গিরগিটি
– সুজিত চট্টোপাধ্যায়
মার্ডার মশাই মার্ডার। মার্ডার উইথ রেপ।বডি, রেললাইনের ধারে। একটি মেয়ে, মানে কিশোরী। স্থানীয় লোকজন বডি ঘিরে বিক্ষোভ দেখাচ্ছে। তাড়াতাড়ি আসুন, কেস জন্ডিস।
এ ডাল থেকে সে ডাল, সে ডাল থেকে ও ডাল।দে মা আমায় গিরগিটি করে। ক্ষণে ক্ষণে রঙ বদলের ক্ষ্যামতা দে মা। জার্সি পাল্টাই আর করে কম্মে খাই।ভোট বড়ো বালাই রে মা। ভোট আছে, তাই টুপাইস কামাই আছে। এ ডাল সে ডাল করি কী সাধে রে মা। কামাই যেদিকে জামাই সেদিকে।তুইতো জানিস মা, টু-পাইস এর ভাগিদার কতো।দল আছে , চামচা পোষার খরচ আছে। ওরাই তো আমার আসল শক্তি মা।
সংগঠন রে মা সংগঠন। সঙ সেজে বাহিনী গঠন। নিখরচায় কি তা সম্ভব , তুই বল মা। তাইতো একটু আধটু হাতসাফাই, মানে তোলা বাজি, চমকানো ধমকানো। নেতা সাজার ঝক্কি সামলাতে না পারলে, বেসামাল হয়ে কেৎরে পরতে হবে যে মা। চামচিকেতেও লাথাবে।একটাই নীতি গো মা, যখন যেমন, তখন তেমন। পরিস্থিতির দাস রে মা। একটু মানিয়ে গুছিয়ে নিস মা। ঝপাং…
না না, চিন্তার কিছু নেই, ঝপাং হলো গঙ্গায় ডুব দেবার শব্দ। বেনারসের দশাশ্বমেধ ঘাটে, গুনে গুনে তিনটি ডুব দিয়ে, ভিজে কাপড়ে বাবা বিশ্বনাথের মাথায় পিওর দুধ, আর বেলপাতা চড়াতে হবে।
মানত ছিল কিনা। মা গঙ্গা, বাবা বিশ্বনাথ দু’জনেই আমার ডাকে সাড়া দিয়েছেন। ভোটে জিতেছি। দল বদল, ভোল বদল, বোল বদল করে, তবে না দেব দেবীর আশীর্বাদ ধন্য হলাম। নইলে কপাল চাপড়ে চিত্তির হয়ে ঘরে খিল আটকে বসে বসে মাথার চুল ছিঁড়তে হতো। জয়বাবা, এবার মন্ত্রীত্ব পাইয়ে দাও বাবা।
জনগনেশের পালস বুঝতে হয়। হাওয়াও দিক বদলায়, নদীও গতিপথ চেঞ্জ করে। পরিবর্তন প্রিয় জগৎ। একজায়গায় আটকে থাকলে শ্যাওলা জমবে। এডিস মশার আঁতুড়ঘর হবে।
রাজনৈতিক লংজিবিটি চাও তো হনুমান হও। লাফ মেরে ডাল বদলাও। পুরনো দলের, মানে যে দলে এতদিন মাতব্বরি করে ক্ষীর পায়েস খেয়েছ, তার নামে যাচ্ছেতাই করে বদনাম করো। কুকীর্তির ভান্ডা ফাটিয়ে দাও। তবে তো নির্ঘাত বার্তা দেওয়া যাবে, তুমি সৎ সত্যবাদী যুধিষ্ঠির। ধোওয়া তুলসীপাতা।
আরে বাবা সবই পলিটিক্স। নো পারমানেন্ট মিত্র। নো পারমানেন্ট শত্রু। ঝোপ বুঝে কোপ মারো। আখের গোছাও।
কলিকালে শক্তি দুইপ্রকার। এক প্রশাসনিক শক্তি, দুই রাজনৈতিক শক্তি। শক্তির উৎস কোথায়? ভোটদাতাদের আশীর্বাদ। সেই আশীর্বাদ পেতে হলে কী করতে হবে? প্রতিশ্রুতির বন্যা, ধর্মের সুড়সুড়ি আর বিরোধী পক্ষ কে যারপরনাই খিস্তি দিতে হবে।
অবিশ্যি এতেও যে পুরোপুরি চিঁড়ে ভিজবে তার গ্যারান্টি নেই। তাই প্ল্যান নাম্বার টু মজুত রাখতে হবে। বোমা, পিস্তল, হুমকি, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, জবরদখল, ভোট লুঠ।
টিভিতে কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের সরাসরি সম্প্রসারণ। ব্রেকিং নিউজ। রক্তাক্ত আস্ফালন।
দিনের শেষে, শান্তিপূর্ণ ভোটের নিশ্চিন্ত সমাপন। গনতন্ত্র মাইকি জয়..
