বিনয়ের বুদ্ধি
– লোপামুদ্রা ব্যানার্জী
প্রায় ত্রিশটা বছর পার হয়ে গেল রসময় দাশ চলে গেছেন। রসময় দাশের বড়ো ছেলে বিনয় তখন সবে কলেজে উঠেছে। বিনয়ের দু’ চোখ জুড়ে তখন কত স্বপ্ন। পড়াশোনায় তেমন মেধাবী না হলেও তার প্রতুৎপন্নমতির কাছে সকলকেই নতি স্বীকার করতে হয়। এ হেন প্রানবন্ত ছেলেটি পিতৃবিয়োগের পর হঠাৎ একটু বেশি ম্যাচিওর হয়ে উঠল।
উনিশ বছর বয়সেই বিনয় বুঝে গিয়েছিল তার পায়ের তলার মাটিকে আরো শক্ত করতে হবে। শুধুমাত্র চাষবাসের ওপর নির্ভর করে থাকলে সংসারের শ্রী বৃদ্ধি ঘটানো সম্ভব নয়। বিনয়ের নীচে আছে তার বোন মলি ও ছোট ভাই বিমল। তারাও তখন যথেষ্ট ছোট ছিল। বিনয়ের জীবনের মূল লক্ষ্যই হয়ে দাঁড়ায় ছোট ভাই বোন দু’টো সুস্থ ও সুন্দর জীবন দান করা। বিনয়ের মা কমলা দেবী তাই তার যৎসামান্য গয়নাটুকুও বিনয়ের হাতে তুলে দেয় যে কোন একটা ব্যবসা দাঁড় করাবার জন্য।
বিনয় প্রথমে আরামবাগ শহরে একটি ছোট্ট দোকান ঘর ভাড়া নেয়। সেখানে শুরু করলো ব্যাটারির কারবার। বেশ কয়েক বছর বিভিন্ন দোকানে দোকানে নিজে গিয়ে ব্যাটারির সাপ্লাই দিয়ে আসত। আস্তে আস্তে একটা পরিচিতি গড়ে উঠলো বিনয়ের এবং ধীরে ধীরে নিজের চেষ্টায় হোল সেলস্ এর লাইসেন্সও অধিকার করে বিনয়। আজ আরামবাগের মতো জায়গায় তার দোকানের নাম সকলে এক ডাকে চেনে। ব্যবসার রীতিও বিনয়ের কাছে একেবারে অন্যরকম।ধারের কারবার বিনয়ের একদম অপচ্ছন্দ।তার দোকানে প্রবেশ করলেই প্রত্যেক গ্ৰাহকের চোখে পড়ে বড় একটা সাইনবোর্ড-‘ধারের বড় জ্বালা
পাওনাদারকে দেখলেই মন বলে,পালা পালা।’
সাইনবোর্ডের চারিদিকে এল ই ডি লাইট লাগানো আছে। রাতের বেলাতেও লেখা গুলো উজ্জ্বল ভাবে খদ্দেরকে আকৃষ্ট করে।
গ্ৰামের বাড়ি ছেড়ে আরামবাগ শহরে তিন কাঠা মতো জায়গা কিনে একখানি সুন্দর ছিমছাম বাড়ি বানিয়েছে বিনয় বছর পাঁচেক হলো। বড় রাস্তার কোনের দিকের জায়গা। তাই তিন খানা রাস্তাও পেয়েছে। তিন দিকে তিনটে ঝুল বারান্দা বাড়িটির সৌন্দর্য আরো বৃদ্ধি করেছে। বাড়ির সামনে বেশ কিছুটা জায়গা জুড়ে বাগান বানিয়েছে বিনয়। বোন মলিকে খুব শিক্ষিত ঘরে বিয়ে দিয়েছে। ছোট ভাই বিমলকে আলাদা কাপড়ের দোকান খুলে দিয়েছে। মোটামুটি এখন বেশ স্বচ্ছলতার মুখ দেখেছে বিনয়। তার মায়ের যে গয়নাগুলো বিক্রি করে সে ব্যবসা শুরু করেছিল তার দ্বিগুণ গয়না মাকে গড়িয়ে দিয়েছে।
