‘আমার আলেয়া’
– প্রদীপ দে
পর্ব – ১
ট্রেনটা ছেড়ে দিল। বেশ কিছুক্ষণের একটানা আওয়াজ ছড়িয়ে পড়লো চারিধারে। তারপর আবার নিস্তব্ধতা গ্রাস করলো স্টেশন চত্বরে। আমি ছাড়া আর দু’জন নেমেছিল তারা বেড়িয়ে গেছে। আমি এখন একা এই পাহাড়ি স্টেশনে। সিমেন্টের চেয়ারে বসে পড়লাম। ঠান্ডা আছে তবে সহ্য করতে পারছি কারণ শরীরে যথেষ্ট পরিমান শীতবস্ত্র ছিল। কেন যে এখানে নামলাম জানিনা। ট্রেনে এক ব্যক্তির মুখে শুনে এখানকার ইতিহাস জানার একটা তাগিদ অনুভব করলাম, যা শেষ পর্যন্ত আমাকে এখানে টেনে আনলো। কিন্তু এখন আমি এই পাহাড়ি এলাকায় কোথায় থাকার ঘর খুঁজতে যাব? অন্ধকারে কিছু দেখাও যাচ্ছে না ভালো করে। একটা সিগারেট ধরালাম মাথাটাকে কাজ করানোর জন্য। চারবার টানার পর বেশ শরীর মাথা চাঙ্গা মনে হল।
কে যেন পিছন থেকে আমার নাম ধরে ডেকে উঠলো। চমকিয়ে গেলাম – এক পরিচিত মহিলার কন্ঠস্বর! মাথা ঘুরিয়ে দেখলাম পিছনে দাঁড়িয়ে আমার ছোটবেলার বন্ধু আলেয়া। একসঙ্গে পড়াশুনা, বড়ো হয়ে ওঠা, তারপরে বিয়ে। বিয়ের পর শ্বশুরবাড়ি। ব্যাস ছাড়াছাড়ি।
আমি ওকে অবাক চোখে দেখছি।
আলেয়াই সহজ করে দিলো – আরে তুই এখানে?
আমি হতবুদ্ধি।
ওই হেসে ফেললো – আরে আমি আলেয়া!
এখানেই তো আমার শ্বশুরবাড়ি।
পর্ব – ২
আমি ভাবতেই পারছি না এই পাহাড়ি জনমানব শূন্য স্টেশনে আলেয়ার দেখা পাবো। আমি ওর মুখের দিকে চেয়ে অবাক হয়ে ওকেই দেখছি। ও যেন খুব ফর্সা হয়ে গেছে। কেমন সাদাটে লাগছে। ও তো ছিল শ্যামবর্ণ। পাহাড়ি এলাকায় এতো পরিস্কার হয়ে গেছে? আর চোখ দু’টো ও যেন কেমন লাগছে। অথচ মুখে হাসি সেই আগের মতোই। আমি এইসবই ভাবছি। আর ও হেসেই চলেছে। হো – হো -হো। মিষ্টি সুরে পাহাড়ে হাসি ধাক্কা খেয়ে আবার বাতাসে মিলিয়ে যাচ্ছে।
— কি তুই ভাবছিস আমি এখানে তোর জন্য অপেক্ষা করছিলাম? আরে নারে না। আমার কর্তাকে ছাড়তে এসেছিলাম। ও তো তোর ট্রেনেই জলন্ধর গেলো। ফিরছি, দেখি তুই বসে। তুই যেমন অবাক হয়েছিস, আমিও তেমনই।
আমি এবার বুঝলাম – ও তাই বল। তোরা এখানে থাকিস?
– হ্যাঁ রে। আমার শ্বশুর এখানকার পুরোনো আমলের জমিদার।কর্তা হলেন সৈন্যবাহিনীর একজন মেজর।
– ওরে বাব্বা! – যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম।
— তা তুই এখানে কি ভাবে? আগে তাই বল?
– আরে যাচ্ছিলাম জলন্ধরেই। হঠাৎ ট্রেনে এক বয়স্ক লোকের সঙ্গে আলাপ হলো। লেখালিখি করি জানতে পেরে আমাকে এখানে একবার নামতে বললেন। এখানে নাকি পুরানো আমলের অনেক ইতিহাস লুকিয়ে আছে। আমাকে অনুরোধই করলো একবার যদি ঘুরে যাই। তাহলে নাকি অনেকেরই সুবিধা হবে। অনেক খবর নাকি অপ্রকাশিত হয়ে রয়ে গেছে।
দেখলাম ফাজিল আলেয়া মুচকি মুচকি হাসছে
– তুই নিজেকে কি ভাবিস? একজন বড় লেখক না কি?
আমি বেশ লজ্জা পেলাম, যদিও ও আমার বন্ধু। কিন্তু কথাতো ঠিকই বলেছে।
আলেয়া আক্ষেপ করলো — তুই যদি এতই বুঝতিস তাহলে কি আর এতসব ঘটতো?
বুঝলাম ও আমার অসহয়াতার কথাই বলছে। সত্যি আমি ওকে সেদিন গ্রহণ না করে হয়তো আমি ওকে অমর্যাদা করেছিলাম এটা ঠিকই, কিন্তু আমার তো কোনো ক্ষমতাই ছিল না। ওই দিন না করেছিলাম বলেই না, আজ ও এই জমিদার ঘরের এক বৌমণি।
ও তাও হাসছে। ‘তা বলি ওই বয়স্ক লোকটিকে দেখতে কেমন?’
– একেবারে সুন্দর শুভ্রকেশী এক সদাশয় ব্যক্তি।
– নে নে খুব হয়েছে। এবার ওঠ। চল আমার সঙ্গে।
আমার না বলার উপায় নেই। ও ছাড়বেও না তা আমি ভালই জানি। কথা না বাড়িয়ে উঠে পড়লাম, ‘যাব কি ভাবে?’
আলেয়া কাপড় গুছিয়ে চোখ নাচালো, গাড়ি আছে।
আমি কি বোকা? কিসব বলছি?
স্টেশনের বাইরে আসতেই সামনে ঝকঝকে আম্বাসাডার সাদা রঙ্গের গাড়িতে চোখ গেল।
ড্রাইভার খুঁজছি। আবার বোকা বনে গেলাম।
আলেয়া ব্যাপারটা বুঝে হেসে লুটোপুটি খেল। খুব ভাল লাগলো ওকে।
– আরে আমিই ড্রাইভ করি। তুই না একটা পুরানো গরুই রয়েছিস!
