বিভাজনের বিবর্তন
– সঙ্কর্ষণ
“সমাজে প্রতিটি মানুষের সমান অধিকার” এই বক্তব্যকে ঠিক ২টি দৃষ্টিভঙ্গী থেকে ব্যাখ্যা করা যায়। ১। উচ্চস্তরীয় ব্যক্তিবর্গের সামগ্রিক অধিকার নিম্নস্তরে এসে পৌঁছেছে। ২। নিম্নস্তরীয় ব্যক্তিবর্গের সামগ্রিক অধিকার উচ্চস্তরে গিয়ে পৌঁছোবে। লক্ষ্যণীয়, প্রথম সম্ভাবনার প্রকাশক বাক্যবন্ধে আমি ‘বর্তমান কালের’ অবতারণা ক’রেছি এবং দ্বিতীয় সম্ভাবনার ক্ষেত্রে বাক্যটি ‘ভবিষ্যৎ সূচক’।
নৈতিক বিভাজনের মাপকাঠি খুঁজলে পৃথিবীতে তা অসংখ্য পাওয়া যাবে, যেমন- আর্থসামাজিক, সাম্প্রদায়িক, লৈঙ্গিক, বার্ণিক ইত্যাদি। সত্যি ব’লতে কী, দ্বন্দ্ব ব্যতীত জীবন একপ্রকার অচল ব’লে প্রতিনিয়তই বিভাজকের তালিকা দীর্ঘ হ’তে থাকে। তাও এসবের মধ্যে যদি একান্ত একটিই মাত্র বিষয়কে বিচারের জন্য প্রাথমিকভাবে বেছে নিতে হয়, সবার আগে আসবে আর্থসামাজিক প্রেক্ষিত। সহজ ভাষায় বিভাজন ব’ললেই সর্বপ্রথম যে দুটি পক্ষের উদ্ভব হয় তারা হ’লো ধনী আর দরিদ্র। এক পক্ষ বাহু বা বুদ্ধিবলে দ্বিতীয় পক্ষের ‘প্রাপ্য’ সম্পত্তিটুকু আত্মসাৎ করে এবং দ্বিতীয় পক্ষ নিজস্ব ন্যূনতম চাহিদা পূরণের চেষ্টায় প্রথম পক্ষের স্বার্থে অনিচ্ছাকৃত শ্রম বিলিয়ে চলে। এই মেরুকরণ কেবল আজ বা কালকের নয়, এ ঘটনার প্রবাহ চিরকালীন।
এখন প্রশ্ন হ’লো, আপামর পৃথিবীই হোক বা একটি নির্দিষ্ট রাষ্ট্র, প্রত্যেকের ক্ষেত্রেই উপরোক্ত ঘটনা নেহাত সমধর্মী হওয়া সত্ত্বেও দুই পক্ষের ভেতরে সংখ্যার বৈষম্য চিরকাল একই থাকে কেন? আরো ভালোভাবে ব’ললে এমন একপেশে থাকে কেন? বরাবর ধনিক শ্রেণী সংখ্যায় কম এবং দরিদ্র সেই অনুপাতে প্রচুর হয় কী ক’রে? কোথাও ধনী আর দরিদ্র সংখ্যায় সমানও হয়না, ধনীর আধিক্যও কোনোভাবে লক্ষ্য করা যায়না। এ কথা সর্বজনবিদিত, যে উৎপন্ন সম্পদের সবটুকু একান্ত দরিদ্রের স্বার্থবিরোধী কায়িক শ্রমেরই ফলাফল। তাও আশ্চর্যভাবে উভয়ের চরিত্র বিপরীতমুখী হয়না কখনোই।
আসলে একটি নির্দিষ্ট ভৌগোলিক সীমায় আবদ্ধ অঞ্চলে উৎপাদনযোগ্য সম্পদের পরিমাণ সবসময়ই স্থির। যে ব্যক্তি আপন শ্রমেই হোক বা পরের শ্রমেই হোক, সেই সম্পদের অধিকাংশকে কুক্ষিগত ক’রে রাখতে পেরেছে সে দ্বিতীয় পক্ষ অর্থাৎ নিম্নস্তরীয়ের আপন উচ্চতায় পৌঁছোবার রাস্তা আগেভাগেই বন্ধ ক’রে দিয়েছে। দ্বিতীয় পক্ষও ক্রমাগতঃ সম্পদ হারাতে হারাতে এমন একটি জায়গাতে এসে পৌঁছেছে যেখানে তার আর হারাবার কিছুই নেই। সে ত’লিয়ে যাচ্ছে, পূর্বোক্ত অবস্থার আরোও গভীরে ত’লিয়ে যাচ্ছে। অপরের শ্রমকে ব্যবহার করার মতো বুদ্ধি বা বল কোনোকালেই সংখ্যায় অধিক লোকের থাকেনা। তাই একপেশে বৈষম্য চিরকাল থেকেই যাচ্ছে।
