দহন সমাধি
–রীণা চ্যাটার্জী
আজ আসি মামণি। সাবধানে থেকো, প্রণাম করে বলে রাজেশ। রাজেশ নীচু হয়ে প্রণাম করলে মাথায় হাত দিয়ে আশালতা বলেন, তোরা সবাই সাবধানে থাকিস। ভালো থাকিস। রাজেশ মাথা নীচু করে বেরিয়ে আসে। আশালতাও স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন দোরগোড়ায়। এক পা এক পা করে হেঁটে যাওয়ার মাঝে রাস্তার দূরত্বটা বাড়তেই থাকে। মনের মাঝে অদৃশ্য কাঁটাতারের বেড়া। যে কাঁটা বিদ্ধ করে গেছে দু’টো মনকেই। দু’জনেই জানে এই দূরত্ব কমবে না আর কোনোদিন।
একাকীত্বের নতুন জীবনের সূচনার লগ্নে ফিরে যান পঁচিশ বছর আগের এক আনন্দ সন্ধ্যায়,
‘বাবু মশাই দায়িত্ব তো মনে হয় বেড়ে গেল এবার।’ সুধীর বাড়ি ফিরে এলে সোহাগী স্বরে কানে কানে বলে আশালতা। মনে প্রশ্ন এলেও, স্ত্রীর সুখী সুখী মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন উধাও হয়ে যায় নিমেষে। দু’জনের মিলন মুহূর্তের স্বপ্নগুলো বাস্তবের হাত ধরতে চলেছে। বিয়ের ছয় মাসের মধ্যে সন্তানসম্ভবা আশালতা স্বামী সুধীরের সাথে ডঃ দেখিয়ে আনন্দ সংবাদ নিয়ে বাড়ি ফিরছিল বাইকে চড়ে। খুশীর খবর, আহ্লাদ নিমেষে স্তব্ধ হয়ে যায় আচমকা পিছন থেকে আসা নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে যাওয়া একটি চারচাকার ধাক্কায়- সুধীর কিছু বুঝে উঠে সামলে নেবার আগেই এক ধাক্কায় গাড়ি সমেত আশালতাকে নিয়ে রাস্তায় পড়ে যায়। আশালতা ছিটকে কিছুটা দূরে পড়লেও, সুধীরের শরীরকে ছিন্নভিন্ন করে গাড়িটি বেসামাল গতিতে এগিয়ে যায়।
স্থানীয় লোকজন অচেতন আশালতা, সুধীরের ছিন্ন ভিন্ন দেহ হাসপাতালে নিয়ে যান। ডঃ পরীক্ষা করে ঘোষণা করেন- ভ্রুণসন্তানটি মৃত। জীবনের হঠাৎ বদলে যাওয়া গতি শোকে স্তব্ধ করে দেয় আশালতাকে।
দুর্ঘটনার খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে পোঁছে যান অমলেন্দু বাবু। ভগ্নীপতির পারলৌকিক কাজ হয়ে যাবার পর এবং বোনের প্রয়োজনীয় চিকিৎসার পর- একমাত্র বোনকে বাড়িতে নিয়ে যখন ফিরে এসেছিলেন অমলেন্দুবাবু তখন আশালতা প্রায় পাথর। ডাকলে সাড়া দেন না। খাইয়ে দিলেও মুখে খাবার নিয়ে বসে থাকেন, শুধু খরখরে দুই চোখে নিষ্পলক তাকিয়ে থাকেন। বৌদি নির্মলা দেবী যথাসম্ভব চেষ্টা করেন যত্ন করার, খেয়াল রাখার। কিন্তু তিনিও তিন সন্তানের জননী। ছোটটি সবে মাস ছয়েকের। সবকিছু সামলাতে বেশ বেগ পেতে হয়। এমনি একদিনে ননদকে খাওয়ানোর জন্য সবে খাবার প্লেট এনে রেখেছেন, ছোট ছেলেটি হঠাৎ তারস্বরে কেঁদে উঠলো। টেবিলে খাবার রেখে দৌড়ে গেলেন ছেলের কাছে মাতৃধর্ম পালনে। মেজ সন্তান রাজেশ সামনে বসেই ছিল। এই ক’দিন দূর থেকেই দেখেছে তাদের স্নেহময়ী পি’মণির বদলে যাওয়া রূপ। মা- বাবা দু’জনেই বলে রেখেছে, ‘একদম বিরক্ত করবে না..’ সাহস করে আর যাওয়া হয়ে ওঠেনি পি’মণিরর কাছে। এখন মা’ও ব্যস্ত, বাবা অফিসে, দিদিও সামনে নেই। তাই মনে একটু সাহস করে কোলের কাছে দাঁড়ায়, আস্তে আস্তে গলা জড়িয়ে কোলেও উঠে বসে। তারপর কচি কচি অপটু হাতে খাবার নিয়ে মুখে খাবার তুলে দেবার চেষ্টা করে, কচি গলায় আদো সুরে বলে- খেয়ে নাও পি’মণি।
