গল্প- সালিশির রায়

সালিশির রায়
– শচীদুলাল পাল

বীরভূমের আদিবাসী গ্রাম। আসনবনি। সেই গ্রামে বাস করত এক দীন দরিদ্র মেয়ে। বয়স ষোল। নাম তার কলি। বাবা দিন মজুর। প্রতিদিন কাজ জোটেনা। তাই কলিকে পেটের দায়ে কাজে যেতে হয় ক্ষেতে খামারে পাথর খাদানে যখন যেখানে। একদিন সুর্যি প্রায় ডুবু ডুবু। কলি ত্রস্ত পায়ে বাড়ী ফিরছিলো। হঠাৎ তার নজর পড়লো রাস্তার ধারে তাদের গাঁয়ের শাপলা সোরেন ও তার তিন সাঙ্গপাঙ্গ হাঁড়িয়া খাচ্ছে। ওরা প্রায়ই তাকে বিরক্ত করত। কুপ্রস্তাব দিত। সেজন্য সে ভয়ে সিঁটকে থাকতো। আজ শাপলা তার একেবারে সামনে। গায়ে হাত দিয়ে বললো, “তুই ত বেশ ডাগর হয়ছিস। চল আমাদের সঙ্গে ফুর্তি করবো।” কলি এক ঝটকায় শাপলার হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে দিল দৌড়। দৌড়তে দৌড়তে সে ঢুকে গেলো সামনের জঙ্গলে। পিছু নিল সাপলা ও ওর সাথীরা।ক্লান্ত কলি জঙ্গলে গাছগাছালির মধ্যে হারিয়ে যাবার চেষ্টা করলো। এক সময় সে সফল হলো সামনে একটা গভীর গর্ত- ডোবা। মারল ঝাঁপ। গর্তের এক কোনায় লুকিয়ে পড়লো। সাপলার লোকজন যারা পিছু পিছু দৌড়াচ্ছিল তাদের মধ্যে একজন তাকে দেখতে পেয়ে বাকীদের সবাইকে ডাকলো। উল্লাসে চীৎকার করতে লাগলো। একে একে সেই চারকোনা চৌকো পুকুরের মতো গর্তে ঝাঁপ দিল। চারজনে অবসন্ন কলিকে ধর্ষণ করল বার বার। গ্রামের দু’জন কলির সম্পর্কে কাকা হয় সামনে দিয়ে যাচ্ছিল গোঙানির শব্দে সামনে গিয়ে সাপলা ও সাঙ্গপাঙ্গদের প্রতিরোধ করার চেষ্টা করলো। সাপলা পকেট থেকে পিস্তল বের করে তাদের মাথায় ঠেকিয়ে বলল “কাউকে যদি জানাস গুলি করে মারে দিব।” সাপলা ছিল গাঁয়ের মোড়লের ছেলে, বখাটে গুন্ডা। বাপ দুনম্বরী করে বড়লোক। রাজনীতি করে। আদিবাসীদের প্রধান। মাঝিহারাম। পুলিশ প্রশাসন হাতের মুঠোয়।
কলি বাড়ি ফিরলো দেরি করে। বাবা তো রেগে আগুন। এত দেরি করে ফিরছিস। কাল থেকে তুকে কাজে যেতে হবেক না। মা বলল “ও যদি কাজে না যায় আমরা সবাই উপোস করে মরব। তুমিও ত রোজ কাজ পাওনা। ”
বাপ কিছু শান্ত হলো। কলি অত্যন্ত শান্ত হলো। ঘটনাটা জানায়নি ভয়ে। বাপকে ওরা মেরে ফেলবে শাসিয়েছে। অসুস্থ শরীরে শুয়ে পড়লো। মা খেতে ডাকলে খেতে গেল না। উভয়সঙ্কট। কি করবে?
কয়দিন সে কাজে গেলো না।
সাপলার আড্ডার সামনে দিয়ে আর ওকে যেতে না দেখে ওরা কলির ঘরের সামনে উঁকি মারত।
কলিকে খুঁজতো। কলি একদিন চান শেষে উঠানে কাপড় মেলছিল হঠাৎ কাঁধের উপর একটা আলতো ছোঁয়া। কলি ভয়ে বিবর্ণ হয়ে পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখলো প্রদীপ। সে আস্বস্ত হলো। ছোটো থেকেই দু’জনের মধ্যে ভালোলাগা থেকে ভালোবাসা। একে অপরকে ছেড়ে থাকতে পারতো না। তোমাকে কদিন থেকে দেখতে পায়নি তাই তোমার ঘরে চলে এসেছি। কলি প্রদীপের হাত ধরে বললো “তুমি কি আমাকে সত্যি ভালোবাসো। তাহলে চলো এখনি পালিয়ে যাই দূরে অনেক দূরে। আমি তুমাকে অনেক ভালোবাসি প্রদীপদা।”
