কাঁচের ফুলদানি
– লোপামুদ্রা ব্যানার্জী
‘যাঃ,দিলি তো! একেবারে চার টুকরো হয়ে গেল। এই একটি জিনিষই ছিল আমার একান্ত নিজের।’ কথাগুলো বলতে বলতে চশমার ফাঁক দিয়ে কয়েক ফোঁটা চোখের জলও গড়িয়ে এলো। আঁচলের খুঁট দিয়ে তাড়াতাড়ি জলটা মুছে নিলেও সুরমা দেবীর বৌমা হিয়া কিন্তু লক্ষ্য করেছিল সেই অশ্রুধারা।
একটা কাঁচের ফুলদানি ভেঙে গেল বলে তার প্রবল প্রতাপশালী, মুখরা শাশুড়ি কাঁদছে। ভাবা যায়! কোন কিছু না বলে হিয়া চুপচাপ কিচেনে চলে গেল। কাজের মেয়ে রিঙ্কি ভয়ে একেবারে জড়সড় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আজ তার কপালে অনেক কষ্ট। গিন্নী মা আজ তাকে বাক্যবাণে এফোঁড় ওফোঁড় করবে।
কিন্তু সুরমা দেবী আজ রিঙ্কিকে নতুন করে একটি কথাও বললেন না। চুপচাপ ফুলদানির ভাঙ্গা টুকরোগুলো জড়ো করতে লাগলো একটা পলিথিন ব্যাগে। ভালো করে তুলে নিয়ে রিঙ্কিকে বললেন ভিজে কাপড় দিয়ে চেপে জায়গাটা মুছে নিতে। এরপর সারাদিন সুরমা দেবী চুপচাপ বসে রইলেন। তাকে দেখে মনে হচ্ছিল কেউ যেন তাকে সজোড়ে কষ্টের সাগরে ঠিলে ফেলে দিয়েছে।
অন্যদিন বাড়ির সকলকে দুপুরের খাবারটা সুরমা দেবীই পরিবেশন করে। আজ একটা বাংলা মাসিক পত্রিকা নিয়ে সোফায় বসে রইলেন। হিয়া কাকে কি দিচ্ছে কিছুই দেখছে না। ‘রান্নায় আজও তেল বেশি’ বলে হিয়াকে বকাবকিও করছেন না। সুরমা দেবীর বড় ছেলে সমীরণ খেতে বসার আগে মা’কে ডাকাডাকি করলেও চুপচাপ বসেই রইলেন। হিয়ার স্বামী মিলন তো হিয়াকে বারবার জিজ্ঞেস করেই চলেছে ‘ও গো মায়ের আজ পাওয়ার অফ কেন? ব্যাটারি মানে শরীর ঠিক আছে তো?’ হিয়া নিচু গলায় বলল ‘কী জানি বাপু। এই দশ বছরেও তোমার মা’কে বুঝে উঠতে পারলাম না। কখন হাসে, কখন কাঁদে বোঝা দায়।’
জলখাবার বেলাতেই তো কাঁচের ফুলদানিটা ভাঙ্গার ঘটনাটা ঘটলো আর তখন থেকেই মুখে কুলুপ এঁটেছেন সুরমা দেবী। আজ নিজের ইচ্ছা মত জমিয়ে রান্না করেছে হিয়া।এত বছর শাশুড়ির কথা মতো রাঁধতে হয়েছে ভালো লাগুক না লাগুক। হিয়া মনে মনে কিন্তু বেজায় খুশি সুরমা দেবী চুপচাপ আছেন বলে। কিন্তু একটা সামান্য কাঁচের ফুলদানির জন্য তার বাজখাঁই গলার অধিকারিণী শাশুড়ি তো বাক্যহারা হয়ে গেল এটা কিছুতেই হজম করতে পারছে না হিয়া।
বাড়ির ছেলেদের খাওয়া হয়ে গেলে হিয়া সুরমা দেবীর জন্য ভাতের থালা সাজিয়ে বলে -‘মা আসুন। অল্প দু’টো খেয়ে নিন। একটা সামান্য ফুলদানির জন্য উপোস দেওয়ার কী দরকার?’ হিয়ার মুখের কথা শেষ হয়েছে কি হয়নি সুরমা দেবী হাউ হাউ করে কেঁদে ওঠেন- ‘অনেক যত্নে বছরের পর বছর ধরে আগলে রেখেছিলাম। এতটুকু আঁচ লাগতে দিই নি। কিন্তু শেষ রক্ষা করতে পারলাম না।’ হিয়া একটু ভয়ে ভয়েই শাশুড়ির পাশে গিয়ে বসে। শান্ত গলায় বলে ‘মা আপনার খুব কষ্ট হচ্ছে বুঝতে পারছি। কিন্তু কেন হচ্ছে এটা বোধগম্য হচ্ছে না। আমাকে খুলে বলুন মা। দেখবেন অনেক খানি হালকা লাগছে।’
