে ভিড়ের মাঝে! বোঝাই যাচ্ছে পথ চলতি কোন গাড়ি ধাক্কা মেরেছে তার মাথায়। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো, তাকে হাসপাতালে না নিয়ে গিয়ে, আশেপাশের লোকজন বিষয়টাকে নিয়ে নানা মন্তব্য করতে এবং মোবাইলে ফটো তুলতেই ব্যস্ত!
লোকটার বুকে আলতো হাত রেখে সুশ বুঝলো যে তার দেহে প্রাণ আছে। সে আশেপাশের সমস্ত লোকের কাছে অনুরোধ করলো, আহত লোকটিকে হাসপাতালে পৌঁছতে তাকে সাহায্য করার জন্য। কিন্তু এটা এক্সিডেন্টের ঘটনা, হয়তো কোন পুলিশি কেসে ফেঁসে যাবে…এই ভয়ে কেউই এগিয়ে এলো না সামনে। বিস্মিত সুশ তখন নিজেই লোকটিকে পাঁজাকোলা করে তুলে এনে রাখলো ক্যাবের ভেতর। তার নির্দেশে অনিচ্ছাসত্ত্বেও ক্যাবের ড্রাইভার চলতে লাগলো নিকটবর্তী একটি হাসপাতালের উদ্দেশ্যে। সুশের সমস্ত গা লোকটির মাথা থেকে বেরোনো রক্তে ভেসে যাচ্ছে…সে রুমালটা বার করে লোকটির মাথায় বেঁধে দেওয়ার উদ্দেশ্যে তার ঝাঁকড়া চুলের গোছাটিকে সরালো দাড়ি-গোঁফে ভর্তি মুখের ওপর থেকে…আর ঠিক তখনই যেন বিদ্যুৎপৃষ্টের মত চমকে উঠলো সুশ…এ কাকে দেখছে সে!…এ যে তার দাদা কুশল!
কেটে গিয়েছে বেশ কয়েকটি ঘন্টা। সুশ অপেক্ষা করছিলো অপারেশনের থিয়েটারের বাইরে। আর হতবাক হয়ে চেয়েছিলো মলিন শতছিদ্র পোষাক পরা অভাব-অনটনে জর্জরিত এক বয়স্ক মহিলার দিকে…তার গর্ভধারিণী মা, প্রভাদেবী! তিনিও যেন অবাক নয়নে চেয়েছিলেন সুশের দিকে! এমন সময় ডাক্তারবাবু বেরিয়ে এলেন অপারেশনের ঘরের বাইরে, মুখে হাসি নিয়ে সুশকে বললেন, -“আপনাকে অনেক ধন্যবাদ, আপনি যদি সঠিক সময়ে পেশেন্টকে এখানে না আনতেন, বা দরকারী সময়ে নিজের রক্ত দিয়ে সাহায্য না করতেন, তাহলে হয়তো ওকে বাঁচানো যেত না! বাট হি ইস সেফ নাও!”
এমন সময় একজন নার্স এগিয়ে এলেন সেই দিকে, তারপর প্রভাদেবীকে বললেন, -“আপনিই নিশ্চয় পেশেন্টের মা…পেশেন্টের কাছ থেকে পাওয়া মোবাইল ফোনের কল-লিস্ট থেকে নাম্বার নিয়ে আপনাকেই তো ডেকেছিলাম আমরা, তাই তো? আসুন, বিলিং কাউন্টারে আসুন…”
ঠিক সেই সময় সুশ বলে উঠলো, “পেমেন্ট আমি করবো ম্যাডাম…চলুন যাচ্ছি!”