প্রদীপ বললো “আর কিছুদিন অপেক্ষা কর আমার চাকরিটা হয়ে যাবে তখন তুকে আমি নিয়ে দিল্লি চলে যাব বিয়ে করে। পূর্ণ মর্যাদায়। ”
কলিদের উঠানের সামনে গাছের আড়াল থেকে দেখছিল সাপলার চ্যালা শিবু।
শিবু গিয়ে সাপলাকে খবর দিল। সাপলা তো প্রথমে রেগে গিয়েছিল। বলা, যাদু, দামু, এক স্বরে বললো “মাথা ঠান্ডা কর গুরু। এইতো মোকা। এবার আর কোনো অসুবিধা নাই। অর্ডার দে গুরু এখনি কলিকে তুলে নিয়ে আসি।”
সাপলা বলল “দাঁড়া অল্প রাত হোক।”
রাত গভীর হলো। গরমকাল। কলির ঘরের দরমার দরজা দিয়ে শুয়ে ছিলো। সাপলা তার সাঙ্গপাঙ্গ বেড়া টপকে দরজা ভেঙ্গে মুখে কাপড় বেঁধে কলিকে তুলে নিয়ে এসে বললোয়”তুই অন্য জাতের ছেলার সাথে ভাব করছিস আর আমরা ভোগ করলে অমন কেন করিস।”
কলি বললো “প্রদীপ ও আমি দু’জনে দুজনকে ভালবাসি আমরা বিয়া করবো।
– অন্য জাতের ছেলার সাথে বিয়া?
– আজ ত ইয়াকে শিখাতে হবেক। এই শিবু দামু। ইয়ার কাপড় ট খুলে মুখে বাঁধে দে।
হাত দুটা ধর।
তারপর সাপলা শিবু দামু বলা রাতভর ধর্ষণের পরে বলল, “যা এবার ঘরে যা। ঘরে যদি বলেছিস তো প্রথমে তুর মাকে তুলে আনবো। আরও বাড়াবাড়ি যদি করিস তাহলে তুর বাপটোকে মারে দিব।”
কলি চুপচাপ ঘরে এল। কিন্তু সকাল হতেই কথাটা জানাজানি হয়ে গেল। কলি ভিনজাতের ছেলার সাথে ভাব করেছে। বিয়া করবে। প্রদীপ আর কলির ফোটো মোবাইলে মোবাইলে ছড়িয়ে গেল। আদিবাসী সমাজে অআদিবাসী বা অন্যজাতের ছেলের সাথে বিয়ে ঘোরতর “অপরাধ”।
এবার কলি একদম মুষড়ে গেলো। সে কাজে যাওয়া বন্ধ করলো। সংসার আর চলেনা। ঘর থেকে বের হয়না। এমনি করে মাস দুয়েক কাটলো। একদিন মাঠ থেকে ঘরে এসে কলির বাপ মেয়েকে সটাস করে এক চড় মারলো। “তুর জন্যে আমরা এই গাঁয়ে থাকতে লারব। অন্য জাতের ছেলাকে বিয়া করবি। আমার কোনো মান রাখলি নাই। হারামজাদি। “সে ভাতের সঙ্গে ইঁদুর মারার বিষ মিশিয়ে আত্মহত্যা করতে গেল।মা বাধা দিল। বাপকে বুঝালো। কলি চুপ করে থাকল। মোড়লের ছিলা তাকে যখন রেপ করল তখন কোনো অপরাধ হলনা। আজ উল্টো অন্যজাতের ছেলার সাথে ভাব করেছি বলে অপরাধী হয়ে গেলুম। না ইয়ার বিচার চাই। সারারাত ভেবে ভোরবেলা ঘর থেকে বেরিয়ে সে থানায় এল বাসে। থানায় দারোগা বাবুকে সব কথা খুলে বলে বললো” ডায়েরি লিখুন। ”
– “কি বলছিস। মোড়লের ছেলার নামে কেস ডায়েরি। ওর হাত কত বড় জানিস। কিছুই করতে পারবিনা। পারবি প্রমাণ করতে। কার হিম্মত সাক্ষী দিবে। রেপের দু’ মাস পরে এসেছিস রেপ কেস করতে। পাগল নাকি। যা এখান থেকে। শুনলে সাপলার বাপ তোদের সবাইকে মেরে পুঁতে দিবে।
– ডায়েরি না লিখলে আমি এখান থেকে যাবোই না।
অগত্যা দারোগা নিজেকে বাঁচার জন্য বলল ” সিউড়ি যা। ওখানে ডায়েরি লেখাগা যা।”
– কলি সিউড়ি গেল। বড় পুলিশ হেড কোয়ার্টারসে গেল। সেখানে বললো “এখানে কেন এসেছ। তোমাদের গ্রামের কাছে থানায় যাও।”