সুরমা দেবী হিয়ার দিকে বড় বড় গোল গোল চোখ করে তাকিয়ে বলে -‘তুমি বুঝবে আমার কষ্ট! যত সব ন্যাকামি। বড়লোকের ঘরের আল্লাদি। সে বুঝবে! না চাইতে তো হাতের কাছে সব পেয়েছো। খাওয়া, পরা, মাখা, আহ্লাদ কোন জিনিসটার কমতি তো কোথাও পাও নি। বাপের ঘরে যেমন ছিলে, শ্বশুর ঘরে এসেও তেমনটি আছো।’ হিয়া আর একটু সাহস সঞ্চয় করে বললো ‘ঠিক আছে।আজই বিকালে বিগ বাজার থেকে এর থেকেও সুন্দর একটা ফুলদানি নিয়ে আসবো আপনার জন্য।’
সুরমা দেবী অবাক হয়ে হিয়ার দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থাকে। তারপর বলে ‘আমার কাছে ওটা শুধু ফুলদানি ছিল না। ওটা ছিল আমার কিশোরী বেলার অস্তিত্ব, যৌবনের হিল্লোল।’ শাশুড়ির এই কথা শুনে হিয়া তো অবাক হয়ে যায়। জিজ্ঞাসু নয়নে বলে ‘মানে?’
সুরমা দেবী বলেন ‘আমি কোনদিনই পড়াশোনায় ফার্স্ট, সেকেন্ড, থার্ড হবার সুযোগ পাই নি। তবে খেলাধূলায় ছোট থেকে খুব ভালো ছিলাম। আমি বাড়িতে লুকিয়ে আমাদের স্কুলের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় অংশ গ্ৰহণ করি। আমাদের বাড়িতে মেয়েদের খেলাধুলায় তেমন অনুমতি দেওয়া হতো না। আমি রানে, লং জাম্প, হাই জাম্পে খুব ভালো ছিলাম। তখন আমি ক্লাস ইলেভেনে পড়ি। আমাদের কো-এডুকেশন স্কুল ছিল। হাই জাম্প ইভেন্টে দশ বারোটা মেয়ের মধ্যে আমি হিট থেকে ফাইনাল তিন তিন বার প্রথম হই। আমি যখন ভিত্তি স্ট্যান্ডে উঠি তখন আমার মনে হচ্ছিল আজ আমিও পেরেছি নিজের কৃতিত্ব দেখাতে। যোগ্যতা থাকলে যে কোন কঠিন পরিস্থিতির মোকাবিলা করা যায়। আমাদের স্কুলের প্রধান শিক্ষক মহাশয় আমার গলায় মেডেল ও হাতে তুলে দেন এই কাঁচের ফুলদানিটা। বাবার ভয়ে আমার কঠিন লড়াইয়ের পুরষ্কারটি বাড়িতে নিয়ে যেতে পারি নি। এক বান্ধবীর বাড়িতে রেখে দিয়েছিলাম। প্রায় এক নিঃশ্বাসে এতগুলো কথা বলে চলেছেন সুরমা দেবী।
হিয়া আস্তে আস্তে বলে ওঠে ‘মা আপনার দেরী করে খেলে তো হজমের অসুবিধা হয়। চলুন না আমরা খেতে বসে শুনবো বাকি কথাগুলো।’ সুরমা দেবীর কী মনে হল নিজের কষ্টকে সাময়িক দূরে সরিয়ে রেখে বেসিনে হাত ধুয়ে খেতে বসলেন। হিয়ার পচ্ছন্দ মতো মেনু দেখে বললেন ‘স্বাধীনতা পেলে ভালো লাগে তাই না। নিজের ইচ্ছা মত মন দিয়ে কাজ করা যায়।’ হিয়া খেতে খেতে বললো ‘তারপর কী হয়েছিল মা?’