এমতাবস্থায়, এমন একদল লোকের উদ্ভব হ’লো যারা এই নিম্নস্তরীয়দের বোঝাতে পারলো যে সব হারালেও তারা তাদের সংখ্যাধিক্য হারাতে পারবেনা কোনোদিন। এই সংখ্যাধিক্যকে সুশৃঙ্খলভাবে সংখ্যালঘুর বিরূদ্ধে ব্যবহার ক’রলেই তারা তাদের প্রাপ্য অধিকারটুকু ফিরে পাবে। আগেই বলে রাখি মানুষ কিন্তু প্রাপ্য ব’লতে মূলতঃ তার অধিকারই খোঁজে, অর্থ বা আর্থিক সম্পত্তি নয়। প্রাপ্য বুঝে নেওয়ার মতো বোধ তার মধ্যে আসে প্রধানতঃ কায়িক শ্রমের বিচারে। ঐ যে ব’লছিলাম ‘অনিচ্ছাকৃত শ্রমের’ কথা। মাথায় ঠিক এই চিন্তাই বারংবার চলে, যে কৃষক গা ঘামালে ফসলের অধিকারী জমির মালিক কীভাবে হয়? শ্রমিক পাথরে গাঁইতি চালালে খনিজ সম্পদ মালিকের হয় কী ক’রে? জনৈক কৃষক বা শ্রমিকের আসলে ফসল নয়, তাদের শ্রমের বিনিময়ে মূল্য চাই। তা যখন হারিয়েছো, অতএব “ওয়ার্কার্স অফ দ্য ওয়ার্ল্ড ইউনাইট, কজ ইউ হ্যাভ নাথিং টু লুজ বাট ইওর চেইনস”।
ঠিক এইবারে আমি ঢুকবো আমার প্রথমদিকে বলা বর্তমান আর ভবিষ্যতের গল্পে। এতোক্ষণের আলোচনা থেকে এইটুকু তো স্পষ্ট, যে নিম্নস্তরীয় মানুষ কেবল একতার বলকে কাজে লাগিয়ে উচ্চস্তরীয়ের সমান অধিকার লাভ ক’রতে পারে। এখন দেখার, যে সে আপন ক্ষমতায় উচ্চস্তরে পৌছোবার প্রচেষ্টা শুরু ক’রছে কিনা? এ কাজে কিন্তু কেবল বাহুবল নয়, চাই ক্ষুরধার বুদ্ধি ও ব্যবহারিক জ্ঞানের প্রাচুর্য। একমাত্র নির্দিষ্ট দীর্ঘমেয়াদী প্রক্রিয়াই কিন্তু এর সম্পূর্ণ ফলাফল মানবজাতিকে দিতে পারে, অতএব এর সাফল্যের বিচার নিতান্তই ভবিষ্যতের গর্ভে। বরং কেবল বাহুবলের দ্বারা জনৈককে নিম্নস্তরীয়ের সমান হ’তে বাধ্য করা অনেক বেশী সহজ, প্রক্রিয়া হিসাবে অধিকতর দ্রুত এবং সাফল্যের মেয়াদও মহাকালের বিচারে অতিরিক্ত দীর্ঘ কিছু নয়। সর্বোপরি এই পথ কায়িক ব্যতীত মানসিক শ্রমকে আদৌ কোনো গুরুত্বই দেয়না।
সমস্যাও ঠিক এইখানে এসেই দেখা দেয়। নিজে ওপরে না উঠে অপরকে টেনে নামানো খুব খারাপ, এহেন সরলীকরণ ক’রে বিষয়কে ছোটো করা নেহাতই ভুল, কিন্তু আত্মিক উন্নতি না ক’রে নিয়মের নিগড়ে গোটা সমাজব্যবস্থাকে একটি না সম্পূর্ণ নিম্ন, না সম্পূর্ণ উচ্চস্তরে বেঁধে ফেললে ব্যক্তিগত পরিসরে ‘মানবাধিকারের’ নতুন প্রশ্ন উঠে আসে। আচ্ছা এ’ও কি সম্ভব, যেখানে রাষ্ট্রের প্রতিটি মানুষ আর্থিকভাবে স্বচ্ছল? যদি তা হয়, তবে কী হবে? কিছুই না, তখন মূল যে সমস্যার উদ্ভব হবে তা হ’লো কায়িক পরিশ্রম দেওয়ার মতো মানুষের অভাব। হিসেবমতো নিম্নস্তর অবলুপ্ত হ’য়ে যাবে। তা আমরাও তো তা’ই চাইছি। হ্যাঁ চাইছি ঠিকই, কিন্তু ব্যক্তিপরিসরে মানুষের হাতে প্রভূত অর্থ থাকলে সম্পত্তি কুক্ষিগত করার চিন্তা প্রত্যেকে নতুন ক’রে শুরু ক’রবে আর শুরু হ’লেই বৈষম্য দূরীকরণের এতোদিনের প্রচেষ্টা একেবারে ব্যর্থ হ’য়ে যাবে।