এসো, আমার রাজা এসো। সোনার চাঁদ দুলাল আমার রাজা হয়েছে।এসো হোলি খেলবে এসো। অকাল হোলি। বাদ্যি বাজাও, নাচো নাচো, হুল্লোড় করো, জয়ধ্বনি দাও। আকাশ বাতাস মুখরিত হোক। দুলাল আমার রাজা হয়েছে।
ও বাবা দুলাল, সব কথা রাখবে তো? যা যা বলেছিলে, মনে আছে তো, ভোটের আগে ?
বেশি কিছু নয়। রোটি, কাপড়া আর মকান।
ও বাবা দুলাল, মনে আছে তো?
দুলাল দা, বহুত ফেঁসে গেছি। একদম যা-তা কেস..
দুলাল দে। সদ্য নির্বাচিত জন প্রতিনিধি। নিজের বাড়ির একতলায় রমরমা ভিড়।
কয়েকটি জায়গা আছে, যেখানে ভিড় দেখলে কেউই আশ্চর্য হয় না। নেতাদের আসর তাদের অন্যতম। ধান্দাবাজদের মন্ত্রণা কক্ষ।
অবিশ্যি ব্যতিক্রম নিশ্চয়ই আছে। সব্বাইকে এক পঙক্তিতে বসানো যায়না। উচিৎও নয়।
দুলালদা বিরক্তি ভরা চাহনিতে ওদের দেখে নিয়ে,রুক্ষ স্বরে বললো, কী হয়েছে, কী ব্যাপার..?
কালু কাঁচুমাচু মুখে আমতা আমতা করে বললো, মানে, দাদা..খুন হয়ে গেছে..
দুলাল কপাল কুঁচকে, কঠিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো, মানে? কে খুন হয়েছে? কে করেছে?
কালু আর নেলো, দু’জন একসঙ্গে ধরাস করে দুলালের পায়ের ওপরে কাটা কলাগাছের মতো হুমড়ি খেয়ে পড়লো।
– দাদা, বিরাট ভুল হয়ে গেছে দাদা..এবারের মতো বাঁচিয়ে দাও দাদা.. আর কক্ষনো এমন হবে না।
দুলাল বিরক্ত হয়ে, ঝটকা দিয়ে ওদের সরিয়ে দিয়ে বললো, আরে ধুস, কী হয়েছে বল না, ফালতু চ্যাঁচামেচি সকালবেলা..
ঠিক তখনই দুলালের ফোন বেজে উঠল।
– গুডমর্নিং ঘোষদা। কী ব্যাপার সকালেই ফোন,
ওপারে পুলিন ঘোষ। থানার ওসি।
– সেকি মশাই, এখনো খবরটা পাননি: আশ্চর্য! আপনি এলাকার জনপ্রতিনিধি, অথচ আপনিই বাদ? তাহলে তো বলতে হবে, আপনার ইনফরমেশন শেল কোনও কম্মের নয়।
-কী ব্যাপার বলুনতো! কিসের ইনফরমেশন?
– মার্ডার মশাই মার্ডার। মার্ডার উইথ রেপ।
-বলেন কী ? কোথায়?
-বডি, রেললাইনের ধারে। স্থানীয় লোকজন বডি ঘিরে বিক্ষোভ দেখাচ্ছে। আপনি থানায় আসুন। লোকাল মেয়ে, মানে কিশোরী। থানায় আসুন, সব বলছি, তাড়াতাড়ি আসুন, কেস কিন্তু জন্ডিস, আসুন..
ফোন কেটে গেল।
দুলাল আশ্চর্যরকম ঠান্ডা রইলো। যেন কিছুই হয়নি। শুধু একটা লম্বা শ্বাস নিলো। পকেট থেকে পানমশলার প্যাকেট বের করে, গলা তুলে হাঁ করে মুখে ঢেলে দিয়ে, চোখ বুঁজে চিবোতে চিবোতে পা নাচাতে লাগলো।
নেলো, কালু, হেরে যাওয়া অসুরের মতো, ফ্যালফ্যাল করে দুলালের দিকে তাকিয়ে আছে। এখন সেই তাদের ত্রাণকর্তা।
দুলাল চোখ না খুলেই হালকা গলায় বললো, মেয়েটা কে? থাকে কোথায়?
