Site icon আলাপী মন

রম্য- কল্কি এলো দেশে (রূপক)

কল্কি এলো দেশে (রূপক)
– সুজিত চট্টোপাধ্যায়

 

 

সত্য কী? সহজ উত্তর, যা মিথ্যে নয়।
পিতৃসত্য কী ?
এইতো প্যাঁচে ফেলে দিলেন। পিতৃসত্য বললেই , মগজে আসবে রামচন্দ্র, বনবাস, রাবণ, সীতাহরণ, লঙ্কাকাণ্ড। মানে হুলুস্থুল ব্যাপার।
আচ্ছা, রামচন্দ্র বনবাস স্বীকার করতে গেলেন কেন। সরাসরি বাপের মুখের ওপর বলে দিলেই হতো…
দূর মশাই , আপনি প্রতিজ্ঞা ফতিজ্ঞা করে উল্টোপাল্টা জট পাকিয়েছেন, আপনি যা পারেন সালটান, আমি বনে গিয়ে লাইফ হেল করতে পারবোনা, ব্যাস।
জঙ্গলে গিয়ে টিপ প্রাকটিস করার সময় খেয়াল ছিল না, আলটপকা অন্য কেউ শব্দভেদী ধনুর্বাণ খেয়ে মারা যেতে পারে , নিদেনপক্ষে উন্ডেড হতে পারে? আপনি তো রাজা। আপনার রাজনৈতিক বিবেচনা কী বলে? পাবলিক নিয়ে কাজ। অন্ধ বাপ মায়ের একমাত্র অবলম্বন ঝপ করে কেড়ে নিলেন। নেহাৎ বিরোধী বলে কিছু নেই , বেঁচে গেছেন। নইলে দেখতেন, ওই এক ইস্যুতে কুপোকাত করে দিতো। রাজ্যপাট হারিয়ে আপনাকেই বনবাস নিতে হতো।

যাক, সেসব কিছু হয়নি। কেন হয়নি? যুগধর্ম। সেই যুগটাই ছিল সত্যের যুগ। সত্যের জন্য যেকোনো বলিদান, আত্মত্যাগ, নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করাই ছিল সুসমাজের রীতি। তাই, সুবোধ বালকের মতো রামচন্দ্র বনে চলে গেলেন। কিন্তু লক্ষ্মণ গেলেন কেন? ওর তো পিতৃসত্য পালনের দায় ছিল না , তবে?
মনে হয়,বাল্মিকী মুনি ভেবেছিলেন, বোধহয়..
রামচন্দ্র , রাজপুত্র বলে কথা। দুম করে একলা বনে গিয়ে সামাল দিতে পারবেন না। একটা সাপোর্টিং ক্যারেক্টর সঙ্গে জুড়ে দিলে পরবর্তী কালে সুবিধেই হবে। সুতরাং চালাও লক্ষ্মণ। একেই বলে দুরদর্শিতা। লক্ষ্মণ না থাকলে কীভাবে সবদিক ম্যানেজ হতো বলুন তো? এইরকম ভাই থাকলে একটা কেন, দশটা রাবণের মাথা কাটা কোনও ব্যাপারই নয়।

