গল্প-“অলিভার অলবিদা”

“অলিভার অলবিদা”
– রাখী চক্রবর্তী

 

 

প্রথম পর্ব
কুউউ..ঝিকঝিক.. সুপার ফাস্ট এক্সপ্রেস তীব্র গতিতে চলছে। চার নম্বর বগিতে মাত্র তিনটে প্যাসেঞ্জার। আমি মনোময়, রিতম ও কুমার। আমরা তিন বন্ধু যাচ্ছি মুম্বাই। চোখে হিরো সবার স্বপ্ন ভরপুর। কিন্তু পকেটটা হাল্কা আমাদের।
হাওড়া থেকে যখন আমরা ট্রেনে উঠলাম তখন একটি অল্প বয়সী মেয়ে ও তার মা ঐ বগিতে উঠেছিল। ট্রেনে উঠেই মেয়েটি খুব কান্নাকাটি করছিল। কুমার তো এতো কষ্ট পাচ্ছিল ঐ মেয়েটির কান্না দেখে,পারলে সোজা জাপটে ধরে নিজের বুকের মধ্যে মেয়েটিকে রেখে দেয়।
আমি ভাবছি এই কেলো করলো কুমার আবার না মেয়েটির প্রেমে পড়ে যায়। কোনো মেয়ের চোখের জল কুমার সহ্য করতে পারে না। ওর যে বৌ হবে ভাগ্য তার খুব ভালোই হবে। যাই হোক অচেনা মেয়েটির সাথে আড় চোখে দৃষ্টি বিনিময় আমরা তিন বন্ধুই করছি তবে সোজাসুজি নৈব নৈব চঃ।
হুম, একটা কথা ভেবে পাচ্ছি না এতো গরমেও মেয়েটি মাথা থেকে চাদরের ঘোমটা কিছুতেই সরাচ্ছে না। তবে চোখ দু’টো দেখলে মনে হয় মেয়েটি খুব সরল প্রকৃতির। অবশ্য এটা আমার অভিমত। এদিকে
কুমারের ভাবগতিক আমার ঠিক লাগছে না। থেকে থেকে ম্যাডাম সেফটিপিন আছে?
ম্যাডাম বোরলীন আছে? ঠোঁটটা শুষ্ক হয়ে গেছে। নানান ছুঁতো করে মেয়েটির সাথে ভাব জমাতে যাচ্ছে কুমার।
আর মেয়েটির জননী রণচণ্ডীকা মূর্তি হয়ে এদিক ওদিক ঘাড় ঘুরিয়ে যাচ্ছে।
আমি কুমারের কানে কানে বললাম, এবার চেপে যা। বড় বাঁশ অপেক্ষা করছে তোর জন্য। প্যাদানি খাবি কিন্তু।
রিতম আমার কথায় ঘাড় নেড়ে বললো, যা বলেছিস।
আমরা ডিনার করে নিলাম রাত নটার সময়। তারপর বাঙ্কে উঠে পড়লাম। ঘুমের সাগরে পারি দিলাম তিনজনই।

অ-লি-ভা অ-লি-ভা বলে কে যেন চিৎকার করে উঠলো! ট্রেনের ঝাঁকুনিতে অস্বাভাবিক মাত্রাতে আমরা দুলছি। মোবাইলটা হাতে নিয়ে দেখলাম রাত বারোটা দশ কিন্তু ঐ মেয়েটা আর ওর মা কোথায় গেল?
আর অলিভা কে?

এই কুমার, রিতম ওঠ গাধার দল,পাহারাদার নাকি আমি।
রিতম চোখ ডলতে ডলতে বললো, কি রে চিৎকার করছিস কেন? কি হলো?
আরে ঐ মেয়েটা কোথায় গেল?

