Site icon আলাপী মন

গল্প- এ তুমি কেমন তুমি

এ তুমি কেমন তুমি
          –  রাণা চ্যাটার্জী

 

 

না বাবা, তুমি মাকে ওভাবে বাজে লোকের হাতে তুলে দেবে না। প্লিজ বাবা, তোমার দু’টি পায়ে পড়ি। আমায় নিয়ে চলো বরং যা বলবে শুনবো। মায়ের লাগছে বাবা, ছাড়ো। টানা হ্যাঁচড়ায় প্রত্যাঘাত করতে ব্যর্থ লতা কান্নায় হতাশ কিন্তু তার মাকে রক্ষা করবে কি করে বাবা রূপী মানুষটার ভয়ঙ্করতা থেকে!

মাধবীর শরীরটা উত্তেজনায় থরথর কাঁপছে। এই মানুষটাকে কিনা ভরসা করে ভালবেসেছিল! অবিশ্বাস যত কড়া নাড়ছে, অসীমের পুরুষালী হাতটা ততো বাগে আনতে চাইছে মাধবীকে। আজ মাস দেড়েক পর মদে টইটম্বুর হয়ে পাশবিক আচরণের শক্তি সঞ্চয়ে অঘটন ঘটাতে মরিয়া।

উল্লসিত দেঁতো হাসিতে অসীম পাঁজাকোলা করে বাইরে নিয়ে যেতে উদগ্রীব শান্ত নিরীহ মাধবীকে। লতা কোথা থেকে আধলা ইঁট কুড়িয়ে  মাথার ওপর সজোরে মারতেই আঁক করে বসে দৌড় দিলো বিশ্বাস ঘাতক। মুহূর্তেই মা-মেয়ে ভয়ে আশঙ্কায় পরস্পরকে জড়িয়েও কান্না মুছে ঝেড়ে মেরে উঠলো, যেন এক মৌন শপথ
“অনেক হয়েছে-আর নয়”।

রেল কলোনির প্রাইমারি স্কুলে ক্লাস থ্রিতে পড়া মাধবীর মেয়ে লতা, কি ভাগ্যিস দুপুরে বাড়ি এসেছিল বাথরুম করতে। স্কুলে ওইটুকু সব ছাত্ররা থাকলে কি হবে, মেয়েদের বাথরুমের ভাঙা দরজার দিকে হাঁ করে এমন তাকিয়ে থাকে, মেয়ের মুখে কথাটা শুনেই মায়ের পরামর্শে  টিফিনে বাড়িতে বাথরুম আসে। আজ ঝুপড়ি ঘরের চৌকাঠে পা রাখতেই এ দৃশ্যে হতচকিত লতা। বাবার হম্বিতম্বি,”এডভান্স নিয়েছি, মুখ পুড়বে যেতেই হবে শালী তোকে, কলকাতার শেঠ-ইস কি ভাষা, মানুষটা কিনা এত নোংরা, ভাবতেও কষ্ট!

 এ বয়সেই একি দেখছে লতা! এই মানুষটাই কিনা ভালো করে বাঁচার স্বপ্ন দেখিয়েছিলো তাদের। পরোপকারী হাত বাড়িয়ে বাঁচার রসদ, তবে কি এই নোংরামি দেখার জন্য, শিশুমনে হাজার প্রশ্নের ঢেউ!

বছর খানেক আগে অসীম আলিপুরদুয়ার জংশনে আলো-আঁধারি জনমানবশূন্য সন্ধ্যায় মাধবী ও শিশুকন্যাকে অঝোরে কাঁদতে দেখে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে ছিল।সুনসান স্টেশন মোটেই নিরাপদ নয় বুঝে সাথ দিয়ে এনেছিল মালদায়। সত্যি তার মধ্যে এমন নোংরামি, অসাধু উদ্দেশ্য ছিল না। প্রথম দেখায় কারুর ওপর এমন সন্দেহ আসা স্বাভাবিক হলেও ব্যবহারের আন্তরিকতায় পেয়েছিল ভরসার আশ্রয়। কপালের দোষে ঘর থেকে শাশুড়ি যেভাবে স্বামীর মৃত্যুর তিনরাত্রি পার হতে না হতেই ঝেঁটিয়ে বিদেয় করেছিল, গ্রামের এতগুলো মানুষের মাঝে তখনই লজ্জায় ঘেন্নায় অপমানে মাথা নিচু করে এক কাপড়ে বেরিয়ে আসতে বাধ্য হয় মেয়েকে নিয়ে মাধবী। সেদিনের এক রাশ আশঙ্কার কালো মেঘ, চোখের জল সঙ্গী করে অজানার উদ্দেশ্যে তার পাড়ি শহর আসার শেষ বাসে ঘোমটা আড়ালে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে।