লজ্জায় কথা বাড়ালাম না গাড়িতে উঠে বসলাম। আলেয়া গাড়ি স্ট্রাট দিয়ে দিল।একটা শীতল বাতাস ছুটে এলো। গাড়ি প্রচন্ড জোরে চালাচ্ছিল ও। আমি এই পাহাড়ি এলাকায় নির্জন স্থান এক ভীতু মানুষ আলেয়ার সাহসে সাহসী হলাম।
পর্ব- ৩
মাঝরাত। অন্ধকার। নির্জন। কালোমেঘে আকাশ যেন মুড়ে রয়েছে। একটা দমবন্ধ করা পরিবেশ।
আলেয়া গাড়ি নিয়ে যেখান থামলো, সেখান জমাট বাঁধা অন্ধকারে কিছুই দেখা যাচ্ছিল না। চোখ কচলে গাড়ি থেলে নামলাম আলেয়ার সঙ্গে। ভাল করে তাকিয়ে অবাক বিষ্ময়ে দেখলাম আমি এক বিরাট রাজপ্রাসাদের সামনে দাঁড়িয়ে। আলেয়া বুঝতে পেরে সেই রাজহাসি হাসলো – কি দেখছিস?
– বিরাট ব্যাপার! ভাবতে অবাক লাগছে। তার মানে তুই এই রাজপ্রাসাদের মালকিন? কিন্তু আলো নেই কেন?
ঝকঝকে দাঁত দেখা গেল আলেয়ার।
– কে বললে আলো নেই? তুই পাহাড়ি অঞ্চলের খবরাখবর রাখিস না তাই জানিস না। পাহাড়ি অঞ্চলে অধিকাংশ সময়ে বিদ্যুৎ থাকে না।
আমি এখন পুরোদম পেয়ে গেছি। আর নিজেকে বোকা ভাবতে পারছি না। লড়ে গেলাম — দ্যাখ আলেয়া তুই সব ব্যাপারে মাতব্বরি করবি না। তুই বড়লোকের বউ বলে কি সব জেনে গেছিস? কে বলেছে সব পাহাড়ি অঞ্চলে সবসময় আলো থাকে না?
আমি বড় লোহার গেটে দাঁড়িয়ে। আলেয়া আমার হাত ধরে এক হ্যাচকা টান মারলো এমন ভাবে যে আমি ওর বুকে গিয়ে পড়লাম। অনেকদিন বাদ ওর শরীরের স্বাদ যেন আমায় রোমাঞ্চিত করলো। খুব দামী মনে হলো নিজেকে আলেয়ার সান্নিধ্যে এই বিশাল রাজবাড়ির এক অতিথি হয়ে।
আলেয়া আরো ঘনিষ্ঠ হয়ে এলো, ‘অনেক জেনে গেছিস না? আমি বলছি এখানে বিদ্যুৎ প্রায়ই থাকে না আর তুই চালাকি মারছিস? চল ভিতরে চল।
আমি খুশি হলাম, তাই বল।
ওর হাত ধরে আমি অন্ধকারেও হাঁটতে পারি। আগে কত হেঁটেছি। হঠাৎ যে কি সব হলো। একটা ভালো চাকরি যদি জোতাতে পারতাম তাহলে আলেয়াকে হারাতে হত না। তা যাকগে। ভগবান যা করে মঙ্গলের জন্যই করে। না হলে কি এইদিনটা কে এইরকম ভাবে পেতাম।
বাগান পেড়িয়ে, উঠোন ডিঙিয়ে, যখন রাজ মহলে প্রবেশ করলাম, তখন আলেয়া একটা ঘরে নিয়ে গেলো। দেখলাম ঘরটায় বেশ আলো হয়ে রয়েছে।
আমি অবাক হয়ে দেখছি।
আলেয়া মুখ খুললো, এটা ইমার্জেন্সি আলো।
আমি কিন্তু আলোর বাতি খুঁজে পেলাম না। চকিতে আলেয়া আমাকে ঠেলে বাথরুমে চালান করে দিল। ও নিজেও অন্য বাথরুমে সেঁধোলো।
বিরিয়ানি সহ বেশ কয়েকটি ভাল ভাল পদ ও ড্রাইনিং টেবিলে সাজালো। আমাকে ডাকলো, আয় আগে দু’জনে খাওয়াটা সেরে ফেলি তারপর কথা হবে।
আমি সব কিছু খুঁজি। কাউকে দেখতে না পেয়ে মনটা উশখুশ করছিল। আলেয়া ঠিক বুঝে নিল। ও আমার সব বোঝে।
-দেখলি তো স্বামী বাইরে চলে গেল। শ্বশুর কাজে বাইরে। কাজের সব লোককে রাতে বাড়ি পাঠিয়ে দিই।
আমি বুঝলাম। হাসলাম। ও মুখ ভেংচি কাটলো।
চোখ দিয়ে ইশারা করলো যার মানে, ও যদি অবিবাহিত হত এবং আমার প্রেমিকা এখনও থাকতো, আমি সে সুযোগ নিতাম।
খাওয়া দাওয়া সেরে ও কয়েকটা ঘর আমাকে ঘুরে দেখালো। ইমার্জেন্সি আলোয়। শ্বশুরের ঘরে নিয়ে গেল না। জানালা দিয়ে আমি ভিতরটা দেখার চেষ্টা করলাম। একপলকে ঘরের টাঙানো বিশাল ছবিটা আমার নজরে এলো। কি রকম যেন মনে হল আমি জানালা দিয়ে আবার দেখবার চেষ্টা করলাম। ট্রেনে এই ভদ্রলোকই তো আমায় এখানে নামতে বলেছিল। আমি ভাল করে দেখছি।
আলেয়া ওর সরু সরু আঙুলগুলো আমার চোখের সামনে নাড়ালো।
– কি দেখছিস উনি আমার শ্বশুর মশাই।
– আমি তো তাই দেখছি। উনিই তো আমার ট্রেনে ছিলেন। ওনার কথামতোই আমি এই পাহাড়ি স্টেশনে ইতিহাস জানতে নেমে পড়ি।
– তাই নাকি? ওনার সঙ্গে দেখা হয়েছে। বাঃ বেশ। বেশ! তাহলে তো কাল ওনার সংগে তোর দেখা হয়ে যাবে।
আলেয়া হাসছে। আমি ওর খুব কাছে। ইচ্ছা হচ্ছে ওকে ভাল করে দেখি। কথা বলি। পারলে পুরানো আদর ফিরিয়ে দিই।
শেষ রাত। আলেয়া আমায় একটা ঘরে বিশ্রাম নিতে বললো, তুই এই ঘরে শো। আমি পাশের ঘরে আছি। কাল সব ঘুরে দেখাবো।রাতে দরকার হলে ডাকিস।
আমি মুচকি হাসলাম, আর দরকার! শুভ রাত্রি।
একটু তন্দ্রা এসেছে। এমন সময়ে দরজা খোলার আওয়াজ হলো। আড়চোখে তাকিয়ে দেখি আলেয়া দাঁড়িয়ে।
– কিরে তুই ঘুমাচ্ছিস? আমি ঘুমোতে পারছি না আর তুই দিব্যি ঘুমাচ্ছিস? এতদিন পর দেখা?