শিশু স্পর্শের ছোঁয়া পেয়ে বোধহয় সম্বিত ফেরে আশালতার। দু’চোখ দিয়ে নেমে আসে জলের ধারা- শোকের প্রথম অশ্রুপাত। দু’হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরেন রাজেশকে। শিশু স্পর্শ আর কান্না মিলিয়ে বাস্তবের মাটিতে ফিরে আসেন- প্রিয়জন হারানো- মাতৃত্ব হারানো নির্মম বাস্তবে।
নির্মলা দেবী ছোটো ছেলেকে সামলে ফিরে এসে হঠাৎ এই দৃশ্য দেখে থমকে দাঁড়িয়ে পড়েন নির্বাক হয়ে। বেশ কিছুক্ষণ পরে বৌদিকে দেখতে পেয়ে আশালতা শুধু দু’টো হাত জোড় করে বলেন, আমার কাছে দেবে ওকে? দেবে বৌদি? বুঝতে পারেন না নির্মলা দেবী কি উত্তর দেবেন। পাশে এসে দু’জনকেই বুকে জড়িয়ে ধরেন। দু’জনেই যে ভীষণ আপন তাঁর কাছে। তবুও সন্তান কিভাবে দেওয়া যায়! সেই প্রশ্নের উত্তর যে তাঁর জানা নেই।
ভাগ্যের পরিহাসে আশালতার জীবনে যখন অকাল বৈধব্য নেমে আসে, তখন তাঁর বয়স চব্বিশ বছর। তিন সন্তানের জনক-জননী ভাই- ভাজ দু’জনেই দ্বিতীয় সন্তান রাজেশকে আশালতার কোলে তুলে দিয়েছিলেন। স্বামীকে বলেছিলেন নির্মলা- যদি শোকতাপ পাওয়া মানুষটা একটু ভালো থাকে, মন্দ কি? ছেলে তো চোখের সামনেই থাকবে, এক উঠোনের মাঝে, এক ছাদের নীচে।
অমলেন্দু বাবু স্ত্রী’র দিকে সকৃতজ্ঞ দৃষ্টিতে তাকিয়ে হাত দু’টো ধরে বলেছিলেন- সন্তান ভাগ করে নিতে অনেক বড়ো মন লাগে, তুমি মহীয়সী। নির্মলা দেবী মনের কষ্ট, চোখের জল গোপন করতে স্বামীর বুকে আশ্রয় নেন।
সন্তান হারানোর ব্যথা তো তিনি বুঝতেন। তাই কৃতজ্ঞ ছিলেন বৌদির মহানুভবতার জন্য। কিন্তু বৌদির কাছে থেকে রাজেশকে আলাদা করে রাখার চেষ্টাও করেন নি কোনো দিন। শুধু মমতার সবটুকু সুধা দিয়ে মাতৃস্নেহে পালন করেছেন আশালতা দেবী তাঁর রাজেশকে। নিঃসন্তান বিধবার বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন।
জীবনটা নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখেন রাজেশকে কোলে নিয়ে। জীবনবিমার অর্থ, সুধীরের অফিস থেকে পাওয়া অর্থ কিছুটা ব্যাঙ্কে রেখে, বাকি অর্থ দিয়ে আশালতা একটি বুটিক খোলেন। হাতের কাজে বরাবর পটূ আশালতার বুটিক ধীরে ধীরে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। বুটিকের কাজের মাঝেও রাজেশের প্রতিদিনের কাজ নিজে হাতে করতেই আশালতা ভালোবাসতেন। ‘মামণি’ বলে ডাকতে শিখিয়েছিলেন রাজেশকে। অভ্যাস করে নিয়েছিল রাজেশের শিশু-মন ক্রমশ পি’মণি থেকে মামণি সম্বোধনে। আদরের- আবদারের- স্নেহের- ভালোবাসার আত্মিক এক বন্ধন। দুঃখ-কষ্টগুলো মনের মধ্যে সময়ের পলিতে চাপা পড়তে থাকে। আস্তে আস্তে বাচ্চাদের স্কুল, পড়াশোনা সবকিছুর মাঝে ব্যস্ত হয়ে ওঠে ননদ- ভাজের সংসার। সারাদিনের কাজের শেষে কমতে থাকে অবসর। তাও পারিবারিক আসরে, অবসরে মাঝে মিলেমিশে কেটে যায় দিন- মাস- বছর।
