হাত
– দেবস্মিতা ঘোষ
প্লেনটা এয়ারপোর্টের মাটি ছাড়তেই একটু নিশ্চিন্ত হল তিন্নি। সপ্তাহের মাঝখানে হঠাৎ ছুটি পেতে খুব সমস্যা হত শুধু রবার্ট ছিল বলে সুযোগটা পেয়েছে। তিন্নির বন্ধু রবার্টৈর সাথে ওর বসের ভালো জানাশোনা আছে। তাই তিন্নির দরকার অনুযায়ী এক সপ্তাহ ছুটি পেতে অসুবিধা হয়নি। সিডনি থেকে কলকাতা যেতে মোটামুটি এগারো বারো ঘণ্টার বেশি লাগে না, সেই হিসাবে কাল সকাল দশটার মধ্যে পৌঁছে যাবে ও। কিন্তু তারপর কি করবে ও সেটা কল্পনা করতেই ওর মাথায় চিন্তার মেঘ ঘনিয়ে এল।
রাত তিনটে নাগাদ কলকাতা থেকে ফোন পেয়ে খুব একটা অবাক হয়নি ও। সিডনিতে আশার পর থেকেই সময়ের ব্যবধান বুঝতে তিন্নির বাড়ির লোকের একটু সময় লাগছে। ফোনের ওপারে বছর এগারোর রিমির গলা শুনে অবাক হয়েছিল তিন্নি। রিমি ওর মামার মেয়ে। তিন্নির মায়ের একটি মাত্র ভাই, ওর সুবল মামা। তার এক ছেলে অনুভব আর এক মেয়ে রিমি। রিমি কাঁদতে কাঁদতে যা বলল তার মর্মে তিন্নি শুধু এটুকু বুঝলো বছর একুশের অনুভব দু’দিন ধরে হাসপাতালে ভর্তি। সম্ভবত সুইসাইড করার ব্যর্থ চেষ্টা। রিমির পক্ষে পুরোটা বোঝা সম্ভব হয়নি। ওর মা বাবা ওকে দাদার সাথে দেখা করতে দেয়নি, দাদার ব্যাপারে কিছু জানায়নি। চিন্তিত রিমি তাই ওর তিন্নিদিকে লুকিয়ে ফোন করা ছাড়া কিছু ভাবতে পারেনি। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ফিরবে আশ্বাস দিয়ে তিন্নি ফোন রেখেছিল। অনুভব আর তিন্নির সাথে ওর খুব ভালো সম্পর্ক। সেই অনুভব কেন সুইসাইড করবে ভেবে পেল না ও। একটু স্পর্শকাতর হলেও তুচ্ছ কোনও কারণে ভেঙ্গে পরার মত ছেলে অনুভব নয় তা খুব ভাল করে জানে তিন্নি। ছোট বেলায় অনুভবের ব্রেন টিউমার দেখা দেয়ার জন্য বেশ কিছু ব্রেন সার্জারি করতে হয়েছিল ওকে। পরিবারের সবাই উদ্বিগ্ন থাকলেও অনুভবকে কখন চিন্তিত লাগেনি। সেই ছেলে কি কারণে নিজের জীবন দিতে চেয়েছিল।
কলকাতায় এসে সোজা মামারবাড়িতেই গেল ও। জানতো ওর মা বাবাও এখানে থাকবে। ওকে দেখে ওর মামিমা আর ওর নিজের মা দু’জনেই অবাক হয়ে গেল। রিমি এসে ওকে জড়িয়ে ধরলো। ওরা দু’জনেই বুঝতে পারলো তিন্নিকে খবর কে দিয়েছে। রিমিকে কেউ কিছু বলার আগেই তিন্নি বলল, ’’তোমরা কেউ ওকে কিছু বলবে না। ব্যাপারটা কি চলছে বলতো? আমাকে কি বাড়ির মেয়ে বলে মনে করোনা? দেশের বাইরে বলে একটা খবর দেয়ার প্রয়োজন মনে করোনা।‘’ ওর মামিমার চোখে জল দেখে চুপ করে গেল তিন্নি। তিন্নির মা বললেন, ‘’দেখ তিন্নি না জেনে বুঝে চেঁচামেচি করিস না। ঠাণ্ডা মাথায় শোন সবটা। এরকম একটা লজ্জাশীল ব্যাপার জানাজানি হলে খারাপ হবে বলেই তোকে জানানো হয়নি। আর অনুভব ভালো আছে কাল হয়ত বাড়ি চলে আসবে।‘’
