আদালত
– রাখী চক্রবর্তী
সুত্রধর জানো তো, তোমার তোলা এই ছবিগুলোর টানেই তোমার বাংলোতে আমায় আসতে হয়। কোথায় ছবিগুলো তুলেছো এখনও বললে না। জঙ্গলের দৃশ্য আমার মনটাকে বড় নাড়া দেয়। বিশেষ করে এই ছবিটা, দু’ধারে শাল বাগান মাঝখানে সরু রাস্তা, শেষ যেখানে রাস্তাটা হয়েছে তার সামনে জলাশয়টা বেশ আবছা দেখাচ্ছে।ছবিটা দারুণ তুলেছো। কিন্তু খটকা লাগে তোমার মতো নামী ফটোগ্রাফার ফিনিশিংটা কেন এমন করলো।
– সিগারেটে টান দিতে দিতে সুত্রধর বললো, না না দাস বাবু ওতোসতো ভেবে ফটোটা তুলিনি। সন্ধ্যা ঘনিয়ে রাত হতে লাগলো তখনও আমি জঙ্গল থেকে বের হওয়ার রাস্তা খুজে পাচ্ছিলাম না। মাথায় অনেক চিন্তা ছিল সেই সময়। জাস্ট ক্যামেরা নিয়ে একটা জঙ্গলের ফটো তুললাম। এই..আর কি।
– হ্যাঁ, সেইটাই তো জানতে চাইছি কোন জঙ্গল এটা? আমিও যাব।
– তোমার কি মরার শখ হয়েছে?
– ওও তুমি গেলে যখন তখন বুঝি তোমার বাঁচার শখ হয়েছিল!
– আমারটা জাস্ট হবি।
আর ইচ্ছে করেই জায়গার নাম তোমাকে বলছি না। যা জেদি তুমি। কখন চলে যাবে!
এই ছবিগুলো দেখে দেখে আমি রোজ বাঁচি নতুন ভাবে।
– কি বললে! আবার বলো
– আজ মনে হয় ঝড় বৃষ্টি হবে আকাশটা কেমন দুম হয়ে আছে। তুমি তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে যাও দাস বাবু। ঝড়ঝাপটা শুরু হলে বিপদে পড়ে যাবে।
– তাড়িয়ে দিচ্ছো। তা দাও। কিন্তু আমার তোমার এখানে থাকতে ভালো লাগে।
– অনেক বার বলেছি বৌদিকে একবারও তো নিয়ে এলে না। আমাকেও তোমার বাড়ি নিয়ে গেলে না।
– বিয়ে শাদি তো করলে না। বৌয়ের মুখ ঝামটা শুনে আর বৌকে নিয়ে কোথাও যেতে ইচ্ছে করে না।
সুত্রধর তুমি আর আমি যদি একসঙ্গে থাকি আজ রাতে। পারবে না আমাকে ভালবাসতে? ঐ দেখো নীলাকাশ কি সুন্দর ঝড়ের পূর্বাভাস দিচ্ছে। ভেসে বেড়াব তুমি আমি নীল আকাশে..
– আহ্ হাত ছাড়ো। কি হচ্ছে! আহ্ সাপের মতো জড়িয়ে ধরে আছো কেন? ছাড়ো বলছি..
– আমি তোমাকে আজ ছাড়বো না। যতই তুমি ছেলে সাজতে চাও না কেন আমি ধরে ফেলেছি তুমি একজন নারী। তোমার কন্ঠস্বর তোমার চলনবলন যতই পুরুষালি হোক না কেন আমি সিওর তুমি নারী। আজ তুমি আমাকে সঙ্গ দেবে সারারাত। আমার হাত থেকে পালাবে কোথায় ডার্লিং?
-আলোটা নিভালো কে?
-সুত্রধর তুমি কোথায়? ঝড়বৃষ্টিতে কোথায় গেলে? দরজাটা কে খুললো?
