ঝালমুড়ি
– শান্তনু ব্যানার্জী
ই সি এলে নূতন চাকরি । বাড়ি কলকাতায় কিন্তু থাকে বরাকরে । ঘর ভাড়া নিয়ে থাকে। মাঝে মধ্যে শনিবার বা কোনো ছুটির দিনে বাড়ি আসে আর তার পরদিন আবার ফিরে আসে বরাকরে। মাস গেলে মোটা টাকা ঘরে আসে। তাই কলকাতায় এলে এটা ওটা সকলের জন্য খরচা করে। তার মানে এই নয় যে সকলেই বরাকরে বা নিজ নিজ চাকরি স্থলে ঘর ভাড়া নিয়ে থাকে। বেশিরভাগ লোকই ডেইলি প্যাসেঞ্জার। যাতায়াত মিলিয়ে হাওড়া থেকে হাওড়া ট্রেন লেট না হলে ছয় সাত ঘন্টা লেগে যায়। তার ওপর কেউ থাকে গড়িয়া বা কেউ বেহালা বা শ্যামবাজারে। অর্থাৎ বাড়িতে সর্বসাকুল্যে তিন চার ঘন্টা বিছানায় গা এলিয়ে নিতে পারে। কিন্তু পারিবারিক দায়বদ্ধতায় হাসিমুখে দিনের পর দিন এই একই রুটিন চলতে থাকে । তাছাড়া প্রত্যেকের মাইনে তো সমান নয় যে অফিসের কাছে ঘর ভাড়া নিয়ে সব খরচ খরচা সামলে নিতে পারে। কিন্তু এই ট্রেন জার্নির একটা মজার দিকও ছিল । কেউ লেট করে স্টেশনে এলে ডেইলি প্যাসেঞ্জারেরা তার জন্য জায়গা রেখে দিত । তাস খেলা, চা খাওয়া, ঝালমুড়ি ইত্যাদি চলতেই থাকত। মাঝে মধ্যে মিষ্টিও হত। হয়ত কারো সন্তান হয়েছে বা কারো ছেলে মেয়ে রা ভালো রেজাল্ট করেছে অথবা কারো প্রমোশন হয়েছে। আবার একটা বেদনার জায়গাও ছিল। যখন কেউ রিটায়ার করে। এমনও অনেককে হতাশ হতে দেখা যেত যে শেষ জীবনে এত কষ্ট করে সংসার অতিবাহিত করেও বাড়িতে প্রাপ্য মর্যাদা পান না। সব মিলিয়ে অনাত্মীয় সকলেই আত্মীয়ের মতো হয়ে যেত। কারও অকালমৃত্যু বেদনা আরও বাড়িয়ে তুলতো।
শোভনের অবশ্য এদিনের জার্নিটা রবিবারেই ছিল। সন্ধ্যের মধ্যে বরাকরে পৌছে পরের দিন অফিস করবে। আরেকজন কলিগ প্রীতমের বড় ঘড়ির তলায় হাওড়া স্টেশনে অপেক্ষা করবে। যাই হোক ট্রেনটা ছিল তুলনামূলক ভাবে ফাঁকা। তার মধ্যে একটা জায়গা বেছে নিয়ে শোভন আর প্রীতম বসে পড়লো। সাধারণ দিনে তিন জনের সিটে চার থেকে পাঁচ জন বসে। সেদিন একপাশে তিনজন মহিলা আর উল্টো দিকে জানালার পাশে আরেকজন মহিলা। সেই মহিলার পাশে শোভন আর তার পাশে প্রীতম৮। অর্থাৎ দু’দিকে তিনজন করে । ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে। হঠাৎই একজন লোক এসে প্রীতমকে বলল একটু সরে বসতে।
শোভনের সামনের সিটে বসা একজন ছিল অতীব সুন্দরী বয়স্কা মহিলা। চারজন মহিলাই একসঙ্গে আছেন। যাইহোক শোভনের চোখ যেন ওই মহিলা থেকে সরছিলই না। হঠাৎ সম্বিত ফিরল। ভদ্রমহিলা মৃদু হেসে বলল তাস খেলবে?