অমলেন্দু- নির্মলার প্রথম সন্তান ইন্দু লেখাপড়া শেষে কর্মজীবন শুরু করেছে বছর দুয়েক হলো।
যথাসময়ে রাজেশ লেখাপড়া শেষ করে, চাকরি জীবনে প্রবেশ করলো। ছোট সন্তান রাকেশ এখনো শিক্ষার্থী।
একটা কাজে মন দিতে হবে কিন্তু তোমাদের, ইন্দুর জন্য পাত্র দেখো এবার- নির্মলা দেবী ছুটির দিনে চায়ের আসরে বললেন। অমলেন্দু, আশালতা, রাজেশ, রাকেশ সবাই সায় দিলো। আশালতা বললেন, ঠিক বলেছো বৌদি, এবার কোমর বেঁধে নামতে হবে। আমাদের ইন্দুর বিয়ে- কি যে আনন্দ হবে! আমি ইন্দুর পচ্ছন্দ মতো শাড়ি বানাবো বুটিকের, আর গয়না…
-ওরে বাবা, আগে পাত্র তো একটা খুঁজতে হবে। একটু সবুর কর। হাসতে হাসতে বলেন অমলেন্দু বাবু।
-তুমি ভেবো না বাবা, একটা ডট কমে দিয়ে দিচ্ছি এক্ষুণি, চল ভাই, এই দিদি চল ছবি দিবি চল। রাজেশ এই কথা বলে ব্যস্ত হয়ে ওঠে ভাইয়ের সাথে। ইন্দুকেও সাথে নিয়ে যায় হাত ধরে।
সুন্দরী, শিক্ষিতা ইন্দুর জন্য সম্বন্ধের অভাব হলো না। ভালো পরিবার, পাত্র দেখে ইন্দুর বিবাহ স্থির হলো। ননদ-ভাজে মিলে পাড়া প্রতিবেশী, আত্মীয়- বান্ধব নিয়ে শুভ কাজে মেতে উঠলেন। পাকা দেখা, আর্শীবাদ, গায়ে হলুদ, বিয়ে সব কিছু নির্বিঘ্নে হয়ে যাবার পর সেই মুহূর্ত, বিদায়ের মুহূর্ত। নিজের হাতে বড়ো করা প্রাণপ্রতিমাকে তুলে দেওয়া পরের হাতে। চোখের জল বাঁধ মানে না কারোর। তবুও বিদায় জানাতেই হয় প্রথা মেনে কনকাঞ্জলী নিয়ে। মেয়ে শ্বশুর বাড়ি যাবার পরেও তো দায়িত্ব থেকে যায়, দায়িত্ব আবার সচল করে তোলে সংসার। দ্বিরাগমনে বাড়ি আসে ইন্দু, সাথে মামাতো ননদ কণা। ভারী মিষ্টি মেয়ে। হাসি, খুশী, প্রাণোচ্ছল।
বিয়ের সময়ও দেখেছিলেন আশালতা। ভালো লেগেছিল। আজ ইন্দুর দ্বিরাগমনে গান শুনলেন কণার গলায়। ভাবলেন মনে মনে- রাজেশের জন্য এমন একটি মেয়ে হলে বেশ হয়। বলেও ফেললেন দাদা- বৌদির কাছে মাসখানেক পরে মনের ইচ্ছের কথা,
-ইন্দু চলে গিয়ে বাড়িটা কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে গো। মেয়ে ছাড়া কি বাড়ি মানায়। বেশ হাসবে- ঘুরবে- গাইবে, তবে তো ভরা সংসার।
-ঠিক বলেছিস রে আশা, মেয়ে ছাড়া সত্যি বড়ো ফাঁকা ফাঁকা লাগে। অমলেন্দু বাবু বলেন।
-কন্যাসন্তান তো পাঠাতেই হয় পরের ঘরে বিয়ে দিয়ে। ওখানেই ওর নিজের সংসার তৈরী হবে নতুন করে। এই তো চলে আসছে, আমরাও তো এসেছি। খারাপ তো লাগে গো, কিন্তু মানিয়েও নিতে হয়। ছোট্ট একটি শ্বাস ফেলে বলেন নির্মলা দেবী।
– ঠিক বলেছো বৌদি। কিন্তু একটি মেয়ে নাহলে ভালোও তো লাগে না। তাই ভাবছি এবার রাজেশের বিয়ে দিয়ে একটি মেয়ে নিয়ে এলে কেমন হয় বৌদি?