আমি বললাম, চিৎকার শুনিস নি তোরা অলিভা বলে কে যেন চিৎকার করছিল।
কুমার আপশোসের সুর টেনে বলল, হা ভগবান দিলে আবার কেড়েও নিলে।
এই থাম টিটি এলে আমরা সবাই অলিভার কথা জিজ্ঞাসা করবো।
ঐ তো টর্চের আলো দেখা যাচ্ছে।
টিটি আমাদের সামনে আসতেই বললাম, স্যার, এই বগিতে একটি মেয়ে ও তার মা উঠেছিলেন। ওনারা কি নেমে গেছেন?
– কেন বলুন তো কি হয়েছে?
অলিভা বলে একটা চিৎকার শুনলাম। কিছু বুঝতে পারছি না। সামনের গেটটা খোলা দেখলাম। কিন্তু ওটা বন্ধ ছিল।
টিটি রিজার্ভেসনের চেক লিস্ট দেখে বললেন, না অলিভা বলে কোনও নাম নেই।
রিতম বললো, বাঁচা গেল। খুব অস্বস্তি লাগছিল আমার।
কুমার মাথা নিচু করে বেশ কিছুক্ষণ বসে রইলো তারপর দু’ হাত তুলে বললো, ভগবান যা করেন মঙ্গলের জন্যই। জানিস তো মেয়েটির জন্য আমরা হয়তো ফ্যাসাদে পড়ে যেতাম।
রিতম বললো, একদম হক কথা কইছো ব্রো হা হা হা ।
সকাল বেলায় কফি কাপে চুমুক দিতে দিতে মুম্বাই পৌছে কি কি করবো তার প্ল্যান করে নিলাম আমরা।

দ্বিতীয় পর্ব

ইয়ার্কি ফাজলামি করতে করতে স্বপ্নের রাজ্যে পৌছে গেলাম আমরা।পথ চলতি মানুষজনকে দেখছি আর ভাবছি এদের মধ্যেই আছে হয়তো এমন কেউ যারা আমাদের মতো স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করার জন্য এই শহরে এসেছে।
কুমারের এক পরিচিত ভদ্রমহিলা আমাদের থাকার জন্য একটা ঘর ভাড়ার ব্যাবস্থা করে রেখেছিলেন দিন দশেক আগেই। ফলে বাড়ি ভাড়া নিয়ে কোন টেনশন ছিল না।
একটা বড় ঘর, বাথরুম আর একটা বারান্দা। একেবারে ঝকাস। দিব্যি থাকতে পারব তিন বন্ধু ।
এক সপ্তাহ ধরে অনেক ঘুরে আমরা তিনটে নামী স্টুডিওর ম্যানেজারের ফোন নম্বর জোগাড় করেছি। এই ম্যানেজারগুলোও সেলিব্রিটি। ধরা ছোঁয়ার বাইরে। যাইহোক কথাবাত্রা হলো। দু’দিন পর গেলাম।
তিনজনই চান্স পেলাম রবি দেওল প্রোডাকশনের মেগা সিরিয়াল “দোস্তী” তে। যাক বাবা একটা কাজের কাজ হলো। বিকেলে ভাড়া বাড়িতে ফিরে এলাম।
ফুরফুরে মেজাজ এখন আমাদের। সন্ধ্যা বেলায় হাল্কা সুরা পান করে আমরা তিন বন্ধু তাস খেলছি। মৃদু হাওয়া বইছে বাইরে।গুনগুনিয়ে এককলি গানও গাইছি আমি।এর মধ্যে হঠাৎ লক্ষ্য করলাম কুমারের হাতে বড় বড় নখে নেল পালিশ লাগানো ।
আমি হেসে বললাম, এই কুমার নেল পালিশ কখন পড়লি?
রিতম আমাকে থামিয়ে বলল মস্করা করিস না কুমারের রোল কিন্তু জমজমাট। তোর আমার রোল তেমন কিন্তু না।
-আরে নেল পালিশটা দেখ।
কুমার বললো, তোর মাথা খারাপ হয়ে গেছে। কলকাতা চলে যা। আমার নখ দেখ কি পরিস্কার।
-কি বলছিস কুমার আমার মাথা খারাপ।গোলাপী রঙের নেল পালিশ তোর নখে। কি সুন্দর করে লাগানো দেখলাম। যেন কেউ সুন্দর করে লাগিয়ে দিয়েছে। তা আবার এক সেকেন্ডে উধাও হয়ে গেল।
কুমার, রিতম দু’জনেই বললো আমাকে, বেশি খেয়ে নিয়েছিস। শুয়ে পড়। কাল শুটিং আছে।
আমি কিছু না বলে ঘরে চলে এলাম। ঘরে তিনটে ছোট ছোট ডিভানের মধ্যে মাঝের ডিভানটি আমার। আমি শুয়ে পড়লাম।খানিকক্ষণ পর ওরাও শুয়ে পড়লো।