ওনাদের সকলে আবার তাস খেলতে পারেন না। প্রীতমের পাশের লোকটা লাফিয়ে উঠে বললো যে সে খেলতে চায়। শোভনের প্রথম থেকেই লোকটাকে পছন্দ হয়নি। কেমন যেন হ্যাংলা মার্কা। শোভন বলে উঠলো, না না গান হবে। প্রীতম ভালো গান করে। প্রীতম লজ্জা পেয়ে কিছুতেই গান করতে রাজি হল না। তখন বৃদ্ধা মহিলা বলল আমিই তবে গান গাই। আমার বয়স কিন্তু চুরাশি বছর। বলে শুরু করলেন, সে কি গান! পুরোপুরি ক্লাসিকাল বেসে।
‘নুরজাহান, নুরজাহান
সিন্ধু নদীতে ভেসে
এলে মেখলামতির দেশে, ইরানি
গুলিস্তান।’
……….. ……… …………
……….. ……… …………
গান ত নয় যেন এক মূর্ছনা। পিন পড়ার শব্দ নেই। এ বয়সে যে এত ভালো গান করতে পারেন ভাবা যায় না। নানা গল্পের মাঝে একসময় মানকড় স্টেশন পেরিয়ে গেল।
মহিলারা নিজেদের মধ্যে নানা রকম রান্না নিয়ে আলোচনা শুরু করলো। প্রীতমের পাশের লোকটা এবার বলে উঠল যে সে নাকি কাঁচালঙ্কা খেতে ওস্তাদ। যত খুশি কাঁচালঙ্কা চিবিয়ে খেয়ে নিতে পারে। মনে হলো এর মধ্যে দিয়ে একটা বীরত্ব প্রকাশের উন্মাদনা কাজ করছে। পানাগড় স্টেশন আসছে। একটা ঝালমুড়িওয়ালার আওআজ পাওয়া গেল। পাশের কিউবিকিউলে বিক্রি করছে। ঐ সময় প্রীতমের পাশের লোকটি একটু টয়লেটে গেল। শোভন বিদ্যুত গতিতে মুড়িওয়ালাকে কিছু বলে নিজের সিটে বসে পড়লো। টয়লেট থেকে ওই লোকটিও এসে বসলো। শোভন বলল সময়টা সকলের সাথে খুব সুন্দর ভাবে কেটে গেল। তাই ও সবাইকে ঝালমুড়ি খাওয়াবে। বলতে বলতে ঝালমুড়ি ওয়ালা এসে হাজির। শোভন সেই ভদ্রলোককে দেখিয়ে বলল উনি দুর্গাপুরে নেমে যাবেন। ওনাকে স্পেশাল করে আগে বানিয়ে দাও । খেতে খেতে দুর্গাপুরে পৌছে যাবে। যেন তৈরিই ছিল। ওনার হাতে এক ঠোঙা ধরিয়ে দিয়ে অন্যদেরটা বানানো শুরু করলো।
এবার কিন্তু ভদ্রলোক অসম্ভব গম্ভীর হয়ে ঝালমুড়ি খেয়ে যাচ্ছেন। মহিলাদের মনে হয় কিছু চোখে পড়েছে। সবাই মিটিমিটি হাসছে।
দুর্গাপুর স্টেশন এসে পড়লো। শোভনের দিকে একটা জ্বলন্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে দরজার দিকে এগিয়ে গেল।
শোভন এখন রিটায়ার করে গেছে। হঠাৎ একদিন এয়ার ইন্ডিয়ার অফিসে দেখা। শোভন খেয়াল করেনি। সকলেরই বয়স হয়েছে। কুশল বিনিময়ের পর উনি হেসে হেসে বললেন যে লঙ্কার ঝালটা কিন্তু এখনও মুখে লেগে আছে।
বাড়ি ফিরতে ফিরতে শোভন ভাবলো যে হবেইবা না কেন? ঝালমুড়িতে চারভাগের তিন ভাগই লঙ্কার কুচি দেওয়া ছিল।