– এটা তো খুব ভালো কথা বললি রে। কি বলো নির্মলা?
-সত্যিই খুব ভালো কথা। তাহলে তো পাত্রী দেখা শুরু করতে হয়।
– কণাকে কেমন লাগে তোমাদের? একটু ইতস্তত করে বলেই ফেললেন আশালতা।
– কে? ইন্দুর ননদ? বেশ ভালো মেয়ে। চেনা- পরিচিতির মধ্যে। ইন্দু এবার এলে ওর সাথে কথা বলে নিও। রাজেশকেও একবার জিজ্ঞেস করে নাও। তোমার ছেলে তুমি যা বলবে সেটাই হবে।
ভাই-ভাজ বরাবরের মতো এবারও তাঁর মতামতকেই প্রাধান্য দিলেন। রাজেশকে জিজ্ঞেস করে সম্মতি নিয়ে যোগাযোগ করলেন কণার পরিবারের সাথে অমলেন্দু বাবু। পরিচিতের মধ্যে সম্বন্ধ, ভালো ছেলে, ভালো চাকরি। রাজি হয়ে গেল দু’পক্ষ।
আশালতা ব্যস্ত হয়ে উঠলেন, ছেলের বিয়ে দেবার জন্য। সাজো সাজো রবে ধূমধাম করে শুভদিন দেখে বিয়েও হয়ে গেল। আশালতা আগলে রাখা স্ত্রী ধন থেকে ভীষণ প্রিয় বালা জোড়া, হার দিয়ে নববধূকে আর্শীবাদ করলেন প্রাণ ভরে।
বিয়ের যাবতীয় আচার- বিধির শেষে এলো ফুলশয্যা। ফুলশয্যার রাতে নবদম্পতির ঘরে বেজে উঠলো যুগলের নতুন সুর, নতুন আলাপ, ভালোবাসার জ্যোৎস্না।
পাশাপাশি ঘর থাকার সুবাদে আশালতার কানে এলো সেই সুর- আলাপ। মনের মধ্যে ঘুমিয়ে থাকা অনুভূতিগুলো যেন নাড়াচাড়া শুরু করে দিল। ঘুম ভাঙতে শুরু করলো- অনেক পুরোনো স্মৃতির, স্পর্শের। মনের মধ্যে অজস্র পুরোনো ক্ষতের রক্তক্ষরণ হলো সারারাত। দু’ চোখের পাতা এক হলো না- ভোর হয়ে এলো। এক নতুন ভোর- অন্যদিনের থেকে আলাদা। বুঝতে দিলেন না।
সামলে নিলেন নিজেকে। সকালে সবার সাথেই স্বাভাবিক ব্যবহার করলেন। অভ্যাস মতো নিত্যদিনের পুজো, বুটিক, কাজকর্ম করতে করতে ভুলেও গেলেন রাতের কথা। অবশেষে আবার রাত- পাশের ঘর থেকে শব্দের আবছা- অস্পষ্ট যুগলবন্দী। শুরু হলো আবার রক্তক্ষরণ। পুরোনো স্মৃতির রোমন্থন আর রক্তক্ষরণ। ক্রমশঃ এই কষ্ট যেন নিত্য সাথী হয়ে গেল।
জীবনের চরম দুঃখ যাকে নিয়ে ভুলে ছিলেন, সেও তখন যে আর সম্পূর্ণ তাঁর নেই। তাই ফেলে আসা জীবনের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না নতুন করে রোজ ধরা দিতে লাগলো। বহুদিনের সংযমী জীবনে অভ্যস্ত, ধীর স্থির ব্যক্তিত্বের অধিকারী আশালতা ধীরে ধীরে বদলাতে শুরু করলেন। মুখে কিছু না বললেও নতুন বৌয়ের সবকিছুই তাঁর অপচ্ছন্দের কারণ হয়ে উঠলো। কিন্তু নতুন বৌয়ের কোনো দোষ কেউ দেখতে পায়না, তিনিও পান না। তবুও অসহিষ্ণুতা গ্ৰাস করলো তাঁকে।
অসহিষ্ণুতা এমন রূপ নিলো যে রাজেশের চোখ এড়িয়ে গেল না আর। কণা সন্ধ্যায় চা দিচ্ছিল সবাইকে। হাসি- গল্পের মাঝে কণা এসে বসতেই আশালতা উঠে চলে গেলেন। হঠাৎ উঠে যাওয়া সবার চোখে লাগলেও রাজেশ বললো, কি হলো মামণি উঠে যাচ্ছো? বসো এখন তো সবে সন্ধ্যা..