রাতে বেশ কয়েক বার আমাকে উঠতে হয়।অভ্যাসবশত আমি উঠলাম। দেখলাম কুমার বেডে নেই। হয়তো বারান্দায় আছে।বারান্দাটা বেশ রোমাঞ্চকর লাগে। একটু জল খেলাম। ভাবলাম আমিও কিছুক্ষণ বারান্দায় পায়চারি করি। একটু চাপ তো আছেই। রিতম শান্তিতে ঘুমোচ্ছে। বেশ ভোলাবালা ছেলে রিতম। কুমার আবার প্রেমিক প্রেমিক ভাব দেখায় সব সময়।
ঘরের দরজাটা ভেজানো আছে। হাত দিয়ে দরজাটা খুলেই দেখলাম বারান্দাটা ঘুটঘুটে অন্ধকার।

তৃতীয় পর্ব

বাথরুমে যাব বলে একটু এগিয়ে গিয়েই আমি থমকে দাঁড়িয়ে গেলাম। রোডের আলোর খানিকটা আমাদের বারান্দার এই দিকটার ওপর পড়েছে। আমাদের বারান্দায় কোন লাইট নেই। কিন্তু কে বসে আছে ! ওখানে আলো আঁধারি অন্ধকারে মোহময়ী ভঙ্গিতে? পা টিপে টিপে গেলাম আমি। আসলে বারান্দাটা লম্বা মানে এ প্রান্ত আর ও প্রান্ত।
“আস্তে আস্তে চুলের জট ছাড়াও লাগছে তো। লম্বা চুল আমার ভালো লাগে না। তাড়াতাড়ি তুমি খোঁপা করে দাও। গোলাপ লাগিয়ে দিও। কাঁটা যেন রক্ত ঝরায় না তোমার, দেখো। অলিভাকে খুব ভালোবাসো তাই না..” এ কি মেয়েদের মতো গলা করে কথা বলছে কুমার!
এ কোন কুমারকে আমি দেখছি, ও অলিভা হয়ে উঠেছে কেন !
লম্বা চুল, একা একা কি সব বকছে ও এই অন্ধকারে বসে। ও মাই গড, হাওয়া বাতাস লাগলো না তো কুমারের ! আমার বাথরুম ডগে উঠলো। চুপিচুপি ঘরে এসে রিতমকে ডাকলাম। তারপর আমরা আড়াল থেকে যা দেখলাম তা ভাষায় প্রকাশ করা খুব কঠিন।কুমার নিজের পায়ে পায়েল পড়ছে। অঙ্গভঙ্গি নারীদের মতো করছে। শরীরি আবেদন এমন করছে যেন এক বিশেষ পুরুষের জন্য কোনো নারী করে। কিন্তু কি করে সম্ভব এসব? কিছু বুঝতে পারছি না।
রিতম আমার হাত শক্ত করে ধরে রেখেছে।ও ভিতু প্রকৃতির ছেলে।
রিতমকে বললাম, চল কুমারকে ডাকি
-না না। অশরীরি আত্মা তোকে আমাকে ছাড়বে না। জানিস মনোময়, ট্রেনের ঐ মেয়েটা রে, অলিভা মনে হয় ওরই নাম। ট্রেন থেকে ঝাঁপ মেরে আত্মহত্যা করেছে মনে হয়। তুই তো চিৎকার শুনেছিলিস। ওর আত্মা কুমারের ওপর…রাম কৃষ্ণ রাম হরে হরে।
বরং ঘরের দরজাটা ভেজিয়ে দি। আমরা ঘরের ভেতরে এসে দরজা ফাঁক করে
বারান্দার ঐদিকে তাকালাম মনে হলো কুমার আমাদের লক্ষ্য করেনি। কিছুক্ষণ পর আমি রিতম ঘরে এসে শুয়ে পড়লাম। শুধু ভোরের অপেক্ষাতে রইলাম।

মনোময়, রিতম তাড়াতাড়ি ওঠ। শুটিংয়ে যাব তো। আমরা ধড়ফড় করে উঠলাম। কখন যে চোখ লেগে গেছিল আমার আর রিতমের বুঝতে পারিনি। চোখ খুলেই কুমারকে দেখলাম কি সতেজ লাগছে কুমারকে। সুন্দরীরা কুমারের পেছন আর ছাড়বে না আজ।

