গ্যাঁদা ফুল- কার হাতে
– সঙ্কর্ষণ
ছোটোবেলায় প’ড়েছিলাম, “শি ইজ পুওর ‘বাট’ শি ইজ অনেস্ট”। অর্থাৎ ‘আর পাঁচজনের মতো’ ঠিক ঐ বা ঐ জাতীয় কিছু ক্ষেত্রে দারিদ্র্য মেয়েটির সততার প্রতিবন্ধক হ’য়ে দাঁড়ায়নি, তাই সে শিক্ষিতদের পাঠ্যবইয়ে স্থান পেয়েছে। গরীব মানুষ তো, রক্তে প্রতারণার দোষ না থাকা নেহাতই অস্বাভাবিক। পেটে খাবার না জুটলে তো সে মেয়ে কুচ্ছিতও বটে। তবে অদ্ভুতভাবে সেই কারণবশতঃ মেয়েটির সৌন্দর্য এবং যৌবন কিন্তু টাল খায়না।
অতএব সদ্বংশজাত জনৈক ধনীপুত্র নিশ্চিন্তে তাকে নিজের বাড়ির বড়ো বাগানে ডেকে নিতে পারলো। দেখিয়ে দিলো অবস্থার এই দুস্তর ব্যবধান বর্তমান থাকতেও সে কতো ভালোবাসে তাকে। কথা দিলো নিজের দায়িত্বে জীবনের সংগ্রাম থেকে অনতিকাল পরেই উদ্ধার ক’রে আনবে তাকে। কিন্তু ‘ভালো ছেলের’ প্রেম কি আর মন শরীর এসব অতো গভীরভাবে বোঝে? মেয়েও তো জানে এইই তো পতি। পরম গুরু। আশ্বাস দিচ্ছে যখন, মিথ্যে হবেনা।
সে ঘটনার কিছু সময় পরেই এক ফুটফুটে কন্যাসন্তান কোলে কোনো বাউলের আখড়ায় দেখা যায় মেয়েটিকে। কুমারী অবস্থায় মা হওয়ায় তাকে আর স্থান দেয়নি সমাজ। গরীব মানুষের মেয়ে ‘অসতী’ তো হওয়াই স্বাভাবিক। অসতী মেয়েকে তো আর ঘরের বৌ করা যায়না। হয়তো এক শ্রেণীর কাছে এ ঘটনাও প্রত্যাশিত, অপরদিকে তৈরী থেকেও দ্বিতীয় শ্রেণীর কাছে এ যেন অপ্রত্যাশিত। তাই গাছের ছায়ায় ব’সে একান্ত নিজস্ব স্নেহপুত্তলীটিকে সাজায়-গোজায় সে। প্রেমিককে ফিরে না পাওয়ার দুঃখ তার মুখের কথায় ফুটে ওঠে বারবার। মনে পড়ে সাধ, আহ্লাদ, অনুভূতি এসব তো তার মতো মেয়েদের জিনিস নয়। কিন্তু তার অমূল্য ধনটির মুখমণ্ডলে সে ফেলে আসা সুখস্মৃতি খুঁজে ফেরে বারবার। অকারণে গেয়ে ওঠে, “বড়োলোকের বিটি লো, লম্বা লম্বা চুল/অমন চুলে বেন্ধে দিবো লাল গ্যান্দা ফুল”…
.
.
সেকালের বাঙালী সংস্কৃতিতে এ ছবি নতুন কিছু ছিলোনা। পটের গান, গল্প, কবিতা, ছড়া ইত্যাদিতে প্রচুর দেখাও পাওয়া যায় তার। এ দুঃখ, এ হাহাকারে বাংলার প্রতিটি নারী, পুরুষ যেন একাকার হ’য়ে যায়, যেমনটি গেছিলেন গানটির আসল রচয়িতা শ্রী রতন কাহার। এ গানের ইতিহাস ও মর্ম যদি কিছুমাত্র জানতেন সোনি মিউজিকের কর্ণধার, সম্পর্কিত প্রতিটি শিল্পী, ‘গেন্দা ফুল’ গানটির গীতিকার, তাঁরা হয়তো বুঝতেন যে মানসিকতা কতোখানি নীচ হ’লে এই আবেগকে লাস্যের রঙ লাগিয়ে পণ্য হিসাবে বিক্রী করা যায়। আজ যখন গণমাধ্যমে বর্তমান প্রজন্মের গানটিকে সমর্থন জানানো দেখি তখন কিছু মনে হোক আর না হোক, প্রতিবাদ দেখলে হাসি তো পায় বটেই। আসল গানটি শুনেছি ক’জনে? ক’টি মানুষই বা জানেন লোকগীতিকার শ্রী রতন কাহারের নাম? আহা ও তো ছোটোলোকেদের জিনিস। গরীব মানুষের। ওসব চর্চা করা সদ্বংশীয় অভিজাতদের মানায় কি? হ’লোই বা সে আদি, হ’লোই বা সে আমাদের শিকড়… বাঙালির মতে আধুনিকতার অর্থই হ’লো পুরাতনকে ভুলে থাকা। ‘আত্মঘাতী’ বিশেষণ তো আর এমনি এমনি আমরা লাভ ক’রিনি, তাই না?