অণু গল্প- অভাগা

অভাগা
-সুজিত চট্টোপাধ্যায়

 

পরেশ বাবু তার মৃত্যুর আগে উইল করেছিলেন, তার মৃত্যুর পর তার অগাধ সম্পত্তির মালিক সেই হবে , যে এই পৃথিবীর সবচেয়ে অভাগা।
এক আইনজীবী কে তিনি এই দায়িত্ব পালনের ভার দিয়ে গিয়েছিলেন।
আইনজীবী মহাশয় অনেক খোঁজাখুঁজি করলেন কিন্তু উইলের শর্ত মোতাবেক কাউকেই তিনি মনোনীত করে উঠতে পারলেননা।

একদিন তার সাত বছরের ছেলের কাছে গল্পের ছলে, তার এই না পেরে ওঠা কাজের কথাটি আক্ষেপের সুরে বললেন। সেখানে তখন তার স্ত্রী উপস্থিত ছিলেন। তিনিও সমস্ত ব্যাপারটাই জানতেন এবং , এই নিয়ে তার মনেও কষ্ট ছিল এই কথা ভেবে যে,, একজন মৃত মানুষের শেষ ইচ্ছে তারা পূরণ করতে ব্যার্থ হতে চলেছেন।

সাত বছরের ছোট্ট ছেলেটা সবটুকু শুনে আশ্চর্য হয়ে বললো, সেকি! এতো খুবই সহজ ব্যাপার বাবা। আমি এর উপায় বলে দিতে পারি , যদি আমাকে অনুমতি করো।
ছোট্ট ছেলের মুখে এমন কথা শুনে , আইনজীবী এবং তার স্ত্রী যারপরনাই আশ্চর্য হয়ে বললো, তুই কী বলছিস জানিস ! একজন অভাগা চাই , পৃথিবীর সবচেয়ে অভাগা। তুই কেমন করে এর সমাধান করবি ? তুই এই জগতের কী জানিস , কতটুকু বুঝিস?
ছোট্ট ছেলেটা একটা গোলাপ ফুলের ছবিতে লাল রঙের প্রলেপ দিতে দিতে বললো, শুনেছি আমার দাদু আর ঠাম্মা এখনো বেঁচে আছেন। কিন্তু তোমাদের ভুলবোঝাবুঝির কারণে, আজ অব্দি তাদের দেখিনি। তারাও আমাকে দেখেননি। তাদের আদর ভালবাসা কিছুই পেলামনা। একটু চোখের দেখাও দেখলাম না। তারাও আমাকে দেখেননি। কিন্তু আমি জানি তারা আমার কথা খুব ভাবেন। মনে মনে আশীর্বাদও করেন নিশ্চয়ই। আমিও ওদের না দেখেও, মনে মনে খুব ভালবাসি। আমি জানি তোমরা আমাকে দাদু ঠাম্মার কাছে নিয়ে যাবেনা। আর আমি যখন ওদের কাছে যাবার মতো বড় হয়ে যাবো , তখন ওরা কেউ হয়তো আর থাকবেন না। আমারও দেখা হবেনা , কথা হবেনা , পাশে শুয়ে গল্প শোনা হবেনা , আঙুল ধরে বেড়াতে যাওয়া হবেনা , বুকে চেপে ধরে আদর পাওয়া হবেনা , আব্দার করে জ্বালাতন করা হবেনা , মাথায় হাত রেখে মানুষের মতো মানুষ হবার প্রেরণা পাওয়া হবেনা ।
আমার চেয়ে অভাগা পৃথিবীতে আর কেউ নেই বাবা।
আমিই পৃথিবীর সবচেয়ে অভাগা।

আইনজীবী আর তার স্ত্রী দুজন দুজনের দিকে তাকাতে গিয়েও চোখে চোখ মেলাতে পারলোনা। চেষ্টা করেও নিচু মাথা উঁচু করতে পারলোনা। তাদের মতো এমন অভাগা সন্তানের পিতামাতাও বোধকরি পৃথিবীতে দুটি নেই।

Loading

One thought on “অণু গল্প- অভাগা

Leave A Comment