এবার কলির ধৈর্যের বাঁধ গেলো ভেঙ্গে।
– গ্রামের থানা বলছে সিউড়ি যা। আর আপনারা বলছেন গ্রামের স্থানীয় থানায় যা। কলি চীৎকার করে বললো,
– আমার ডায়েরি না লিখলে আমি এখান থেকে যাবো না। ”
অফিসের বড়কর্তা কলির চীৎকার শুনে কলিকে নিজের অফিসে নিয়ে গেল। সব কথা শুনলো। ডায়েরি লিখতে অর্ডার করল।
কলি ডায়েরি লিখিয়ে গ্রামে ফিরে এল।
স্থানীয় থানা থেকে খবরটা সাপলার বাপ মিলকা সোরেনের কাছে পৌঁছে গেলো ফোনে। মিলকা বিশাল ক্ষমতাবান ছিল। সে ছিল সাঁওতাল সমাজের দশ গাঁয়ের প্রধান। সে যা বলবে সবাইকে তা মানতে হবে। সে প্রথম সালিশি সভায় নির্দেশ দিল “অন্য জাতের ছেলার সাথে প্রেম। কলি আর প্রদীপকে পঁচিশ পঁচিশ হাজার টাকা জরিমানা দিতে হবে। সালিসি সভা হলো প্রচুর লোকজন। সবাই মজা, দেখতে এলো। প্রথমে কলিকে শুধালো ” তুই কি এই ছেলার সাথে ভালোবাসা করেছিস, বিয়া করবি?
সবার সামনে তুকে বলতে হবেক।
কলি ইতস্তত করে অবশেষে বলে দিল “হাঁ আমি প্রদীপকে ভালবাসি। উয়াকেই বিয়া করবো।”
এবার প্রদীপের পালা, “তুই কি বলেছিস কলিকে বিয়া করবি” প্রদীপ অস্বীকার করে বললো, “না। মিথ্যা কথা। আমি ভালোবাসিনা আর বিয়াও করবনা। এমন কোনো কথা বলি নাই।” পঁচিশ হাজার টাকা দিয়ে রেহাই পেয়ে গেল। মাঝিহারাম নেতা মিল্কা সালিসি সভায় নির্দেশ দিল “এই বিটিছিলা কলির দোষ সব। অপরাধ করেছে কলি। ইয়াকে সবার সামনে ন্যাংটো কর।সাপলা এগিয়ে এসে একটা একটা করে কাপড় খুলে দিল। অনেকে মজা লুটলো।কেউ কেউ মোবাইলে ফটো তুললো। তারপর মাঝিহারম মিল্কা নির্দেশ দিল “ইয়াকে তুলে নিয়ে যা সবাই মিলে ধর্ষণ কর।”
সাপলা সহ তেরো জনা মিলে কলিকে ধর্ষণ করলো। এর মধ্যে বিকৃত কাম কলির দুই কাকাও ছিল। একজন মোবাইলে ভিডিও তুলেছিল পরে তেরিয়ে তেরিয়ে দেখবে বলে।রাতভর তেরো জন অত্যাচার করার ফলে একসময় কলি জ্ঞান হারালো। সাপলার খামার থেকে জঙ্গলে ধারে ফেলে দিল।সকালবেলা দশ গাঁয়ে ছড়িয়ে পড়লো। কেউ একজন সিউড়ি সদরে জানালে এস পির নির্দেশে মিল্কা সমেত তেরো জন গ্রেপ্তার হলো। মাঝিহারামের প্রশাসন আজও সমান্তরাল চলছে। চরম এই “অপরাধ” আদিবাসী জাতি, বাংলা তথা ভারতের কাছে অবমাননাকর।
তেরো জন এখনো জেলে বিচারাধীন। সবার মোবাইল সিজ করা হয়েছে। যোনি গর্ভে সিমেন টেস্টের জন্য ফরেনসিক লেবরেটারিতে পাঠানো হয়েছে।
কলির মুঠিবদ্ধ হাতে পাওয়া গেছে সাপলার যৌনকেশ।

Loading

3 thoughts on “গল্প- সালিশির রায়

  1. সত্য ঘটনা অবলম্বনে। লেখাটি পড়ে ভালো লাগলে লাইক কমেন্ট করবেন ।
    সবাই ভালো থাকুন

  2. আপনি কি পেশায় ঊকিল ? ঘটনার বিবরণ দেখে মনে হল যেন চোখের সামনে দেখছি ।

    1. আপনার অনুভবকে ধন্যবাদ। কিন্তু আমি উকিল নই।
      আমি যখন লিখি তখন বিষয়ের উপর একাত্ম হতে হয় এইটুকু জানি।
      আপনার মুগ্ধতায় ও মন্তব্যে প্রীত হলাম।
      অসংখ্য ধন্যবাদ।

Leave A Comment