– কি করবো বল তুই তো আর এখন আমার নয়, অন্যের।
ও এক ঝটকায় আমাকে জাপটে ধরলো, বিছানায় উঠে, ‘কে বলেছে আমি তোর নয়? আমি তোরই! মন অন্য কাউকে দেওয়া যায়? মেয়েরা বারাবার প্রেম করতে পারে না, একবারই করে।
আমি আর নিজেকে ধরে রাখতে পারছিলাম না। অসহায় ভাবে আলেয়াকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে নিলাম। অনেকদিনের বাকি থাকা ভালোবাসা আদরে আদরে ভরিয়ে দিলাম। যৌবনে এরকম বহুবার ওকে ভালোবেসেছি। আজ আবার নতুন করে বাঁধ ভাঙা ঢেউয়ে ওকে ভাসিয়ে দিলাম। দেহসুখে আমারা দু’জনে তখন দুই বিহঙ্গ এক হয়ে গেছি। আলেয়া যে এখনো আমায় ভোলেনি এবং ওর চাওয়া পাওয়া অনেক বাকি তাই বোঝাতে লাগলো। আমি এই মূহুর্তে শুধুই আমার পুরানো অক্ষমতার গ্লানি থেকে বাঁচতে, ওকে উজাড় করে ভালোবাসা দিতে থাকলাম।
পর্ব – ৪
মধুর এক তৃপ্তি নিয়ে চোখ বুঁজে আছি, হঠাৎই গুলির আওয়াজে রাজপ্রাসাদ কেঁপে উঠলো।
আমি সবে বোঝবার চেষ্টা করছি, তখন আলেয়া আমাকে জড়িয়ে ধরলো। ‘তুই আমাকে তোর বুকে লুকিয়ে রাখ। না হলে ওরা আমায় মেরেই ফেলবে।’
আমি হতবুদ্ধি। সেটা আবার কি?
ততক্ষণে পুরো রাজপ্রাসাদ জুড়ে বোমা গুলির আওয়াজে ভরে গেছে। তীব্র আর্তনাদ শুনতে পেলাম। গুলি খেয়ে পড়ে যাওয়ার মতই সে আওয়াজ। অনেক কালো কালো ছায়া শরীরের দৌড়াদৌড়ি দেখতে পেলাম। আমি এমনিতেই ভীতু। আরো ভয় পেয়ে শক্ত হয়ে গেলাম। আলেয়াকে সর্বশক্তি দিয়ে ধরে রাখার চেষ্টা চালালাম। আমার ঘরের মধ্যেও ওদের হানা শুরু হলো। কি করবো বুঝতে পারলাম না। কথা বলতেও পারছি না। আলেয়ার শরীর যেন ভয়ে শক্ত হয়ে গেছে। মিনিট দু’য়েকের পরেই। দেখলাম আলেয়া আমার বুকে নেই। আমি চমকে উঠে বসে পড়লাম। সারাঘরে ওকে খুঁজতে লাগলাম অন্ধকারে। না ও কোথাও নেই। কোথায় গেল আলেয়া। ততক্ষণে আওয়াজ অনেকটাই কমে গেছে। শুধু কারা যেন চুপিচুপি কিছু কাজে ব্যস্ত। সময় নষ্ট না করে সাহস করে দরজা খুলে উঁকি মারতেই চক্ষু চড়কগাছ! দেখি উঠোনে আলেয়াকে দু’জনে ধরে রেখেছে, অন্যজন রিভলভার তাক করে।
আলেয়া চিৎকার করে চলেছে..আমাকে মেরো না তোমার পায়ে পড়ি। আমায় ছেড়ে দাও। প্লীজ আমায় দয়া করো।
এক আগুন্তককে বলতে শুনলাম- ক্ষমা আমি তোকে করতে পারবো না। তুই একটা পাপী। কুলটা। মিথ্যাবাদী।
– তুমি কি বলছো? তুমি যে আমার স্বামী। তুমি আমাকে কেন অবিশ্বাস করো? আমাকে বিশ্বাস করো, আমি তোমারই। তোমার বিয়ে করা স্ত্রী।
আলেয়া নিজেকে বাঁচানোর জন্য আকুল প্রার্থনা জানাচ্ছিল। নিজেকে সৎ প্রমাণ করার প্রয়াসে আছড়ে তার দুইচোখ দিয়ে জল গড়াতে লাগলো।
অন্ধকারেও যেন আমার দু’চোখ আলোতে ভরে গেল। আলেয়ার করুণ আকুতি তার স্বামীকে ছড়িয়ে দিল।
তার স্বামী কিন্তু তার রুদ্র মুর্ত্তিতে হো হো হো করে হাসিতে ভরিয়ে দিল সেই রাজপ্রাসাদ। আবার বোমা গুলির আওয়াজ হলো। মাঝরাতে কাক পাখি ডেকে উঠলো। একটা বড় পেঁচা কর্কশ শব্দে আলোড়িত করলো কালো রাত্রিকে।
আর সময় দেওয়া ঠিক হবে না ভেবে প্রচণ্ড সাহসের সঙ্গে চিৎকার করে উঠলাম। গুলি ছুটে গেল অনেকগুলো। আর আমার পিছন থেকে প্রবল জোরে মাথায় আঘাত পেলাম। মাথা ঘুরে গেল -সব কিছু কালো অন্ধকারে হারিয়ে গেলাম।
চোখ খুলেও খুলতে পারছিলাম না। একটা ঘোরে ছিলাম। আরও সময় লাগলো। যখন একটু ঘোর কাটলো তখন দেখলাম আমি একটা বেডে শুয়ে আছি। মাথায় অসহ্য যন্ত্রনা। হাত দু’টো বাঁধা বেডের সঙ্গে। কেউ কিছু বলছেও না দেখছেও না।
সময় এরকম করে এগোচ্ছে আর আমার যেন অনেক কথাই মনে পড়ছে। আরো মনে করার চেষ্টা করতে থাকলাম। পারলাম না মাথায় অসহ্য যন্ত্রনায় কাতর হলাম।
পর্ব – ৫
কত দিন পরে আমার মাথা হালকা হলো বলতে পারবো না তবে যখন আগের কথাগুলো মনে হলো তখন যেন কেমন স্বপ্ন বলেই মনে হতে লাগলো।
কি ভাবে কি হলো বোঝবার জন্য আমি এক নার্সের সঙ্গে ভাব জমালাম। নার্স বেশি কিছু জানতোও না। শুধু জানালো, এটা একটা পাহাড়ি অঞ্চলের স্বাস্থ্যকেন্দ্র মাত্র। আপনি স্টেশনে রাতে ঠান্ডায় অসুস্থ হয়ে পড়েন। অঞ্জান হয়ে পড়েন। পাহাড়ি আদিবাসীরা আপনাকে উদ্বার করে এখানে নিয়ে আসেন। অতিরিক্ত ঠাণ্ডার কবলে আপনি নিউমোনিয়া আক্রান্ত হন।
আমি আরো কিছু জানতে চাইছিলাম, কিন্তু পেলাম না। বুঝলাম এরা কেউ জানে না। তবুও বুদ্ধি করে প্রশ্ন করলাম- তাহলে আমার মাথায় কিসের আঘাত লেগেছিল?