কুশলের বেডের পাশে বসে চোখের জল ফেলেছিলেন প্রভাদেবী, “তোর চলে যাওয়ার পর ধুমধাম করে বিয়ে হল তোর দাদার। এরপরই একদিন হঠাৎ আমাদের সকলকে ছেড়ে চলে গেলেন তোর বাবা। এদিকে আমাদের বাড়িতে মন টিকলো না তোর বৌদির, সে তোর দাদাকে বললো শ্বশুর বাড়িতে ঘর-জামাই হয়ে থাকতে…তোর দাদা রাজী হল না সেই প্রস্তাবে, আর সেখান থেকেই শুরু হল বিপত্তি! স্বামীর ওপর থেকে আশা মিটে গেল ওই ধনীর দুলালীর, তার সম্পর্ক হল পরপুরুষের সাথে। নিত্যদিন ঝগড়া অশান্তি করতে লাগলো সে তোর দাদার সাথে…একদিন আমাদের সকলকে বধূ নির্যাতনের কেসে ফাঁসিয়ে কেটে পড়লো সে!…সেই কেস চালাতে গিয়ে বাড়ি বিক্রি করে নিঃস্ব হয়ে উঠলাম আমরা…তোর দাদার চাকরি তো আগেই চলে গিয়েছিল…এই শোকে দুঃখে ওর কিছু মানসিক সমস্যা দেখা দিলো। সারাদিন বাড়ির বাইরে বাইরে ঘুরতে লাগলো সে…কখনো ইচ্ছা হলে ফোন করতো, কখনো বা খিদের চোটে বাড়ি ফিরে আসতো… এখন আমরা একটা বস্তিতে থাকি… কোনো মতে টুকটাক সেলাই আর বাড়ি বাড়ি কাজ করে আমি…”
কান্নায় ভেঙে পড়লেন প্রভাদেবী, “আমাদের ক্ষমা করে দে, বাবা…তুই ছাড়া আজ আমাদের আর যে কেউ নেই!”
মায়ের চোখের জল মুছিয়ে দিলো সুশ, অস্ফুট কণ্ঠে বললো, -“জানো তো মা…আজ কেন আমি প্রথমে দাদাকে না চিনেও হাসপাতালের উদ্দেশ্যে নিয়ে যেতে মনস্থির করলাম? কেন নিজের রক্ত এবং সার্জারির জন্য সঞ্চিত সমস্ত অর্থ দিয়েও সেই দাদাকে বাঁচলাম, যে একদিন আমাকে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে বলেছিল? তার কারণ আমি সমাজে নারী বা পুরুষ হিসাবে নয়…শুধুমাত্র একজন মানুষ হিসাবে বাঁচতে চাই! আমার মনুষ্যত্বই আমাকে নির্দেশ দিলো একজন মুমূর্ষু মানুষের প্রাণ বাঁচাতে, যা করে দেখানোর সাহস বা ইচ্ছা ওই স্থানে উপস্থিত কোনো ‘স্বাভাবিক’ পুরুষ বা নারীর ছিলো না! আজ যদি সমাজ আমাকে মনে রাখে, তাহলে তা রাখবে দাদার প্রাণ বাঁচানোর জন্য…আমি পুরুষ হয়েও পুরুষদের প্রতি আকৃষ্ট তার জন্য নয়!…আর আজ তোমাদের চোখে লোক সমাজে পরিচয়ের অযোগ্য’ হয়েও, আবার আমার মনুষ্যত্ব যে আমাকে নির্দেশ দিলো তোমাদের দায়িত্ব গ্রহণ করতে! বলো থাকবে আমার সাথে?”
সুশের এক হাতের পাতায় মুখ ঢেকে কেঁদেই চললেন প্রভাদেবী, ঠিক সেই সময় জ্ঞান ফিরলো কুশলের। একদিন মানসিক ভাবে সুস্থ অবস্থায় যে ভাইকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিলো সে, আজ মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে সেই ভাইয়েরই আরেকটি হাত যেন পরম স্নেহে স্পর্শ করলো সে নিজের স্যালাইনের নল বাধা হাতের সাহায্যে!
(সমাপ্ত)