যেকোনো গঠনমূলক চিন্তা প্রধানতঃ ২টি অবস্থা থেকে জন্ম নেয়, ১। সংগ্রাম, ২। অবসর। সংগ্রাম থেকে যে চিন্তার উৎপত্তি তা মূলতঃ কারণ, কার্যপদ্ধতি ও কাল এই ৩টি অলিখিত সীমানা দ্বারা আবদ্ধ থাকে এবং ফলাফল মূলতঃ একমুখী হয়। অবসর থেকে যে চিন্তা আসে তা একটি নির্দিষ্ট কারণে উৎপন্ন হ’লেও সেই ‘কারণ’ কিন্তু একান্ত স্বতঃস্ফূর্ত। এক্ষেত্রে নিজস্ব বহুমুখী দৃষ্টিভঙ্গী জনৈক চিন্তককে যুগপৎ বাধা ও উৎসাহ দুইই দিয়ে দীর্ঘ সময় পর তার অভীষ্টে পৌঁছোতে সাহায্য করে। সমাজে বা রাষ্ট্রে কিন্তু উপরোক্ত ২ প্রকারেরই আশু প্রয়োজন। নিয়মের নিগড়ে সবটুকু বেঁধে একটি মানুষের মূল্য কেবল কায়িক শ্রম দ্বারা বিচার করা একান্ত নির্বুদ্ধিতার পরিচায়ক। যে ব্যক্তি রাষ্ট্রের জন্য চিন্তা ক’রছে সে আপাতদৃষ্টিতে হাত গুটিয়ে ব’সে থাকলেও তার দায়িত্ব অবশ্যই রাষ্ট্রের। একটি রাষ্ট্র সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহার চিন্তককে পৌঁছে দিতে বাধ্য, তাতে শ্রমিক বা কৃষকের যতোই আপত্তি থাকুকনা কেন। অবসর থেকে উৎপন্ন চিন্তা ন্যূনতম চাহিদা পূরণের প্রচেষ্টা বজায় থাকলে আসেনা কখনও। যে ব্যক্তি ন্যূনতম চাহিদা পূরণের পাশাপাশি চিন্তা করে, তার চিন্তা সংগ্রামের। বৃহত্তর ক্ষেত্রে একটি নির্দিষ্ট সময়ের পরে সংগ্রাম মূলতঃ তত্ত্ব আর অবসর স্বয়ং বৃহত্তর ক্ষেত্রের বিস্তৃতি।
‘সাম্যবাদ’ আর ‘মার্ক্সবাদ’ কি এক? উত্তর হ’চ্ছে “না”। সাম্যবাদ বা বৈষম্য অপনয়নের বিজ্ঞানসম্মত প্রচেষ্টা সারা পৃথিবীতে বহুকাল যাবত হ’য়ে এসেছে, এমনকি ভারতেও হ’য়েছে। শ্রী সুভাষচন্দ্র বোস তাঁর একটি রচনায় জানিয়েওছিলেন, লেনিন বা মার্ক্স নয়, ভারতবর্ষ সাম্যবাদ শিখবে তার নিজস্ব দর্শন থেকে। আসলে লেনিন রুশ বিপ্লব আনতে পেরেছিলেন মার্ক্সীয় সাম্যবাদের ব্যাখ্যাকে হাতিয়ার ক’রে। তাই তাঁর হাত ধ’রেই সারা পৃথিবীতে সাম্যবাদ আর মার্ক্সবাদ সমার্থক হ’য়ে উঠেছিলো আর সেই রাষ্ট্রব্যবস্থায় নান্দনিকতার মূলতঃ কোনো স্থানই ছিলোনা। অনেকে ব’লতেই পারেন, রাশিয়া কলাবিদ্যায়ও তো পারদর্শী ছিলো। হ্যাঁ তা ছিলো, কিন্তু সে বিদ্যা নেহাত একমুখী। সে শিক্ষা গৃহীত রাষ্ট্রনীতিকে মজ্জাগত করার প্রাথমিক স্তর মাত্র।