কিন্তু, সীতা? তিনি স্বামী সঙ্গিনী কেন হলেন! তিনি অনায়াসে রাজপ্রাসাদের যাবতীয় সুখ ভোগ করতেই পারতেন। কেউ বাধা দেবার ছিল না। অথচ তিনি তা করলেন না। পতি পরম গুরু। এই দৃষ্টান্ত প্রতিষ্ঠা করতে তিনি স্বামীর পদাঙ্ক অনুসরণ করলেন।
এসব সত্য পরায়ণতা প্রকৃতপক্ষে যুগের ব্যাপার।
কালের অমোঘ টানে, সেই যুগ বিদায় নিলো, সঙ্গে নিলো সেই যুগ পরায়নতা।
যুগ কখনও একজায়গায় চুপটি করে ললিপপ খেতে খেতে দাঁড়িয়ে থাকে না। যুগ অর্থাৎ কাল বা সময়। সে ছুটে চলেছে। থামার উপায় নেই। উত্থান পতন, ভাঙা গড়া, ভালো মন্দ সব্বাইকে সঙ্গে নিয়ে সে চলেছে। পরিবর্তন আবার পরিবর্তন, চক্রবৎ পরিবর্তন।
আজকের যুগে দাঁড়িয়ে, সত্যযুগের রীতি প্রত্যাশা করা মুর্খতার সামিল। ভাবুন একবার। সত্য প্রত্যাশা নাকি মুর্খতা। কোন যুগে বাস করছি! সত্যবাক্য, সত্যনিষ্ঠা প্রায় উধাও। তাহলে হাতে রইল কী? লবডঙ্কা। ঠকবাজি আর ঢপবাজির রমরমা জলসা।
ললিতা, আপেল খেতে খুব ভালবাসে। তার স্বামী ললিত, অফিস ফেরতা লাল টুকটুকে আপেল কিনে বাড়ি এলো। ভালবাসার আপেল। ডাইনিং টেবিলের ওপর ফলের ঝুড়িতে সাজানো রইল। দুপুরে টিভি সিরিয়াল দেখতে দেখতে ললিতা খাবে। জৌলুশ বাড়বে। ললিতার ঠোঁটে চাঁদের হাসি। আড়চোখে প্রেমের ঝলক। আহা, আপেল কেনা সার্থক।
পরদিন দুপুরে, ললিতের ফোন বেজে উঠলো। ললিতার তীব্র ঝাঁঝালো কন্ঠস্বর,
-কী আপেল এনেছো শুনি, ওটা আপেল? সারা গায়ে মোম লাগানো। ছুরি দিয়ে কাটতে গিয়ে টের পেলুম। ভাগ্যিস কামড়ে খাইনি। তাহলে তো বুঝতেই পারতুম না। ছি ছি ছি… আমাকে ক্যান্সার ধরিয়ে মারতে চাও.. কান্না..ফোন কাট।
ললিত, অপরাধীর মতো মুখ করে, মাথা নিচু করে বসে রইল। আপেলওয়ালার মুখ, মনের স্ক্রিনে ভেসে উঠছে। ব্যাটা মিথ্যুক, জোচ্চর। এইভাবে ঠকালি, সংসারে আগুন লাগালি! দাঁড়া, তোর দেখাচ্ছি মজা।
আস্ফালনই সার, ললিত জানে, আসলে কিসসু হবে না। বিষ্ঠায় লাথি মারলে, নিজেকেই নোংরা হতে হয় ।
এই হলো যুগধর্ম। মিথ্যের বেসাতি।

সুশান্ত , বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান। তার বাবা নিতান্তই ছাপোষা মানুষ। অনেক লড়াই করে, কৃচ্ছসাধন করে, সুশান্তকে উচ্চশিক্ষা দিয়েছেন।
উপার্জনশীল করে তুলতে তার ভূমিকা মনে রাখার মতো।
সেই ছেলে লায়েক হয়ে উঠলো। বিয়ে থা করে, বাবা-মা কে, টাটা বাই বাই করে কিংবা না করে, আলাদা ফ্ল্যাট কিনে, জবরদস্ত খেলনাবাটি সংসার পেতে ফেললো। এখন, হাম দো, হামারা এক এর যুগ। বাইচান্স কখনো সখনো হামারা দো হয়ে যায়।
আচ্ছা, এবার বলুন, এটা কোন সত্য..
একে বলে নিদারুণ সত্য। একেই বলে যুগসত্য। যে যুগে যেমন। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলো। ভালো মন্দ, ন্যায় অন্যায়, মারো গুলি। স্বার্থপর হও, নিজের আখের গুছোবার ব্যবস্থা দ্যাখো। প্যানপ্যানানি স্মৃতি ফৃতি ডোন্ট কেয়ার। ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করে, “আয় আয় কাছে আয়” করার রাস্তায় নো এন্ট্রি বোর্ড ঝুলিয়ে রাখতে হবে। বউ যেখানে আমি সেখানে, এই ফর্মুলা এপ্লাই করতে হবে জীবনে। বউ যা বলবে তাই শেষ কথা। নিজের কোনও বক্তব্য বা মতামত থাকতে পারে না, থাকবে না। ওল্ডম্যানদের জন্যে, ওল্ড এজ হোম আছে। পুরাকালে বানপ্রস্থে যাওয়ার রেওয়াজ ছিল। কই, তারা তো তাতে দুঃখিত হতো না। বরঞ্চ আনন্দের সাথে তারা তাদের ভবিতব্যকে স্বীকার করে নিতে জানতো। তারা মহানুভব ছিলেন। তাহলে, এখন বৃদ্ধাশ্রমের কথা উঠলেই গেল গেল চিৎকার , কেন রে বাবা ? যত্তসব ফালতু।