– আপনি বসার সিট থেকে উল্টে পড়ে যান। পিছনের মাথায় ধাক্কা লাগে এক বড় প্রস্তরখন্ডে।
তাতেই এই বিপত্তি।
বৃথা চেষ্টা! আমি চুপ করে গেলাম।
– কবে ছুটি হবে?
ডাক্তার বাবু আপনার ছুটি দিয়ে রেখেছেন। আপনি ইচ্ছা করলে বাড়ি যেতে পারেন।
ধন্যবাদ — জানিয়ে নার্সকে বিদায় জানালাম।
হসপিটাল থাকে বেড়িয়ে পড়লাম। প্রথমেই স্টেশনের দিকে পা বাড়ালাম।
তন্য তন্য করে স্টেশন সংলগ্ন অঞ্চল খুঁজলাম।
কিছু বুঝতে পারলাম না।
পর্ব – ৬
দিন দশেক বিশ্রাম নিয়েছি। এখন অনেকটাই ভালো লাগছে। মনের জোর নিয়ে ঠিক করলাম আমায় এই ঘটে যাওয়া ঘটনার রহস্য উন্মোচন করতেই হবে। এটা স্বপ্ন বলে মানতে পারছি না। উদ্যোমের সঙ্গে প্রথমেই ওই রাজপ্রাসাদের খোঁজ করতে হবে। পথে নামলাম। শীতকাল দুপুর বারোটা, বেশ আমেজ ছিল। হাঁটতে শুরু করলাম। দেখলাম পাহাড়ি রাস্তা এবড়ো খেবড়ো হয়ে এঁকেবেঁকে চলেছে। সুন্দর প্রকৃতির প্রকাশ। কোনদিকে যাবো, কাউকে দেখতে পেলে খুব ভাল হত। খানিকটা হাঁটার পর একটা ঝুপড়ি চোখে এল। এক বয়স্ক ব্যক্তি চা তৈরি করছিল। সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম।
দোকানে কোন খরিদ্দার ছিল না। দেখে মনে হল উনি এখানেই থাকেন। আমাকে দেখেও না দেখার ভান করলো।
আমিই জানতে চাইলাম- চায়ে মিলেগা?
লোকটি কোন উত্তর দিল না। আমি বারবার জানতে চাইলেও কোন উত্তর এলো না। আমার মূল উদ্দেশ্য কাজে লাগলো না। কিছু সাহায্য পাওয়ার আশা ত্যাগ করে এগিয়ে চললাম।
আরো কিছুটা এগিয়েছি, সামনে একটা বাজার পেলাম। বাজার মানে পাহাড়ের কোলে বেশ কয়েকজন সব্জি বিক্রি করছে। ভালো লাগলো। আশা করে এগিয়ে গেলাম। এক মহিলা সব্জিবিক্রেতার সঙ্গে কথা চালালাম। ভদ্রমহিলা কেন জানিনা কথা বললো এবং অবাক হলাম ভাঙ্গা ভাঙ্গা বাংলায় কথা বললো। প্রথমে এখানকার বিষয় নিয়ে কথা বললাম। পকেট থেকে একটা একশো টাকার একটা নোট ওকে বাঙালি বলে উপহার দিলাম। গরীবলোক কিছুটা লোভে পড়ে গেল। ভাবলো আমি বোধহয় কোন সরকারি লোক, কিছু খবর দিলে কিছু পাওয়া যাবে। যদিও মুখে একটু লাজ দেখালো। কাজ হবে ভেবে খুশি হলাম। ও সব্জি গুটিয়ে নিয়ে, আমাকে ইঙ্গিত করলো যাতে আমি ওর সঙ্গে যাই। বাজারে ও কোন কথা বলতে চাইছিলো না।
— চলো আমার সনে।
— তাই চলো।
দশমিনিট হেঁটে ওর কুঁড়েঘরে গিয়ে উঠলাম।
দৈন্যদশা কাকে বলে? মহিলা একটা ভাঙ্গা
টুলে বসতে দিল। বললে – চা আনি।
আমি বাইরে বসে আর উনি ভিতরে চা বানাতে গেলেন। চারিদিকে ছোট ছোটো পাহাড়। বেশ মনোরম পরিবেশ।
চা খেতে খেতে জানতে চাইলাম- এখানে রাজবাড়ি কিছু আছে?
-কেনে বাবু?
– না একটু ঘুরে দেখতাম।
ও কোনো উত্তর দিল না। নিজের বাজার গোছাতে ব্যস্ত রইলো। দ্বিতীয় বার প্রশ্ন শুনে জানালো — আগে ছিল এখন আর নেই।
– কেন, কোথায় গেল?
— না, বাড়ি আগুনে পুড়ে নষ্ট হয়ে গেছে।
— সে কি? কেমন করে হল এসব?
আমি ওকে আরো একশো টাকার একটা নোট এগিয়ে ধরলাম। ও নিল। খানিকটা সময় চুপ করে রইলো। তারপর মুখ খুললো।
— আমি মান্ডি ওই বাড়িতেই কাজ করতেম।উখানে কর্ত্তা, গিন্নি আর উদের বাপটা থাকতো। এ থানের অনেকেই কাম করত উনাদের বাড়ি। একদিন রাতে সব শেষ হয়ে গেল।
মান্ডি সময় নিল। আমি ধৈর্যের বাঁধ ছাড়াচ্ছি।
— কি হয়েছিল সে রাতে?
স্বামী -স্ত্রী ঝামালা ছিল। মন অমিল। আমারা জানতেম। এক অমাবস্যায় রাতে স্বামী সকলকে মাইরা সব খতম করে দিল।
আমি কাঁপছিলাম ভিতরে ভিতরে।প্রকাশ করলাম না।
ওই বললে — সবাই শেষ।
আমি হঠাৎ কি মনে করে জানতে চাইলাম,
সকলের বডি পাওয়া গেছিল?
-হ্যাঁ। না, তবে গিন্নিমার বডি মেলে নি।
তারপর কি হয়েছে জানতে চাওয়ায় মান্ডি জানালো, ও বাড়িতে আর কেউ যেতে পারতেম না, ডর লাগতো। একবার বিতেন গেছিল ও বোবা হয়ে গিয়েছে।
– সে এখন কোথায়?
– একটু আগেই ওর ঘর আছে। চা বানায়।
এবার আমি ফেলে আসা বয়স্ক লোকটির কথা মনে করলাম। বুঝলাম তাই ও উত্তর দেয়নি। অনেক কথা জেনে মান্ডির ঘর ছাড়লাম। ভাবতে লাগলাম এবার কি করি?
গুটিগুটি পায়ে রাজবাড়ির পথ ধরলাম। বিকেল গড়িয়ে পাহাড়ে অন্ধকার নামছে। সে এক অপূর্ব দৃশ্য। কিন্তু আমার মন অন্যখানে অন্য কোথাও।
মান্ডির কথাটা মাথায় গেঁথে বসে গেছে – ‘গিন্নিমার বডি মেলে নি।’
পর্ব – ৭
ভারাক্রান্ত মনে হাঁটছি আর ভাবছি কি হতে পারে?
