গল্প- পরিপূর্ণতা

পরিপূর্ণতা
– সঞ্চিতা রায়

 

 

হিয়ার আজ সাত বছরের জন্মদিন। যেদিন হিয়াকে আশ্রম থেকে সার্থক আর কোয়েল নিয়ে এসেছিল‘সেই দিনটাকেই তারা জন্মদিন হিসাবে পালন করে। মাত্র পাঁচ মাস বয়সে হিয়াকে তারা নিয়ে এসেছিল। অনেক স্নেহ অনেক ভালোবাসায় হিয়াকে তারা সব সময় ভরিয়ে রাখত। কোয়েল আর সার্থক যখন জানতে পারে তারা বায়োলজিকাল শিশুর বাবা মা হতে পারবে না,তখন ই তারা এই সিদ্ধান্ত নেয়। হিয়াকে সমাজের মানুষ ভুল বোঝানোর আগেই কোয়েল একদিন ওকে বলে,ছোট্ট সোনা ভগবান তোমাকে আমার জন্য আশ্রমে রেখে গিয়েছিল,আমি আর তোমার বাবা সেখান থেকে নিয়ে এসেছি। ঠিক করে সময় সুযোগ মত ওকে সব বুঝিয়ে বলবে। সার্থক ও খুব আদরে মানুষ। কিন্তু ওর যখন চব্বিশ বছর বয়স তখন ওর বাবা মা এক দুর্ঘটনা য় মারা যান। টাকা পয়সা যথেষ্টই রেখে গিয়েছিলেন তার বাবা মা। তিরিশ বছর বয়সে সে বিয়ে করে। এক সময় সার্থক দের বাড়ি তার ঠাকুমা, দাদু ,বাবা ,মা ,পিসি সবাইকে নিয়ে পরিপূর্ণ ছিল। প্রথমে ঠাকুমা পরে দাদু মারা যান। পিসির বিয়ে হয়ে যায়। সার্থক দাদু ঠাকুমার অভাবটা বড় বেশী অনুভব করত। তাই তার বাবা তাকে মাঝে মধ্যে বৃদ্ধাশ্রমে নিয়ে যেত,সেখানে দাদু ঠাকুমার বয়সী অনেককে পেয়ে সার্থকের মন ভরে উঠত। রবিবার এলেই সে দাদু ঠাকুমাদের সম্পর্শ পেতে বৃদ্ধাশ্রমে চলে যেত। আজ হিয়ার জন্মদিনে হিয়া প্রচুর উপহার পেয়েছে। সে খুব খুশি । কিন্তু বাবার কাছে গিয়ে সে হঠাৎ বলে “বাবা তোমার কাছে আজ একটা উপহার চাইবো,দেবে?” সার্থক বলে “বলো ছোট্ট সোনা তোমার কি চাই”। “আমাকে ঠাকুমা দাদু এনে দাও,আমার বন্ধু আদৃযার বাড়িতে গিয়ে দেখেছি,ও কেমন ঠাকুমা দাদুর কোলে চড়ে গল্প শোনে,আমার ও খুব ইচ্ছা করে,দাও না বাবা ঠাকুমা দাদু এনে”। সার্থকের নিজের বাবা মা ঠাকুমা দাদুর কথা মনে পড়লো,চোখে জল এল। জন্মদিনে আসা অতিথিদের ও চোখে জল। সত্যি আজকের সমাজে সংসার যখন ভেঙে যাচ্ছে,বয়স্ক মানুষদের বাড়তি মনে করছে অনেক পরিবার তখন ঠাকুমা দাদুর ভালবাসা দেখে মুগ্ধ একটা শিশু।
আর এটাও ঠিক সার্থক বাবা মায়ের অভাবটা সব সময় অনুভব করে। জ্বর আসলে মনে হয় মা এসে মাথায় হাত বোলালে বোধহয় ভাল লাগতো। বাড়ি থেকে বেড়ানোর সময় বাবা মায়ের বলা“সাবধানে যাস বাবু”!কথাটার ও অভাব অনুভব করে। বাবার সাথে সে বৃদ্ধাশ্রমে যেত,এখনও যায়। আর চলে আসার সময়“সাবধানে যেও বাবা”কথাটা শুনলে তার মনটা কেমন উদাস হয়ে যায়। ঘটনাচক্রে বৃদ্ধাশ্রমে থাকা এক দম্পতির ছেলের নাম সার্থক। এই দম্পতি তাদের ছেলেকে উচ্চশিক্ষা দেওয়ার ব্যায়ভার বহন করতে গিয়ে বাড়িটাও বিক্রি করে দিয়েছিলেন। ছেলেরএখন বিদেশে। বাবা মায়ের খোঁজ ও নেয় না। তারা জানেন তাদের এক নাতনী আছে,কিন্তু নাতনীকে তারা দেখেননি। ছেলের বিভিন্ন বয়সের ছবি দেখে দেখেই তারা ছেলেকে পাশে পাওয়ার সুখ অনুভব করতে চান। সার্থক আসলে তারা ভীষণ ভীষণ আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন। হয়তো ছেলের সঙ্গে সমনাম হওয়ায় টানটা আরো বেরে যায়। মেয়ের কথা শুনে সার্থকের মনে পড়লো সেই বৃদ্ধ দম্পতি র কথা। মনে হ‘ল এনাদের যদি বাড়িতে আনা যেত,তবে হয়তো বাড়িটা আবার পরিপূর্ণতা লাভ করবে। আর ওই দম্পতির ও ভাল লাগবে একটা পরিবার পেলে। জন্মদিনের পরের দিন ছিল রবিবার। সার্থক বৃদ্ধাশ্রমে গিয়ে সরাসরি তাদের বলল“আমার নামটা তোমাদের ছেলের সঙ্গে এক,আমি তোমাদের ছেলে হয়েই থাকতে চাই,তোমাদের বাড়ি নিয়ে যাব। ”কিন্তু”!কোনো কিন্তু নেই ,আমি আশ্রম কর্তৃপক্ষের সাথে কথা বলবো।
সন্তান দত্তক নেওয়া গেলে ,বাবা মা দত্তক নেওয়া যাবে না কেন?আচ্ছা বেশ এক্ষেত্রে আইনি জটিলতা থাকলে আমি এনাদের দত্তক সন্তান হ‘ব। মা বাবা তোমাদের ফর্ম এনে দেব, ফিল আপ করে দিও। আর যা যা করার আমি করবো। সার্থকের মুখে বাবা মা ডাক শুনে তাঁদের চোখে জল এল। হ্যাঁ তাঁরা এবং আশ্রম কর্তৃপক্ষ রাজী হ’লেন।
আজ সার্থকের বাড়ি সত্যিই পরিপূর্ণ। হিয়া পেয়েছে ঠাকুমা, দাদু। কোয়েল আর সার্থক পেয়েছে বাবা মা। আর তাঁরা দুজন পেলেন ছেলে মেয়ে নাতনী। এ যেন চাঁদের হাট। সত্যিই সার্থকের নাম আজ সার্থক।

Loading

Leave A Comment