মায়ার ঋণ
– রাখী চক্রবর্তী
নারায়ণ পুর শহর থেকে বেশ খানিক দুরে “ছাই গাদা বস্তি”,সেই বস্তিতে আজ কারোর ঘরে উনুন জ্বলেনি। বস্তির গা ঘেঁষে যে রাস্তাটা চলে গেছে সেটা প্রধান সড়কের দিকেই যায়।
আজ নানান মানুষের ভিড় সেই সড়কে ।যানবাহন চলছে না বললেই হয়। মাথায় ঘোমটা দিয়ে মুখে কাপড়ের আঁচল দিয়ে বস্তির বৌ ঝিরা দাঁড়িয়ে আছে। সবার মুখ গম্ভীর। চোখের কোনে জল সবার, সে তো থাকতে হবেই।
কথায় কথায় খিস্তি দেওয়া বুড়ো রিক্সাওয়ালা মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে ।বিড় বিড় করে বলছে একবার ফিরে এসো।না জানি কতো গালাগাল করেছি, তোমায় কতো পিটিয়েছি। একটি বার তোমার পায়ে পড়তে দাও ক্ষমা চেয়ে নেব। আমরা তো মুকখু মানুষ। কি করে বুঝবো বস্তির ঘরে ভগবান হয়ে তুমি এসেছিলে। অতোটুকু মেয়ে শিলা বুঝলো আর আমরা বুঝলাম না।
বস্তির মানুষদের মান সম্মান নিয়ে যে কেউ ভাবে না সে তো আমরা সবাই জানি। কিন্তু দশ বছরের শিলা বস্তির মানুষগুলোকে বোঝাবার চেষ্টা করেছিল। বস্তি মানে সবাই একসঙ্গে যেখানে বসবাস করে, মানে বসতি। বস্তি কথাটা লোকের মুখে মুখে চলে এসেছে। তোমরাও মাথা উঁচু করে চল। সভ্য ভাবে চলাফেরা করো। দেখবে তোমাদের সবাই মান দিচ্ছে। কথায় কথায় গালিগালাজ করো না, মানুষের মঙ্গল করো,
পারিনি রে শিলা, মঙ্গল করতে কারোর,
—কি রে আর কতক্ষণ, মৃত্যুর প্রহর গোনা শেষ তো হয়েছে,তবে কিসের দেরি,
গতকাল সন্ধ্যা বেলায় একটা কাপড়ের পুটলি নিয়ে ছাইগাদা বস্তির বটগাছের তলায় কে যেন বসে আছে। মুখটা কেউ দেখতে পাচ্ছে না। মাথায় ঘোমটা টানা। হাতে তো শাঁখা পলা আছে। তারমানে এয়ো স্ত্রী। কেউ কিছু বলার আগেই বুড়ো রিক্সাওয়ালা একটা বড় লাঠি দিয়ে পেটাতে শুরু করলো। আর মুখে বিশ্রী গালাগাল। চোরের ব্যাবস্থা করতে হবে।
– আমাকে মেরো না ,আমি চোর না।
– কোথা থেকে এসেছিস বল? না হলে এখখুনি পুলিশ ডাকব। কি নাম বল তোর?
– মায়া। আমার নাম মায়া। আমারও শ্বশুর বাড়ি ছিল। স্বামী ছিল। কপাল দোষে পথ চলতে চলতে তোমাদের এখানে চলে এসেছি।
– তা শ্বশুর স্বামী কোথায় গেল?
– আমি বাঁজা বলে আমার স্বামী আবার বিয়ে করছে। আমাকে বাড়ি থেকে ওরা তাড়িয়ে দিল।
কি সর্বনেশে কাণ্ড শেষে কিনা ভোর বেলায় ঘুম থেকে উঠে বাঁজা’র মুখ দেখতে হবে। না না তুমি অন্য জায়গায় যাও। আমাদের রেহাই দাও।
– আমাকে তাড়িয়ে দিও না।
– তাই তো..তোমাকে থাকতে দি আর আমাদের বাচ্চাগুলোকে চুরি করো। বদমাশ মেয়েছেলে।
বস্তির সব ছেলেরা বুড়ো রিক্সাওয়ালার কথায় সায় দিয়ে মায়াকে পিটিয়ে আদমরা করে দিল। ভোর বেলার আগেই যেন এখান থেকে চলে যেও ।
মায়া কিছুক্ষণ অজ্ঞান হয়ে পড়ে রইলো।তারপর আস্তে আস্তে চোখ খুলে দেখলো বটগাছের সামনে আর কেউ নেই। আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখল আকাশটা গুমোট ধরে আছে ঝড় বৃষ্টি হবে বোধহয়। তেষ্টাতে গলা বুক কাঠ হয়ে গেছে মায়ার। মায়া একটু চিৎকার করে বলল জল দেবে..একটু জল।
নিঝুম রাত, নিদ্রায় মগ্ন ছাইগাদা বস্তির মানুষগুলো।
মায়ার চিৎকার সে নিজেই শুনছে। দুই হাঁটুর মধ্যে মাথা দিয়ে মায়া ছোটবেলার কথা ভাবছে, মার শাসন আবদার সব কোথায় গেল, এরই নাম জীবন কি! মা বেঁচে থাকলে মার কাছে গিয়ে থাকতাম, এর মধ্যে মায়া কিসের চিৎকার শুনতে পাচ্ছে,