মার্ক্স ব্যতীত বিশ্বব্যাপী যে সাম্যবাদী দর্শন, সেখানে কিন্তু এমন জোড়াতালি দেওয়া মুখোশ পরিহিত স্বৈরাচারী রাষ্ট্রব্যবস্থা আদৌ অভীষ্ট ছিলোনা। সাম্যবাদ আসলে আদর্শ গণতন্ত্রেরই একটি সুনির্দিষ্ট রূপরেখা মাত্র। সে উভয় শ্রেণীর ভেতর একতা আনতে গিয়ে একটির সম্পূর্ণ বিলুপ্তি চেয়েছে, অহেতুক বিলোপের দ্বারা একতা চায়নি। উভয় শ্রেণীতে ভারসাম্যই তার লক্ষ্য, আজও হয়তো সেই বিষয় গবেষণাধীন।
এই চিরকালীন প্রশ্নেরই সম্ভবতঃ সহজতম উত্তর হ’লো, বিভাজনের বিলুপ্তি সামাজিকতায় ঘটানো, সমাজব্যবস্থায় নয়। দার্শনিককে মজুরের পর্যায়ে নামিয়ে আনায় মজুরের সম্মান আদৌ বাড়েনা, বাড়ে তাকে দার্শনিকের সমান গুরুত্ব দিলে। নিম্নস্তরীয়কে বোঝানো প্রয়োজন, যে সমাজে তার অবস্থান অনুসারে সে আসলে ব্যবস্থার একটি সুদৃঢ় স্তম্ভ মাত্র। একদিন নিম্নস্তরীয়ই স্বতঃস্ফূর্তভাবে উচ্চস্তরের খামতি ভরাট করে, স্তম্ভকে পুনরায় দৃঢ় ক’রতে এগিয়ে আসে নতুন লোক এবং এই প্রক্রিয়া চ’লতে থাকে চক্রাকারে। সুস্থ পরিবেশ কখনও বাহ্যিকভাবে সৃষ্টি করা যায়না, একাধিক সুস্থ মানসিকতাই একত্রে তার জন্ম দেয়। যে সময়ে দাঁড়িয়ে অন্যান্য দার্শনিকেরা বৈষম্যের অপসারণ দেখে কেবল চমৎকৃতই হ’য়েছেন, উপরোক্ত প্রেক্ষিত আলোচনা ক’রেছেন জনৈক ভারতীয় দার্শনিক, যাঁর প্রতিটি চিন্তন আজও বিশ্বময় প্রাসঙ্গিক…
আর ঠিক সেইজন্যই শ্রী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যাদের চোখে ‘বুর্জোয়া কবি’ তারা হয় সাম্যবাদ পড়েনি, নয় সাহিত্য। প’ড়েছে শুধু মার্ক্স… আদপে তাও পড়েনি, এদিক ওদিক থেকে সে ব্যাপারে ভুলভাল শুনেছে মাত্র। কিন্ত জ্যোতিবাবুর সরকারী দপ্তর এদের থেকে একটু আলাদা। বামপন্থার মুখোশ প’রতেও যৎসামান্য ঘাঁটাঘাঁটি করা প্রয়োজন আছে যে। অতএব তাঁরা প’ড়লেন, বুঝলেন এবং ‘রাশিয়ার চিঠি’কে নিষিদ্ধ ঘোষণা ক’রলেন। দুঃখের বিষয়, বাঙালি জানলোনা সাম্যবাদের গভীরতম সমস্যার সহজতম সমাধান যিনি দিয়ে গেলেন বিশ্বকবি আর নোবেলজয়ীর বাইরে তাঁর পরিচয় বেরোলোই না কোনোদিন। কিশোর কবি শ্রী সুকান্ত ভট্টাচার্যের একটি স্বীকারোক্তি এ প্রসঙ্গে মনে পড়ে, যে এক জীবনে একটি মানুষের যতো জিজ্ঞাস্য আসতে পারে বিশ্বকবির কলম সেই সীমানা ছাড়িয়েও বহুদূর বিস্তৃত হ’য়েছে বহুদিন হ’লো। এরপরেও কি বলা যায়, রবীন্দ্র-সাহিত্য সকলের জন্য নয়? অন্ততঃ সাম্যবাদী আদর্শের জন্য অনেকখানি তো বটেই। মনে রাখবেন, আদর্শ মানুষের জন্য, মানুষ কিন্তু আদর্শের জন্য নয়। তেমনই ভারতবর্ষের শ্রেষ্ঠ দার্শনিকের কলমও মানুষের জন্য, কোনো তত্ত্বের অন্ধভাবে অনুগত নয়।
ধন্যবাদ।