ভৌতিক? প্রথমে মনে হলেও এখন মন বলছে অন্য কিছু ঘটনা এর পিছনে লুকিয়ে আছে। সেটা আমায় জানতে হবে। আলেয়ার শ্বশুর আমায় কিছু খুঁজতে বলেছে নিশ্চয়ই। হয়তো ওনার অতৃপ্ত আত্মা এটা চেয়েছে। আর আলেয়া? সে যদি একটা মৃত ছায়া হয়ে খেলা করে তবে সে কি বোঝাতে চাইছে তাও বোঝা যাচ্ছে না। তবে ওর স্বামী যে আসল কালপিট তা বোঝা হয়ে গেছে।
সবার ডেডবডি যদি পাওয়া যায়, তাহলে আলেয়ার বডি কোথায় গেল?
চোখ তুলে দেখি আমার স্বপ্নে দেখা ভগ্নপ্রায় রাজবাড়ি আমার সামনে। অনেকটাই অন্ধকার নেমেছে। পাহাড় এখানে বাঁক নিয়েছে। আমি কিছু সময় নির্বোধের মত দাঁড়িয়ে রইলাম। প্রকান্ড লোহার গেট যেন আমায় হাতছানি দিয়ে ডাকছে।
লোভ সামলাতে পারলাম না। দ্রুতগতিতে ভিতরে প্রবেশ করলাম। প্রচন্ড গতিতে একটা ঝনঝনানি আওয়াজ তুলে গেট বন্ধ হয়ে গেল। নিস্তব্ধতার মধ্যে একটা দমবন্ধ করা পরিবেশ। গা ছমছম করা ভাব। আমি সাহস করে ভিতরে চললাম- যেন স্বপ্নের মত আগের ঘোরে আলেয়ার সঙ্গেই।
উঠোন পেরোতেই পিলে চমকে গেল। দেখলাম জমাট বাঁধা অন্ধকারে কালো কালো ছায়া মূর্তি সরে সরে যাচ্ছে। আমি ভুত বলে মানতেও পারছি না, আবার ভয়ে সিঁটিয়েও গেলাম। কি করবো বুঝতে পারলাম না। এগোবো, না কি পালাবো? পালানোই বুদ্ধিমানের কাজ। শুনলাম এখানে এসে অনেকেই বোবা হয়ে গেছে, ভয় পেয়েছে। কিন্তু পরক্ষণেই ট্রেনে আলেয়ার শ্বশুরের আকুতিও মনে পড়ে গেল। এখন আমি কি করবো? কি করা উচিৎ? মনে হয় আলেয়া বিপদেই পড়েছিল তাহলে আমি এত ভীতু হব কেন? আর ম়ৃত আত্মার ইচ্ছা যখন, তখন একবার সাহস করে ঢুকেই দেখি কি আছে কপালে?
ভিতরে আওয়াজ হচ্ছে। নানারকম। ভুতুড়ে কিনা জানিনা। তবে পরিবেশ ভয়ার্ত রূপ নিচ্ছে। মাকড়সা যেন জাল বিস্তার করে রেখেছে।
উঠোন পেরিয়ে ঘর। সব লন্ডভন্ড হয়ে। ধাক্কা খেলাম টেবিলে। খুব জোরে। ব্যথা সামলাতে যাবো, কোথা থেকে এক মহিলার কান্নার শব্দ পেলাম। সঙ্গে সঙ্গে গুলি ছুটলো.. আবার চিৎকার। আবার বোমা- গুলি এবার এক পুরুষ মানুষের আর্তনাদে, কিছু হুড়মুড় করে পড়ার আওয়াজ হলো।আমি দিশেহারা হয়ে অন্ধকারে পথ খুঁজতে লাগলাম।
সামনে সিঁড়ি মনে হল। সময় নষ্ট না করে উঠে গেলাম। মনে হলো কেউ যেন আমার পাশ দিয়ে চলে গেল। তারপর ফিসফিস শব্দ শুনতে পেলাম। কারা যেন কথা বলছে।
আর আমি ভয় পাবো না। কারণ আমার আর বেরোনোর উপায় নেই। সিংহের গুহায় যখন ঢূকেই পড়েছি তখন মৃত্যু অবধারিত। মরণই হয়তো আমাকে এখানে টেনে এনেছে। সুতরাং মরার আগে অন্তত একবার সাহস করে আলেয়ার জন্য কিছু করি। এই সাহসে ভর করেই আমি আলেয়ার শ্বশুরের ঘরে উঁকি মারলাম।
উরি বাবাঃ। দেখে পিলে চমকে গেল। ঘর ভর্তি অশরীরী কালো কালো ছায়া মূর্তি কিছ যেন করছে। ধোঁয়া ভরে রয়েছে। কটু গন্ধ। তবে গন্ধটা যেন বেশ চেনা। জানালাটা আরো একট ভাল করে খুলতে গিয়েই বিপত্তি ঘটিয়ে দিলাম। ভিতরে ছায়ামুর্তিরা লাফালাফি করে উঠলো। দুমদাম আওয়াজ হলো। কান্না হাসির রোল উঠলো। দমকা বাতাসের শব্দ। ভয়ে সিঁটিয়ে গেলাম। বুঝলাম আমি ওদের নজরে। সবাই আমাকে ঘিরে ফেলেছে। সবার হাতে অস্ত্র। পালাতে গিয়ে পড়ে গেলাম। চারদিকে ভৌতিক পরিবেশ আমাক খেতে এলো।
হঠাৎই। একটা তীব্র আলোর রোশনাই ছিটকে এলো। চোখের মধ্যে আলোটা ঠিকরে পরছে। আমি জ্ঞান হারালাম।
পর্ব – ৮
চেতনা ফিরে পেয়ে চোখ মেলে তাকালাম। এ আমি কোথায়? চারদিকে উর্দ্দিধারী পুলিশ। আমি একটা চেয়ারে বসে। চোখে মুখে জলধারার অবশিষ্টাংশ। আমাকে একজন ধরে রয়েছে পিছু থেকে। আবার সব মনে করার চেষ্টা করলাম। মনে পড়তে সময় লাগলো না। আমি ভুতের গুহায় ছিলাম – কি করে যে এখানে এলাম বুঝতে পারছি না।বোঝার চেষ্টা করছি। তার মানে আমাকে পুলিশে ধরে রেখেছে।
আমি কি কিছু অন্যায় করে ফেলেছি? এই সব ভেবে ভীতু এক লেখক হাত পা পেটের মধ্যে নিয়ে ফেলেছি।
সামনে ওসি বসে। আমাকে দেখে হাসছে। আরো ভয় পেয়ে গেলাম এবার বুঝি আমায় কোর্টে চালান দেবে। চারপাশে অনেক আদিবাসী লোক দাঁড়িয়ে ভিড় করে রয়েছে।সকলেই মজা দেখছে যে এক বাইরের লোক এসে এখানে ঝামেলা করেছে।
আমি সকলের মুখগুলি দেখছি। হঠাৎই চোখে এল মান্ডিকে আর সঙ্গে সেই বোবা চা ওয়ালাকে। আমি আরো ঘাবড়ে গেলাম।
ওসি আমার দিকে চেয়ে মুচকি -মুচকি হাসছে। বোঝাচ্ছে দ্যাখ বেশি পাকাপোনা করার ফল কেমন পাস।
হঠাৎ ওসি একেবারে শুদ্ধ বাংলায় বললে- কি খুব ভয় পেয়েছেন? আপনি তো বেশ সাহসীই!