-তোমরা বসো, আনন্দ করো আমার কাজ আছে।
বলে আর কথা বলার সুযোগ না দিয়ে নিজের ঘরে চলে গেলেন। রাতে আর বেরোলেন না, খেলেন না, হাজার ডাকাডাকিতে সাড়াও দিলেন না। এইভাবে কখনো খাবার টেবিলে অর্ধেক খাবার ফেলে উঠে যান, কখনো রান্নাঘরের কাজ ঢেলে সরিয়ে দিয়ে বের হয়ে যান। সবখানেই কণাকে দেখলেই কেমন যেন ধৈর্য্য হারিয়ে ফেলেন। পরিবেশ থমথমে হয়ে যায়।
কণা এই নিয়ে কখনো কোনো অভিযোগ করে না। কিন্তু তার স্বতঃস্ফূর্ত হাসি,গান, কথা যেন হারিয়ে গেছে। ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে থাকে সবসময় মামণির অসন্তোষের জন্য। শুধুমাত্র রাতটুকু রাজেশের নিরিবিলি সাহচর্যে প্রাণ ফিরে পায় সে বন্ধ দরজার ভেতর।
রাজেশও কণা আর মামণির মাঝে পড়ে পিষতে থাকে। নির্মলা দেবীও কিছু বলতে পারেন না। কিন্তু সংসারে অকারণ এই অশান্তি তাঁকেও অধৈর্য্য করে তোলে। চেনা মানুষ যখন বদলাতে শুরু করে সে এক ভীষণ জ্বালা! কোনো উপায় খুঁজে পান না সমাধানের।
সংসারের চাপা অশান্তি আশালতা নিজেও বুঝতে পারেন। অপরাধ বোধে ভোগেন। বদলাবার চেষ্টাও করেন নিজেকে। কিন্তু প্রতিটি রাত নতুন করে তাঁকে বেদনায় নীল করে দেয়। দিনের শুরুতে তাই সেই অচেনা, অজানা অসহিষ্ণু আশালতা।
এক বৃহস্পতিবার লক্ষ্মীপুজোর দিন ধূপের প্যাকেট কণা এগিয়ে দিতে গেলে, হাত থেকে প্রায় কেড়ে নিতে যান আশালতা। কাছেই জ্বলন্ত প্রদীপ পিলসুজ থেকে কণার হাতে পড়ে। ‘মা গো’ বলে কঁকিয়ে ওঠে কণা। ‘অসহ্য’ বলে পুজোর আসন ছেড়ে উঠে যান অমলেন্দু বাবু। বহুদিনের পুরনো সখী-শুভাকাঙ্খী নির্মলা দেবীও তির্যক দৃষ্টিতে ননদের দিকে তাকিয়ে কণার শুশ্রূষায় ব্যস্ত হয়ে উঠলেন।
সেদিন কেউ আর কথা বললো না কারো সাথে বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া। আশালতা সেই ঘটনার পর যে নিজের ঘরে ঢুকলেন, কেউ তাঁকে ডাকতে এলো না। নাহ্, রাজেশও আসে নি। মামণির সাথে রাত্তিরে দেখা না করেই চলে গেল নিজের ঘরে। সব কিছুই বুঝতে পারলেন নিজের অন্ধকার ঘরে বসে। অনুশোচনায় দগ্ধ হতে লাগলেন। কানে ভাসছে কণার আর্তনাদ ‘মা গো…’ ওকে তো নিজে ভালোবেসে পচ্ছন্দ করে ঘরে এনেছিলেন। কি হয়ে গেল সব কিছু ওলোট- পালোট! কখনো অনুশোচনায় কখনো অভিমানে কখনো অকারণেই দু’ চোখে প্লাবন নামলো।