বাঁচাও বাঁচাও…বলে চিৎকার শুনতে পেয়েই মায়া এদিক ওদিক দেখতে লাগল। তারপর অনুমান করে দেখল চিৎকারটা পেছনের জঙ্গল থেকে আসছে। যে লাঠিটা দিয়ে বুড়ো রিক্সাওয়ালা ওকে পিটিয়ে ছিল। সেই লাঠিটা সামনেই পড়ে ছিল, সেই লাঠিটা হাতে নিয়ে ছুটতে শুরু করলো মায়া। চারটে ছেলে মিলে একটা মেয়ের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে যাবে, মেয়েটি ভয়ে কুঁকড়ে গেছে। তীব্র লালসা ওদের চোখে মুখে, লকলকে ওদের জিহ্বা, সাপের থেকেও ওরা বিষাক্ত। তোদের রেহাই নেই বলেই মায়া এলোপাথাড়ি লাঠিটাকে ঘোরাতে লাগল। মেয়েটি তখন মায়ার পেছনে লুকিয়ে আছে। চারটে ছেলের সাথে মায়া অনেক লড়াই করছে। এর মধ্যে একটা গুলি মায়ার মাথা ভেদ করে চলে গেল। মায়া মাটিতে লুটিয়ে পড়ল।
ছেলেগুলো পালিয়ে গেল।
মেয়েটি বলল, তোমার কিছু হবে না আমি সবাইকে ডেকে আনছি।
বস্তির কেউ বাদ নেই। সবাই দেখতে এসেছে বাঁজা হয়েও কারোর সন্তানকে এ ভাবে রক্ষা করা যায়। বুড়ো রিক্সা ওয়ালা চম্পাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলল, এতো রাতে তুই বাড়ি ফিরছিলিস কেন?
চম্পা বলল, আজ বিকেলে হাসপাতাল গিয়ে চারদিনের ছুটি নিলাম। ভাবলাম এখনও সন্ধ্যা হয়নি বাড়ি ফিরে যাই। ট্রেনটা যত গন্ডগোল করলো। আমি যখন বাড়ি ফিরছি চারটে ছেলে আমার পিছু নিয়ে ছিল।আমি এতোটা ভাবিনি বাবা। ঐ মহিলাকে বাবা বাঁচাতে হবে। আমার হাসপাতালে নিয়ে চলো। আমি ওনাকে ঠিক সারিয়ে তুলবো।
–হ্যাঁ মা চল
মায়াকে নিয়ে গেল ওরা ঐ হাসপাতালে চম্পা যেখানে নার্সের কাজ করে ।
অপেক্ষা করে আছে ছাইগাদার মানুষগুলো মায়ার মৃতদেহের জন্য ।
মায়ার মৃতদেহ এলো, বুড়ো রিক্সাওয়ালার হৃদয়ে অঝরে ঝরছে অব্যক্ত বেদনার দীর্ঘশ্বাস।
মায়া চেয়েছিল দাবিদার হোক ওর মৃতদেহের, বাঁজা বলে সংসার টিকলো না ওর, মায়ার জ্ঞান ফিরে ছিল যখন চম্পা বলেছিল, তুমি আমার কাছে থাকবে,আমার আরও একটা মা হয়ে, মায়ের ঋণ শোধ দিতে পারব না সে সাধ্যও নেই আমার।
মায়া বলেছিল, মেয়ে তো তুই আমার শেষ কাজটা করিস মা। চির ঋণী হয়ে থাকবে তোর এই অভাগী মা। আমি শান্তি পাব রে,
মায়ার মৃতদেহ সৎকার হলো আগুনের লেলীহীন শিখায় হারিয়ে গেল মায়ার জীবনের বাঁজা নামক কলঙ্ক।
বুড়ো রিক্সাওয়ালা বটগাছের তলায় প্রদীপ জ্বালিয়ে রোজ বলে, তোমার ঋণ আমায় শোধ করতে দিলে না, তার আগেই চলে গেলে।
এক এক করে দিন যায়, বটতলায় কে যেন বসে থাকে নিঝুম রাতে, সবাই আলোচনা করে,মায়ার আত্মা আমাদের রক্ষা করতে আসে রে,
বুড়ো রিক্সাওয়ালার কানে কে যেন বলে,
“আমি তোমাদের সবার মধ্যে আছি। মায়া ,মমতা, ভালবাসার ঋণ কোনদিনও কেউ শোধ করতে পেরেছে? পারেনি, মায়াতে আমরা যে সবাই আটকে থাকি। ছাড়ি বললেও ছাড়তে পারি কি। মায়ার আঁচলে আমরা সবাই বাঁধা থাকি যে, শক্ত গিঁট, কেউ এ গিট খুলতে পারবে না।
বটগাছের মতো ছায়া দেব, ভরসা দেবো, আমি মায়া যে, ঋণ শোধের কথা কখনও বলবি না মায়ার ঋণ শোধ হয় না কোনোদিন,
ছাইগাদার মানুষগুলো এখন এক অন্য মাত্রার জীবন যাপন করে, ভালবাসার চাদরে মোড়া ওদের জীবনগুলো রাগ, হিংসা, দলাদলি ওদের কাছে আসতে পারে না।
মায়ার মহিমা এমনই হয়, জন্ম জন্মান্তরে মায়ার বন্ধনে আমরা আবদ্ধ হই, হিসাব মেলে কারোর,কারোর হয়তো সুযোগ আসে না হিসাব মেলাবার..