আমি একটু অবাক হলাম। বুঝলাম উনি একজন বাঙালী।
– না না ভয়ের কিছু নেই। আপনি শান্ত হয়ে বসুন। আপনার চেষ্টায় আজ একটা বিরাট অভিযানে আমরা সফল হয়েছি।
আমি কি শুনছি? বুঝতে না পেরে বোকার মত চেয়ে রইলাম।
ওসি সাহেব বললেন- আপনার সাহসের জন্য আজ বহুদিন বাদে একটা ঘটনার রহস্য উন্মোচিত হল। জানেন আপনি কতবড় কাজ করেছেন?
আমি ভুত ছাড়া কিছুই জানিনা। তাই উত্তর দিতে পারলাম না। চুপ করে জানতে চাইলাম।
ওসি বললো- একটা স্মাগলিং গ্রুপ আজ ধরা পড়লো। যারা বছর তিনেক ধরে ওই ভগ্নপ্রায় রাজবাড়িতে ভুত সেজে কারবার চালাচ্ছিল। আমাদেরও বোকা বানিয়ে রেখেছিল। এখান কার সব আদিবাসীও ভয়ে তাই বুঝতে পারেনি।
আমি মান্ডির মুখের দিকে চাইলাম। ওসি দেখলো। ‘হ্যাঁ, ঠিকই এই মান্ডির জন্য আপনিও বাঁচলেন। আমরাও রাস্তা পেলাম। ওই এসে খবর দিয়েছিল যে আপনি রাজবাড়ি যাচ্ছেন।’
এবার আমি জানতে চাইলাম- কিন্তু মান্ডিকে তো আমি কিছু বলিনি?
–না ও জানতো আপনি সেই কাজেই খবর সংগ্রহ করছেন।
আমি অবাক। আরো অবাক হলাম যখন ওসি আরও ভেঙে বললেন।
— আর ওই চা ওয়ালা হারুণ আদৌ হাবাবোবা নয়। ও রাজবাড়ির সব ব্যাপারটা জানতো। সব ধরে ফেলেছিল। তাই ওকে প্রাণে মেরে দিতেও গেছিল। ও ওদের কাছে প্রতিজ্ঞা করেছিল ও সারাজীবন বোবা সেজেই থাকবে। কাউকে কিছু বলবে না। এটা যদিও সহজে হয়নি আপনার ওই আলেয়ার স্বামী রাজকিশোর বাবুই ওকে মাফ করে দিয়েছিলেন। কারণ ও ছিল ওদের বংশেরই ওরসজাত এক পুর্বপুরুষ। হারুণ যদি আমাদের এই কথা আগে জানাতো তাহলে আমরা কাজটা সহজেই করতে পারতাম। আজ আপনার বিপদ দেখে মান্ডিটই ওকে এখানে নিয়ে আসে। আর এই সুযোগে আমরা আপনার পিছনে ধাওয়া করি আপনাকে বুঝতে না দিয়ে- তাই কাজটা সহজ হলো।
আমি বোকার মত চেয়ে- তাহলে ভুতেরা? আর অতো শব্দেরা?
– ওগুলো সব সাজানো। লোককে বোকা বানাতে। আমরা তো ভুত না মানলেও ওই বাড়ি নিয়ে মাথাই ঘামাই নি। রাজকিশোর জমিদার আন্তর্জাতিক চোরাকারবারের একজন হর্তাকর্তা।
আজ সবাই ধরা পরে গেল।
আমি আশস্ত হলাম। আসল প্রশ্নের উত্তর খুজঁতে ওসির মুখে তাকালাম।
– না। সরি ওদের বাঁচাতে পারিনি। ওরা অনেক আগেই ওর শিকার হয়ে গেছিল।
– কিন্তু কেন?
– আলেয়ার শ্বশুর মানে রাজকিশোরের বাবা এটা মানেনি। প্রতিবাদ করেছিলেন। বৌমাকে নিয়ে পরিকল্পনা করছিলেন কি করা যায়। আলেয়াও অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল। রাজকিশোর বুঝতে পেরে সেই রাতেই ওদের শেষ করে দেয়।
– ওদের কি ডেডবডি পেয়েছিলেন?
— আলেয়ার পাওয়া যায়নি। এটা রহস্যই রয়ে গেছে।
আমি চুপ। এবার আমি কি করবো? আমার কাজতো শেষ হলো না। আলেয়া কোথায় হাওয়া হয়ে গেল। ও যে আমার বড়ই প্রাণের। ওই তো আমায় টেনে এনেছে এখানে। আমি শেষ দেখতে চাই!
– যাক। আপনার নাম আমরা প্রধান দপ্তরে পাঠিয়েছি একজন সাহসী লেখক হিসাবে। আপনি এখন কি করতে চান?
আমার মাথায় আর কিছু কথা ঢুকলো না।আমি ওদের ধন্যবাদ জানিয়ে থানা থেকে বেড়িয়ে পড়লাম। মান্ডি আর হারুণ আমার সঙ্গে এলো।
আমার হাত ধরে নিল- সাব আমাদের কোঠিমে চলিয়ে।
পর্ব – ৯
মান্ডি আর হারুণের হাত ধরে মান্ডির ঘরে চলে এলাম। মান্ডি বেশ খাতির করছে। হয়তো ওদের মালকিনকে ওরা ভালবাসতো তাই। আমাকেও পারলে একটু খুশি করে, এমনই ভাবখানা।
মান্ডি খাবার বনাতে থাকলো। আমি আমার ব্যাগ ঘোছাতে ব্যস্ত রইলাম।
মান্ডি জানতে চাইলো- কেয়া বাত সাব?