সুত্রধর..সুত্রধর আমাকে ছেড়ে দাও কোথায় নিয়ে যাচ্ছ? ভালো হবে না বলে দিচ্ছি, নিজেকে পুলিশের হাতে তুলে দাও, রাজসাক্ষী হয়ে যাও,আমি কথা দিচ্ছি সাজা কম করে দেবো তোমার।
– দাস বাবু অনেক কিছু জেনে গেছো তুমি, এবার মরবে তুমি।
খুব জানতে ইচ্ছে করে না ছবিটা কোথায় তুলেছি। চলো দেখবে চলো।
– সুত্রধর, আমি কে তুমি জানো না, আমি সি.আই.ডি. অবনি দাস। পুলিশ তোমাকে গুলি করে ঝাঁঝড়া করে দেবে।
– এই দেখো দাস বাবু সেই জঙ্গল সেই আবছা জলাশয় ।
আর্তনাদ শুনতে পাচ্ছো কি? বাঁচাও.. বাঁচাও হ্যাঁ আমিও একদিন চিৎকার করে বলেছিলাম মেরো না আমার মা, বাবা ভাইকে। ওরা শোনেনি। তাই আমার আদালতে আমিই জজ, আমি উকিল। কেউ রেহাই পাবে না। তুমি ও না।
– আমাকে পুরো ঘটনাটা বলো, কি হয়েছিল তোমার পরিবারের সাথে?
– তার আগে বলো বন্ধুত্বের সুযোগ নিয়ে আমাকে ঠকিয়েছো কেন? কেন? জবাব দাও। বিশ্বাস করেছিলাম তোমাকে ।
– বলছি সব বলছি, পামেলা দে নামে একটি খুনি মেয়েকে পুলিশ তন্ন তন্ন করে খুঁজেও যখন তার হদিস পাইনি তখন আমার ডাক আসে লালবাজার থানা থেকে। তারপর পামেলার ডিটেলস্ পেলাম। আমি কেসটা নিয়ে বেশ চিন্তিত ছিলাম। একের পর এক মার্ডার। সমাজের বিখ্যাত শিল্পপতি ছেলেদের খুন করছে। চারটে অলরেডি হয়ে গেছে। গত তিন মাস আগে আমি এই কেস হিসট্রিটা নিয়ে গঙ্গারাম পুর আসি। যেদিন তোমার সাথে আমার দেখা হলো মানে আমি জল খেতে চাইলাম তুমি তখন বাংলো থেকে বের হচ্ছিলে সন্ধ্যে বেলায়।
-মনে আছে।
তুমি সুন্দর মেকআপ করে মেয়ে থেকে ছেলে হয়েছো কিন্তু তোমার ভ্র দু’টো দেখে আমার সন্দেহ হয়েছিল। পামেলার ফটোর সাথে তোমার মুখ বারবার মেলাতে চেষ্টা করি।কোথায় পামেলার হৃস্টপুষ্ট দোহারা শরীর আর কোথায় কাঠকাঠ হাড় পাজরা বের করা তোমার শরীর। তবুও সন্দেহ আমার হয়েছিল। আমি শেষ দেখার জন্য তোমার সঙ্গে বন্ধুত্ব করি। রোজ তোমার কাছে আসা জঙ্গলের ছবি সম্পর্কে জানা সবটাই আমার কাজের সুত্রের জন্য। তুমি পুলিশের সাহায্য না নিয়ে নিজেই বিচার করেছো এ তোমার বিরাট অপরাধ।
– টর্চের আলো চারদিক থেকে কে ফেলছে?
