Site icon আলাপী মন

গল্প- মোহর

মোহর
-পারমিতা চ্যাটার্জী

 

 

মোহর বিদেশ থেকে শাশুড়ি মাকে ফোন করলো-
– কেমন আছো মা?
– এই আছি মা, চলে যাচ্ছে
– আমি জানি মা তোমার খুব একা লাগে তাইনা?
– হ্যাঁ রে একাকীত্ব বড়ো কষ্টকর, সব থেকেও যেন কিছু নেই, মাঝে মাঝে খুব অসহায় লাগে নিজেকে।
– আর অসহায় লাগবে না, আমার ওপর একটু ভরসা রাখো, আর সেই পুরানো সব সংস্কার থেকে তোমাকে আমি বের করে আনবোই। সব কর্তব্য তোমার হয়ে গেছে, এবার তোমাকে শুধু নিজের জন্য বাঁচতে হবে।
– মা সামনের মাসে আমি আসছি তোমার কাছে, অনেকদিন তোমাকে দেখিনি, খুব দেখতে ইচ্ছে করছে, তুমি তো জানো সেই ছোটবেলায় মাকে হারিয়েছি, এখন মা বলতে তোমাকেই বুঝি।
অন্নপূর্ণা দেবী জানেন এই মেয়েটি নামেই তার পুত্রবধূ, কিন্তু তার ভালোবাসা, কোনো সন্তানের চেয়ে কিছু কম নয়।
তাঁর অন্তরের দুঃখ- বেদনা, নিত্য স্বামীর অপমান সে নিজে চোখে দেখেছে, একমাত্র সেই রুখে দাঁড়িয়ে ছিল শ্বশুরের স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে।
আঙুল উঁচু করে বলেছিল, “আর যদি কোনদিন দেখি আপনি আমার মামনিকে কোনো অপমান করেছেন, তবে জেনে রাখবেন সেদিন আপনার কপালে অনেক দুঃখ আছে।”
আধুনিক মেয়ে মোহরের তীব্র চোখের দৃষ্টির সামনে সেদিন মাথা নীচু করতে বাধ্য হয়েছিল সেই লোকটা, যার নাম ছিল প্রদ্যোত, আজ তিন বছর হল তাকে সে মুক্তি দিয়েছে, কিন্তু একথা সত্যি যে তার মৃত্যুতে বিন্দুমাত্র কষ্ট হয়নি অন্নপূর্ণাদেবীর বরং একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস বেরিয়ে এসেছিল তার।
সারাজীবন শিক্ষিতা স্বনির্ভর অন্নপূর্ণাকে সে মানসিক তো বটেই শারীরিক অত্যাচারও কম করেনি। রাতগুলো ছিল বিভীষিকা, রীতিমত ধর্ষিত হতেন তিনি স্বামীর হাতে প্রতি রাতে, একবার বড়ো ছেলেকে লজ্জার মাথা খেয়ে বলেছিলেন, “তোরা তো বড়ো হয়েছিস তাই বলছি, প্রতি রাতে তোর বাবার এ অত্যাচার আর তো আমি সহ্য করতে পারছিনা।” মায়ের ঘাড়ে দগদগে আঘাতের চিহ্ন স্পষ্ট তখনও, সে তাড়াতাড়ি মায়ের ক্ষত জায়গায় ওষুধ লাগিয়ে দিল,তারপর মায়ের হাত ধরে বাপের সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলেছিল, এটা কি? নির্লিপ্ত উত্তর দিয়েছিল নির্লজ্জ লোকটা, আমি কি করবো? ওরকম সব মেয়েদেরই হয়,
ছেলে রুখে দাঁড়িয়ে আবার বলেছিল, না সবার হয়না, তোমার মতন পশুর সাথে যাদের ঘর করতে হয় তাদেরই হয়।
