গল্প- খাই -খাই

খাই -খাই
– লোপামুদ্রা ব্যানার্জী

‘অ্যাই য়ে ম্যাডাম। দো কামরা, এক কিচেন অর দো বাথরুম। আগে এক ব্যালকনি ভি হ্যায়। ব্যালকনি মে খাড়া হোনে সে আপকো প্লেন ভি দিখাই দেগা।’ সত্যি! বারান্দাটায় দাঁড়িয়ে থাকতে তো মিতার বেশ লাগছে।মাথার ওপর দিয়ে ঘনঘন দৈত্যাকার পাখীর মত উড়ে যাচ্ছে প্লেনগুলো। বড় রাস্তার দিকে তাকিয়ে শহুরে ব্যস্ত জীবন দেখতে মিতার বরাবরই খুব ভালো লাগে। আসলে গতিময় জীবন তার খুব পছন্দের। হঠাৎ মিতার কানে এলো ক্যাঁক ক্যাঁক একটা কর্কশ আওয়াজ।এই আওয়াজ তো আগে কখনও শোনেনি মিতা। সে তার নতুন মকান মালকিনকে জিজ্ঞেস করে ‘কিস চিজ ক্যা আওয়াজ হ্যায়?’ আরে ম্যাডাম ‘ও তো মোর কি আওয়াজ হ্যায়।’ উৎসুক নয়নে, উৎফুল্লিত কন্ঠে মিতার মুখ থেকে বেরিয়ে আসে ‘মোর মানে peacock’। বাড়িওয়ালি দন্ত প্রসারিত করে জানায় ‘সামনে নিম কা পেড় হ্যায়।উধার বহুত সারে মোর হ্যায়।’ এই কথা শোনা মাত্রই আনন্দে ময়ূরের মত পেখম তুলে মিতার মন ও নেচে উঠল। আর অন্য কোথাও ঘর দেখার কোন মানেই হয় না। এই তিন বছরের জন্য এই বাড়িটাই তারা ভাড়া নেবে। সঙ্গে সঙ্গে অ্যাডভ্যান্স দিয়ে মিতা জানায় আগামী রবিবার তারা শিফট করবে।

সোমবার সকালে প্যাকারস এসে মিতার সংসারের সব জিনিসপত্র সযত্নে, দক্ষ হস্তে, নিপুণ প্যাকিং করে পালাম এয়ারপোর্টর নিকটবর্তী বাগডোলা নামক স্থানটির উদ্দেশ্য রওনা দেয়। সুবীর কলকাতা এয়ারপোর্ট থেকে দিল্লি এয়ারপোর্টে বদলি হয়ে আসছে। মিতা তো তাই আগেই তার দিদি জামাই বাবুর কাছে চলে এসেছে। ভাড়া বাড়িটা ঠিক করার পরই সুবীর প্যাকারস এ্যান্ড ট্র্যাভেলসের সহায়তায় তাদের সংসাকে দিল্লির উদ্দেশ্যে রওনা করিয়ে দিয়ে নিজে সন্ধ্যার ফ্লাইটে শালী শালীপতির বাড়িতে এসে পৌঁছায়।

মিতা তার জামাই বাবুর সঙ্গে সুবীরকে নিতে এয়ারপোর্ট আসে। মাত্র এক সপ্তাহ মিতা সুবীরকে ছেড়ে ছিল। কিন্তু সুবীরকে দেখা মাত্রই মিতা যে ভাবে লাফালাফি শুরু করে দিয়েছে তাতে দেখে মনে হচ্ছিল তারা যেন সদ্য বিবাহিত কাপল। প্রায় পনেরোটা বছর হতে চলল মিতা সুবীরের দাম্পত্য জীবন। কিন্তু আজ ও মিতা নববধূটির মতো নানা আবদারে সুবীরকে অস্থির করে তোলে। সুবীর ও যথাসাধ্য চেষ্টা করে মিতার আবদারগুলো মেটাতে। সুবীর জানে মিতা তার চপলতার মধ্যে লুকিয়ে রাখে তার চাপা ব্যাথা। বাইরে থেকে মিতাকে দেখে বোঝার উপায় নেই যে সে মাতৃত্বের স্বাদটুকু উপলব্ধি না করতে পেরে মরমে মরে আছে। মিতা তার দিদির ছেলে অর্ককে এই কদিনে এক সেকেন্ডের জন্য কাছ ছাড়া করে নি। মিতার দিদিও ভীষন খুশী সুবীরের দিল্লি এয়ারপোর্টে পোস্টিং হওয়ায়।

