Site icon আলাপী মন

গল্প- দুটি পাতা

দুটি পাতা 

-অঞ্জনা গোড়িয়া

 

 

কোথায় যে গেল ওরা? কেউ জানে না।চারিদিকে ঘন অন্ধকার । মাতাল ঝড়ে বাগানের গাছগুলো দুলে দুলে উঠছে। এই অন্ধকারে কি করে গেল দুজনে?অবশ্য ওরা খুব সাহসী তা পাড়ার সবাই জানত। তাবলে এই ঝড়ে বেরিয়ে গেল?
মা হ্যারিকেন নিয়ে নিজেই খুঁজতে বেরিয়ে পড়লো। বাগানের দিকে। ওখানে আছে দুটো বড়ো আম গাছ।কুশি কুশি আমে গাছ ভর্তি।বড্ড সখ ছিল, একটু বড়ো হলেই পেড়ে আনবে। কাঁচা আম নুন লংকা মাখিয়ে খেতে ভীষণ ভালোবাসে। নিশ্চয় এই ঝড়ে আম কুড়াতে গিয়েছে। তাই ওদের মা ভেবে ছিল। কিন্তু সেখানে ও দেখতে পেল না।আশেপাশের বাড়ি। বন্ধুর বাড়ি কোথাও খুঁজে পাওয়া গেল না। ভীষণ অস্থির হয়ে পড়লো।
এত করে বারন করা স্বত্তেও বেরিয়ে গেল দুটোতে?
দুই জমজ বোন। সীমা আর সীজা। যেমন চঞ্চল তেমন মিষ্টি দু ‘বোন। যখন যা ইচ্ছে হয় তাই করে দু’জনে একসাথে। পাড়ার সবার নয়নের মনি।সারাক্ষণ টো টো করে ঘুরে বেরায় সারা পাড়া।
আজ খুব জব্দ হয়েছে। ঘরে আটকে রেখেছে মা।
বলেছে, একদম বাইরে না যেতে। কুশি আমের গন্ধে মো মো করছিল সারা ঘর। মন ছুটে যাচ্ছিল বাগানের দিকে। এদের ঘরটার পাশেই যে বাগান। যেদিন থেকে আমের মুকুল ধরেছে। সেদিন থেকে একটাই বায়না, কবে কুশি কুশি আম হবে? কবে ঝরে পড়বে মাটিতে?
কচি আমের নাম শুনলেই জীভে জল এসে পড়ে। খুব ইচ্ছে ঝরে পড়ে যাওয়া আম কুড়াতে। নিশ্চয় আজ বাগান ভর্তি ঝরে পড়েছে। তবু মায়ের আদেশ। বৃষ্টি না থামলে বাইরে যাওয়া যাবে না। তাই ঘরেই ছিল দুই বোন। ঘরের মেঝেই খেলা করছিল।
মা ও নিশ্চিত মনে রান্না ঘরে চলে যায়। খাবার বানিয়ে ফিরে এসে দেখে কেউ নেই।
খোঁজাখুঁজির পর যখন দেখা মিলল না। বাবা বলল, চলো একবার পুলিশ স্টেশনে। দিন কাল ভালো নয়। একবার জানিয়ে আসা-ই ভালো। মা আরও চিন্তায় ভেঙে পড়লো।
অনেক ভেবে চিন্তে ছাতা হাতে বেরিয়ে পড়লো দুজনে। ঠিক তখনই পথে দেখা হলো দু’বোনের সাথে। জলে ভিজে কাঁপতে কাঁপতে ফিরছে।
ওরা ভেবেই ছিল খুব বকবে মা। তাই মুখে আর কিছুই বলল না। চুপচাপ বাড়ি এলো। মায়ের বকা সব সইবে। কত করে বাবা জানতে চাইল কোথায় গিয়েছিলে তোমরা? কোনো উত্তর দিল না। নিজের রাগ কষ্ট বুকে চেপে কিছুই জানতে চাইল না মা।

সেই রাতেই ছোট বোনের খুব জ্বর এলো।ডাক্তার ডাকতে হলো। ওষুধ খাইয়ে জলের পট্টি দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিল মা। ভোরের আলো ফুটতেই দাশুর ঠাকুমা বাড়ি এল লাঠি হাতে। এক কোঁচর কুশি আম নিয়ে । কোথায় গেলি মা? একবার কাছে আয়। একটু আদর করি। আমার জন্য কাল তোদের খুব কষ্ট হয়েছে। আম কুড়ানো হয় নি। এই দেখ আমি কত আম এনেছি।
মা শুনে অবাক! 
-ওদের কোনো দোষ নেই গো। ওদের বকা দিও না।কাল রাতে আমার জন্যই ওরা ভিজে গেছে।
সীজার মা অবাক হয়ে জানতে চাইল, কি ব্যাপার? কিছুই তো বুঝতে পারছি না।
দাশুর ঠাকুমা বলতে শুরু করল, অভাবের সংসার আমার। ছেলে বউ দু’মুঠো ভাত ডালও দেয় না। ওদের বোঝা আমি। বৃদ্ধাভাতায় যেটুকু টাকা পাই। কোনো ক্রমে ভাত ফুটিয়ে খাই। তাই ঝড়ে পড়ে থাকা পাতা ডালপালা কুড়োতে গিয়েছিলাম। যদি কিছু বিক্রি করতে পারি। উনুন ধরাতে কাঠ কুটোর দরকার। এই ঝড়ের মধ্যেই বেরিয়েছিলাম গো সব বাগানে। বয়স হয়েছে। শরীরটা ভালো ছিল না। কিভাবে হোঁচট খেয়ে পড়ে যাই বাগানে। মনে নেই। মাথাটা হঠাৎ ঘুরে যায়। যখন একটু জ্ঞান ফেরে, দেখি আমার পাশে ওরা দু’বোন। কিভাবে দেখতে পেয়েছিল তোমাদের ঘরের জানলা দিয়ে, আমি পড়ে আছি ।বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছিল আমার কাছে। আমাকে ধরে তুলে বাড়ি পৌঁছে দেয়। পাতার বোঝাটা ওরাই টানাটানি করে ঘরে নিয়ে যায়। বারন করেছিলাম। শোনে নি। কত যত্ন করে আমাকে ঘরে দিয়ে গেল। ওদের ভালো হোক। ওদের জন্য কিছু আম এনেছি মা । একটু ডেকে দেবে ওদের।
আর কিছুই বলতে হলো না। সকালের আলো চোখে পড়তেই উঠে পড়েছে দু’বোনে। জ্বরটা কমে গেছে। গলা জড়িয়ে ধরে মায়ের।
মায়ের সকল রাগ বৈশাখী ঝড়ে উড়ে গেল।হাসি মুখে দুহাত ভরে নিল কুশি কুশি আম।

Exit mobile version