আমি তোমার বিরহে রহিব বিলীন
– পিয়ালী চ্যাটার্জী
পশ্চিমের আকাশ গেরুয়া আলো ছড়িয়ে দু হাত তুলে বিদায় জানাচ্ছে গোটা শহর, গোটা দেশের মানুষকে। সায়ন সোহিনীর হাতটা শেষবারের মত ধরতে চেয়েও পারলো না। হয়তো রাগ, হয়তো বা অভিমান কিংবা হয়তো অনুশোচনা ঠিক জানা নেই তবে পারলো না আটকাতে সোহিনীকে। কোন মুখেই বা আটকাবে গত ছয় বছরের ঘাগুলো যে সোহিনীর চোখে মুখে এখনো স্পষ্টভাবে দেখতে পাচ্ছে সায়ন। কোর্টের একটি বেঞ্চের দু প্রান্তে বসে রয়েছে সোহিনী এবং সায়ন, আজ শেষ সইটি করে দিয়েছে তারা দু’জনে। গত ছয় বছরের রাগ, অভিমান সব একটি মাত্র সই দিয়ে শেষ করে ফেললো সায়ন এবং সোহিনী। সায়ন একটু গলা ঝেড়ে নিজে থেকেই কথা বললো হয়তো বা তার নিজের ভিতরের অনুশোচনার সাথে কিছুটা লড়াই করেই…
– চা খাবে?
– হুম? না। বাড়ি যেতে হবে।
– ডিভোর্সের ফর্মটা আসতে আসতে চা খাওয়া হয়ে যাবে। তাছাড়া সব তো মিটেই গেল আজ তো সব শেষ। তুমি বসো আমি দু’টো চা নিয়ে আসছি।
– কফি আনতে পারবে প্লিজ?
সায়ন বেঞ্চ ছেড়ে উঠে যেতে গিয়ে সোহিনীর মুখে কফি শুনে একটু দাঁড়িয়ে গেল। পিছন ফিরে বললো – সিওর, কফি আনছি দু’টো।
আঠ বছর আগে সোহিনীর সাথে আলাপ হয় সায়নের খবরের কাগজের একটি বিজ্ঞপ্তি দেখে চাকরির ইন্টারভিউয়ের জন্যে দু’জনেই গিয়েছিল সেখানে। সেদিন চাকরিটা উভয়ের মধ্যে কেউ পায়নি তবে ইন্টারভিউ শেষের পর সেই অফিসের নীচে একটি চায়ের দোকানে বসে চায়ের চুমুকে একে অপরের মনের মধ্যে সফল ভাবে জায়গা করে নিয়েছিল দু’জনে।
– দাদা দু’টো চা দিন তো।
-সত্যি সেই কোন সকালে বেড়িয়েছি চা না খেলে আমার আবার সারাদিন মাথাটা ধরে থাকে।
– তোমার মত সকল বাঙালিরই মাথা ধরার ওষুধ হলো এক কাপ গরম চা। উফফফ যা দিন গেল আজ আর বলার না।
– খুব আশা নিয়ে এসেছিলাম। সেই কোন সকালে ব্যারাকপুর থেকে সল্টলেকে আসলাম। তারপর ঠিকানা খুঁজতে আরো এক আধ ঘন্টা মত লাগলো। তাও যদি চাকরিটা পেতাম।
– চিন্তা করো না। পরেরবার নিশ্চয়ই পেয়ে যাবে। তোমার নামটা যেন কি?
– সোহিনী গাঙ্গুলী। আপনার নামটা?
– এই দেখো আবার আপনি কি আমি তোমাকে তুমি বলছি দেখছো না? আমার আবার এসব আপনি আজ্ঞে পোষায় না। আমার নাম সায়ন মুখার্জী।
– না না আসলে হুট করে তুমি বলাটা কেমন একটা লাগে তাই, ঠিক আছে তাহলে তুমিই বলছি। তুমি কোথায় থাকো?