রেডি হয়ে আমরা স্টুডিওর উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। গতরাতের ঘটনা কুমারকে আমরা বললাম না। রিতম বললো, বাড়ি ফিরবো তো দুপুরে তখন আমরা কুমারকে কাল রাতের ঘটনা বলবো। আমি সম্মতি জানালাম। আগে কাজে মন দিতে হবে আমাদের।

মেক আপ কমপ্লিট।”দোস্তী “মেগা সিরিয়াল স্পটে আমরা। ডায়লগ রেডি। লাইট ক্যামেরা, অ্যাকশন..
কুমারের চরিত্রের নাম আলবার্ট ডিসুজা।ডিসুজার ঠোঁটে চুরুট বিরাজ করছে। হাল্কা হাতে চুল সেট করতে করতে ডিসুজা বলছে, অলিভা হৃদ স্পন্দন শোনো আমার বুকে মাথা রেখে আস্তে..আস্তে।
চুরুটের স্পর্ধা কি ! তোমার ঠোঁট যেখানে থাকার কথা সেখানে কিনা..কাট ইট।

-কি হচ্ছে অলিভা কেন? পান্না..পান্না বাঈ বলুন।
যতবার শর্ট নেওয়া হচ্ছে ততবারই কুমার পান্না বাঈয়ের বদলে অলিভার নাম নিচ্ছে।কুমারকে বিশ্রী ভাবে অপমান করে ডিরেক্টর সেট থেকে তাড়িয়ে দিলেন। কুমার গজগজ করতে করতে বাইরে বেরিয়ে এল। পেছন পেছন আমিও এলাম। আমি বললাম কি হলো তোর? কুমার বললো, আমি বাড়ি যাচ্ছি তোদের শুটিং হয়ে গেলে চলে আসিস। আমরা দুপুরের বাড়ি ফিরলাম।বাড়ি ফিরে দেখি দরজায় তালা ঝুলছে।তারমানে কুমার ভেতরে নেই। ডুপ্লিকেট চাবি দিয়ে তালা খুলে ঘরে ঢুকলাম। ডিম সিদ্ধ ভাত রান্না করে খেয়ে নিলাম আমি আর রিতম। অনেক রাতে কুমার বাড়ি ফিরলো।কোন কথা হলো না ওর সঙ্গে। রাত বাড়ছে থমথমে ভাব আমাদের ঘরটাতে। হাত পা অসাড় হয়ে যাচ্ছে। অনেক কিছু ভাবতে ভাবতে আমি রিতম ঘুমিয়ে পড়লাম। সকাল বেলায় রেডি হয়ে আমরা স্টুডিও গেলাম।
কুমারকে আবার কাজে নিয়ে গেলাম। যদি আজ ঠিক ঠাক করে। কিন্তু না আজও একই ডায়লগ বলছে কুমার। অগত্যা কুমার বাড়ি চলে এল। আমার টানা এক ঘন্টার শুটিং হবে। রিতম বললো, আমি বাড়ি ফিরে যাই।তোর শুটিং শেষ হলে চলে আসিস। আর শোন কুমারকে আমি সেদিনের রাতের কথা জিজ্ঞাসা করবো। ঠিক আছে টা-টা।

আমার বাড়ি ফিরতে একটু রাত হলো। কিছু কেনাকাটা করতে করতে দেরি হয়ে গেল।
কুমার আমাকে দেখে বেশ রেগে বললো, তোরা আমার কথা একবারও ভাবলি না।সেই সকাল থেকে একা একা বসে আছি আর ভালো লাগছে না।
-রিতম তো দুপুরেই চলে এসেছে। হ্যাঁ আমার একটু রাত হল বটে..
-রিতম? রিতম আসেনি তো!
-তোর মাথা খারাপ হয়ে গেছে বুঝলি।
-তুই ভুল বকিস না। রিতম আসেনি এখনও।
রিতমের খোঁজ শুরু করলাম আমি। অচেনা শহর এতো নার্ভাস লাগছিল। না.. কোনো হদিস পেলাম না রিতমের। অনেক খুঁজলাম। রাতটা কোনোমতে কাটিয়ে খুব ভোরে আবার বেরিয়ে পড়লাম আমি রিতমের খোঁজ করতে। দুপুর বেলায় কিছু না ভেবেই থানায় গেলাম। কুমার আমার সাথে থানায় এলো না। যাই হোক পুলিশকে আমাদের তিন বন্ধুর মুম্বই আসার উদ্দেশ্য বললাম। রিতমের ছবি দেখিয়ে বললাম গতকাল দুপুর থেকে মিসিং রিতম। পুলিশ আশ্বাস দিয়ে বললেন আমাকে, যথাসাধ্য চেষ্টা করবো।চিন্তা করবেন না।
রাত দু’টোর সময় মুম্বাই পুলিশ এল আমাদের ভাড়া বাড়িতে। কুমার তখনও নাক ডেকে যাচ্ছে। কুমারের অস্বাভাবিক ঘটনার কথা পুলিশকে বলিনি আমি।

