Site icon আলাপী মন

গল্প- যে পথ গেছে বেঁকে

যে পথ গেছে বেঁকে
-পারমিতা চ্যাটার্জী

একা মল্লিকা দাঁড়িয়ে আছে বারন্দায়। ছোট্ট মেয়েটাকে নিয়ে কবে ঘর ছেড়ে চলে এসেছিল তখন থেকেই বসন্তের রঙ ফিকে হয়ে গিয়েছিল। বসন্তের পর বসন্ত কেটে গেছে একা – তার একাকীত্বে ঘরে বসন্ত আর ফুল ফোটায়নি। সে কিন্তু তার ছোট্ট বারন্দায় টবে টবে অনেক ফুল ফুটিয়েছে বিশেষ করে গোলাপ।
গোলাপ তার খুব প্রিয় ফুল বলে বিয়ের পর স্বামী কৌশিক তাকে নানা রঙের অনেক গোলাপ এনে দিয়েছিল তার সাথে ছিল একটা হীরে বসানো আংটি।
মল্লিকা বলেছিল, ফুলই তো অনেক আবার আংটি কেন?
ছিটকে সরে এসে কৌশিক বলেছিল, মধ্যবিত্ত আর কাকে বলে, এতো সাধারণ মানুষিকতা নিয়ে আমার সাথে কি করে থাকবে?
স্তম্ভিত মল্লিকা অবাক হয়ে চেয়ে থাকলো তার সদ্য বিবাহিত স্বামীর দিকে! এই রূপটা আজই প্রথম দেখলো। কাল রাতেও সে যখন স্বামীর অনুরোধে গান গেয়েছিল তখনও বলেছিল, এই টিপিকাল গানগুলো থেকে বেরিয়ে এসে একটু অন্য ধরনের গান গাও।
সে গেয়েছিল,’ যখন প্রথম ধরেছে কলি আমার মল্লিকা বনে’। তখনও সে অবাক হয়ে বলেছিল এতো রবীন্দ্রসঙ্গীত চিরকালীন গান…
— আমার ভালো লাগেনা মনে হয় যেন কেউ কানের কাছে মিনমিন করে কাঁদছে।
তখনও স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিল মল্লিকা এ মানুষ কি? রবীন্দ্রনাথের গানকে বলে মিনমিনে।
মল্লিকা লক্ষ করেছিল ছোটখাটো বিষয় নিয়ে কৌশিক প্রায় তাকে অপমান জনক কথা বলে সেও নীরবে মেনে নেয়, সবে তো তিন মাস বিয়ে হয়েছে এখনও যে অনেকটা পথচলা বাকি এখনই অধৈর্য্য হলে চলবে কি করে?
মল্লিকা সাধারণ বাড়ীর সাধারণ বিয়ে পাশ করা মেয়ে। আর কৌশিক বড়লোকের বাড়ীর চাটার্ড অ্যাকাউন্টেট ছেলে, চেহারায় সুন্দর পয়সারও কোন অন্ত নেই। তার তুলনায় মল্লিকা সত্যি খুব সাধারণ।
কিন্তু মল্লিকার মধ্যে একটা শান্ত সুদর স্নিগ্ধ সৌন্দর্য ছিল। তার বড়ো বড়ো কাজল কালো চোখদুটো যেন কথা বলতো। আর ছিল ভালো গানের গলা, কবিতা সাহিত্যের প্রতি গভীর অনুরাগ যা কোনটাই কৌশিককে আকর্ষণ করতে পারেনি। কৌশিকের পছন্দ ছিল উদ্যম উচ্ছল মেয়ে যে তার পার্টিতে এবং ঘরে সবেতেই স্বাচ্ছন্দ।
উগ্র আধুনিকতার সাথে মানিয়ে চলতে মল্লিকাকে বাড়ীর সবার কাছে পদে পদে লান্ছিত অপমানিত হতে হতো। তবু কান্নাকে লুকিয়ে রাখত হাসির আড়ালে।
মা যখন আঁচলে মুখ মুছিযে জিজ্ঞেস করত– তুই ভালো আছিস তো মা? সে হেসে উত্তর দিত ভালোই তো আছি মা চিন্তা কোরনা।
মল্লিকা জানে তাকে বড়লোকের বাড়ীতে বিয়ে দিতে গিয়ে তার সাধারণ বাবা মা ক্ষমতার অতিরিক্ত খরচ করেছে। মায়ের সব গয়নাগুলোই বোধহয় মেয়ের বিয়ে দিতে চলে গেছে।
বাবা একদিন বললেন – হ্যাঁ রে কৌশিক আসেনা কেন একদম, ওর কি শ্বশুরবাড়ীতে আসতে লজ্জা করে? জামাইষষ্ঠীতে এতো করে বললাম তোর মা নিজে হাতে এতো রান্না করলো আর ও এলোনা…
মল্লিকা শান্ত গলায় বলেছিল, ও খুব ব্যস্ত বাবা সময় পায়না।
মল্লিকা জামাইষষ্ঠীর দিন কৌশিককে বলেছিল, আজ একবার যাবে তো আমাদের বাড়ী? বলা নয় তো যেন অনুনয় করা ।
— কৌশিক বলেছিল কেন আজ কি আছে?
