জ্যান্ত শিব
– লোপামুদ্রা ব্যানার্জী
শনিবার কৈলাসে ফিরতে শম্ভুনাথের বেশ রাত হয়ে গিয়েছিল। শুক্রবার সন্ধ্যা ছ’টা থেকে শিব চতুর্দশী শুরু। পরের দিন সন্ধ্যা পর্যন্ত চললো। দেড় দিন ধরে ভক্তদের শ্রদ্ধায়, ভক্তিতে শিবের মাথায় নাগারে দুধ ঢালায় শম্ভুনাথের সামান্য সর্দি লেগেছে। কৈলাসে ফিরে এসেই দু’চারটে গগনভেদী হাঁচি দিয়ে দূর্গাকে বলে একটু ভালো করে আদা দিয়ে চা বানাতে। আগে চা খেতো না শম্ভুনাথ। সেবার নীল ষষ্ঠীতে এক ভক্ত দার্জিলিং থেকে আনা সুগন্ধি যুক্ত একটা চায়ের প্যাকেট রেখে গিয়েছিল শম্ভুনাথের পদতলে। সেই থেকেই মাঝে মধ্যে একটু আধটু চা পান করে শম্ভুনাথ।
কিছুক্ষণের মধ্যে দূর্গা একটা বড়ো কফি কাপে বেশ করে আদা দিয়ে কড়া চা নিয়ে হাজির। চা-টা খেয়ে রাতের খাবারটাও কিন্তু তাড়াতাড়ি সারতে হবে বলে জানিয়ে দিয়ে গেল। তিন দিন একটানা নিরামিষ খেতে হয়েছে শম্ভুনাথকে। তাই সে দূর্গাকে বলে ‘আজ কিন্তু মাছের ঝোল দিয়ে গরম ভাত খাবো।’ দূর্গা একগাল হাসি দিয়ে বলে ‘আমি জানি তোমার নিরামিষ খেতে খুব কষ্ট হয়।’ দূর্গা তাই চারাপোনা দিয়ে পাতলা মাছের ঝোল আর মুসুর ডালের বড়ি ও শুকনো লঙ্কা ভালো করে ভেজে আলুভাতে মাখলো। সেই শুক্রবার সকাল দশটা নাগাদ দু’টো পোস্ত ভাত খেয়ে বেরিয়ে ছিল শম্ভুনাথ শিবরাত্রির উদ্দেশ্য। তারপর রাত বারোটা নাগাদ মন্দিরে দু’টো শুকনো রুটি আর আঝালা আলুর তরকারি। শনিবার ভোর থেকেই ভক্তদের সমাবেশ। কমপক্ষে হাজার খানেক ভক্ত উপস্থিত হয় বুড়ো শিব তলায়। এখানে নাকি মহাদেব সশরীরে বিরাজ করে। পূজার শেষে মহাদেব প্রতিটি ভক্তের মাথায় হাত দিয়ে আশীর্বাদও করে। এ যেন ভক্তদের পরম প্রাপ্তি।
বুড়ো শিবতলার নামটা দশ বছর আগেও এত প্রসিদ্ধ ছিল না। কিন্তু যে বছর থেকে শম্ভুনাথ এখানে অধিষ্ঠান করতে শুরু করেছে তখন থেকেই বুড়ো শিবতলার নাম চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়তে লাগল। বাঁকুড়ার আশে পাশে যত গ্ৰাম আছে এমনকি দূর্গাপুর থেকেও একদল ভক্ত এসেছিল। তারা তো শম্ভুনাথের জন্য পেটি পেটি জিনিস এনেছে। আসলে এই ভক্ত কোন ছাপোষা বাঙালী নয় দূর্গাপুরের একজন বিখ্যাত ব্যবসায়ী। তার ওপর মাড়োয়ারি।অন্য সব ভক্তরা তো টেরিয়ে টেরিয়ে প্রনামীগুলো দেখছে আর বলছে- ‘এতো আর বাবার কাজে লাগবে না। সবই যাবে মন্দির কর্তৃপক্ষের কাছে। বাবার আর কি! ফুল, বেলপাতাতেই উনি সন্তুষ্ট। এই কথাটা ভীষন দামি। এই দেড় দিন ধরে জলে, দুধে নাকানি চোপানি খেয়েও পূজার শেষে শম্ভুনাথের দক্ষিনা মাত্র দেড় হাজার টাকা।