‘’কিন্তু ভাই এরকমটা করলো কেন সেটা কি কেউ বলবে আমায়? আর লজ্জাকর ব্যাপার বলতে কি বোঝাতে চাইছো একটু খুলে বলবে কি? সুইসাইড কবে থেকে লজ্জাকর ব্যাপার হয়ে গেল’’ ওর মা আর মামির এত চুপচাপ ভাব আর নিতে পারছিল না তিন্নি। ওর অবস্থা দেখে ধীরে ধীরে ওর মামিমা পুরোটা খুলে বললেন। ‘’আগের শনিবার তোর মামার বন্ধু চিরাগের বিবাহবার্ষিকীতে নিমন্ত্রণ ছিল। আমরা সবাই গেছিলাম। অন্য সব অতিথি চলে যাবার পর শুধু আমরাই ছিলাম। রিমি ঘুমিয়ে পরেছিল। আমরা গল্প করছিলাম। অনুভব চিরাগের মেয়ে প্রিয়ার সাথে পাশের ঘরে টি ভি দেখছিল। হঠাৎ প্রিয়ার চিৎকারের শব্দে আমরা সবাই ওখানে গিয়ে দেখি অনুভব এক হাত দিয়ে প্রিয়ার শার্টের বোতাম খোলার চেষ্টা করছে…’’ উনি আবার কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন। ‘’ চিরাগ গিয়ে টেনে প্রিয়াকে সরিয়ে আনেন। উনি যা তা বলেন তোর মামাকে। পুলিশে যাবার ভয় দেখান। শেষে আমরা সবাই প্রিয়ার কাছে ক্ষমা চাই। অনুভবের গায়ে হাত তোলেন, আমি আটকাতে পারিনি… কথা বন্ধ হয়ে যায় ওর সাথে। তার কিছু দিন পরই এই…।‘’ উনি চুপ করে যান। হঠাৎ রিমি বলে উঠে, ’’শুধু বাবার কথা বলছো কেন মা… তুমিও তো দাদাকে বাজে বাজে কথা বলেছিলে। কথা অবধি বলতে না ওর সাথে, আমাকেও কথা বলতে দিতে না।‘’ তিন্নির মা রিমিকে নিয়ে ঘরে চলে যান।
তিন্নির দিকে চেয়ে ওর মামিমা বলে উঠেন, ’’কি করতাম বল তো… যত বার জিজ্ঞেস করেছি কেন এমন করলি বারবার সেই একই কথা… ওর বাঁ হাত নাকি ওর আয়ত্তে ছিল না, ও নাকি ইচ্ছা করে করেনি এসব…কি করতাম আমি বল’’ তিন্নি এতক্ষণ কিছু বলেনি। ওর মাথা কাজ করছে না। ও উঠে ভিতরে চলে গেল। স্নান খাওয়া করে বিছানায় শুতেই ওর ঘুমিয়ে পরার কথা। কিন্তু অনুভবের কথা ভেবে ভেবে ওর আর ঘুম আসছিল না। রিমি এল ওর ঘরে, ’’হসপিটালে যাবার আগের দিন দাদা আমাকে বলেছিল যদি তুমি আসো তো তোমাকে এটা দিতে। আমি লুকিয়ে লুকিয়ে নিয়েছিলাম। মা আমার সাথে দাদাকে কথা বলতে দিত না’’ রিমি ওর হাতে একটা ডাইরি দিয়ে চলে গেল। এমনিতেও ঘুম আসছিল না, তাই ও পড়তে আরম্ভ করল। ডাইরিটা পড়ার পর ওকে ইন্টারনেট খুলে কিছুটা সময় দিতে হল। বিকালে অনুভবকে দেখতে যাওয়ার আগে ও কিছুটা নিশ্চিন্ত ছিল। অনুভবকে চিনতে ওর কোনদিন ভুল হয়নি, এই ব্যাপারটাই তিন্নিকে স্বস্তি দিয়েছিল। হাসপাতালে গিয়ে ওর মামার সাথে দেখা হয়।