— আজ জামাইষষ্ঠী।
— দূর ওসব আমি মানি না, আমার পার্টি আছে, অফিস পার্টি ! কেরানীগিরি তো করিনা তাই ওসব জামাইষষ্ঠী নিয়ে মাতামাতি করার সময় আমার নেই। তোমার যেতে হয় তুমি যাও আমায় এসব থেকে দূরে রাখলেই আমি খুশী হবো।
— তোমার খুশীর জন্যেই তো চেষ্টা করে যাই আপ্রাণ সফল হচ্ছি কই?
— বেরোবার সময় এতো কথা আমার ভালো লাগেনা যেতে হলে যেও গাড়ী ড্রাইভার সব আছে, আর হ্যাঁ হাতে টাকা আছে তো? টাকা না থাকলে বলো শূণ্য হাতে যেওনা!

বলে দুহাজার টাকার দুটো নোট বিছানায় ফেলে দিয়ে চলে গেল।
মল্লিকার মনে হলো যেন সে ভিক্ষাপাত্র নিয়ে দাঁড়িয়েছিল আর তার স্বামী ভিক্ষা দিয়ে গেল। এইভাবে দূরত্ব বাড়তে থাকে দুজনের মধ্যে কথা বলার সময় কোন নেই। কৌশিক বাড়ী ফিরত অনেক রাতে, বাড়ীতে থাকলেও ফোনে ব্যস্ত থাকে ওর প্রিয় বান্ধবী শর্মিষ্ঠার সাথে। আগে মানুষিক নির্যাতন ছিল আসতে আসতে সেটা শারীরিকে গিয়ে দাঁড়ায়, মাঝরাতে গলা ধাক্কা দিয়ে ঘর থেকে বার করে দেওয়া, মাঝে মাঝেই চর মারা এসব লেগেই থাকতো। কৌশিকের বাবা মাও নির্বিকার ছেলের কোন কাজে কোন প্রতিবাদ কখনো করেননি, উল্টে মল্লিকাকে বলেছেন, তুমি যদি একটু ওর মতন করে নিজেকে তৈরী করতে পারতে তাহলে আর এতো ঝামেলা হত না।
তারমধ্যেই জন্ম হলো পিকুর,  মল্লিকার মেয়ে। মেয়েকে দেখে খুব খুশী হয়েছিল নিজেই নাম রাখলো মল্লিকার মেয়ে মালিনী। তারপর মল্লিকার থুতনিটা তুলে ধরে বলে কি খুশী তো?
এতোদিন পর স্বামীর আদর পেয়ে মল্লিকার চোখে ধারা শ্রাবণ।
— একি কাঁদার কি হলো? এতো আনন্দের দিনে কেউ কাঁদে নাকি?
মল্লিকা চোখে জল মুখে হাসি নিয়ে বললো- খুব খুশী।
তারপর একটা বছর ভালোই কাটলো, ঘটা করে মেয়ের অন্নপ্রাশন দিলো। মা মেয়ের অনেক ছবি তুললো, ওদের তিনজনেরও অনেক ছবি উঠলো তারপর আবার সেই একই ছবি ফিরে এলো।
মল্লিকাকে একদিন ডাকল। তারপর গলাটা পরিস্কার করে বললো- দেখো আমার মনে হয় আমাদের এবার আলাদা থাকাই ভালো। দুটো মানুষ সম্পর্কবিহীন হয়ে এক ছাদের তলায় থাকার কোন মানে হয়না। আমি শুধু পিকুর জন্য মেনে নিচ্ছিলাম কিন্তু আর সম্ভব নয়। আমি শর্মিষ্ঠাকে ভালোবাসি, ওই বা আর কতদিন অপেক্ষা করবে? মিউচুয়াল ডিভোর্সের কথাই ভাবছি। তোমার কোন ভয় নেই তোমার আর পিকুর জন্য ভালো টাকা আমি দিয়ে দেবো।
ডিভোর্সের দিন মল্লিকা কঠিন গলায় জানিয়ে দিল মেয়ে নিয়ে আমায় বেরিয়ে যখন আসতে হচ্ছে তখন মেয়ে তার মায়ের দায়িত্বেই থাকবে।
— মেয়ে আমারও, একা তোমার নয়, আমার মেয়ে কষ্টে থাকুক এ আমি চাইনা!