– আমি নেতাজী নগরে থাকি।
– ও তাহলে তো বেশি দূর না।
– হ্যাঁ তোমার বাড়ির তুলনায় অনেক কাছে।
চায়ের ভারে শেষ চুমুক দিয়ে সোহিনী বললো- না এবার উঠি বেশি দেরি করলে রাস্তায় অসুবিধায় পড়তে হবে। উল্টোডাঙ্গা থেকে ট্রেন ধরে ফিরতে হবে। আজ আসি পরে কোথাও কোনো চাকরির ইন্টারভিউয়ে দেখা হবে।
– সোহিনী!
– হ্যাঁ বলো।
– আমি ছেড়ে দিয়ে আসতে পারি তোমায়?
– তুমি? এতটা পথ আমাকে ছাড়তে যাবে কেন?
-না মানে এমনি। ট্রেনে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। চলো একটা ক্যাব বুক করে নি।
– না সায়ন। বাবা রিটায়ার করেছে আগের বছর। মায়েরও শরীরটা ভালো না। ভাই উচ্চ মাধ্যমিক দিচ্ছে সামনে কলেজে ভর্তির জন্য অনেক টাকার প্রয়োজন তাছাড়া এখন প্রায়ই আমাকে আসতে হবে ইন্টারভিউ এর জন্য অভ্যাসটা খারাপ করলে চলবে না। তুমি বাড়ি চলে যাও আমার ট্রেনে অসুবিধা হয়না বরং তাড়াতাড়ি পৌঁছে যাই।
সেদিন সোহিনীর সাথে সায়নও ভিড় ট্রেনে চড়েছিল। বাবা মায়ের এক মাত্র ছেলে সায়ন কখনো সেভাবে জল গড়িয়েও খেতে হয়নি তাকে সেই ছেলে ওভাবে ট্রেনে চড়েছে দেখলে সায়নের বাবা মা নিশ্চই সেদিন অক্কা পেতো।
– এই নাও কফি।
– থ্যাংক ইউ।
– এক কাপ কফির জন্য আর ধন্যবাদ চাইনা। তবে সোহিনী একটা জিনিস চাইবো?
-হ্যাঁ বলো না।
– পারলে সব ভুলে যেও। অতীতকে মনে রেখে নিজেকে কষ্ট দিও না। আগে ঠিক যেমনটা ছিলে হাসি খুশি, প্রাণোচ্ছল তেমনটা হয়ে যাও।
– হাহাহাহাহা।
সোহিনী খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো। সায়ন ভারী অবাক হলো।
-একি হাসছো যে?
-হাসবো না? আগের আমিটাকে বদলে ফেলার জন্য কত জোর করেছিলে ভুলে গেছো বুঝি? এত কষ্ট করে নিজেকে বদলেছি আর এখন বলছো আবার আগের মত হয়ে যেতে? পারলে সায়ন এবার নিজেকে একটু বদলে ফেলো। কারণ আমি আর নিজেকে কোনো পরিস্থিতিতেই পাল্টাবো না। কফি শেষ। আমি গিয়ে দেখি পেপারগুলো রেডি হলো কিনা।
সোহিনী উঠে সামনের দিকে এগিয়ে চললো এবং সেই সঙ্গে সায়ন পিছিয়ে গেল চার বছর।
-সোহিনী আমার সাথে গাড়িতে চলো আমি ক্যাব বুক করে দিয়েছি এখুনি চলে আসবে।
-না সায়ন আমি বাসে যাবো প্রতিদিন ক্যাবে করে অফিস যেতে অনেকটা খরচ পরে তুমিও তো আমার সাথেই বাসে যেতে পারো আমরা তো একই অফিসে কাজ করি।
-দোহাই করো। তোমার যেতে হয় যাও আমি ওই ভিড় বাসে যেতে পারলাম না।
-কিন্তু সায়ন সকালে বাস ফাঁকাই থাকে আর টাকাটাও তো অনেকটা বাঁচবে।
-উফফফ বললাম তো তুমি যাও।
-ঠিক আছে তোমার টিফিনটা টেবিলের উপর রেখে দিয়েছি যাবার সময় নিয়ে নিও।
-আমি ক্যান্টিনে খেয়ে নেবো টিফিন লাগবে না।
-কি ব্যাপার বলো তো প্রতিদিনই ক্যান্টিনে খাচ্ছো?