ইদানিং বিনয়ের মা কমলা দেবীর একটাই চিন্তা কীভাবে বিনয়কে সংসারী করা যায়। কোন অল্প বয়স থেকে কমলাদেবীর সংসারের জোয়াল কাঁধে নিয়ে ঘুরছে। বোন,ভাই সকলেরই আলাদা আলাদা সংসার হয়েছে। শুধুমাত্র বিনয় আজও অবিবাহিত। বিয়ের কথা বললেই বলে ‘মা গাঁটছড়া তো অনেকদিন আগেই বেঁধেছি আমার দোকানের সাথে। আমার সমস্ত মন জুড়ে আছে আমার ব্যবসা। সেখানে আর কাউকে বসানোর মতো সামান্য জায়গাটুকু নেই’। বিনয়ের মা খুব ভালো বোঝে তার বড় ছেলেকে। বিনয়ের মতো সৎ মানুষ পাওয়া ভার।
কমলা দেবীর সকালের বেশীরভাগ সময়টাই কাটে ঠাকুর ঘরে। নিজে হাতে বাগান থেকে ফুল তোলা, মালা গাঁথা, ঠাকুরের বাসন ধোয়া, ঠাকুরের জন্য থালা ভর্তি ফল কাটা। এইসব কাজ করে পূজা সারতে সারতে প্রায় বেলা দশটা বেজে যায়। আজও ঐ সময় ঠাকুর ঘরের দরজা টেনে বন্ধ করতে যাবেন হঠাৎ ল্যান্ড ফোনটা বেজে উঠলো। কমলা দেবী হন্তদন্ত হয়ে এসে ফোন তুলতেই ওপার থেকে ভেসে আসে ‘মা ,বড়দা’র কান্ড শুনেছো? আমি তো ভাবতেই পারছি না বড়দা এমন কাজ করতে পারে। আমার দেওর আজ সকালে বাজারে গিয়েছিল। গোটা আরামবাগ বাজারে তো এখন একটাই চর্চা তোমার বড় ছেলে। বিনয় দাশ।’ কমলা দেবী নিজের উত্তেজনাকে সংযত করে বলে ‘কী হয়েছে খুলে বল। কী শুনেছে তোর দেওর? তবে সব সময় সব শোনা কথা সঠিক হয় না কিন্তু।’ অপর প্রান্ত থেকে মলি বলে ওঠে ‘মা রাগ করো না। কিন্তু বড়দা আজ এমন কাজ করেছে যেটা আমি স্বপ্নেও ভাবতে পারিনি। আমাদের কাউন্সিলর গুরুপদ কুন্ডু দাদাকে তার বাড়ির সামনে কান ধরে উঠবস করাচ্ছে।’ আঁতকে ওঠে কমলা দেবী ‘কী বলছিস তুই? কী এমন করলো বিনয়? আমি এখনি যাচ্ছি গুরুপদ কুন্ডুর বাড়ি। তুই ও জামাইকে নিয়ে শিগগির ওখানে আয়। পরিবারের কেউ বিপদে পড়লে ফালতু মান অভিমানের পালা করলে চলে না।আমি ফোন রাখছি।’
আজ রবিবার। তাই বিমলের দোকান বন্ধ।বেলা পর্যন্ত ঘুমানোর বদ অভ্যাস এখনও ছাড়তে পারে নি সে। তবে আজ কমলা দেবীর চিৎকারে ধড়ফড়িয়ে উঠে পড়ে এবং নিচে নেমে আসে। কমলা দেবী মলির ফোনের কথা সব খুলে বলে বিমলকে। বিমল চোখে মুখে জল দিয়েই বাইক বের করে কমলা দেবীকে নিয়ে ছোটে কাউন্সিলার গুরুপদ কুন্ডুর বাড়ি।