কালু কাঁপা গলায় বললো, বিনি। ছাব্বিশ নম্বর বস্তিতে থাকে।
দুলাল একইভাবে চোখ বন্ধ রেখে বললো, ছাব্বিশ নম্বর বস্তি থেকে, রেললাইনের ধার,
কতদূর?
নেলো একটু ভেবে নিয়ে বললো, মাইল দুই হবে..কেন দাদা?
-রাতেরবেলা, একটা কিশোরী একা-একা এতটা রাস্তা পেড়িয়ে রেললাইনের ধারে গেল কেন?
কালু নেলো পরস্পর মুখ চাওয়াচাওয়ি করলো। তারপর মাথা নেড়ে নেলো বললো, তা তো জানিনা দাদা, আমরা ওই অন্ধকার নিরিবিলিতে বসে মাল টানছিলাম, এমন সময় ওকে দেখতে পেলাম। তারপর..
-তারপর? মেয়েটাকে দু’জন মিলে খুবলে খেলি?
-মানে.. নেশার ঝোঁকে.. কিন্তু বিশ্বাস করো দাদা, এরকম বাজে ব্যাপার হয়ে যাবে একদম বুঝতে পারিনি। আসলে, নেশার ধুনকিতে ওকে চিনতেই পারিনি, ভেবে ছিলাম কে না কে, একটা ডবকা মাল… অন্ধকারে,
দুলাল কথা শেষ করতে দিলো না। এক ঝটকায় চেয়ার ছেড়ে লাফিয়ে উঠে, ওদের দু’জন কে এলোপাতাড়ি মারতে শুরু করলো।
শালা হারামির বাচ্ছা, কুত্তার বাচ্ছা। শালারা নিজেরা মরবে, আমাকেও মারবে। পলিটিক্স বুঝিস? এই কেস কতদূর যাবে আন্দাজ করতে পারিস? বিক্ষোভ শুরু হয়েছে। এরপর সোস্যাল মিডিয়ায় আর টিভিতে খবর ছড়াবে। দলে দলে বিরোধী পক্ষের লোকেরা জড়ো হয়ে, মোমবাতি মিছিল করবে। স্লোগান দেবে, ধর্ষণকারীর ফাঁসি চাই।
দুলাল আবার চেয়ারে বসলো। বেশ উত্তেজিত দেখাচ্ছে ওকে। ঘনঘন জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিচ্ছিলো।
-মেয়েটাকে মেরে দিলি কেন?
– উপায় ছিলনা দাদা। ও আমাদের চিনে ফেলেছিল। কালু বললো।
দুলাল ঠোঁট বাঁকিয়ে ক্রুর হাসি হেসে বললো, কী ভাবছিস, বেঁচে যাবি। সাক্ষী লোপাট করে দিলেই কেস লোপাট হয়ে যাবে? শালা গাধার বুদ্ধি আর বলে কাকে!