বাবার চিৎকারকে থামিয়ে দিয়ে বলেছিল একবার গলা তুলে দেখ, তোমার জিভ আমি টেনে ছিঁড়ে দেব,আর আজ থেকে মা আলাদা শোবে, এই নিয়ে তুমি যদি কোন গণ্ডগোল কর তাহলে তোমাকে আমি টানতে টানতে পুলিশের কাছে নিয়ে যাব। চিৎকার চেঁচামেচিতে অন্য দুই ছেলেও এসে গেছে। ছোট ছেলে তো মায়ের আঘাত দেখে উত্তেজিত হয়ে বাবাকে মারতে উঠেছিল, অন্য ভাইয়েরা থামিয়ে দিয়ে বললো ছেড়ে দে।
সেই থেকে তার শোবার ঘর আলাদা, বউমারা এসেও দেখেছে শাশুড়ি মায়ের আলাদা শোবার ব্যাবস্থা। শ্বশুরের মুখে কুশ্রাব্য ভাষায় গালাগাল শুনে আলাদা থাকার কারণটা তারা বুঝে নিয়েছিল।
মোহর শাশুড়ি মায়ের খুব কাছাকাছি চলে এসেছিল, তাকে অনেক মনের কথা বলেছিলেন অন্নপূর্ণা দেবী।
সেই সময় মোহরকে বলে ফেলেছিলেন, তার একান্ত মনের গোপন কথাটি।
কলেজে পড়বার সময় তাঁর খুব ভালো লাগতো তাঁদের প্রফেসর অমলেন্দু নাগকে, বোধহয় তাঁরও ভালো লেগেছিল স্বল্পভাষী মিষ্টি অন্নপূর্ণাকে, সবাই বলতো স্যার তো একজনের মুখের দিকে চেয়েই লেকচার দিয়ে যান, আর কোনদিকে তাকান না। লজ্জা পেতেন তিনি সহপাঠীদের কথায়, কিন্তু এ কথা সত্যি যে তিনি তার দিকে তাকিয়ে পড়িয়ে যান। কিন্তু কেউ কোনদিন মনের কথা কাউকে বলেন নি। কলেজ শেষ হবার পর মার্কশীট আনতে যেদিন অন্নপূর্ণা কলেজে গেলেন সেদিন তিনি নিজেই স্যারের সাথে দেখা করতে গেলেন, স্যারের ঘরে তখন নতুন ভর্তির জন্য বেশ কিছু লোকজন ছিল, তাকে দেখে তাদের একটু অপেক্ষা করতে বলে তিনি বাইরে এসে বলেন,”আমি জানতাম তুমি আসবে।”
অন্নপূর্ণা মাটির দিকে চোখ নামিয়ে নিয়েছিলেন লজ্জায়। তিনি ওর মাথায় হাত রেখে বলেছিলেন, একটু বাইরে অপেক্ষা করতে পারবে? আমি এই কাজটা সেরেই আসছি –
অন্নপূর্ণা মাথা নামিয়েই সম্মতিসূচক ঘাড় নেড়ে বাইরে আসেন।
একটু পরেই উনি বেরিয়ে এলেন, বললেন চল-
অন্নপূর্ণার ইচ্ছে থাকলেও জিজ্ঞেস করতে পারলেন না কোথায়! নীরবে অনুসরণ করে চলতে লাগলেন। একটু পরেই একটা কফিশপে দু’জনে বসলেন, তারপর উনি খুব ধীর স্থির গলায় বললেন, বহুদিন থেকেই একটা কথা তোমাকে বলতে চাইছিলাম কিন্তু বলতে পারিনি, আজ তোমার কলেজ জীবন শেষ হয়ে যাচ্ছে, আজ আর না বললে আর হয়তো বলাই হবে না তাই তোমাকে এখানে নিয়ে এলাম-
– অন্নপূর্ণা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালেন। উনি বললেন, কলেজে যখন তোমার মুখের দিকে চেয়ে পড়াতাম, তখনই বুঝতে পেরেছিলাম যে তুমি আমাকে একটু অন্য ভাবে পছন্দ করো, মানে আমার প্রতি একটা ভালোলাগা তোমার মধ্যে কাজ করে। কি আমি ঠিক বলছি তো?
অন্নপূর্ণা তখন রীতিমতো ঘামতে শুরু করে দিয়েছেন। কোনোরকমে মুখ নামিয়ে বললেন, হ্যাঁ –

