জননী
-পারমিতা চ্যাটার্জী
আজ সকাল থেকে দময়ন্তীর মনটা একটু খারাপ হয়েই আছে। সবে নারায়ণ পুজো সেরে উঠে এসেছেন আর দেখেন যে ছেলে পাপুনের সাথে রহমানের সদ্য মাতৃহারা ছেলেটা আসিফ এসে বসে আছে। পাপুন বলছে, মাগো আমার আর আসিফের দু’জনেরই খুব খিদে পেয়েছে। আসিফ সকাল থেকে কিছু খায়নি।
দময়ন্তী যেন একটু বিরক্ত হয়েই বলেছিল, কেন খায়নি কেন?
ওর আম্মু যে মারা গেছে মা। ওর আব্বু ওর জন্য নাস্তা বানাতে পারেনি।
– যতসব..এসব আবার কোথা থেকে শিখেছ? নাস্তা আবার কি? বলো ব্রেকফাস্ট। ঠিক আছে দাঁড়াও। আমি আনছি।
একটু পরে দময়ন্তী দু’টো প্লেটে খাবার সাজিয়ে নিয়ে এসে বললো, পাপুন এদিকে এসো খাইয়ে দি। আর আসিফ তুমি এখানে বসো। মাটিতে একটা চাটাই পেতে কলাইয়ের থালা করে মাতৃহারা ছেলেটাকে সে খেতে দিল। পাপুন যখন বললো, ওকে ওখানে দিলে কেন মা? ও যে নিজে খেতে পারেনা।ওর আম্মু ওকে খাইয়ে দিত। তখনও সে পাথরের মতই শক্ত হয়ে নিজের সংস্কারকে ভেঙে বলতে পারে নি, তুই আয় বাবা আমার কাছে আয়। আমি তোকে খাইয়ে দিচ্ছি। এ কেমন মা সে? নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করে।আজ তার স্বামী অনুপমের কথা খুব মনে হচ্ছে। সে সবসময় বলে, যেদিন জাতপাত এসব বিসর্জন দিয়ে সমস্ত শিশুর মা হতে পারবে সেদিনই তুমি হবে প্রকৃত জননী। তার আগে নয়।
বারবার চোখের সামনে আসিফের করুণ মুখটা ভেসে আসছে।
অনুপম ঘরে ঢুকে বললেন- কি হল আজ? মন খারাপ মনে হচ্ছে?
– হ্যাঁ গো আজ সত্যি আমার খুব মন খারাপ। নিজেকে বড়ো ছোটো মনে হচ্ছে। সত্যি আমি মা নামের কলঙ্ক।
অনুপম এগিয়ে এসে সস্নেহে স্ত্রীর মুখটা তুলে ধরে বলেন- আমাকে বলবে না কি হয়েছে?
দময়ন্তী আকুল কান্নায় ভেঙে পরে নিজেকে উজাড় করে স্বামীর কাছে সব বললেন।
অনুপম তার মাথার চুলে হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন, ঠিক আছে কাল তুমি ভালো করে সুজির হালুয়া আর লুচি বানিয়ে পুপুনকে নিয়ে রহমানের বাড়িতে গিয়ে দু’জনকে একসাথে খাইয়ে এসো।
– যাবো? কিছু হবেনা তো?
– আমি বলছি কিছু হবে না। তোমার নারায়ণ শুধু তোমার ছোট্ট ঠাকুর ঘরে আবদ্ধ নেই।তিনি ছড়িয়ে আছেন বিশ্বব্যাপী। আসিফের মধ্যেও আছেন তিনি। আমরাই তো বলি শিশু নারায়ণ – কি বলিনা?
– হ্যাঁ বলি, ঠিক বলেছ তুমি, আমি কালই যাবো আর এবার থেকে আসিফ আমার কাছেই পাপুনের সাথে একসাথে খাবে ও যতদিন না বড়ো হয়।
অনুপম খুব খুশি হয়ে স্ত্রীকে কাছে টেনে বললেন এই তো এতদিনে আমি আমার দময়ন্তীকে খুঁজে পেয়েছি।
পরদিন সকালে দময়ন্তী দেখলো পাপুন মুখ ভার করে বসে আছে। একবারও বলছে না খিদে পেয়েছে। তিনি আড়চোখে দেখছেন আর মিটিমিটি হাসছেন। একটা টিফিন বক্সে সব খাবার গুছিয়ে নিয়ে পাপুনকে বললেন, চল আমার সাথে.
-কোথায়?
– চল ই না দেখতেই পাবি।
পাপুন অবাক হয়ে দেখল মা তাকে নিয়ে আসিফের বাড়ির দিকে যাচ্ছে। তারপর দেখলো আসিফের দরজায় কড়া নাড়ছেন– কি ব্যাপারটা হচ্ছে ওর ছোট্ট মাথায় ঠিক ধরছেৎনা।
একটু পরে রহমান চাচু এসে দরজা খুলে তো অবাক- মা ঠাকরন আপুনি?
হ্যাঁ আমি, আসিফ কোথায়? এই যে মা ঠাকরন এইখানে বয়ে আছে আর কানদেছে খালি আম্মু আম্মু কইরা.. খাইছেনা কিচ্ছনা-
– এইবার আসিফ খাবে। দময়ন্তী ঘরে ঢুকলেন। রহমান ব্যস্ত হয়ে তাকে একটা কাঠের চেয়ার এগিয়ে দিয়ে বলে– এইখানে বয়েন — কাঠে দোষ লাগেনা–
কিসের দোষ রহমান? কোন কিছুতেই দোষ নেই সবই আমাদের মনের ব্যাপার। তুমিও মানুষ আর আমিও মানুষ, মাঝের বিভাজনটা আমরা ইচ্ছা করে সৃষ্টি করি। আসলে কি জানো? যিনি রাম তিনি রহিম, যিনি কৃষ্ণ তিনি করিম। যাও এখন তুমি আমাকে দু’টো থালা এনে দাও তো। ছেলে দু’টোকে একটি খাইয়ে দি..
– হ্যাঁ এই যে দি মা..বড়ো সোন্দর কথাখ্যান বললেন– যিনি রাম তিনি রহিম।
আসিফ আয় বাবা আমার কাছে আয়।আজ আমি আমার দুই ছেলেকেই একসাথে খাইয়ে দেব।
আসিফের মুখ আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। আমায় তুমি খাইয়ে দিবে?
– হ্যাঁ তো দেবো তো? শুধু আজ নয় এবার থেকে রোজই আমি তোকে খাইয়ে দেব। দুই ছেলেকে আমার কোলে একসাথে বসিয়ে একথালা থেকে খাইয়ে দেব– কি এবার খুশি তো?
– হ্যাঁ আম্মু খুব খুশি।
– তবে আয়..
দময়ন্তী ওদের দু’জনকে দু’ কোলে বসিয়ে খাওয়াতে লাগলেন। দু’টো শিশুর কি আনন্দ। খুশিতে যেন মুখ দু’টো জল জল করছে। তার মনে হল দূর থেকে যেন তাঁর নারায়ণ দাঁড়িয়ে হাসছেন আর বলছেন- এবার তুই সত্যিকারের জননী হলি। জননী কথাটার অর্থ যে ব্যাপক। তা তো শুধু নিজের সন্তানের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনা। যিনি প্রকৃত জননী তিনি সবার জননী। এই দেশমাতার সব শিশু সন্তানদেরই তিনি জননী।
দময়ন্তী আজ এই নতুন মন্ত্রে নিজেকে দীক্ষিত করল।