যেখানে বাঘের ভয় ….
– ব্যানার্জী শান্তনু
রাত বারোটা বেজে গেছে। গোমর নদীতে বোট চলছে। নিকষ অন্ধকার। ডিসেম্বর মাস। চারদিকে ছোট বড় নানা আয়তনের দ্বীপ। এদিক ওদিক করে এগিয়ে চলেছে আমাদের বোট। গন্তব্যস্থল দুলকি গ্রাম। যাত্রী সংখ্যা হবে ছত্রিশের মতন। রান্না চলছে নীচে ইঞ্জিন সংলগ্ন ঘরে। ছোট একটা আলো আছে তবে জ্বালানো হয়নি।
ঘন কুয়াশা। বোট চলছে আস্তে ধীরে । রাতে বিশেষ কারণ ছাড়া বোট চলে না । সে অর্থে প্রয়োজনও নেই । তবে ভারত বাংলাদেশের জলপথে জাহাজের আনাগোনা আছে। দূর থেকে মাস্তুলের আলো দেখা যায়। নির্দিষ্ট দূরত্ব রেখে সারি দিয়ে জাহাজ যাতায়াত করে। পণ্যবাহী জাহাজ। আছে জায়গায় জায়গায় নদী পারে লাল আলোর দিক নির্দেশকারী নিশানা। কারণ অনেক জায়গায় পলি পড়ে নাব্যতা কমে গিয়েছে। দিনের বেলা অবশ্য অনেক জায়গায় গাছে সাদা কাপড়ের টুকরো বাধা থাকে দিক নির্দেশের জন্য। আরেকটা বিষয় হল অনেক সময় কোনো জায়গায় গাছে লাল কাপড় বাধা থাকে। জঙ্গলে যারা মধু সংগ্রহ করতে যান তাদের জন্য সতর্কীকরণ। অর্থাৎ ঐ পথে বাঘ কাউকে তুলে নিয়ে গিয়েছে। আর আছে নদীর পাড়ে কিছু জায়গায় বনবিবির মন্দির।ধর্ম নির্বিশেষে মৌলেরা এখানে পুজো দিয়ে মধু সংগ্রহে যায়। ব্যস্। ভয় ভয় ভাব নিয়ে সবাই বাঘের সম্পর্কে নানা প্রশ্ন শুরু করলো।
এহেন অবস্থায় আলো জ্বালতে হলো। একজনের জন্মদিন। বন্ধুরা কেক নিয়ে এসেছে। বোট চলা অবস্থায় তা পালন হবে। নিস্তব্ধতার মধ্যে মানুষের আওয়াজ চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল।
এত দেরী হবার কারণ হচ্ছে কুয়াশা। সারা ভারতেই এখন কুয়াশার দাপট। বিমানের ওঠা নামা অনিয়মিত। তাই চোদ্দটি চিকিৎসক পরিবার দিল্লি থেকে ট্রেনে করে এসেছেন। কিন্তু লাভ হয়নি। সকাল এগারোটার বদলে সন্ধ্যা ছয়টার সময়ে হাওড়া স্টেশনে ট্রেন পৌঁছায়। যাত্রীনিবাসে পরিচ্ছন্ন হয়ে একটু খেয়ে নিয়ে সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় রওনা হওয়া গিয়েছিল সুন্দর বনের গতখালির উদ্দেশ্যে। রাত সাড়ে এগারোটা বেজে গিয়েছিল পৌঁছতে। তারপর মালপত্র বোটে তুলে যাত্রা শুরু। রীতিমতো অ্যাডভেঞ্চার একে রাত, তার উপর সবাই নূতন।
দু’টি পরিবার ছাড়া সবাই অবাঙালি। নদীবহুল জায়গায় ঘোরা অভ্যাসের মধ্যে পড়ে না। অনেকের মধ্যেই ইতি উতি একটু ভয়ের চিহ্ন দেখা গেল। যখন জানা গেল আরও দু’ঘণ্টার উপরে জলপথ পেরোতে হবে। কম সময়ে এভাবে সুন্দরবন ঘুরলে আনন্দ একটা পাওয়া যায় ঠিকই তবে ঠিক ঠাক ঘুরলে মোটামুটি সাত দিন লেগে যায়। বোটেই ভ্রমণ এবং খাওয়া দাওয়া আর মাঝে মধ্যে ওয়াচ টাওয়ারে ওঠা। এদেশের তুলনায় বাংলাদেশের সুন্দরবন আয়তনে বড়ো।
দেখতে দেখতে দুলকি গ্রামের নদীপাড় পৌঁছে গেলাম। অন্ধকার এবং প্রচণ্ড ঠাণ্ডা। রাত দুটো পেরিয়ে গেছে। নামতে হবে। তারপর এক কিলোমিটার হেঁটে রিসর্টে পৌছতে হবে। ভয়ে সকলের মুখ শুকিয়ে গেছে। বোট থেকে নদীর পাড় অনেক ফারাক। লাফিয়ে নামা যাবে না। তাই সরু পাটাতন লাগিয়ে দেওয়া হলো। তাতে মাঝে মধ্যে ছোট ছোট কাঠের টুকরো লাগানো আছে যাতে পা হড়কে না যায়। উপরে একজন এবং নিচে একজন একটা বাঁশ ধরে দাড়িয়ে আছে রেলিং এর মতো করে। প্রথম নামলেন একজন মহিলা চিকিৎসক। তাকে দেখে অন্যরা নামতে শুরু করলেন। যদিও সবকিছু সহজ হয়নি।
আসার সময় বাঘের গল্প অনেক হয়েছে। তাই সকলের মধ্যে একটা ভয় তো আছেই। কেউ পেছনে থাকতে চাইছে না। শোনা হয়ে গেছে যে বাঘ পেছন থেকে আগে আক্রমণ করে। সামনে একজনের হাতে টর্চ দিয়ে আমি সবার শেষে দাঁড়িয়ে বললাম রিসর্টের দিকে এগোতে ।
হঠাৎ একটা জোরালো ঝাপটা খেলাম। মাটিতে পড়ে গেছি। মনে হলো একটা ভারী কিছু আমার উপর দিয়ে চলে গেল। বেশ ভয় লাগল। তবে কি বাঘ ! আমাকে ছেড়ে দিয়ে চলে গেল! ওরা কেউ জানতে পারেনি। এগিয়ে গেছে। সাহস সঞ্চয় করে উঠে দাঁড়িয়ে তাড়াতাড়ি হাঁটা শুরু করলাম।
আকাশ ফরসা হলো। একটু বেলাতে চা পান করে ছুটলাম সেই জায়গায় যেখানে ঘটনাটা ঘটেছিল। আশেপাশের লোকজন জানাল যে দু’দিন আগে বাঘ এসেছিল ঐ জায়গায় কিন্তু সকাল সাড়ে দশটার সময়।
কিন্তু ধাক্কাটা কিসের ছিল। …..বাদুড়! বন বাদারের জায়গা তো।
ঘটনাটা বছর পাঁচেক আগেকার।
অসাধারণ লিখেছেন বন্ধু