আরে তখন শুধু রেপ কেস খেতিস। এখন রেপ মার্ডার ডবল কেস খাবি। মর শালারা।
দুলালদের পার্টি অফিসে আজ মিটিং ডাকা হয়েছে। পার্টির হেবিওয়েট নেতারা উপস্থিত থাকবেন। দুলাল পোর খাওয়া লোক। অনেক দিন রাজনীতির উঠোনে দাপিয়ে বেড়িয়েছে। আগে থেকেই গন্ধ পায়। আজকের মিটিংয়ের টার্গেট কে, বুঝতে অসুবিধে হচ্ছে না।
দুলাল মনে মনে নিজেকে তৈরি করে নিয়েছে। এসব ব্যাপার ও অনেক সামলেছে, নতুন কিছু নয়।
তাপস শিকদার, দলের রাজ্য সভাপতি। সরাসরি দুলালকে আক্রমন করে বললেন, দেখুন দুলাল বাবু, আপনি আমাদের দলে নতুন। আমাদের বুঝতে আপনার সময় লাগবে। আমাদেরও আপনাকে বুঝতে সময় লাগবে। কিন্তু, মানুষের মানে জনগণের বুঝতে সময় লাগবে না।
দুলাল একটু চুপ করে থেকে বললো, ঠিক বুঝলাম না। একটু পরিস্কার করে বললে ভালো হয়।
তাপস শিকদার, রুমালে মুখ মুছতে মুছতে বললেন, দেখুন, আপনি ছ’মাস আগেও উল্টো দিকের দলে ছিলেন। ওরা আপনাকে ভোটে দাঁড়াতে দিলো না। মানে টিকিট দিলো না। আমরা আপনাকে এসিওর করলাম, আপনাকে ক্যান্ডিডেট করবো। আপনি দল বদল করে, আমাদের দলে চলে এলেন। আমি আপনার হাতে দলীয় পতাকা ধরিয়ে মিডিয়ার সামনে দলে স্বাগত জানালাম…
দুলাল, তাপস শিকদারকে থামিয়ে দিয়ে বললো, বুঝলাম! কিন্তু, হঠাৎ এখন এইসব কথা উঠছে কেন, বুঝতে পারছি না। আসলে ব্যাপারটা কী খুলে বললে আমার সুবিধে হয়।
-ভুল করছেন দুলাল বাবু। এটা একটা দল। এখানে ব্যক্তিগত সুবিধে অসুবিধের কোনও মূল্য নেই।
_ আমি আপনাদের দলে নতুন অবশ্যই, কিন্তু রাজনীতিতে নতুন নই, এটাও মনে রাখতে হবে নিশ্চয়ই।
-আপনি কী আমার কথায় রাগ করলেন?
-রাগ নয়, বিরক্ত হচ্ছি। অকারণ পুরনো কাসুন্দি ঘাঁটাঘাঁটি করছেন কেন? যা বলার সোজাসাপ্টা বলুন না। আমি সেটাই পছন্দ করি।
ঘরে একটা গুঞ্জন শুরু হয়ে গেল। সভাপতির সঙ্গে এইভাবে কথা, অনেকেই মেনে নিতে পারলেন না।
সভাপতি হাত তুলে সবাইকে শান্ত করলেন।
তারপর, শান্ত গলায় বললেন, অসুবিধে আপনাকে নিয়ে নয়। আপনার যোগ্যতা আপনি প্রমাণ করেছেন। উল্টো দিকের দলের লোকটাকে হারিয়ে দিয়েছেন। সাবাশ। এনিয়ে কোনও কথাই হবে না। কিন্তু আপনার সাঙ্গপাঙ্গরা তো আমাদের দলের ইমেজ একেবারে মাটিতে মিশিয়ে দিচ্ছে। ওদের আপনি সামলাতে পারছেন না। এটা তো মানবেন না কি?
দুলাল একথার কোনও জবাব দিলো না। চেয়ার ছেড়ে উঠে পায়চারি করতে করতে দু’হাতের তালু মুখের সামনে নিয়ে ঘষতে লাগলো।
সভাপতি মশাই দুলালের চলমান শরীরের দিকে তাকিয়ে, ধীর গলায় বললেন, দুলাল বাবু আমি কী বলতে চাইছি, আপনি বুঝতে পারছেন?