-ক্যান্টিনের খাবার আমার ভালো লাগে।
– ঠিক আছে তাহলে কাল থেকে আর টিফিন বানাবো না তোমার জন্যে। আমি যাই আমার দেরী হয়ে যাচ্ছে।
-সায়ন বাবু।
উকিলের মুখে নিজের নামটা শুনে সায়ন বর্তমানে ফিরলো।
-হ্যাঁ?
– আপনার ফর্মটা।
-হ্যাঁ দিন। আচ্ছা সোহিনী?
-উনি চলে গেছেন।
-ওহ আচ্ছা ধন্যবাদ।
-হ্যালো সোহিনী তুমি কোথায়?
-আমি বাড়ি যাচ্ছি সায়ন।
-বাড়ি যাচ্ছো মানে?
– মানে আমার ভালো লাগছে না তাই আমি বাড়ি যাচ্ছি।
-সোহিনী এটা আমাদের অফিসের পার্টি তুমি এভাবে যেতে পারোনা।
-আমার থাকা না থাকায় তোমার কি কিছু এসে যাচ্ছে সায়ন? তোমার বন্ধু বান্ধবীদের সাথে তোমার নাচানাচি শেষ হলে তুমিও নাহয় চলে এসো।
– ও এবার বুঝলাম প্রবলেমটা কোথায়। আমি ওদের সাথে একটু টাইম স্পেন্ড করছিলাম সেটা তোমার ভালো লাগেনি।
-প্রবলেমটা সেটা না সায়ন প্রবলেম এটা না যে আমার হাসবেন্ডকে অন্য মহিলারা জড়িয়ে ধরে নাচ্ছে প্রবলেম এটা যে অফিসের কেউ জানেও না যে আমরা স্বামী স্ত্রী। আমাদের সম্পর্কটা কি লুকানোর খুব দরকার ছিল?
-হ্যাঁ দরকার ছিল। তুমি জানোনা আজকের দিনে একটা ভালো চাকরি পাওয়া কতটা কঠিন তারপর বিবাহিতদের জন্য অনেক স্কোপ চাপা পড়ে যায়। আগের অফিসে তো নিজেই দেখলে আমার বিয়ে হয়ে গেছে বলে আমাকে বিদেশের কাজটা দিলো না। এই অফিসেও সেই একই জিনিস হোক সেটা আমি চাইনা।
সায়ন হাটতে হাটতে বাস স্ট্যান্ডে এসে দাঁড়ালো। আজ আর ক্যাব বুক করার ইচ্ছে হলো না। বাস পাঁচ মিনিটেই চলে এলো।
-সায়ন চলো না আজ কোথাও চা খেতে যাই সেই আগের মত।
-চা খেতে? বরং চলো কফি খেতে যাই।
-কফি?
-হ্যাঁ কফি। এবার থেকে কফি খাওয়া অভ্যেস করো।
-জানো কফি খাওয়াটা একটা ক্লাস বোঝায়। ওই মাটির ভাঁড়ের চা আর কতদিন?
দাদা নেতাজী নগর নামবো। সায়ন বাস থেকে নেমে পাড়ার চায়ের দোকানে গিয়ে বসলো।
-মুন্না এক কাপ চা দে তো।
-আরে দাদা তুমি চা চাইছো যে তোমার জন্য তো স্পেশাল কফির প্যাকেট কেনাই আছে আমার দোকানে?
– কফিগুলো অন্য কাউকে খাইয়ে দিস রে মুন্না। আজ থেকে আমি চা-ই খাবো। আজ বেশ বুঝতে পারছি কফি খাওয়া একটা ক্লাস হলেও মাটির ভাঁড়ের চা হলো এমন একটা ইমোশন যা আমাদের রক্তে মিশে যায় ঠিক যেমন কিছু কিছু মানুষ।
-হুম কিছু বললে দাদা?
-না রে দে একটা চা দে।