— তোমার চাওয়ার ওপর আরতো কিছু নির্ভর করেনা! এমন বাবার মেয়ে যে তাকে বাড়ী থেকে বেরিয়ে আসতে হচ্ছে।
প্রথম প্রথম মেয়েকে মাসে একবার করে নিয়ে যেতো তারপর পিকু আর নিজেই কিছুতেই যেতে চাইতনা। কৌশিক অনেক অনুনয় বিনয় করে কিছুতেই মেয়েকে নিয়ে যেতে পারেনি।
মল্লিকা বাবার একটা মেয়ে তাই থাকার কোন অসুবিধা হয়নি, নাতনী আসায় বাড়ীটাকে নতুন করে সাজিয়ে ছিলেন মল্লিকার বাবা। আর এককতলায় একটা ঘরে মল্লিকার গানের স্কুল হলো, তাছাড়াও সে একটা নামকরা স্কুলে গানের টিচারের কাজ পেলো।ভালোভাবেই চলে যাচ্ছে, বাবাও বেশ কিছু টাকা রেখে গেছেন তার প্রভিডেন্টফাণ্ডের। বাড়ীর একটা দিক ভাড়া দেওয়া হয়েছে তাই মেয়েকে তার সবটুকু দিয়ে মানুষ করতে কোন অসুবিধা হয়নি।কৌশিকও মাঝে মাঝেই মেয়ের নাম করে টাকা পাঠিয়ে দিতো, মল্লিকা সেই টাকাগুলো ওর নামেই জমিয়ে রাখতো।
একদিন ওই টাকার সাথে একটা ছোট খাম এলো তাতে লেখা আছে সমুদ্রের উচ্ছাস উদ্যমতা দেখতে ভালো লাগে কিন্তু দিঘীর শান্ত স্নিগ্ধ জল একটা শীতল আশ্রয় দেয় সেটাই বোধহয় ভালোবাসার আশ্রয়।
মল্লিকা চিঠিটা পড়লো তারপর রেখে দিলো।
— ড্রাইভার জিজ্ঞেস করলো বৌদি কিছু উত্তর দেবেন না?
— আমি তোমাদের আর বৌদি নই মদন!
— আপনিই আমাদের চিরকালের বৌদি। উত্তর?

মল্লিকা যেন একটু আনমনা হয়ে গিয়েছিল! চমকে উঠে বলল, হু কি বললে?
— উত্তর?
– না কিছু দেবার নেই আর
–না দাদা বলছিল বৌদি কোন চিঠি দিলে নিয়ে এসো।
— আমার কিছু দেবার নেই আর!  বলে দিও তোমার দাদাকে।
এরপর মাঝে মাঝেই টাকা আসতে লাগলো। মল্লিকা দুবার ফিরিয়ে দিয়েছে।
আবার চিঠি এসেছে, তাতে লেখা ছিলো আমার সবই আছে শুধু ঘরটা খালি আছে, একটা কচি মেয়ের গলার আওয়াজ নেই আর আমার জন্য কারও অপেক্ষা নেই। মল্লিকা তারও কোন উত্তর দেয়নি।
আবার চিঠি এসেছে দোলে শান্তিনিকেতনে এসেছিলাম, চারিদিকে লাল পলাশ আর কৃষ্ণচূড়া রাধাচূড়ার ছড়াছড়ি। একা একা লাল মাটির রাস্তা দিয়ে আমি হেঁটে যাচ্ছিলাম, কিসের যেন অভাববোধ আমার মনটাকে অশান্ত করে রেখেছিল। যে কৃষ্ণচূড়া লাল পলাশকে আমি নিজে হাতে ছিঁড়ে ফেলে রক্তাত্ব করেছিলাম সেই ফুলগুলোকে ফিরে পাবার জন্য এতো আকুলতা কেন বলতে পারো?
এরকম চিঠি মাঝে মাঝেই আসত। এবারের জন্মদিনে একটা রজনীগন্ধার স্তবক রবীন্দ্রনাথের ঘরেবাইরে এলো উপহার স্বরূপ। তাতে লেখা ছিলো, এটুকু ফিরিয়ে দিওনা প্লিজ। আচ্ছা একবার যদি পথ ভুল হয়ে যায় তাহলে কি আর ঠিক পথে ফেরার কোন উপায় থাকেনা?