– পালাবার পথ নেই তোমার কাছে। পুলিশ ফোর্স এসেছে। স্যারেন্ডার করো।
পামেলা দেবী। তোমার বাংলোতে পুলিশ পাহারা ছিল তুমি টের পাওনি।
– থামুন। দৌড়াবেন না। গুলি চালাতে বাধ্য হবো।
পুলিশের গুলি পামেলা দে ওরফে বিমান সুত্রধরের পায়ে লাগল। সি.আই.ডি. অবনি দাস পুলিশের সাহায্য নিয়ে জলাশয়টা পরিষ্কার করার ব্যবস্থা করছে ততক্ষণে জঙ্গলের ভেতরে শাল গাছের ফাঁক দিয়ে সূর্য দেব দেখা দিয়েছে। ভোরের আলোতে জলাশয় সহ পুরো জঙ্গলটা পুলিশ তদন্ত করে দেখছে কিছু রহস্যের জট যদি খোলা যায়। এদিকে পামেলাকে পুলিশ কোর্টে চালান দেবে আজ।
জলাশয় থেকে বস্তা বন্দী চারটে পচাগলা মৃতদেহ উদ্ধার করেছে পুলিশ।
মিডিয়ায় এই খবর প্রচার হতেই, আলিপুর কোর্ট চত্বরে ভিড় উপছে পড়ছে পামেলাকে দেখার জন্য।
– অর্ডার.. অর্ডার.. আসামির পক্ষে কোনও উকিল নেই। আসামির বিপক্ষের উকিলের সাওয়াল জবাব শুরু হল,
পামেলা দেবী আপনার জবানবন্দিতে কিছু বলার থাকলে বলুন।
পামেলা দে বলতে লাগলো, হুজুর বাবা, মা, ভাই এই নিয়ে খুব ভালো ছিলাম আমরা।আমি কলেজে পড়তাম। ফটোগ্রাফি হবি ছিল। ভাই স্কুল, ক্লাস সেভেনে পড়তো। বাবা রেলে কাজ করতো।
আমার সাথে কলেজে পড়তো পরিবহন মন্ত্রী রবি ওঝার দিদির ছেলে কমলেশ। কমলেশ নানা ভাবে আমাকে উত্যক্ত করতো।কলেজে, রাস্তায়। যেখানেই আমি যেতাম।একদিন রাত্রি আটটার সময় আমি টিউশন করে বাড়ি ফিরছিলাম। কমলেশ আমার জামা ছিঁড়ে দিয়ে রাস্তায় উল্লাস করছিলো।আমি ওকে থাপ্পড় মেরে বাড়ি ফিরে আসি।
তারপর দু’দিন কলেজে যাইনি আমি।
সেদিনটা রবিবার ছিল। মে মাসের দশ তারিখ। রাত্রি বেলায় কমলেশ ছয়জন গুন্ডাকে সঙ্গে নিয়ে আমাদের বাড়ি চড়াও হয়। আমার ভাই মা বাবাকে বেঁধে রেখে আমার ওপর পাশবিক অত্যাচার করে ওরা সবাই। তারপর আমার পরিবারের সবাইকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে কুপিয়ে মেরে ফেলে। সে রাতের ঘটনা আমার কাছে আজও দগদগে হয়ে আছে। প্রতিশোধ নিতে হবে আমাকে। আমার গোলগাল চেহারাকে আমি কাঠামোতে পরিণত করেছি। শুধু মাত্র ওদের নিজের হাতে শাস্তি দেব বলে। তারপর নিজেই আদালত হয়ে নিজের নাম পাল্টে নির্জন জায়গায় থাকতে শুরু করি।চারজনকে মেরে জলাশয়ে পুঁতে দিয়েছি। এখনও দু’জন বাকি আছে। আদালত যখন আমাকে ন্যায় বিচার দিতে পারেনি তখন আইন নিজের হাতে তুলে নিয়ে কোনো অন্যায় আমি করিনি ।
পরিবহণ মন্ত্রী রবি ওঝা আদালতে চিৎকার করে বলছেন, কমলেশের খুনির ফাঁসি চাই, ফাঁসি।
আদালত কক্ষ গুঞ্জনে ভরে গেল। পামেলার চোদ্দ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড ধার্য হল।
সি.আই.ডি. অবনি দাস পামেলার সামনে গিয়ে বললেন তোমাকে বাঁচতে হবে পামেলা। প্রতিশোধের জ্বালায় জ্বলে তুমি শুদ্ধ হয়ে গেছো। চোদ্দ বছর বেশি না। সুস্থ ভাবে তুমি বাঁচবে। তোমার সাজা কম যাতে হয় তার ব্যবস্থা আমি করবো। জেলে তুমি পড়াশোনা করবে।
তারপর দিন মাস যায়। পামেলা আইন নিয়ে পড়তে লাগলো। আইনি পরীক্ষায় পাস করে পামেলা আইনজীবী হল।
নির্যাতিতা মহিলাদের নিয়ে একটি সংগঠন তৈরি করে তাদের মনোবল বাড়াতে লাগলো পামেলা।
পামেলা সব হারিয়েও জিতে গেছে আজ।সমাজে এক দৃষ্টান্ত হিসাবে রেখে দিল নিজের হাতে তৈরি সংগঠন “নারী নিকেতন ” যেখানে শেখানো হয় ভয়ে ভয়ে নারীরা বাঁচবে না আর সাহসী হয়ে এগিয়ে যাবে পথ যতই দুর্গম হোক। নারী শক্তির জয় হবেই হবে।
সমাপ্ত