‘’দিদি ফোন করে বলেছিল তুই আসবি। আমি তাহলে বাড়ি যাচ্ছি। এমনিতে এখানে থেকে তেমন কিছু করার নেই আমার। ও ভালই আছে। কাল বাড়ি নিয়ে যাব। কিন্তু কারুর সাথে কথা বলেনি সুস্থ হওয়া অবধি। ডাক্তার চেনাশোনা বলে সুইসাইড কেস হয়েও পুলিশ আসেনি। দেখ তোর সাথে কথা বলে কিনা’’
‘’ঠিক আছে মামা, তুমি যাও। আমি দেখছি’’
তিন্নিকে দেখা মাত্র অনুভব উঠে বসল।‘’ তিন্নিদি, আমি… ‘’ অনুভবকে শেষ করতে না দিয়েই তিন্নি বলল, ’’আমি জানি অনুভব। আমি সব জানি, আমাকে কিছু বোঝাতে হবে না। তুই চিন্তা করিস না । আমি সব ঠিক করে দেব।‘’ তিন্নি অনুভবের পাশে বসে ওর একটা হাত ধরলো। ‘’তুমি আসতে এত দেরি করলে কেন দিদি’’ অনুভবের চোখে জল।‘’ আমাকে কেউ জানাই নি রে, কিন্তু এত কিছু করার আগে তুই আমাকে একবার জানাস নি কেন? একবার ফোন করতে পারতিস।‘’ তিন্নিও আর নিজেকে সামলাতে পারল না।‘’ বাবা ফোন নিয়ে নিয়েছিল। কেউ বিশ্বাস করছিল না আমার কথা। আমি নিজেও জানি না কি হচ্ছে এইসব। তারপর মা বাবা… আমি আর পারছিলাম না দি।‘’। তিন্নি এবার বললো, ’’তুই আর ভাবিস না। আমি কাল তোকে নিয়ে যাব। সবাইকে সব বুঝিয়ে দেব।‘’
পরের দিন সকালে তিন্নি একা গিয়েই অনুভবকে হাসপাতাল থেকে নিয়ে এল। সাথে রিমিও ছিল। এতদিন পর দাদাকে দেখে ও খুব খুশি হয়েছে। বাড়ি ফিরে অনুভব রিমি আর তিন্নি ছাড়া কারুর সাথে কথা বলেনি। বিকালে তিন্নি সবাইকে এক ঘরে ডাকল। রিমি কেও। ‘’আমি সবাইকে ডেকেছি, বেশি সময় নেব না। আধ ঘণ্টা মত হলেই হবে।‘’
তিন্নির বাবা বললেন, ‘’যা বলবি তাড়াতাড়ি বল। অনুভবের এখন রেস্ট দরকার’’
‘’তার থেকেও বেশি দরকার ওর এই কথাগুলো শোনা। আমি ওকে আমার সাথে সিডনি নিয়ে যাব, ওর চিকিৎসার জন্য। এখানেও হতে পারত কিন্তু আমি ওকে আমার সাথে নিয়ে যেতে চাই। ওর কোনও আপত্তি নেই, বাকিটা তোমরা ভাবো।‘’
‘’আমরা তো কিছুই বুঝতে পারছিনা। ও তো সুস্থ আবার কিসের চিকিৎসা। কি বলতে চাইছিস তুই?’’ তিন্নির মামিমা বললেন।
