বাবুয়া ও কালুয়া
– জ্যোৎস্না ভট্টাচার্য ত্রিবেদী
আজ চারদিন হয়ে গেলো বাবুয়া ঘরে ফেরেনি। অদিতি চুপচাপ বাইরের ঘরের জানলায় বসে বাবুয়ার কথাই ভাবছিলো। নাহ, এই মূহুর্তে বাবুয়া কোথায় গেছে, এখন কোথায় আছে, কেমন আছে, কিছু খেয়েছে কিনা এসব আর তার চিন্তায় নেই। তার মন জুড়ে এখন শুধুই স্মৃতির মেলা। বাবুয়ার জন্মক্ষণ থেকে গত বাইশটা বছর যত ভালো মন্দ স্মৃতি, সব তার মনের আকাশে শরতের মেঘের মতো ভেসে উঠছে। আবার বুদবুদের মতো মিলিয়েও যাচ্ছে। কখনো অদিতির মুখটা উজ্জ্বল হয়ে উঠছে খুশীতে, আবার কখনো মলিন, জলে ভরে উঠছে দু’চোখ।
ঢং ঢং করে জানান দিলো ঘড়ি পাঁচটা বাজছে। চমকে তাকালো জানলার বাইরে, ভোর হয়ে গেছে। পাখীরা বেরিয়ে পড়েছে তাদের নিত্যকার কাজে, পেপারওয়ালা, সব্জীওয়ালা, দুধওয়ালা সবাই যে যার কাজে চলেছে। শুধু অদিতিই আজ চার দিন এই জানলার সামনে চুপচাপ নিষ্কর্মা…..
নাহ্, আর না, উঠে পড়লো অদিতি। অনেক কাজ পড়ে আছে, এভাবে বসে থাকলে কি চলবে… চার দিন পেটে কিচ্ছু পড়ে নি। পেটের ভেতর খিদে পেয়ে পেয়ে অদ্ভুত কষ্ট আর যন্ত্রণার সৃষ্টি হয়েছে। আর না, এবার কিছু মুখে দিতে হবে। রান্না ঘরের দিকে পা বাড়ালো, একটু চা আর কটা বিস্কুট আপাতত…
কি আর করা যাবে… ও তো যাবারই ছিলো। হয় নিরুদ্দেশ আর না হয় জেল। এ বরং ভালোই হয়েছে, পুলিস এসে বাড়ী থেকে টেনে নিয়ে যেত অদিতির চোখের সামনে দিয়ে, সেটা তো আরো অসহ্য, আরও অসন্মানের। তার চেয়ে এই ভালো, সবাই জানলো বাছা আমার নিরুদ্দেশ। একমাত্র অদিতিই জানে বাবুয়া…. কতো বড়ো অন্যায় করে চলেছিলো। ড্রাগস এর চালান, বাচ্চাদের স্কুলে বিক্রি। ছিঃ ছিঃ, একজন আদর্শবান স্কুল শিক্ষকের ছেলে হয়ে শেষে কিনা… ভাগ্যিস আজ অরীন বেঁচে নেই…. থাকলে তো এসব জানার পর সে নিজেই আত্মঘাতী হতো। কিন্তু অদিতি অতো বোকা নয়, হলোই বা ছেলে, সে খারাপ হয়েছে বলে অদিতি মরবে..! কেন? কখনোই না, বাঁচবে অদিতি, বাবুয়াকে ছাড়াই।
এই সময় দেখে কালুয়া কোথা থেকে এসে ওর গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে লেজ নাড়ছে। ওর পোষা কুকুর ছানা, এখন একটু বড় হয়েছে। বাবুয়ার সাথে মিলিয়ে ওর নাম কালুয়া রেখেছিলো। বড্ড নেওটা অদিতির। ওকেই কোলে তুলে নিলো অদিতি, জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে কেঁদে উঠলো। গত চার দিনের জমিয়ে রাখা সমস্ত কষ্ট, সমস্ত কান্না চোখের জল হয়ে কালুয়াকে ভিজিয়ে দিলো। ও বেচারিও খায় নি চারদিন কিচ্ছু, বুঝেছে কিছু একটা ঘটেছে। চুপচাপ বাইরের ঘরে পড়েছিলো।
হঠাৎ কুঁইকুঁই করে উঠতে অদিতির মনে হলো ওকেও খেতে দিতে হবে। তাড়াতাড়ি বিস্কুটের কৌটো খুলে চারটে বিস্কুট বার করে ভেঙে ওকে খেতে দিলো। আর মাথায় হাত বুলোতে বুলোতে মনে মনে বিড় বিড় করতে লাগলো, আজ থেকে শুধু তুই আর আমি। ব্যাস, এই দু’জন, তুই আমার জন্য আমি তোর জন্য। আর কেউ নেই পৃথিবীতে আমাদের…. আর কেউ নেই, তুই আর আমি, শুধু তুই আর আমি……