আমি চাইছি কিছু কথা আলোচনা চালাতে। ওদের জানাতে চাইছি আমার মনের দদ্দ্বটা।
ওরা বুঝতে পারলো। কিছু খাবার খাওয়ার পর আমরা তিনজনে বসে পড়লাম।
– সব রহস্য রয়ে গেছে। আমাকে আলেয়াই সমস্ত ঘটনা ঘুরিয়ে দেখিয়েছিল। সম্ভবত ওর আত্মাই এই কাজ করে থাকবে। তা হলে ধরে নিতে হয় ও মারা গিয়েছিল।
হারুন আর কথা বলতে দিল না- সাব আপকা থোরাসা গলতি হোতা হ্যায়। উসিকা শ্বশুর জি আপকো এহি সব বাতায়া, দেখায়াভি।
মান্ডি সব কথা শুনে হারুনকে বললে- এক কাম কিজিয়ে দা ‘সাব গুনিনজিকি পাশ চলিয়ে। সব সাচ মিল যায়েগা।
হারুন লাফিয়ে উঠলো- এহি একদম আচ্ছা হোগা।
আমি চুপ করেই ছিলাম। আমি এইসব বিশ্বাস করিনা।
হারুন সব বুঝে গেল। দেখিয়ে সাব আভি দুসরা কহি রাস্তা নেহি। এ গুনিন বহুৎ পুরানা আদমি হ্যায় ইধারকা। একবার যানেসে মালুম হো জায়েগা। আউর রাস্তা ভি মিলেগা।
মান্ডিও রাজী। আমার এখন ছটফটানি মন। মানতেও পারলাম না ফেলতেও পারলাম না। একপ্রকার রাজী হয়েই গেলাম।
গ্রামের শেষে শশ্মান। আর তার বাম পাশে যে পাহাড়টা ঢালু হয়ে নেমে এসেছে তার পাশেই পর্ণকুটির।
মান্ডি আর হারুন ঢুকে কথা বলে এলো।আমাকে নিয়ে ভিতরে ঢুকতেই গুনিনটি চিৎকার জুড়ে দিল – এ কৌন আছে? ইসিকা সাথ বিশ্বওয়াস না আছে।
ব্যাটা বুঝতে পেরেছে আমার কাছ দিয়ে ওর আমদানি ভাল হবে না।
মান্ডি আর হারুন ও সব কিছু শুনেও শুনলো না। ওনাকে সমস্ত ঘটনা বিস্তারিত বললো। গুনিনজী সব ধৈর্য্য ধরে শুনলো- গুনানে পড়েগা।
গোনা – গুনির কাজ করতে থাকলো। মান্ডি আর হারুন হাত জোড় করে বসে। আর আমি মজা দেখতে থাকলাম। অনেক সময় চলে গেল।
গুনীনিজি গুনে গুনে অস্থির হয়ে উঠলেন। সঙ্গে ছিল মড়ার খুলি, বড় বড় কড়ি আর তামার পয়সা।
হাঁক দিয়ে জানালে- নেহি নেহি ও আভিতোক জিন্দা হ্যায়।
আমি তড়াক করে উঠলাম। মনের মত কথা। কিন্তু ব্যাটার ছেলে ভন্ড কায়দা মারছে এই ভেবে চুপসে গেলাম। চক দিয়ে এঁকে বললেন – ভাগবান কা দিক মে দেখাতা হ্যায়।
আমি লেখক হওয়ার কারণে ওর হেয়ালি সহজেই বুঝে গেলাম- মানে উত্তর দিকের কথা বলছে।
মান্ডি আর হারুন না বুঝে অনেক প্রশ্ন করে চলেছে। অনেক কিছু জানতে চাইছে আর ভন্ড সব উত্তর দিয়ে দিচ্ছে।
একটা কথা আমার কানে এল- উসিকা শ্বশুর জী কা প্রেত মেই এয়সা কুছভি কিয়া থা।
উসকা শান্তি হুয়া নেহি। আলেয়া কা রূপ
সে ওহি দেখা দিয়া। হামারা হিসাব নিকলায়া আলেয়া আভিতোক জিন্দা হ্যায়। কথাগুলো ও বেশ জোরের সঙ্গেই বললো।
অনেক কিছু জানার পর আমারা তিনজন ওখান থেকে ফিরে এলাম।
সুযোগ খুঁজছিলাম। মধ্যরাতে সকলে ঘুমালে আমি অতি সন্তর্পণে ঘর ছাড়লাম।
পথ খুঁজে আবার স্টেশনেই চলে এলাম।জানতাম, যে ট্রেনটায় আমি এখানে নেমেছিলাম, সেই ট্রেনটা এখনি এখান দিয়ে পাশ করবে। টিকিট কাটার কথা মনে এলো না। শুধু একটা কথাই মনে বসে গেছে- উত্তর দিক। বারবার জলন্ধর নামটা চলে এসেছিল। তার মানে কি বোঝাতে চাইছিল সবাই?
যদি ভুতের কথাই মানি অথবা ভগবানের কথাই মানি- তাহলে উত্তর দিক মানে জলন্ধর কেই বোঝায়। সময় নষ্ট করা ঠিক হবে না আর সবাইকে নিয়েও কাজ করা যাবে না। তাই লুকিয়ে চলে এলাম ।
ট্রেন এসে গেল। জলন্ধর এক্সপ্রেস। তড়িঘড়ি উঠে পড়লাম। কোনকিছু না দেখে না বুঝে। উঠেই বিপদ! এ আবার অন্য ফ্যাসাদে পড়লাম। চক্ষু চড়কগাছ। একেবারে ধরা পড়ে গেলাম।
অন্তিম পর্ব
ট্রেনে উঠেই দেখি একেবারে কালোকোর্ট পড়ে চেকার সাহেব যেন আমার জন্যই অপেক্ষা করছে।
টিকিট নেই তার উপর ফার্স্ট ক্লাস। অল্প টাকা ছিল, ম্যানেজ হলো না। তার উপর চেকারের দাবি ওনাকে রসিদ কাটতেই হবে। নাহলে অসুবিধা, ওনাকে ডেলি কিছু কেস নাকি দিতেই হয়। আমাকে নিয়ে জলন্ধর স্টেশনে নিয়ে অফিসারের কাছে তুলে দেবে। উনি মাফ করলে মাফ। আমার অসুবিধা হওয়ার কথা নয় দিব্যি দাঁড়িয়ে রইলাম। ভোর বেলায় তো নেমেই যাব।
অনেক টিকিটবিহীন যাত্রী ছিল ট্রেনে। সবাইকে নিয়ে জি আর এফ স্টেশনের একটা ঘরে তুললো।
আমি নিরুপায়। উপায় পাচ্ছি না।
ভুতের বোধহয় বিশেষ কৃপা আমার উপর। না হলে মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসি। তাই হল, থানার বাঙালী ওসি আমাকে দেখে দৌড়ে এলেন- আরে আপনি?
সব জানলেন। একমিনিট লাগলো না, আমি ছাড়া পেয়ে গেলাম। উনি খাতির করে আমায় জীপ গাড়িতে তুললেন — দেখেছেন কি কান্ড? কাল রাতে আমি জীপ নিয়ে জলন্ধর এসেছিলাম। এখন ফিরতি পথে আপনাকে এই অবস্থায় দেখে ফেললাম। যাক কোথায় যাবেন? নিশ্চয়ই কোন অভিযানে।
হেসে ফেললাম। সত্যি উনি একজন সজ্জন ব্যক্তি। উনি আমার জীবনদাতা। ওনাকে সব খুলে বললাম আমার মনের ইচ্ছা। গুনিনের কথাও জানালাম।
উনি এক মিনিট চুপ করে থেকে বললেন- আমার কাজ হয়ে গেছে। ফিরছিলাম। তা আপনার কাজে আমায় নিতে পারেন। আমারও খুব ইচ্ছা হচ্ছে। যদি সঙ্গে যেতে পারমিশন দেন?