সেই রামও নেই , সেই রাজত্বও নেই। কেবল আওয়াজ আছে। আওয়াজ তুলে ভীড় জমাও। ভোটের মেশিনে ফুল ফোটাও। রামলীলা ময়দানে রাবণ যুগের লীলাকীর্তন করো। মনুষ্যত্ব যাক, নাগরিকত্ব থাক।
এবার প্রশ্ন করুন , এটা কোন যুগ ?
নরখাদকের যুগ।
ছিলো নর নারায়ণ, হ’য়ে গেল নর খাদক।
যুগ ধর্ম। পরিবর্তন, কিন্তু কোনদিকে?
ভালবাসা , শ্রদ্ধা , সহনশীলতা, বিশ্বাস, মানবতা, মানে মনুষ্যত্বের সাথে জড়িত সকল সুপ্রবৃত্তি নিম্নগামী। মনুষ্যত্বহীন হীনমন্যতা জাতির অবক্ষয় ডেকে আনে। নর নারায়ণ থেকে নর খাদক।

বাহাত্তুরে ননী ঠাকুমা, তার চালাঘরে সে আজ একা। একদিন অনেকে ছিল। কেউ মারা গেছে , কেউ চলে গেছে , কেউ বা ভুলে গেছে।মারা যাওয়া মানুষ গুলোর প্রতি তার শ্রদ্ধা আছে , চলে যাওয়া মানুষ গুলোর জন্য চিন্তা আর শুভকামনা আছে, আর ভুলে যাওয়া অমানুষ দের জন্য আছে করুণা।
ননী ঠাকুমা আজও একলাই আগলে রেখেছে শ্বশুরের ভিটে। উঠোনের তুলশী গাছ টা শুকিয়ে গেছে। তবুও, অভ্যেস বশত সন্ধ্যায় ধুপ দেখায়, জল দেয়। কেউ কেউ হেসে বলে,
_ মরা গাছে জল ঢেলে কী হবে ঠাকুমা , ও গাছ কী আবার বেঁচে উঠবে ?
ঠাকুমা হেসে বলে,
_ মাটিতে ওর মঞ্জরী ছড়িয়ে আছে রে বাপ। ওরা জেগে উঠবে। নতুন সবুজ চারা। আশা মরে না রে বাপ, স্বপ্ন বেঁচে থাকে ভালবাসা আর ইচ্ছের কোলে। রাতের আঁধারের ওপারেই আছে নতুন সকাল।

টিভিতে প্রচারিত বিজ্ঞাপন গুলোর দিকে তাকিয়ে মনে হয় , স্বর্গের নন্দনকাননে বসে আছি। পৃথিবীতে যেন কোথাও কোনও দুঃখ কষ্টের লেশমাত্র নেই। অনাহার নেই , অপুষ্টি নেই , অসহ্য অনাদর অসম্মান নেই , নির্দয় প্রতারণা নেই , ধর্ষন নেই। কেবলই উচ্ছ্বাস, আবেগ মথিত উল্লাসে উৎসবমুখর জীবন। মেনকা রম্ভা উর্বশী দের উন্মুক্ত আনাগোনা। আহা, চোখ জুরিয়ে গেল। প্রাণে অফুরন্ত বসন্তের হিল্লোল। যেন কল্পতরু বৃক্ষের নিচে বসে, কামধেনু গাভীর দুগ্ধ পান করছি। আহা, কী আনন্দ,
মনের সুখে গান আসবে গলায়,
“আয় সবে সহচরী, হাতে হাতে ধরি ধরি
নাচিবি ধিরি ধিরি, গাহিবি গান “

Exit mobile version