তিনি তখন বললেন, ব্যাস আমি এই উত্তরটার জন্যে অপেক্ষায় ছিলাম, আচ্ছা! তুমি কি বুঝতে পেরেছিলে যে আমিও তোমাকে খুব পছন্দ করি।
অন্নপূর্ণা এবার একটু মুখ তুলে বলেছিলেন, আন্দাজ করেছিলাম, তাইতো আজ সাহসে ভর করে আপনার ঘরে এসেছিলাম, যদি কিছু বলেন তাই।
তিনি হেসে ফেলে বললেন, যতোটা ভালো মেয়ে ভেবেছিলাম ততোটা মোটেই নয় তাহলে দেখছি, বলেই হেসে উঠেছিলেন আর অন্নপূর্ণাও ওর টোল ফেলা গাল নিয়ে হেসে ফেলেছিলেন।
তারপর ওরা আরও দু’চারদিন দেখা করেছিলেন, দু’জনে মনের কাছাকাছি এসেছিলেন।
প্রায় একমাস ঘোরাঘুরির পর একদিন গঙ্গার ধারে তার হাতটা ধরে বলেছিলেন, তুমি তো এম এ পাশ করে এম ফিল করবে?
– হ্যাঁ সেই রকমই তো ইচ্ছে আছে।
– ইচ্ছে আছে না করতেই হবে। আর তার সাথে আর একটা জিনিসও করতে হবে।
-কি?
– অপেক্ষা.. পারবেনা আমার জন্য পাঁচ বছর অপেক্ষা করতে? আমি একটা স্কলারশিপ নিয়ে বিদেশ যাচ্ছি পোস্ট ডক্টরেটের জন্য, পাঁচটা বছর দেখতে দেখতে কেটে যাবে, তুমি পারলে পি এইচ ডি আরম্ভ করে দিও, আমি নিয়মিত তোমাকে নোটস পাঠাবো, চিঠিও লিখবো, দেখবে ঠিক সময় কেটে যাবে।
তিনি বলেছিলেন করতেই হবে, এখন তো আর কোন রাস্তা নেই, ভালোবেসেছি যে।
তিনি মৃদু হেসে সেদিন অন্নপূর্ণার মাথাটা বুকের কাছে টেনে এনে তার কপালে একটা আলতো চুম্বন দিয়ে বলেছিলেন, ভালোবাসার অপেক্ষা খুব মধুর হয়।
কিন্তু এমনই ভাগ্য যে এম ফিল শেষ হবার সাথে সাথেই বাবার ক্যান্সার ধরা পড়লো, তারা ধনে প্রাণে শেষ প্রায় শেষ হয়ে গেলেন। বাধ্য হয়ে তাকে কলেজের চাকরি নিতে হল, পি এইচ ডি করা আর হল না। ভেবেছিলেন একটু সামলে নিয়ে পি এইচ ডি আরম্ভ করবেন। তাদের বসতবাড়িও বাঁধা পড়েছিল বাবার চিকিৎসা করাতে গিয়ে, বাধ্য হয়ে তাদের তিন ভাই বোন বোন সমেত মাকে কাকার বাড়ি আশ্রয় নিতে হয়েছিল।
তখন কলেজের মাইনে এতো বেশি ছিলোনা, তাই দুই ভাইবোনের পড়া আর টিউশনির খরচ দিয়ে কাকার হাতে খুব কম টাকাই দিতে পারতেন, এতে কাকা কাকীমার অসন্তোষ টের পাচ্ছিলেন, তখন একাধিক টিউশন নিয়ে সাংসারিক ঘাটতি পূরণ করতে হচ্ছিল, তাতেও শান্তি ছিলোনা। এরকম অবস্থায় একদিন হঠাৎ জানতে পারে কাকা তার বিয়ে ঠিক করেছে, মায়ের কান্না, তার অনেক অনুনয় বিনয়কে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে মূর্খ কিন্তু কিসব চামড়ার ব্যাবসা করে প্রদ্যোতের সাথে তার বিয়ে দিয়ে জীবনের চিত্রটাকে কাকা পুরো বদলে দিয়েছিল। অমলেন্দুকে সবই খুলে লিখেছিলেন তিনি তার অক্ষমতার কথা, অমলেন্দু চিঠিতে জানিয়েছিল, আর একটু আগে কেন জানালেনা? আমি চলে আসতাম
তিনি উত্তরে দিয়েছিলেন, মাত্র সাতদিন আগে তাকে জানানো হয়েছিল তার বিয়ের কথা, তখুনি চিঠি দিয়েছিলাম, কিন্তু তোমার কাছে যখন চিঠি পৌছেছে তখন আমার যা হবার তা হয়ে গিয়েছে।
