লজ্জার প্রতিধ্বনি
-রীণা চ্যাটার্জী
সুধী,
গর্বিত আমরা বাঙালী, তাই। গর্ব আমাদের গুরুদেবের দেওয়া বুলি আজো আমাদের প্রাণের সুধা, মনের ক্ষুধা, ক্লান্তিতে নিদ্রা। না, ওনার লেখা সম্পূর্ণ জানতে পেরেছি, বুঝতে পেরেছি- এই কথা বলার স্পর্ধা নেই। তবুও গুরুদেব মিশে আছেন আমাদের রক্তে- মজ্জায়- আত্মায়। আমাদের আত্মার আত্মীয়। তাঁর বাণী ধ্বনিত হয় আমাদের চেতনায়- ভালোবাসা, বিরহ, শোক- তাপ, উৎসব আবহে সকল অনুভূতির মাঝে।
তবে বর্তমান বড়োই ব্যস্ত ‘নাম-বিদ্রোহ’ দিয়ে অন্য চর্চায়। হ্যাঁ, বিদ্রোহ বা বিরোধীতার নাম নিয়ে, বিশ্বকবির নাম বন্ধনী নিয়ে সেই গুরুদেবের কলমের শরণাপন্ন মুষ্টিমেয় কাঙাল বাঙালী। অবশ্যই কাঙাল। জনপ্রিয়তার কাঙাল, খুব সহজেই শ্লীল- অশ্লীলের সীমারেখা বিসর্জন দিয়ে সমাজে শব্দের জীবাণু ছড়িয়ে দিচ্ছে শুধুমাত্র পরিচিতি পাবার জন্য। কারণ গুরুদেবের কিছু কথা, কিছু শব্দ, কিছু ছন্দের বাস আমাদের মননে- সেই শব্দ, সেই সুর অশ্লীলতা স্পর্শ করলে আমরা ঘৃণায় হোক, বিরক্তিতে হোক, লজ্জায় হোক, ক্রোধের বশে হোক একবার ফিরে তাকাবোই। সেখানেই এই চটুল মানসিকতার সার্থকতা। অশ্লীলতা- নগ্নতা চার দেওয়ালের সীমাবদ্ধতা ছেড়ে যখন বাইরে পা রাখে- তখন আর বুঝতে বাকি থাকে না এদের আসল উদ্দেশ্য। তার্কিক সমর্থকরা প্রশ্ন তুলবেন, “এই কথাগুলো কি রবীন্দ্রনাথের পৈত্রিক সম্পত্তি.. যে আর কেউ বলতে পারবে না।”
নাহ্, পৈত্রিক সম্পত্তি না, ওটা ব্যক্তিগত সম্পত্তি- রচয়িতা সত্ত্বাধিকারী। কারণ এখন সোস্যাল মিডিয়ায় দু’মিনিট চোখ রাখলেই চারটি লেখা চোখের সামনে আসবে। লেখার বিষয়বস্তু বা কলমের দক্ষতার পরিচয় দেখতে পাওয়া না গেলেও নীচে লেখা দেখা যায় “সম্পূর্ণ সত্ত্ব সংরক্ষিত’ “কপিরাইট” ইত্যাদি প্রভৃতি। অবশ্যই রচয়িতার অধিকার সবার আগে। কিন্তু ওনাদের আছে আর বিশ্ববন্দিত গুরুদেবের নেই? এটা কেমন কথা হলো? তর্ক করবো না, তবে নিজের লেখা সম্বন্ধে গুরুদেবের নিজস্ব মতামতটুকুই অন্তত তুলে ধরার চেষ্টা তো করা যেতেই পারে তাঁর মতামতকে সম্মান জানাতে। বিশিষ্ট আইনজীবী জানকীনাথ বসুকে লেখা একটি চিঠি, “আমার গান ইচ্ছামত ভঙ্গি দিয়ে গেয়ে থাকেন, তাতে তাদের স্বরূপ নষ্ট হয় সন্দেহ নেই। গায়কের কণ্ঠের উপর রচয়িতার জোর খাটে না, সুতরাং ধৈর্য্য ধরে থাকা ছাড়া অন্য পথ নেই। আজকালকার অনেক রেডিয়োগায়কও অহংকার করে বলে থাকেন তাঁরা আমার গানের উন্নতি করে থাকেন। মনে মনে বলি পরের গানের উন্নতি সাধনে প্রতিভার অপব্যয় না করে নিজের গানের রচনায় মন দিলে তাঁরা ধন্য হতে পারেন। সংসারে যদি উপদ্রব করতেই হয় তবে হিটলার প্রভৃতির ন্যায় নিজের নামের জোরে করাই ভালো।” (তথ্যসূত্র- সঙ্গীতচিন্তা,২০ ডিসেম্বর,১৯৩৮)
নিজের নাম? হায় রে, আমাদের প্রভাতের উজ্জ্বল আলোটাই মনে হয় কলঙ্কিত হয়ে গেল। নাম তো আর অভিভাবকরা ভবিষ্যত ভেবে রাখেন না। ওটা যে ভালোবাসা ও আদরের পরিচয়। তাই কিছু অপাঙক্তেয় নিয়ে চলতেই হয় আমাদের। কবিগুরুর কথায়
“ধ্বনিটিরে প্রতিধ্বনি সদা ব্যঙ্গ করে/ ধ্বনি কাছে ঋণী সে যে পাছে ধরা পড়ে” আর তো কোনো উপায় নেই, তাই গুরুদেবের বাণীতেই খুঁজে নিলাম আমরা সান্ত্বনা।
সম্প্রতি অনুষ্ঠিত হলো “আলাপী মন” এর দ্বিতীয় মুদ্রণ প্রকাশ অনুষ্ঠান। উপস্থিত সকল বরেণ্য, শ্রদ্ধেয় অতিথিদের আন্তরিক ভালোবাসা, কৃতজ্ঞতা ভালোবেসে আমাদের পারিবারিক সূত্রে গেঁথে দেবার জন্য। যাঁরা আসতে পারেন নি, ব্যক্তিগত অসুবিধার কারণে তাঁদের সবাইকে ভবিষ্যতে আমাদের মাঝে পাবো, এই আশা রাখি।
আলাপী মনের পক্ষ থেকে নিরন্তর শুভেচ্ছা, শুভকামনা।