মিতাদের জিনিস পত্র এসে পৌঁছালো শনিবার বিকালের দিকে। মিতা নিজে দাঁড়িয়ে থেকে তার নতুন ভাড়া বাড়িটা গুছিয়ে নিল প্যাকারসদের লোকজনদের সঙ্গে নিয়ে। কাজের ফাঁকে ফাঁকে মিতার চোখ বারবার চলে যাচ্ছিল মেন গেটের বাইরে। কেউ যেন একটা বারবার এসে উঁকি মেরে চলে যাচ্ছে। মিতা তাই মনে মনে ঠিক করলো এবার ছায়ামূর্তিটা কে দেখলেই খপ করে ধরবে সে। প্যাকারসদের লোকজন চলে যাবার পর মিতা কিচেনের নিত্যপ্রয়োজনীয় কৌটোগুলো গুছিয়ে রাখতে হঠাৎ তার ওড়নায় একটা টান অনুভব করলো।ৎকী ব্যাপার! পিছন ফিরে দেখে একটা ছোট্ট মেয়ে তার ওড়না ধরে দাঁড়িয়ে। মিতা মেয়েটিকে দেখে অবাক। সে হাঁটু গেড়ে বসে বাচ্চা মেয়েটির সামনে। তাকে নিজের বাহু পাশে আবদ্ধ করে বলে ‘কোন হো? ক্যঁহা রহতে হো?’ মেয়েটি তার আদো আদো গলায় বলে ‘আমি নিতি (নিশি)।’ মেয়েটি বাংলায় কথা বলছে শুনে মিতা তো ভীষন খুশী। যাক বাবা, তাহলে কাছাকাছি বাঙালি পরিবারও আছে।

নিশি নিশি করে হাঁক পাড়তে পাড়তে এক মহিলা ঠুকলেন মিতার ঘরে। মিতার সমবয়সীই হবে। মিতা তাকে হাত তুলে নমস্কার করে বলে ‘ও বুঝি আপনার মেয়ে। খুব মিষ্টি।’ মিষ্টির কথা শোনা মাত্রই নিশি বায়না করতে শুরু করে দেয় ‘আমি মিত্তি খাবো।’ মিতা ও নিশির মা (রিমি) দুজনেই নিশির কথা শুনে হাসতে থাকে। রিমি বলে এই হচ্ছে এক ঝামেলা। কোন খাবারের কথা শুনলেই হলো। নিশিকে আগে দিতে হবে। সারাদিন শুধু খাই আর খাই। ভাত রুটি ছাড়া বাকি সব খাবারই পছন্দ নিশির। মিতা এবার ঝপ করে নিশিকে কোলে তুলে নেয়। তারপর আদরমাখা সুরে বলে ‘আজ তো মিত্তি নেই।চকো খাবে কি নিশি। ‘মিতা তার ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে কয়েকটি চকলেট বার করে নিশির হাতে তুলে দিল। নিশির ছোট্ট নরম হাতের স্পর্শে শিহরিত হয়ে ওঠে মিতার মন।

সুবীরের এয়ারপোর্ট থেকে ফিরতে ফিরতে রাত নয়টা হয়ে গেল। যদিও দিল্লিতে রাত নটাকে সন্ধ্যা নটা বললেই ভালো শোনায়। সুবীর বাড়িতে পা রাখা মাত্রই মিতা সুবীরকে নিশির সম্বন্ধে বলতে শুরু করে। সুবীর খুবই একাগ্ৰ চিত্তে মিতার প্রতিটি অভিব্যক্তি লক্ষ্য করছিল। মিতা যেন এই বাড়িটা ভাড়া নেওয়ার সাথে একটা ফ্রি গিফট কুপন জিতেছে। ফ্রি গিফট পেলে যেভাবে সকলে আনন্দ প্রকাশ করে মিতাও সেভাবে আনন্দ প্রকাশ করছে। সুবীর করুণ স্বরে বলে ‘আমি কি এক কাপ চা পেতে পারি।’ এবার মিতা সত্যি সত্যি লজ্জিত হয়ে ওঠে সুবীরের কথায়। ‘এ মা।দেখেছো। নিশির কথা বলতে বলতে তোমার চায়ের কথা ভুলেই গেছি আজ।’

আস্তে আস্তে, ধীর গতিতে, এক পা এক পা করে রিমির সাথে মিতার একটা সুসম্পর্ক গড়ে উঠেছে দিন দিন। নিশি তো বেশির ভাগ সময়ই মিতার কাছে থাকে। রিমিরও এতে ভালো হয়েছে। দু’ দুটো বাচ্চা নিয়ে বেচারীকে হিমশিম খেতে হতো। মিতা নিশিকে চকলেট, চিপস, ড্রাইফ্রুটস দিয়ে বসিয়ে দিব্য নিজের কাজ সেরে ফেলে। মিতার মনে মাতৃত্বের যে ফল্গুধারা এতদিন ছিল তা আজকাল দক্ষিনী নদীর মতো তীব্র গতি পেয়ে নিশির কাছে ধেয়ে চলে রোজদিন।