চতুর্থ পর্ব

ভালো করে আমাদের ভাড়া বাড়িটা পুলিশ দেখছে। জানলা দিয়ে বাড়ির পেছনের জঙ্গল দেখে মুম্বই থানার ওসি বললেন কাল সকালে জঙ্গল সাফ হবে।
আমি বললাম, স্যার রিতমের কোনও খবর পেলেন?
– পেয়ে যাব। ধৈর্য্য রাখুন। আপনার এই বন্ধু তো দিব্যি নাক ডেকে ঘুমোচ্ছে। ডাকুন ওকে।
এই কুমার ওঠে পড়। রিতমের খোঁজ নিতে পুলিশ অফিসার এসেছেন।
কুমার চোখ রগড়াতে রগড়াতে ডিভান থেকে নিচে নামল। কাঁদো কাঁদো স্বরে কুমার বলল, রিতম আমাদের খুব প্রিয় বন্ধু। ওকে যেখান থেকেই হোক খুঁজে বের করুন।
আজ রাতটা আমরা বসেই কাটিয়ে দিলাম।রাত তিনটের সময় পুলিশ চলে গেল। ভোর বেলায় আমরা যাব পুলিশ স্টেশনে।

আমি এখন থানায় বসে আছি। সকাল নটা বাজে। সকাল বেলায় আমাকে ফোন করে পুলিশ অফিসার থানায় আসতে বললেন।একটা বডি পাওয়া গেছে নাকি।
এমন দিন দেখতে হবে স্বপ্নেও ভাবিনি ।ভগবান এই বডি যেন রিতমের না হয়।
রিতমকে কে খুন করবে ?
অজানা শহর। কেউ চেনে না আমাদের।
আমার মনে হয় শুটিং থেকে বাড়ি ফেরার সময় রাস্তায় রিতম অসুস্থ হয়ে পড়েছিল তাই বোধহয় কেউ ওকে হসপিটালে ভর্তি করেছে। হ্যাঁ, হ্যাঁ এমনটাই হয়েছে। নানান রকম চিন্তা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে।
অভিনয়ের ভুত ঘাড় থেকে নেমে গেছে আমাদের।
একজন লাপাতা, একজনকে আত্মা কব্জা করেছে তাই ডিরেক্টর সাহেব আমাকে সোজা বলে দিলেন, আপনাদের জন্য আমার তিনটে সিটিং বেকার হয়ে গেল লস্ খেলাম লস্।
এখন ভালোয় ভালোয় কলকাতা পৌছালে বাঁচি ।
সকাল দশটা নাগাদ থানার ওসি বিনয় বাবু বস্তা বন্দি পরিত্যক্ত ডেডবডির থেকে একটা ছেড়া পাঞ্জাবীর টুকরো আর বড় বড় নখ আর চুলের কিছু ছেঁড়া অংশ টেবিলের ওপরে রাখলেন।
পাঞ্জাবীর টুকরোটা দেখে আমি মাথা ঘুরে মাটিতে পড়ে গেলাম। আধ ঘন্টা অজ্ঞান অবস্থায় আমি ছিলাম। কিছুটা সুস্থ বোধ করার পর আমাকে ওনারা মর্গে নিয়ে গেলেন।

রিতমের মৃতদেহ দেখলাম। চোখ দু’টো ঠিকরে বাইরে বেরিয়ে এসেছে। কি ভয়ঙ্কর দেখাচ্ছে রিতমকে। এ আমাদের রিতম হতে পারে না। কতো সুন্দর রিতম। না না..
কি জবাব দেবো কাকিমাকে। ও ভগবান !