আমি লজ্জায় মরে গেলাম- আরে এ আপনি কি যে বলেন? আমি পারমিশন দেব? আরে আপনি সঙ্গে থাকলে আমার কাজ সার্থক হবে এব্যাপারে আমি নিশ্চিত।
– তা হলে কাজটা আমায় করতে দিন। মানে আমিই অপারেশনটা করবো। আর আপনি শুধু সঙ্গে থাকবেন। আমি এখানকার সব চিনি এবং আমাকেও সবাই চেনে।
আমি খুব খুশি হলাম। হাত বাড়িয়ে দিলাম- একদম। উনিও হাত মেলালেন- ডান।
জীপ ছুটে চললো। পাহাড়ি এলাকায় ধুলো উড়ছে – মুখ চোখ কালো হয়ে যাচ্ছে। এক দুর্নিবার আকর্ষণ আমাদের রোমাঞ্চিত করতে থাকলো।
বুঝলাম উনি অভিঞ্জ। উনি পরিকল্পনা সাজিয়ে ফেলেছেন। চুপচাপ ওনাকে ফলো করতে থাকলাম।
অনেক পথ পার হলাম। জীপ এসে থামলো একটা বড় গেটের সামনে। ভিতরে গাছ, ফুলের বাগান। ইংরেজিতে লেখা ” মিশন”। ব্যাপারটা বুঝলাম। উনি আমাকে নিয়ে ভেতরে গেলেন। একটা অফিস গোছের ঘরে দেখলাম দুইজন মহিলা বসে আছেন।
বাঙালী ওসি ভদ্রলোক ওনার পরিচয় দিলেন। এতক্ষণে ওনার নাম জানতে পারলাম- পরিমল ভট্টাচার্য। আগে নামটা জানা হয়ে ওঠেনি।
পরিমল ওসি সব বুঝিয়ে বললেন। ওনাদের হেল্প চাইলেন। দুই মহিলা বেশ শিক্ষিতা ও রুচিশীলা বলেই মনে হল। রেজিস্টার খুলে দেখলেন কি সব।
দু’ তিনবার ফোনে কথা বললেন। বুঝলাম বছর দুই বা তিন আগের আগত মহিলাদের খবরাখবর সংগ্রহ করতে চাইছেন উনি। দু’টি আশ্রমের নাম লিখে দিলেন। আমরা বেড়িয়ে পড়লাম সন্ধানে।
পরের আশ্রমে এসে ওসি অনেক খবর নিলেন। ভিতরে গিয়ে খোঁজ ও করলেন। সুবিধা হলো না।
গাড়ি ছুটেই চললো সারাদিন। অনেক ঘোরাঘুরি করে অসফল হয়ে পড়েছি। যাবার সময় শেষ একটা আশ্রমে পৌঁছুলাম। বিকেল হয়ে গেছে।সূর্য ডুবুডুবু। পাহড়ি এলাকা রক্তিম আলোয় ঢেকে গেছে। ম্যানেজার চেষ্টা করছিলেন। আমরা ঘরে বসে। সামনে বড় লোহার রডের জানালা। সমস্ত আশ্রমের মহিলারা বাগান ছুঁয়ে প্রার্থনা স্থলে যাচ্ছেন, আমি সেই দৃশ্য দেখছি। হঠাৎই চমকে উঠলাম, আলেয়া যেন চলে গেল মনে হল। হয়তো আমার মনের ভুল, আমি চকিতে জানালার সামনে চলে গেলাম। ও কি আমায় দেখেছে? জানিনা। তবে ওসি পরিমল বাবু ঠিক দেখে নিয়েছে। সত্যি স্বীকার করছি একজন ওসি হিসাবে উনি একদম নিখুঁত। নিখুঁত ওনার চাল। উনি সবেগে ভিতরে চলে গেলেন।
আমি বাইরে ছটফট করছি। আধাঘন্টা কেটে গেল। কোনো খবর নেই। পরিমল বাবু শেষে বেড়িয়ে আমায় একটান মেরে বাগানের দিকে নিয়ে গেলেন। আমি জানতে চাইলাম। উনি হাসলেন — ইউ আর গ্রেট!
দুরে একটা বেঞ্চে বসেছিল আলেয়া। আমি দেখে অবাক। দেখি ও আমাকেই দেখছে। পরিমলবাবু অল্পকরে বললেন- বদমাশদের একজন ওনাকে বাঁচিয়ে দিয়েছিলেন..ম়ৃত বলে।
আমি শুধুই আলেয়াকে দেখছি। কিছু জানার প্রয়োজন নেই। তাতে আমার কিছু যায় আসে না। ওটা ওসির কাজ উনিই করুক। আলেয়ার পাশে গিয়ে বসলাম। ওর হাতটা ধরলাম। আলেয়ার চোখে জল — বাবা মার লোভ আজ আমাকে এখানে এনে ফেলেছে।
আমি ওর হাতটা চেপে ধরলাম। ও করুণ ভাবে অনুরোধ করলো- তুই আমাকে যেতে বলিস না। আমি শেষ জীবনটা এখানেই থাকতে চাই।
আমার সব পাওয়া হয়ে গেছে। তাই মেনে নিলাম।
পরিমল বাবু অফিসিয়াল কাজে ওকে নিয়ে আশ্রমের অফিসে হানা দিল।
আমি বাইরে দাঁড়িয়ে। কিছু বাদে ওসি পরিমলবাবু জীপ থেকে আমায় ডাক দিলেন – লেখক বাবু চলে আসুন, আমার কাজ হয়ে গেছে, এবার ফিরতে হবে। আমি একবার আশ্রমটাকে ভাল করে দেখে নিলাম যদি আর একবার আলেয়ার দেখা পাই। না আর দেখা হল না।
এগিয়ে জীপের সামনের সীটে বসতে যাবো, পরিমল বাবু ইশারা করে পিছনে বসতে বললেন, খারাপ লাগলো উনি বোধহয় আমাকে আর কাছে বসাতে চাইছেন না। পিছনে উঠে বসেই অবাক। এ কাকে দেখছি?
আলেয়া আমার হাতটা ধরে টেনে নিল। আমি একেবারে ওর কাছে চলে গেলাম। ও আমার কাছে আরো সরে এল। আমি পারলাম না, তোকে ফেরাতে.. বলেই হুহু করে কেঁদে উঠলো।
সামনে বসে স্ট্রিয়ারিং হাতে পরিমলবাবু হেসে উঠলো- আমি থাকতে তা আর কি করে হতে দিই?
জীপগাড়ি ছুটে চললো।
সমাপ্ত।
–