যে পথে দাঁড়িয়ে
-সঙ্কর্ষণ
১৯৫৩ সাল নাগাদ সোভিয়েত রাশিয়াতে প্রতিষ্ঠিত শিল্পী ও একটি বিশেষ শ্রেণীর প্রতিনিধি হিসাবে সম্মানিত হ’য়েছিলেন জনৈক আমেরিকান। ভালোবেসে ফেলেছিলেন অবিভক্ত সোভিয়েত ইউনিয়নের শাসনব্যবস্থাকে। রাজনৈতিক নেতৃস্থানীয়দের সে কী আন্তরিকতা, কতো রাজকীয় আতিথেয়তা তাঁর প্রতি। আপন দেশের ‘একুশে আইনের’ গেরোয় তো তাঁর চলাফেরার স্বাধীনতাটুকুই কেড়ে নেওয়া হ’য়েছিলো, এখানে এসে একঝলক টাটকা বাতাস পেয়েছিলেন তিনি। সারাজীবন থেকেই যাবেন ব’লে ঠিক ক’রেছিলেন। টানাপোড়েনটুকু জেগে উঠলো তখনই, যখন তিনি বেশ কিছুদিন সেই দেশে থেকে নিজেকে সামান্য গুছিয়ে নেওয়ার সুযোগ পেলেন। বিভিন্ন মানুষের বিশেষতঃ শিল্পীর সাথে আলাপচারিতার সুযোগ পেলেন, বই পড়ার সুযোগ পেলেন। ইতিহাস সম্পর্কে মানুষের আগ্রহ চিরকালীন। তিনি আরো সমস্যায় প’ড়লেন, যখন দেখলেন যে ঠিক ক’রে খুঁজলে নিজের জাতিটি সম্পর্কেও এমন মেলাই তথ্য পাওয়া যায়, যা তিনি জীবনে ভাবেনইনি।
‘বাক্যালাপ’ আর ‘বার্তালাপ’ দুইয়ের ভেতর কিন্তু যথেষ্ট পার্থক্য বর্তমান। প্রথমটিতে যেখানে দুই বা ততোধিক ব্যক্তির ‘মৌখিক হৃদ্যতার’ পরিচয়টুকুই পাওয়া যায়, সেখানে দ্বিতীয়টি কিন্তু ‘ভাবের আদানপ্রদান’ সূচিত করে। ন্যূনতম দুটি লোক যদি পরস্পরের সাথে মনের ভাব বিনিময় করে, উভয়পক্ষেরই পূর্বে পোষিত মতামতে বিপক্ষ চিন্তার অতি সামান্য স্পর্শ হ’তে বাধ্য। তাই উপরোক্ত ব্যক্তিও যখন প্রাচ্যের এক সদ্য স্বাধীন রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর সাথে সাক্ষাৎ ক’রলেন, স্বাভাবিকভাবেই মনোভাব খানিক পাল্টে গেলো তাঁরও। সোভিয়েতের আসল উদ্দেশ্য ধীরে ধীরে উন্মুক্ত হ’লো তাঁর কাছে। এটুকু খুবই সাধারণ চিন্তাধারা যে প্রয়োজনীয়তাই আবিষ্কারের জন্ম দেয়। তো ‘সাম্যবাদের’ প্রয়োজনীয়তা কী? সাম্য। সাম্য কোথায় প্রয়োজন হয়? অসাম্য। অসাম্য মাত্রেই কি সাম্যের জন্ম দেয়? একেবারেই নয়, অসাম্য তখনই অসহ্য হ’য়ে ওঠে যখন তা বৈষম্যের জন্ম দেয়। বৈষম্যকে কে সূচিত করে? বিপাক্ষিক বিদ্বেষ। তাহ’লে বিদ্বেষ আর বৈষম্যে পার্থক্য কোথায়? যখন বিদ্বেষ অত্যন্ত গুরুতর পর্যায়ে পৌঁছে যায় সে বিপক্ষকে ‘নিপীড়কে’ রূপান্তরিত করে, বৈষম্য বিপক্ষের ব্যক্তিগত পরিসরেই সীমাবদ্ধ থাকে। নিপীড়কের হাত ধ’রে কার উত্থান হয়? নিপীড়িত। নিপীড়িত কারা হয়? যারা নিপীড়ক দ্বারা শোষিত। আর যারা শোষিত তারা কারা? ‘দরিদ্র’, ‘সর্বহারা’, ‘মেহনতী’ মানুষজন।
অতএব সোভিয়েত ইউনিয়ন তাঁকে ‘আপামর পৃথিবীর মেহনতী মানুষের স্বার্থে’ নিজেদের অনুসৃত মতানুযায়ী ‘পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের বর্ণবৈষম্যের জনৈক শিকার’ হিসাবে তুলে ধ’রতে চাইছে এবং সামগ্রিক স্বার্থেই সেই ফাঁদে পা দিয়ে ফেলেছেন পল রোবসন। তিনি সত্যিই মনেপ্রাণে পৃথিবীর সমস্ত আর্ত মানুষের প্রতিভূ (স্বজাত, স্বদেশ নির্বিশেষে), কিন্তু ‘মার্কিন-সোভিয়েত ঠাণ্ডা লড়াইয়ে সোভিয়েতের অ্যাফ্রো-আমেরিকান টোপ’ নন। স্বদেশের সরকার কেবল