একমাত্র সহায় সম্বল ভরসার মানুষ, তার স্বামী টানা দশ দিনের জ্বরে বেঘোরে মারা যেতেই অথৈ জলে পড়ে লক্ষী প্রতিমার মতো শান্তশিষ্ট মাধবী। দু’চোখে স্বপ্নের জাল বুনে, মেয়েকে অনেক আশা ভরসায় স্কুলে ভর্তি করানো যে এভাবে হোঁচট খাবে কল্পনাতেও ভাবে নি। একটা মৃত্যুই সব শেষ করে দিলো! পাছে দু’ মুঠো খাবারের দায় নিতে হয় ,”যা বেরিয়ে যা ঘর থেকে অলক্ষী মাগী, আমার জ্বালা জুড়াবে, পারবো না বসিয়ে খাওয়াতে” স্বামীর মৃত্যু যন্ত্রণা সঙ্গে শাশুড়ির এমন ঘাড়ধাক্কা অপমান নিতে পারেনি তিনকুলে কেউ না থাকা মাধবীর।

কোথায় যাবে কি করবে বাইরের দুনিয়াটা কেমন বিন্দুমাত্র ধারণা না থাকা দু’টোতে গুটিগুটি পায়ে স্টেশনে আসতেই ধূলিঝড়ে থমথমে চারিদিক। সামান্য দু’ চার জন কুলি, প্যাসেঞ্জারের জটলা। দূর থেকে অসীম ঠিক কিছু একটা আন্দাজ করেছে। একসময় আর্ট কলেজে পড়া খামখেয়ালি ছেলেটি পয়সার অভাবে স্বপ্ন পূরণ করতে না পারলেও প্রকৃতির প্রতি অমোঘ আকর্ষণে বেরিয়ে পরে। আজ  দুপুরে চা বাগানে এক আদিবাসী কন্যার ছবি এঁকে মালিককে বিক্রি করে কিছু টাকা পেয়ে উৎফুল্ল। রাতের ট্রেনে ফিরবে সে জন্য স্টেশনে আসা।

শুনশান সান্ধ্য পরিবেশে মহিলা-শিশুকন্যাটি  দেখে থমকে অসীম। “আরে না না ভয় পাওয়ার কিছু নেই- কাঁদছো কেন তোমরা? বাচ্চাটি ভয়ে মায়ের কোলে সেঁধিয়ে, অসীম পরিবেশ হালকা করতে বললো, “কোন অসুবিধা না থাকলে বলতে পারেন ভরসা করে।” নিরুপায় মাধবীও বুঝতে পারছে রাত বাড়বে এখানে মেয়েকে নিয়ে থাকা বেশ চাপের। ভরসায় অল্প কিছু বলতেই স্তম্ভিত হয়ে অসীম জানালো “যদি কিছু মনে না করেন, যখন বেরিয়ে পড়েছেন দুগ্গা দুগ্গা করে চলুন আমার সঙ্গে, কথা দিলাম  ক্ষতি করবো না”।

স্বামী  মারা যাবার পর কেউ এভাবে  আন্তরিকভাবে ভরসা দেয় নি। ভেতর থেকে বুক ফাটা কান্না কেউ যেন উস্কে দিলো। অসীম বলেই চলেছে,”আমার বাড়ি বলতে কিছু নেই, পিছুটানও। পরিবার-পরিজন না থাকার কষ্টটা আমি বুঝি”-বলে হেঁকে দুটো ঝালমুড়ি বানাতে দিলো,”নে ধর,এ নিন ধরুন” বলে মা মেয়ের হাতে গুঁজে দিলো।জীবন যে নদীর মতো এঁকে বেঁকে কোথায় যাচ্ছে উদাস ভাবনার মাঝেই ট্রেনের ঘোষণায় ঝেড়ে মেরে ওরা। নিরুপায় হয়ে অজানা অচেনা মানুষের সাথে রাতের ট্রেনে  মালদা অভিমুখে রওনা, তবু কেন জানি না অচেনা হয়েও এ যেন এক আপন জনের সান্নিধ্য।