মিতার গলার আওয়াজ পেলেই তিনবছরের নিশি ‘আন্তি আন্তি’ করে চিৎকার শুরু করে দেয়। শিশু হৃদয় খুব তাড়াতাড়ি ভালোবাসাকে চিনে নিতে পারে। আজকের সকালটাও ছিল এই রকমের। সাড়ে এগারোটা নাগাদ রিমি এসে নিশিকে নিয়ে গেল স্নান খাওয়ার জন্য। দুপুরে খাওয়ার পর নিশি ঘন্টা খানেক ঘুমায়। তারপর বিকালে মিতার সাথে পার্কে যায়। ছোট নিশি তার সমবয়সীদের সাথে খুব ছোটাছুটি করে। মিতা বেঞ্চে বসে মুগ্ধ দৃষ্টিতে নিশিকে দেখতে থাকে। আর ভাবে যদি নিশি তার নিজের মেয়ে হতো।

বিকাল সাড়ে পাঁচটা নাগাদ মিতা নিশিকে নিতে আসে। রিমি দরজা খুলে বলে ‘দেখো না , সেই যে দুপুরে একটু খিচুড়ি খেয়ে ঘুমিয়েছে মেয়েটা। এখন এত তোলার চেষ্টা করছি কিছুতেই উঠছে না।’ মিতা বলে ‘থাক। ঘুমাচ্ছে যখন। আজ আর আমি ও পার্কে যাবো না।’‌ আবার সন্ধ্যার দিকে মিতা আসে নিশির খোঁজ নিতে। কিন্তু নিশি তখনো‌ ঘুমাচ্ছে। আশাহত মনে ফিরে আসে মিতা। নিশির মাও কিন্তু মনে মনে বেশ চিন্তিত। নিশির বাবা অফিস থেকে ফিরে এসেছে। উনি সব শুনে বলে ‘থাক, ঘুমাচ্ছে যখন ঘুমাতে দাও। ঠিক ভোরে উঠে সকলকে জ্বালাতন করবে।’

পরের দিন সকাল সাতটা বেজে গেলেও নিশি উঠেছে না দেখে নিশির মা এবার কান্নাকাটি শুরু করে দেয়। নিশির বাবা নিশিকে নিয়ে চাইল্ড স্পেশ্যালিস্টের কাছে ছোটে। তিনি তো নিশির পালস্ পরীক্ষা করেন, টেনে চোখ খোলার চেষ্টা করেন। কিছুক্ষণ পর ডাক্তার বাবু বলেন আপনাদের বাড়িতে কি কেউ ঘুমের ওষুধ খান। একথা শুনে রিমি তো অবাক। এরকম কোন ওষুধ তো বাড়িতে নেই। তাহলে কি মিতার বাড়িতে নিশি কিছু খেয়ে এসেছিল। এরকম হাজারো প্রশ্ন রিমির মনে উঁকি ঝুঁকি মারতে লাগলো। ডাক্তার বাবু একটা সিরাপ লিখে দিলেন।আর বললেন মেয়ের দিকে একটু বেশি খেয়াল রাখতে হবে কিন্তু।

নিশিকে নিয়ে বাড়ি আসা মাত্রই পাশাপাশি পড়শী তো খোঁজখবর নিতে হাজির। এদের মধ্যে একজন তো বলেই ফেললো ‘ক্যায়া প্যাতা। কিসকে অন্দর ক্যায়া হ্যায়।’ ইশারাটা যে মিতার দিকেই ছিল তা রিমি বেশ বুঝতে পারলো। স্বল্প সময়ের জন্য রিমির মনেও একটা সন্দেহের বাতাবরণ তৈরি হয়েছে। মিতা যে সন্তানহীনা। অন্যের সন্তান সুখ দেখে তার মনে হিংসার উদ্রেক হতেই পারে। এইসব কথা যখন সে ভাবছে তখন হঠাৎ নিশির দিদি চিৎকার করে ওঠে ‘মা, ও মা, দেখো কান্ড। তুমি আমার জন্য যে সর্দির সিরাপটা এনেছিলে সেটা তো শেষ দেখছি। আমি তো এতটা খাই নি। তাহলে…..’

নিশির মা বাবা তো হতবাক হয়ে যায় ছোট্ট নিশির কান্ড কারখানা দেখে। তাদের মেয়ের খাইখাই বাতিক আছে তা তারা জানতো। তা বলে ওষুধকেও রেহাই দিচ্ছে না আজকাল। সর্দির সিরাপের বোতলের গায়ে মধুর ছবি দেখে নিশি ফাঁক তালে পুরো বোতল সাবাড় করে দিয়েছে তা কেউ টের পায় নি। রিমি নিজেই নিজের কাছে লজ্জিত। বিনা কারণে সে মিতাকে সন্দেহ করলো। মানুষের মনের গতি যে অধোগামী তা রিমি নিজের ক্ষেত্রেও যথেষ্ট বুঝতে পারলো। তাড়াতাড়ি মনের এই সংকীর্ণতাকে দূরে সরিয়ে রেখে রিমি ছোটে মিতার কাছে নিশির অদ্ভুত খাই খাই কান্ডের খবরটা দিতে।

সমাপ্ত

Loading

2 thoughts on “গল্প- খাই -খাই

  1. খুব ভালো লাগল। প্লট ও উপস্থাপনা মুগ্ধ করল। একমুখী চিন্তা না করে বিভিন্ন দিক খতিয়ে দেখতে হয়।

Leave A Comment