মল্লিকা এ চিঠির উত্তরে লিখেছিল-
আপনার ঘরে এখন বৌ আছে তা সত্বেও অন্য নারীকে চিঠি লিখে বিব্রত করাটা অপরাধ। যে পথ আলাদা হয়ে বেঁকে যায় সে পথ আর এক হয়ে মেলেনা।
তারপর আর চিঠি আসেনি।
আজ বাড়ীর সামনে হঠাৎ অনেকদিন পর দেখলো কৌশিকের গাড়ী এসে দাঁড়ালো । হাত ভর্তি নানানরকম গোলাপ নিয়ে কে নামছে গাড়ী থেকে? কৌশিক না? একি? কি চেহারা হয়েছে ওর? মাথায় চুল নেই গালে খোঁচা দাড়ি! কোথায় গেল তার সোই উজ্জ্বল ঝকঝকে চেহারা?
সে তাড়াতাড়ি দরজা খুলে দিলো। এই চেহারা দেখে অভিমান কোথায় চলে গেল যেন বরং উৎকণ্ঠায় ভরে গেল।
কৌশিক হাত বারিয়ে গোলাপগুলো হাতে দিয়ে বললো, আজ নিজেই এলাম, কারণ না এসে আর উপায় ছিলনা।
মল্লিকা অবাক বিস্ময়ে ওর দিকে তাকিয়ে কোনরকমে বললো, কি হয়েছে তোমার?
— কই কিছু না তো…
— তবে এমন দেখাচ্ছে কেন?
— ওই শরীরটা ভালো যাচ্ছেনা….
— সে তো বুজতেই পারছি….
— একটু চা খাওয়াবে তো?
— হ্যাঁ আনছি এখুনি।
–আর ফুলগুলো?
— মল্লিকা পরম যত্নে ফুলগুলো ফুলদানিতে সাজিয়ে রাখলো।
-মিলু?
বহুদিন পর আবার এই ডাক শুনে চমকে উঠলো!
আজ কিন্তু তেমার কাছে দুটো আব্দার রাখবো, তা তোমায় রাখতে হবে। বলতে পারো এই আমার শেষ আব্দার আর তোমাদের জ্বালবনা…
— কি আব্দার? মল্লিকার গলাটা কেঁপে উঠল।
— আরে ভয় পেলে কেন? আজ ভালোবাসার দিন তাই ভালোবাসার মানুষটার কাছেই আব্দার রাখছি..
— আমি তোমার ভালোবাসার মানুষ? অবাক করলে?
— আসলে মানুষটা কাছে থাকলে তাকে বোঝা যায়না আর যাকে ভালোবাসা বলে ভুল করেছিলাম সেটা ছিলো মোহ আর কিছুনা। তোমরা চলে আসার কিছুদিন পর বুঝতে পারলাম আমার ঘরটা আর ঘর নেই সেটা একটা হোটেল হয়ে গেছে…
— কি আব্দার বললে না তো?
— আজ তোমার হাতে গরম ফুলকো লুচি খাবো আর তোমার গলায় সেই গানটা শুনব…
— কোন গান?
— আমার মল্লিকা বনে…
— সে গান তো তোমার…
— থাক না পুরানো কথা মিলু! অনেক শাস্তি পেয়েছি তাও কি তোমাদের আশ মিটছেনা? জীবনটাইতো শেষ হয়ে এসেছে…
— মানে?
— আমায় দেখে বুঝতে পারছনা আমার কেমো চলছে। কি বলছ তুমি? শাস্তি তো আমায় তুমিই দিয়ে গেলে সারাজীবন ! যেখানেই থাক তবু জানতাম মানুষটাতো আছে, সেটুকুও কেড়ে নিচ্ছো, আমি কি করবো বলতে পারো? না পারবো ওখানে গিয়ে তোমায় দেখতে না আমার কাছে এনে রাখতে, আমার সব অধিকার তুমি ছিনিয়ে নিয়েছ, এখন বলছো গান গাইতে এরপর আর গান হয়?
— বেশ তবে লুচি খাওয়াও…
লুচি খেয়ে কৌশিক একটা খাম দিয়ে বললো, এটুকু পিকুর জন্য বাঁচিয়ে রেখেছিলাম, পিকুকে বোল এটা তার জন্য তার হতভাগ্য বাবার উপহার। তোমাকে কিছুই দিয়ে যেতে পারলাম না সব আর একজন নিয়ে নিয়েছে। পারলে আমায় ক্ষমা করো।
চলে গেল কৌশিক তার শেষ কথাটা বলে দিয়ে। আর মল্লিকা অঝরধারে কেঁদে চলেছে আর বলছে , সারাজীবন তো দূরেই ছিলে তবে এতোদিন পর কেন এসে আবার আমায় কাঁদিয়ে গেলে।।

Exit mobile version