‘জানিনা তোমরা কতটা কি বুঝবে। সব কিছু শুনে আমি প্রথমেই খুব অবাক হয়েছিলাম। অনুভবের সাথে আবার খুব ভালো সম্পর্ক। অনুভব যে এরকম কিছু করতে পারে তা আমি কখনও মানতে পারছিলাম না। তারপর রিমি আমকে ওর ডাইরি দেয়। মামিমা তোমাকে তো ও আগেও বলে ছিল যে ওর মাঝেমাঝে মনে হয় ওর বাঁ হাত ওর কন্ট্রোলে নেই। তুমি কোনোদিন বিশ্বাস করো নি। কিন্তু সেদিন যখন দেখলে ও বাঁ হাত দিয়ে প্রিয়ার গায়ে হাত দিচ্ছে তোমার একবারও কিছু মনে হল না? নিজের ইচ্ছায় করলে ও স্বাভাবিক ভাবে ডান হাত ব্যবহার করতো। যাইহোক, তোমরা এতদিনে নিজের ছেলেকে চিনলে না। একটু তো বিশ্বাস করতে পারতে। অনুভব একটা খুবই বিরল রোগে আক্রান্ত। আমিও প্রথমে বুঝতে পারিনি। কিন্তু ওর অপরে আমার বিশ্বাস ছিল তাই ওকে ভুল বুঝিনি এক বারের জন্য। আমার অস্ট্রেলিয়ার এক ডাক্তার বন্ধু, ওকে ফোন করতে ওই ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলেছে। এলিয়েন হ্যান্ড সিন্ড্রোম। এতে মাঝেমাঝে কম ব্যবহৃত হাতের ওপর থেকে মাঝে মাঝে রোগীর কন্ট্রোল চলে যায়। বিশেষত বাঁ হাত। নিজের অজান্তেই রোগীর হাত নানা কাজ করতে থাকে যেমন জামার বোতাম খুলে দেওয়া, মাথায় হাত দেয়া, কোনও জিনিস ফেলে দেওয়া এইসব। রোগী চাইলেও কন্ট্রোল করতে পারে না। কখনও দশ মিনিটের জন্য কখনও আধঘণ্টার জন্য। এর আগেও অনুভবের সাথে এরকম হয়েছে। তখন কেউ ওর কথা শোনেনি। সেইদিনও এটাই হয়েছিল। ওর হাতের ওপর ওর আয়ত্ত ছিল না। আর প্রিয়াও ওর খুব কাছে বসে ছিল। ওর কোনও দোষ ছিল না। বিনা দোষে ওকে কি রকম মানসিক নির্যাতনের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে তোমরাই ভাবো। যদি সাহস করে রিমি আমাকে ফোন না করতো তাহলে কি হত বোলো। কিন্তু সবচেয়ে বড় কথা বিশ্বাস। ওর মা বাবা হয়ে তোমরা ওকে বিশ্বাস করো নি। যাইহোক, আমি ওকে আমার সাথে সিডনি নিয়ে যাব। সব ঠিক হয়ে যাবে অনুভব চিন্তা করিস না।‘’ ঘরের সবাইয়ের মুখে চোখ বুলিয়ে ও থামল।‘’
‘’আমাদের ভুল হয়ে গেছে, আমাকে ক্ষমা করে দে।‘’ অনুভবের মা বাবা ওর দিকে এগিয়ে গেলেন। অনুভব কিন্তু হাসি মুখে এগিয়ে এসে তিন্নির হাত তা ধরলো।
একটু আলাদা কিছুর স্বাদ পেতে চিরকালই ভালো লাগে। এবারেও ঠিক তেমনি হল। এটা শুধুমাত্র কল্পনার উপর ভিত্তি করে লেখা কোনো গল্প নয় … এতে অনেক বাস্তব তথ্যও রয়েছে। এই অদ্ভুত রোগটির সম্পর্কে আমি প্রথম এই গল্পটি পরেই জানতে পারলাম। ধন্যবাদ জানালাম না তবে এইরকম আরো গল্পের অপেক্ষায় রইলাম…
Thnks