দুলাল আরচোখে সভাপতি মশাইকে দেখে নিয়ে, আবার চেয়ারে বসে পড়লো।
এই বসার ভঙ্গিতে বেশ একটা তেজস্বী ভাব ছিল। একটা ডেস্পারেট বডি ল্যাঙ্গুয়েজ দেখা যাচ্ছিল। অথচ আশ্চর্যজনক ভাবে গলার আওয়াজে তার লেশমাত্র প্রকাশ ছিল না। কিন্তু উচ্চারণে তার প্রকাশ বিলক্ষণ ছিল।
দুলাল বললো, আমি জানি এসব কথা কেন উঠছে। সেদিনের রেপ এন্ড মার্ডার কেসে আমার ঘনিষ্ট দু’জন জড়িত ছিল। কিন্তু পাশাপাশি এটাও সত্যি , আমি তাদের সমর্থন বা সাহায্য করিনি। বরঞ্চ আমিই পুলিশকে ডেকে ওদের ধরিয়ে দিয়েছিলাম। অথচ ইচ্ছে করলেই আমি তাদের সেফ জোনে রেখে দিতে পারতাম। বাজার ঠান্ডা হলেই ফিরিয়ে আনতাম।
– সেইটা করাই উচিৎ ছিল আপনার। আরে মশাই এটাই আজকের পলিটিক্স।
– ডার্টি পলিটিক্স । মনুষ্যত্ব বিহীন কুরুচিপূর্ণ পলিটিক্স। তাপস বাবু, ভুলে যাবেন না, মেয়ে কিন্তু আপনার, আমার, সকলের ঘরেই আছে।
– হ্যাঁ , নিশ্চয়ই। আপনি ঠিক বলছেন। কিন্তু রাজনীতি সবসময় সোজা রাস্তায় চলে না। আপনি বলুন তো দুলাল বাবু, ওই দুটো ছেলে যে ওই কাজ করেছে, কী প্রমাণ আছে।
-ভালই তো। প্রমাণ না থাকলে, নির্দোষ প্রমাণিত হয়ে বেড়িয়ে আসবে। সেটাই তো ভালো। ওদের পক্ষে এবং পার্টির পক্ষেও।
– কিন্তু ততদিনে পার্টির সর্বনাশ যা হবার হয়ে যাবে। অথচ ওদের ধরিয়ে না দিলে, আমরা অনায়াসে সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে পারতাম। নারী নির্যাতন, নারীর নিরাপত্তাহীন অবস্থার কথা বলতে পারতাম। কিন্তু এটা কী হলো? উল্টে আমরাই কেস খেয়ে গেলাম। সারা রাজ্যের লোক এখন আমাদের দলকেই দোষ দিচ্ছে। ওরা এখন আমাদের দলের লোক। দল বদলের সময়, ওরাও আপনার সঙ্গে আমাদের দলে ঢুকেছে। ওদের হাতেও আমি দলীয় পতাকা ধরিয়ে ছিলাম মিডিয়ার সামনে।এখন সেই ছবি দেখিয়ে, উল্টো দলের লোকেরা প্রচার করছে, পচে যাওয়া, ফেলে দেওয়া মাল দিয়ে আমরা ঘর ভর্তি করেছি।
নিন, কী কাউন্টার করবেন করুন।
-তাপস বাবু , আপনি বোধহয় খেয়াল করেন নি, লোকে এটাও বলছে যে ওই দুর্বিনীত দুরাচারীগুলোকে আপনারই দলের সদ্য নির্বাচিত প্রতিনিধি, মানে এই আমি দুলাল দে পুলিশের হাতে তুলে দিয়েছে।
– আপনি ভুল করছেন দুলাল বাবু। এই প্রপাগাণ্ডায় আপনার ব্যক্তিগত ইমেজ হয়তো বাড়বে। কিন্তু দলের ইমেজ ধাক্কা খাবে। ব্যক্তি কখনও দলের উপরে নয়।
যাই হোক, দলের মানসম্মান রক্ষার্থে এবং রাজনৈতিক কারণে ওই দু’জনকে দল বহিষ্কার করতে বাধ্য।
-কিন্তু তাপস বাবু, আমার জয়ের পিছনে ওদের অবদান অনস্বীকার্য।
-কে অস্বীকার করছে? ওরাই তো ফিল্ড ওয়ার্কার। কিন্তু ওই যে বললাম, দলের উপরে কেউ না। কেউ যদি দলের ইমেজ নিয়ে খেলা করে, তাকে নিশ্চয়ই দল মাথায় তুলে নাচবে না। এটা দলের সিদ্ধান্ত।
টেবিলের ওপর আঙ্গুলের টোকা দিতে দিতে দুলাল গম্ভীরমুখে বললো, সিদ্ধান্ত পাকা?
তাপস শিকদার চতুর হাসিতে গাল ভরিয়ে বললেন, অবশ্যই। দলে দুষ্কৃতকারীদের জায়গা নেই।
দুলাল টেবিলে সজোরে একটা চাপড় মেরে উঠে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বললো, একদম বাজে কথা বলবেন না। দুষ্কৃতকারীদের জায়গা নেই, ঠগ বাছতে গাঁ উজাড় হয়ে যাবে মশাই। এতবড় দলে বেছেবেছে মাত্র ওই দু’জন দুষ্কৃতি পেলেন; বাকি সব সাধু আর সন্ন্যাসী?