সুরমা দেবী ঠোঁটের কোনে সামান্য একটু বাঁকা হাসি এনে বললেন – ‘বাবার কানে খবর যাওয়া মাত্রই বাবা নিষেধাজ্ঞা জারি করলেন যেন বিকাল বেলায় ব্যাটমিনটন হাতে আর বের না হই। আমি নাকি বাবার বিশ্বাস ভেঙেছি। ছোট প্যান্ট পরে খেলতে নেমে আমি বাবার মান সম্মান ধূলোয় মিশিয়ে দিয়েছি। আমি লড়াই করে যে পুরষ্কার এনেছি তাতে বাবা কাকা কেউ খুশি হয় নি। তাদের মাথা ব্যাথা আমার ছোট প্যান্ট পরা নিয়ে।’
কলেজে উঠতে না উঠতেই সুরমা দেবীর বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয়। যৌথ সংসারের দায় দায়িত্ব, কর্তব্য, অনুশাসন মানতে মানতে একদিন প্রাণোজ্জ্বল সুরমা হয়ে গেল রায় বাড়ির রায় বাঘিনী। সুরমা দেবী তার চারিদিকে বর্ম এর মতো তৈরী করেছিল এক গাম্ভীর্য। নিয়ম অনুশাসনের শৃঙ্খলে নিজের মনকে বেঁধে ফেলেছিলেন। তবুও এই কাঁচের ফুলদানির সামনে দাঁড়িয়ে ওটাকে ডাস্টিং করার সময় নিজের জীবনের সেরা মুহূর্তটাকে অনুভব করতেন।
বিয়ের দিন সুরমা দেবীর বান্ধবী উপহার স্বরূপ তার অর্জিত প্রথম পুরস্কারটি সুরমা দেবীর হাতে তুলে দিয়ে বলেছিল, ‘এই নে তোর পুরষ্কার। লোকে পুরষ্কার পেলেন সবাইকে আনন্দ করে দেখায় আর তুই লুকিয়ে বেরাচ্ছিস! ওটা ঠিক যেন তোর গোপন প্রেমিক।’ সুরমা দেবীও বলেছিল ‘ঠিক বলেছিস। প্রেমিক। আমার জীবনের প্রথম প্রেম ছিল খেলাধুলা। ভেবেছিলাম বড় খেলোয়াড় হবো। সে বোধহয় এজন্মে হওয়া হবে না।’
কথাগুলো বলতে বলতে সুরমা দেবীর অশ্রুধারায় ভিজে যাচ্ছে মুখখানি। আজ বার্ধক্যের বেলায় তারুণ্যের সেই আবেগ, সেই উচ্ছাস দেখতে পেল হিয়া। এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে হিয়া সুরমা দেবীর হাতখানি জড়িয়ে ধরে বলে ‘মা, আমি কি আবার নাচটা শুরু করতে পারি। আমার বোধহয় এখনও সময় আছে।’ সুরমা দেবী মুচকি হেসে বলে ‘এখনকার মেয়েরা কিন্তু অনেক চালাক, অনেক বাস্তববাদী। কাঁচের ফুলদানিটা ভেঙে তোমার জন্য ভালোই হলো বলো।’
.