কৃষ্ণাঙ্গ হওয়ায় তাঁদের সাথে প্রবল অন্যায় ক’রেছে, তাঁর নিজের চলাচলের স্বাধীনতা কেড়ে নিয়েছে, ‘জিম ক্রো দর্শনের’ (কৃষ্ণাঙ্গ দ্বারাই বর্ণবিদ্বেষে সমর্থন) ভিত্তিতে শিক্ষা থেকে স্বাস্থ্য সমস্ত নাগরিক অধিকার খর্ব ক’রেছে, কিন্তু তাঁদের অবস্থার কথা শুনতে সোভিয়েত তাঁকে আদৌ ডেকে পাঠায়নি যতোখানি সে ক’রেছে আমেরিকার কৃষ্ণাঙ্গ সমাজে ‘কমিউনিজমের’ ধারণাকে ছ’ড়িয়ে দিতে। অন্যদিকে তাঁর নিজের দেশে যখন “রোবসন একটি আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের শিকার” এহেন সংবাদ প্রকাশ হ’চ্ছে, সোভিয়েতের গ্রন্থাগার তাঁকে জানিয়ে দিয়েছে কৃষ্ণাঙ্গ মানুষের প্রাচীন সংস্কৃতি কতো বৃহৎ, তার দর্শন কতো গভীর।
সত্যকে স্বীকার ক’রতে কখনও ভয় পাননি মিস্টার রোবসন। কিন্তু কোনো এক অজানা কারণে তিনি মাত্র এক স্থানে মৌখিক স্বীকারোক্তি দিয়েছেন ‘তিনি সাম্যবাদে বিশ্বাসী’ আর কোথাও লিখিত বা মৌলিক কোনো মুচলেকাই তিনি দেননি। কিন্তু তিনি সেই মানুষগুলির সাথে আমৃত্যু ছিলেন, যাদের শ্বেতাঙ্গরা মানুষের পর্যায়েও ফেলেনি কোনোদিনও। তাদের তিনি নিজেদের শক্তি চিনিয়েছেন আর আমাদের চিনিয়েছেন যে বিলেত মানেই শুধু ‘সাগরপাড়ের সাদা চামড়ার স্বর্গরাজ্য’ নয়। এমনও মানুষ সেখানে আছে, যারা সংখ্যায় প্রচুর অথচ অর্থাভাবে আমাদের মতোই এককামরার বাড়িতে, এক বস্ত্রে, অভুক্ত দিন কাটায়। তিনি কৃষ্ণাঙ্গদের জন্য শ্বেতাঙ্গদের সমান অধিকার চেয়েছিলেন মাত্র, তার বেশী আর কিছুই নয়। গৃহীত সাম্যবাদ, লিখিত সাম্যবাদের তুলনায় ঢক্কানিনাদে পিছিয়ে থাকলেও আসলে তার পরিসর যে প্রতিটি মানুষের হৃদয়ে বিস্তৃত তা তিনি নিজের কাজের মধ্যে দিয়ে বুঝিয়ে গিয়েছিলেন। ভারতীয় হিসাবে আমাদের প্রাপ্তি এটুকুই যে যে লোকটিকে আমরা ২বেলা গালাগাল ক’রি যে স্বাধীনতা-উত্তর ভারতবর্ষের সমস্ত সমস্যার জন্য ইনিই দায়ী, সেই পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু কিন্তু তৎকালীন পরিস্থিতিতেও পল রোবসনের মতো একজন মানুষকে ‘মধ্যপন্থী অবস্থান’ (পুঁজিবাদ ও সাম্যবাদের মাঝামাঝি) সম্পর্কে প্রভাবিত করার ক্ষমতা রাখতেন এবং সম্ভবতঃ সেই কারণেই তিনি নিজস্ব রাজনৈতিক চিন্তাধারাকে কোনো নির্দিষ্ট শ্রেণীভুক্ত করেননি। ব্যক্তিগত প্রেক্ষিতে রাজনীতি একটি দর্শন মাত্র, সামগ্রিক পরিসরে এসে তা পূর্বোক্তর ছাঁচে ফেলা পথ ধ’রে অগ্রসর হয়।
একটি বর্ণবিদ্বেষবিরোধী আন্দোলন চলাকালীন দেশ, সমাজ, নেতৃত্ব ও মানুষের অবস্থা। সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল ঠিক কীভাবে সময় দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় এবং একটি মানুষ কীভাবে তার পরিবারের প্রভাবে ‘সমগ্র মনুষ্যত্বের প্রতিনিধি’ হ’য়ে ওঠে একটি আত্মজীবনী তার জলজ্যান্ত প্রমাণ। ‘আঙ্কল টমস কেবিনের’ বীভৎসতা নয়, একটি জনজাতির সযত্নলালিত যন্ত্রণার আলেখ্য মাত্র। কল্পনা ছাড়িয়ে বাস্তবের দিকে তাকানোই তো বড়ো হ’য়ে ওঠা।
তথ্যসূত্র:- পুস্তক- পল রবসন যে পথে দাঁড়িয়ে
অনুবাদ- দীপেন্দু চক্রবর্তী