রাত্রি শেষ হবার আগেই ঘর থেকে বেরোলেন। পুজো করলেন। ঘরে গিয়ে নতুন পুরোনো সব কাগজপত্র একসাথে নিয়ে বসলেন। সব গুছিয়ে নিয়ে বাইরে যাবার জন্য প্রস্তুত হলেন। কেউ জানার আগেই বেরিয়ে গেলেন। ফিরলেন সন্ধ্যায়। সেই পুরোনো শান্ত, সংযমী আশালতা। সারাদিনের অনুপস্থিতি নিয়ে কেউ কোনো প্রশ্ন করার আগেই অমলেন্দু বাবুর কাছে কিছু কাগজপত্র দিয়ে বললেন, ‘দেখো তো সব ঠিক আছে তো?’ কণার দিকে ফিরে বললেন, ‘আমার যা কিছু তোমাকে দিলাম.. যেভাবে খুশী রেখো।’ রাজেশের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘কাল সকালে আমাকে এক জায়গায় নিয়ে যেতে হবে, খুব বেশী সময় লাগবে না। একা যেতে পারতাম, কিন্তু তুই নিয়ে গেলে ভালো লাগতো। ভেবে দেখিস.. যদি পারিস।’
-এটা কি? বুটিকের কাগজ, গয়না সব কণার নামে! মানেটা কি? দেহদানের অঙ্গীকারের আবেদন? বাদবাকি সব.. এ তো উইলের খসড়া!
-হুম, আমি ছিলাম বুটিক চালাতাম। এরপর বুটিক চালাবে, কি চালাবে না সেই সিদ্ধান্ত কণা’ই নেবে। আর গয়না পড়ার বয়েস কি আর আমার আছে? কি হবে রেখে আমার কাছে? আর আমার মৃত্যুর পর আমার যেটুকু অর্থ থাকবে ইন্দু, রাজেশ, রাকেশ সমান ভাগ পাবে। ব্যস.. এইটুকুই। ‘দেহদান’ ওটা ভেবেচিন্তেই করলাম, ইচ্ছেও ছিল যদি চিকিৎসা বিজ্ঞানের কোনো কাজে আসে। ওই কাগজটা পাকাপাকি তৈরী হতে একটু সময় লাগবে। আবেদন করে এলাম। ওরা জানিয়ে দেবে হয়ে গেলে। উইলটাও আইনতঃ রেজিস্ট্রেশন করে উকিল বাবু দিয়ে যাবেন তোমাকে। বলে দিয়েছি ওনাকে।
– ছিলাম মানে? মৃত্যুর পর! এসব কি কথা? নির্মলা দেবী প্রশ্ন রাখেন।
– হুম, ভগবান বাঁধন অনেক আগে কেটে দিয়েছিলেন। বুঝতে না পেরে নতুন বাঁধনে জড়িয়ে ছিলাম। ভগবান যাকে বন্ধন দিতে চান না, তাকে তো মুক্তিই খুঁজতে হবে। আমার এক পরিচিত দক্ষিণেশ্বরের কাছে একটা বৃদ্ধাশ্রমের ঠিকানা দিয়েছিলেন বছরখানেক আগে। উনি থাকেন ওখানে। বেশ ছিমছাম, পরিস্কার। কথা বলে এসেছি, কাল যদি রাজেশ রেখে আসে, তাহলে.. তোমরা বসো। কথা বলো। আমি উঠি। কালকের জন্য গুছিয়ে নিতে হবে। ভোর ভোর বেরোলে রাজেশের ফিরতে সুবিধে হবে।
উঠে চলে যান ধীর পায়ে নিজের ঘরের দিকে। রাজেশকে আজ মুখাগ্নি করার অধিকার থেকেও মুক্তি দিয়েছেন তিনি, মরণোত্তর দেহদানের অঙ্গীকার করে। ঘরে ঢুকে দরজাটা বন্ধ করে দেন। যাতে রাজেশ বা অন্য কেউ আসতে না পারে। বাস্তবে বোধহয় মনের দরজাটাও বন্ধ করেন। ওটা না বন্ধ করলে তো মুক্তি নেই।
সবাই বসে থাকেন চুপ করে যে যেখানে বসেছিলেন। চিরদিনের জেদী, সংযমী, অভিমানী, আত্মসচেতন মানুষটাকে বলার মতো কোনো ভাষা খুঁজে পান না কেউ। বোধহয় এইভাবেই সমাধি হয়ে যায় সম্পর্কের, সম্পর্কের দহনের।