তাপস বাবু আচমকা দুলালের এমন আচরণে হকচকিয়ে গিয়ে বললেন, আরে, কি মুশকিল। এতো উত্তেজিত হলে কী করে কথা হবে; মাথা ঠান্ডা করুন।
তারপর গলার স্বর আরও মোলায়েম করে তোষামোদের ভঙ্গিতে বললেন, এতো সিরিয়াস হচ্ছেন কেন? পলিটিক্স কী জিনিস আপনিও জানেন, আমিও জানি। যারাই পলিটিক্স করেন তারা সব্বাই জানেন। আজকে মাথার মণি, কালকে পায়ের জুতো।
দুলালের পিঠে জোরে জোরে দু’টো চাপড় মেরে বললেন, আপনি কেন আপনার পুরনো দল ছাড়লেন দুলাল বাবু হা হা হা হা..
তাপস শিকদারের সেই উগ্র তাচ্ছিল্য মাখা হাসিতে মিটিং এ উপস্থিত সকলেই যোগ দিলো। সম্মিলিত ব্যঙ্গের তীব্র ঝলকানিতে, রাগে উত্তেজনায় দুলালের সারা শরীর ঝাঁ ঝাঁ করছিল।
বুঝতে পারছিলো, এই দলে সে আগন্তুক কিংবা বহিরাগত। কিছুতেই তাদের নিজের লোকের মতো বিশ্বাসভাজন হয়ে উঠতে পারেনি।
ভোটে জিতেছে সে তার নিজস্ব করিস্মায়। এতে এই দলের কোনও কৃতিত্ব নেই। তার নিজস্ব সাংগঠনিক শক্তিই তাকে এই জয় এনে দিয়েছে। দল একটা সিট পেয়ে গেছে, যেটা তাদের পাবার কথাই নয়।
তাপস বাবু’দের ধান্দা বুঝতে পারছে দুলাল।ওরা দুলালের ডানা ছাঁটতে চায়। ওর নিজস্ব সাংগঠনিক শক্তিটা ভেঙে দিয়ে, ওকে নিজেদের কব্জায় বেঁধে রাখতে চায়।
তাপস বাবুরা ভয় পাচ্ছে। যে লোক বিশ বছর একটা পার্টিতে থেকে, সবরকম সুযোগ সুবিধে ভোগ করে, নিজস্ব রাজনৈতিক পরিচিতি তৈরি করার পরেও, শুধুমাত্র নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবার আবদার পূরণ না হওয়ায়, রাতারাতি দল বদলে বিরুদ্ধ দলে নাম লেখাতে পারে, তাকে লোভী, বিশ্বাসঘাতক ছাড়া আর কিই বা বলা যেতে পারে।
তাপস বাবু’দের পোর খাওয়া ঘট বলছে, দুলালের মতো স্বার্থান্বেষী ধান্দাবাজ গিরগিটিদের চাপে রাখতে না পারলে, অদূর ভবিষ্যতে এরা মাথায় চড়ে নাচবে। এদের দলে রাখতে হবে, কিন্তু ডানাছাঁটা বাজপাখি করে।
দুলালের সামনে এই মূহুর্তে দু’টি পথ খোলা।হয় তাকে এই দলের বিশ্বস্ত কর্মী হয়ে, দলীয় নেতা-কর্মীদের সঙ্গে তালে তাল মিলিয়ে চলা, নতুবা মাথা হেঁট করে নিজের পুরনো দলে ফিরে যাওয়া।
পুরনো দল হয়তো ফিরিয়ে নেবে, কিন্তু সেই বিশ্বাসযোগ্যতা কী আর থাকবে! সেই দাপুটেপনা…নাহঃ সম্ভব নয়। বড্ড একা মনে হচ্ছে নিজেকে।
রাগ আর জেদের মাথায় দুলাল যে কাজ সেদিন করেছিল, আজ তা হটকারি সিদ্ধান্ত বলে মনে হচ্ছে। আফসোস হচ্ছে। পুরনো দলে অনন্ত স্বাধীনতা ছিল, সম্মান ছিল,কিন্তু এখানে, নাহ্.. সময়ের অপেক্ষায় থাকা ছাড়া উপায় নেই। সময় আসবে, নিশ্চয়ই আসবে, ততদিন মানিয়ে নিতেই হবে। মানিয়ে নাও।
ধীরে ধীরে চেয়ারে বসে পড়লো সে। মাথাটা ঝিমঝিম করছে।
ঠিক তখনই ট্রেতে করে চা এসে গেল। সবাই হৈচৈ শুরু করে দিলো। কে যেন বলে উঠলো, একেবারে মোক্ষম সময়ে চা’টা এনেছো ভাই। এটার এখন বড্ড দরকার ছিল।