আমি কুমারকে কতবার ফোন করলাম। সুইচ অফ কেন করে রেখেছে জানি না বাবা, আর কি বিপদ আছে আমাদের কপালে কে জানে? রিতমের বাড়িতে খবর দিতে হবে তো। থানার ওসি আবার আমাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য থানায় নিয়ে এলেন।
আমি পুলিশের গাড়িতে বসে সারাক্ষণ ঐ নখ আর চুলের কথা ভেবে যাচ্ছি কিছুতেই মনে করতে পারছি না। অনেক ভাবার পর মনে পড়ল, কুমারকে যেই রাতে আত্মা ভর করেছিল কুমারের নখে গোলাপি নেল পালিশ ছিল। মনে পড়েছে লম্বা চুল।

আমি চিৎকার করে থানার ওসি বিনয় বাবুকে বললাম, স্যার মনে পড়েছে আমার সব মনে পড়েছে। ততক্ষণে আমার হাত পা কাঁপছে। কুমারকে যদি ঐ আত্মা মেরে ফেলে, ও তো বাড়িতে একা আছে। আমি কম্পিত স্বরে বললাম, কুমারকে বাঁচাতে হবে স্যার। এই জিনিসগুলো সব ঐ প্রেতাত্মার।
-ওহো রাবিশ.. এই যুগে বাস করে যত্ত সব আজগুবি কথা। ক্লিয়ার করে সব বলুন তাহলে কুমার বাবুকে, আপনাকে বাঁচাতে পারবো। আমি জলের বোতল থেকে জল খেয়ে ট্রেনে ওঠা থেকে শুরু করে সে রাতের সব ঘটনা বললাম। শুটিংয়ে ঘটে যাওয়া ঘটনার কথাও বললাম।
– আর দেরি করা যাবে না। লেটস গো.. আমাকে ভ্যানে বসিয়ে গোটা দশজন পুলিশ উঠে পড়ল ভ্যানে।
আমাদের ভাড়া বাড়ির উল্টো দিকে ভ্যানটা রেখে পুরো বাড়িটা পুলিশ ঘিরে ফেললো।
আমি ভেতরে গিয়ে দেখি কুমার নেই। আমি চিৎকার করে বললাম, কুমার কোথায় ভাই ফিরে আয়, রিতমকে বাঁচাতে পারিনি তোকে আমি মরতে দেবো না। চল ভাই আমরা কোলকাতায় ফিরে যাই।

অন্তিম পর্ব

কোথায় তুই কুমার..অভিনয় করতে এসেছিলাম আমরা। রহস্যের পর রহস্যের জাল আমার সামনে এখন। রিতম নেই। কে মারলো রিতমকে জানি না, তোর দেখা নেই।

এমন সময় হাবিলদার অনিল সাঁপুই একটা অল্পবয়সী মেয়েকে ধরে এনে বললেন, স্যার এই মেয়েটা বাড়ির পেছন দরজা দিয়ে পালাচ্ছিল অনেক কষ্টে ধরতে পেরেছি।
মাথাটা পুরো চাদরে ঢাকা মেয়েটার। আরে সেই চোখ!
-স্যার এই মেয়েটি ট্রেনে উঠেছিল ওর মার সাথে। আমি ভেবেছিলাম ও মারা গেছে। ওর আত্মা ট্রেনে উঠেছিল। অলিভা যার আত্মা কুমারকে ধরেছে।

-থামুন আপনি। এই মেয়েটিকে অনেক দিন ধরে খুঁজছে পুলিশ। কিছুতেই নাগাল পাচ্ছিলাম না আমরা।
ব্লুফিল্ম করে এই মেয়েটি। এর আসল নাম কেউ জানে না।কখনও অলিভা কখনও জুলি।এ দের একটা চাঁই আছে। চেইন সিস্টেমে এরা লতা পাতা বিস্তার করে রেখেছে। এবার রহস্যের জট খুলতে পারবো আমরা। রিতমের খুনির সুত্র পেলেও পেতে পারি

-আমাকে ছেড়ে দিন স্যার। আমি টাকার বিনিময়ে এই জঘন্য কাজ করি। আমার মা অসুস্থ।
-আরে ধরা পড়লে সবাই এই এক কথাই বলে।
-না স্যার। ব্লু ফ্লিমের আসল ডিরেক্টর তো মাইকেল মাইক ওরফে কুমার দে।