তবে এতে ও বেশ খুশি শম্ভুনাথ বাগদী। গত দশ বছরে তার সংসারের শ্রী বৃদ্ধিও ঘটেছে যথেষ্ট। দুই মেয়ের স্বচ্ছল পরিবারে বিবাহ, দুই ছেলের সরকারি চাকরি। আর কি চাই।কাতুটার এখনো বিয়ে হয়নি । তাই সে বাড়ি থেকেই কলকাতা যাওয়া আসা করে। দুই ছেলে চাকরি পাওয়ার পর তার পৈত্রিক টালির ঘরটা ভেঙে দু’তলা পাকা বাড়ি তুলেছে। নাম রেখেছে কৈলাস ভিলা। বুড়ো শিব তলার মন্দির কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার পর থেকেই শম্ভুনাথের পরিবারের শ্রীবৃদ্ধি হয়েছে। প্রতিমাসে দশহাজার টাকা বেতন তার উপর উপরি তো আছেই।;কাজ অতি সামান্য। প্রতি সোমবার ভোর পাঁচটা থেকে বেলা দু’টো পর্যন্ত শিব সেজে বুড়ো শিব তলায় বসতে হয়। আর শিবের পূজা পার্বনের দিনগুলোতে একটু কাজের চাপ বাড়ে।
একটা সময় শম্ভুনাথ বাগদীর রোজগার ছিল বহুরূপী সেজে গ্ৰামের লোকদের মনোরজ্ঞন করা। কখনো হঠাৎ বাবু, কখনো একই শরীরে শিব ও কালী, কখনো বীর হনুমান আবার কখনো মহাদিদেব মহেশ্বর। আরোও কত কি না সাজতো শম্ভুনাথ। দশ বছর আগে বুড়ো শিব তলায় তেমন ভক্ত সমাগম হতো না। মন্দিরের সেক্রেটারি শম্ভুনাথকে ডেকে বলে ‘প্রতি সোমবার শিব সেজে মন্দির প্রাঙ্গণে উপস্থিত থাকিস। তোর সঙ সাজ দেখে যদি দু’চার জন লোক যদি এদিক পানে আসে। যদি কিছু পয়সা কড়ি দেয় তাহলে ওটাই হবে তোর উপার্জন। দূর্গা শুনে বলে, ‘এটাই ভালো। রোদে রোদে, পায়ে হেঁটে আর কত ঘুরবে। তার থেকে এক জায়গায় বসে রোজগার করা ভালো।’ বুড়ো শিবতলায় সেদিন ছিল নীল ষষ্ঠী। আর নীল ষষ্ঠীতেই মন্দির প্রাঙ্গণে অভিষেক হলো শম্ভুনাথের। মন্দিরে আসা ভক্তগন পাথরের বিগ্ৰহের সাথে সাথে জ্যান্ত শিব সেজে বসে থাকা শম্ভুনাথের সামনে রাখা থালার মধ্যেও পয়সা দিতে লাগল। শম্ভুনাথ ও তার অন্তর থেকে তাদেরকে শ্রদ্ধা জানাতে লাগলো এবং আশীর্বাদ স্বরূপ ডান হাতখানি ভক্তদের মাথায় রাখতে শুরু করলো।
শম্ভুনাথ সবার প্রথম যে ভক্তের মাথায় হাত দিয়ে আশীর্বাদ করছিল সেই ভক্তের বহুদিনের আটকে যাওয়া কাজ তার কিছুদিনের মধ্যেই নির্বিঘ্নে সুসম্পন্ন হয়ে ছিল। সেই থেকে ঐ ভক্ত সকলকে বলে বেরাতো বুড়ো শিব তলার জ্যান্ত শিবের কথা। শম্ভুনাথের সারল্যে মুগ্ধ হয়ে দিন দিন দর্শনার্থীদের সংখ্যাও বাড়তে লাগলো। একজন সাধারণ বহুরূপী থেকে শম্ভুনাথ আজ বুড়ো শিব তলার জ্যান্ত শিব রূপে বিখ্যাত হয়ে উঠেছে। তবে প্রথম দিকে বামুন সমাজের কিছু লোক একজন বাগদীর শিব সাজার ব্যাপারটাকে ঘোর বিরোধিতা করেছিল। কিন্তু চতুর্দিক থেকে ভক্তগণ শম্ভুনাথ বাগদী এ কথা ভুলে তাকে জ্যান্ত শিব রূপে মেনে নিয়ে পূজাও করতে থাকে। তবে শম্ভুনাথ মনে করে এইসবই শিবের মহিমা। ভক্তি, বিশ্বাস এইগুলো হলো শিবের মহাপ্রসাদ। এই মহাপ্রসাদের জোরেই শম্ভুনাথ আজ জ্যান্ত শিব।
সমাপ্ত