বৃষ্টিভেজা জেনারেল ভিড় কামড়ায় কোনরকমে মা বেটিকে বসিয়ে সামনে ঠায় দাঁড়িয়ে ক্লান্তিতে ঢুলতে ঢুলতে অসীম যেন অসীম ধৈর্যের পরীক্ষা দিচ্ছিল। খুব মনে পড়ছিল বিয়ের পর একবার বরের সাথে ট্রেনে ফেরা,স্বামী এভাবেই গার্ড দিচ্ছিল।স্মৃতির ধাক্কায় ভেতরটা আবার ভারাক্রান্ত হলো মাধবীর। তবে কি পুরুষ মানুষগুলো এমনই দায়িত্বশীল হয়! অন্যদিকে নিজের শাশুড়ি মায়ের রুদ্রমূর্তি যেভাবে রক্তের সম্পর্কের নাতনিকেও তাড়াতে পারে তা নারী জাতির কলঙ্ক।  এসব সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে চোখ জুড়িয়ে এসেছিল। একটা হ্যাঁচকা টানে গলার একমাত্র বিয়ের হারটা ছিনতাই হতেই অসীম চেন টেনে পিছু নিলো। ওই পটু  ছিনতাই বাজদের সাথে টক্কর দিতে।

তারপর এত বড় শহরে ভাঙাচোরা টালির ঘরে অসীমের পাতানো দিদির বাড়ি ওঠা।কাজ না করে বসে বসে খেতেও লজ্জা করছে মাধবীর। বড্ড বেশি নিজেকে বোঝা মনে হচ্ছিল তার। অসীমের নিজের প্রতি কেয়ারলেস জীবন কিন্তু মাধবী ও লতার প্রতি দায়িত্বশীল পুরুষের পরিচয় দেওয়ার মধ্যে কোথায় যেন এক চিলতে ভালোবাসার জন্ম নিচ্ছিল। এক মাঝরাতে লতার অসহ্য পেটের যন্ত্রণায় হাসপাতাল-ডাক্তার নিয়ে দৌড়ঝাঁপ। বাড়ি থেকে নিজে হাতে রান্না করে খাবার পৌঁছানোর মানুষটা অজান্তে হৃদয়ের কাছে চলে আসে। ফিকে হতে থাকা অতীত সরিয়ে মন্দিরে দু’জনে স্বামী স্ত্রীর মন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে সংসার শুরু করে। বাবার কথা মনে পড়লেও লতাকে অসীম বাবার শূন্যস্থান পূরণ করে দেয়।

সব ঠিক ঠাক চলছিল, মাধবী সেলাই মেশিন কিনে বাড়িতে টুকটাক অর্ডার পাচ্ছে। লতা নতুন করে স্কুলে ভর্তি হয়েছে। এরই মাঝে  সংসার জীবনে হঠাৎ ছন্দপতন। অসীম কিনা আফিম পাচারে যুক্ত, হাতে নাতে পুলিশ গ্রেপ্তার করে। জেল খেটে এসে আর বেশি আসতো না বাড়িতে অসীম, কেমন যেন এক উশৃঙ্খল ঝিমুনি জীবন। কত বুঝিয়েছে মাধবী, আঁকার স্কুল খোলো বাড়িতে, চলো সুস্থ জীবন যাপন করি কিন্ত কোথায় কি! এরপর একদিন অসীমের বেশ্যা পাড়ায় যাবার খবরে দগ্ধ হয় মাধবী। যার জন্য জীবনে আজ একটু আশার আলো সেই কিনা এভাবে বখাটে হয়ে যাচ্ছে! একটা চাপা মনোকষ্ট, মেয়েটাকে ভালো জীবন দেবার লক্ষ্য না জানি মুখ থুবড়ে পড়বে! এমন বিহ্বল দিন গুজরানের মাঝে আজ সুনসান দুপুরে নোংরা উদ্দেশ্যে অসীমের এমন অসৎ টানা হ্যাঁচড়ায় বিস্ফারিত চোখে মাধবীর একটাই শব্দ বেরিয়ে আসে “বিশ্বাস ঘাতক”।

Exit mobile version