বেশ লোকের সমাগম ঘটেছে কাউন্সিলারের বাড়ির চারিদিকে।ভিড় ঠেলে এগিয়ে আসে কমলা দেবী ও বিমল। কমলা দেবীর চোখ ছলছল করছে। উপস্থিত সকলের দিকে লজ্জিত দৃষ্টিতে তাকাচ্ছেন তিনি ।মা ও ভাইকে দেখে সাময়িক উঠবস বন্ধ করলেও পর মুহূর্তে আবার উঠবস শুরু করে দেয় বিনয়। কমলা দেবী বিমলকে বলে কাউন্সিলরকে খবর দিতে। বিমল মেনগেটের পাশে কলিং বেলের সুইচটা বাজালো। মিনিট পাঁচেক পর একজন মহিলা আওয়াজ দিল ‘কে’।বিমল করুণ সুরে বলে -‘গুরুপদ বাবুকে বলুন বিনয় বাবুর মা এসেছেন দেখা করতে।’ মেয়েটি কোন উত্তর না দিয়ে ভিতরে চলে গেল। বেশ কিছুক্ষণ পর গুরুপদ বাবু নীচে নেমে এলেন এবং তার হাতে একটি চেন বন্ধ ব্যাগ।
গুরুপদ বাবুকে দেখেই কমলা দেবী করজোড়ে ক্ষমা প্রার্থনা করে বিনয়ের জন্য। উপস্থিত জোড়া জোড়া কৌতুহলী চোখ গুলো বিস্ফারিত নয়নে চেয়ে আছে। এবার তাহলে আসল তথ্য অবশ্যই সবার সামনে আসবে। গুরুপদ বাবু সকলকে অবাক করে কমলা দেবীকে বলে ওঠেন ‘আমি আপনার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করছি । টাকা পয়সা, মান সম্মান থাকলেই বোধহয় সন্তানকে মানুষের মতো মানুষ করা যায় না। আমার একমাত্র ছেলে অমূল্য। একেবারে বকে গেছে। ওর আড্ডা ও বন্ধুবান্ধব থেকে ওকে দূরে রাখতেই বছর দুই হলো আমি একটা ঘড়ির দোকান খুলে দিয়েছি। এই দু’বছর ধরে অমূল্য বিনয়ের কাছ থেকে যত ব্যাটারি কিনেছে তার একটা পয়সাও মেটায় নি। বিনয় তাগাদা করলে উল্টে বিনয়কেই অপমান করেছে। তাই শেষ পর্যন্ত বিনয় এই অভিনব পন্থা অবলম্বন করেছে তারা পাওনা টাকা উদ্ধার করার জন্য। ঠিকই তো। ধার দিয়ে অমূল্যর উপকার করেছে সে দিনের পর দিন। আজ তাই কান ধরে অমূল্যর বাড়ির সামনে উঠবস করে উপকারের প্রায়শ্চিত্ত করছে।’
গুরুপদ বাবু বিনয়ের কাছে গিয়ে বলে এই চেন বন্ধ ব্যাগটাতে হাজার ত্রিশের মতো টাকা আছে। আশাকরি অমূল্য র ধার পরিশোধ হয়ে যাবে। বিনয় গুরুপদ বাবুকে বলে ‘আমায় ক্ষমা করে দেবেন। আমি বাধ্য হয়েই আমার পাওনা টাকা আদায়ের জন্য এই অহিংস ও অদ্ভুত কৌশল অবলম্বন করেছি। আপনার মান সম্মান হয়তো এতে কিছুটা খর্ব হলো। কিন্তু আমি আমার কষ্টের পয়সা কী ভাবে জলে ফেলে দি বলুন।’
গুরুপদ বাবু হাসি মুখে বিনয়কে বলে ‘যে ভাবে কোন রকম হিংসা বা বল প্রয়োগ না করে তুমি তোমার প্রাপ্য আদায় করলে তার বহু দিন আরামবাগের মানুষ মনে রাখবে এবং আশা করি শিক্ষাও গ্ৰহণ করবে।’
সমাপ্ত
.