একমাত্র মোহরকেই এ সমস্ত কথা তিনি বলেছিলেন, মোহর ছয়মাসের ছুটি নিয়ে এলো। অন্নপূর্ণা দেবী আনন্দে জড়িয়ে ধরেছিলেন তাকে, তুই এতোদিন থাকবি আমার কাছে।
– হ্যাঁ মা জীবনে অনেক কষ্ট করেছো, আর নয় এবার তোমার একটা ব্যাবস্থা করবো বলেই এসেছি।
– কি ব্যবস্থা?
– সেটা সারপ্রাইজ থাক।
মোহর অমলেন্দুর সাথে যোগাযোগ করে। শহর থেকে একটু দূরে একটি বিরাট বাড়ি কেনা হয়েছিল, অমলেন্দুই কিনেছেন, মোহর বহুদিন থেকে তাঁর সাথে যোগাযোগ করে এই ব্যবস্থা করেছিল, বাড়িটি হয়েছিল বৃদ্ধাশ্রম, শ্রীরামপুরে একদম গঙ্গার বক্ষে বাড়িটি ছিল, সেখানে ডাক্তার, হোম কিচেন সব ছিল, একটা ঘরওলা ছোট ফ্ল্যাট আবার দু’টো ঘরওলা ফ্ল্যাটও ছিল, বাড়ির সামনে ফুলের বাগান, পিছনে একটি সুন্দর পরিস্কার পরিচ্ছন্ন সাজানো ঝিলকে ঘিরে সব্জির বাগান। অমলেন্দু তার নিজের জন্য দুই ঘরওলা একটা ফ্ল্যাট রেখেছিলেন, বাকি সব ফ্ল্যাটগুলোই ভর্তি হয়ে গিয়েছিল। বাড়ির বাইরে বড়ো বড়ো করে একটি শ্বেতপাথরের প্লেটের ওপর লেখা ছিল অন্নপূর্ণা বৃদ্ধাশ্রম।
এসব কথা অন্নপূর্ণা কিছুই জানতেন না।
কিছুদিন পর মোহর তাকে বেশ সাজিয়ে গুছিয়ে বললো, চল আমার সাথে একটু বেরোতে হবে,
কোথায় রে?
গেলেই দেখতে পাবে।
যাবার পথে মোহর গাড়ি থেকে নেমে কিসব কিনলো যেন, তিনি দেখলেন দু’টো বড়ো ফুলের গোড়ের মালা দু’ তিনটি বিরাট বাক্স ভর্তি করে মিষ্টি।
– তোর মতলবটা কি বলতো? কোথায় নিয়ে যাচ্ছিস আমাকে?
– উফ্ বড়ো কথা বল তুমি, চল তো চুপচাপ।
এরপর তো আরও অবাক হবার পালা, একটি রেজিস্ট্রি অফিসের সামনে দাঁড়ালেন দু’জনে, দেখলেন অমলেন্দু বেরিয়ে এলেন ধুতি পাঞ্জাবী পরে। পরের ঘটনা তো আর বলার দরকার নেই।
সেদিন বৃদ্ধাশ্রমের সবাই খুব আনন্দ করলো, অমলেন্দু সবার জন্য ছোট করে খাওয়ার আয়োজন করেছিলেন, তার সাথে মোহরের আনা মিষ্টি, মায়ের জন্য একটা সাদার ওপর লাল পার দেওয়া বেনারসি, আর অমলেন্দুর গরদের পাঞ্জাবী আর ধুতি। ওদের হাতে তুলে দিয়ে বললো এই নাও মেয়ের বাড়ি থেকে আনা ফুলশয্যার তত্ত্ব।
অন্নপূর্ণা ওকে বুকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলে বললেন তুই পেটে পেটে এতো কিছু করেছিস, আমাকে কিছু জানতে দিস নি!
– আমি তো কিছু করিনি মা শুধু দু’টো বহুদিন ধরে অপেক্ষাকৃত হৃদয়কে মিলিয়ে দিয়েছি, যা তোমার পাওনা ছিল আমি তাই করেছি শুধু এই বৃদ্ধাশ্রমে।
কাকুর কাছে যখন শুনলাম কাকু তোমার নামে এই বৃদ্ধাশ্রম করেছেন আর তিনিও একা কাউকে বিয়ে করতে পারেননি শুধু তোমাকে ভালোবেসে ছিলেন বলে, আমি এই বৃদ্ধাশ্রমে দু’টি ভালোবাসাকে এক করে দিলাম শুধু।
রাত্রি এলো,অমলেন্দু পরিপূর্ণ ভাবে তাকালেন তার যৌবনের ভালোবাসায় দিকে-তারপর দু’হাত বাড়িয়ে দিলেন,
অন্নপূর্ণা ধরা দিল সেই বহু প্রতীক্ষিত বাহুবন্ধনে।
এতদিনের অপূর্ণ ভালোবাসা মুক্তি পেল অবশেষে বৃদ্ধাশ্রমের একটি স্বল্প পরিসর ফ্ল্যাটে।

Exit mobile version