আমি চিৎকার করে বললাম, সাবধান আমার বন্ধু কুমারের নামে বাজে কথা বলবেন না।

– কোনটা বাজে, ট্রেনে কিছুক্ষণ আমার উপস্থিতি, না কি ট্রেনে আমার কাছ থেকে বোরলীন চাওয়ার অছিলায় চিপটা নেওয়া, না কি সেফটিপিন চাওয়ার অছিলায় প্লাস্টিকের নেল নেওয়া। কোনটা!
কুমার বাবু আপনাদের ভালো মানুষের সুযোগ নিয়ে এ সব কাজ করেছেন। ঐ ট্রেনে আমি আর আপনাদের বাড়ি যিনি ঠিক করে দিয়েছেন ঐ মহিলাই ছিলেন।
হঠাৎ কথা বলতে বলতে ‘আঃ’ বলে অলিভা মাটিতে লুটিয়ে পড়ল।
– কে গুলি করলো? কি রক্ত..
অলিভা অলবিদা হা হা হা ।
-কে কে? কুমার দে পালাচ্ছে। এখুনি পুরো ফোর্স যান। ধরে আনুন।ৎকুইক ফার্স্ট
ওনার বয়ান রেকর্ড করুন। আগে গাড়িতে তুলুন ওনাকে হসপিটালে যেতে যেতে সবটা রেকর্ড করবেন।
অলিভার বুকে গুলিটা লেগেছে। কোনোমতে অস্পষ্ট স্বরে অলিভা বলছে, বিশাল হাত ওনার কোলকাতায়। কুমার দে। মুম্বইতে ওনার ফার্স্ট অপারেশন সাকসেসফুল করার জন্য আপনাদের অভিনয়ের টোপ দিয়ে মুম্বই নিয়ে এসেছেন। বাড়ি ঠিক করেছিল যে মহিলা উনিও একই কাজে যুক্ত।
-তাহলে কুমারের ওপর যে আত্মা ভর করেছিল?
-সব দিখাবা।আপনাদের বোকা বানানোর জন্য এ সব নাটক সাজানো হয়েছিল।অলিভার আত্মা সব ফেক। শুটিংয়ে ডায়লগ ভুল বলা যাতে সবাই ভাবে কুমার বাবু অসুস্থ আছেন।
রিতম বাবু সেদিন দুপুর বেলায় হঠাৎ করে বাড়ি ফিরে এলেন সব কিছু নিজের চোখে দেখে নেন। তখন আমি কুমার বাবু মানে আমাদের ব্লু ফিল্মের ভিডিও হচ্ছিল। আমাদের মত্ত অবস্থায় দেখে ফেলেন উনি।
–ষদরজা খোলা ছিল নাকি?
-দুসরা চাবি দিয়ে রিতম বাবু গেট খোলেন।গ্রিলের দরজায় তালা লাগানো ছিল ভেতর দিক দিয়ে। তারপর তর্ক বিতর্ক করতে করতে রিতম বাবুর গলায় কাপড়ের ফাঁস দিয়ে দম বন্ধ করে মেরে ফেলেন কুমার বাবু।ধস্তাধস্তিতে বিছানায় রাখা নখ চুলের অংশ রিতম বাবুর হাতে চলে আসে যেটা উনি লক্ষ্য করেননি। তারপর আমাকে এখানে আসতে মানা করেছিলেন উনি। তবে রিতমবাবুর ডেড বডিটা কোথায় রেখেছেন কুমার বাবু সেটা আমি জানতাম না।
আমি ওনার থেকে পাওনা টাকা নিতে এসেছিলাম। পুলিশের ভ্যান দেখে পালাতে গেছিলাম। ঐ তো কুমার বাবু বলছেন “অলিভা অলবিদা” আমি তোমাকে ভালবাসি কুমার বাবু। কভী অলবিদা না কেহেনা।
আমি পাথর হয়ে গেলাম অলিভার জবানবন্দি শুনে। অনেক চেষ্টা করেছেন ডক্টর। কিন্তু অলিভাকে বাঁচানো গেল না।
পুলিশ অনেক কষ্টে কুমারকে ধরতে পেরেছে। আমি গেছিলাম থানায় ওকে দেখতে মাথা নিচু করে বসে আছে।
-কেন মারলি রিতমকে? জবাব দে.. জবাব দে।
পুলিশের সহযোগিতায় রিতমের মৃতদেহ কোলকাতায় নিয়ে এলাম। কেন জানি না অলিভার কথা খুব মনে ধাক্কা দিচ্ছে কভী অল বিদা না কেহেনা,,
সমাপ্ত

Loading

Leave A Comment