সময় অসময়
– জ্যোৎস্না ভট্টাচার্য ত্রিবেদী
আজ ডক্টর চ্যাটার্জির কাছে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করা আছে আমার। কিছু মেয়েলি সমস্যা হচ্ছে গত কিছুদিন যাবত। উনি এ বিষয়েই স্পেশালিস্ট। সন্ধ্যে সাতটায় সময় দিয়েছে। ছটা নাগাদ তৈরী হয়ে বেরিয়ে পড়লাম, যেতেই আধ ঘন্টা বা তার বেশীই লাগবে। সন্ধ্যে বেলা যা ভীড় রাস্তায়, অটো টোটো যাই নাও, সে তো চলবে শম্বুক গতিতেই। সুতরাং একটু আগে যাওয়াই…..
সাড়ে ছটার আগেই পৌঁছে গেলুম। ভাগ্যক্রমে আজ আর রাস্তার ভিড় তেমন সমস্যা করেনি। গিয়েই দেখি বেশ ভিড় চেম্বারে। আমার ১৭ নং, এখন চলছে সবে ৮…. সুতরাং অপেক্ষা ছাড়া গতি নেই। আজ উনি মনে হয় দেরি করে এসেছেন। এদিক ওদিক চেয়ে একটু বসার জায়গা খুঁজতে খুঁজতে হঠাৎ কোনের দিকে নজর পড়লো। আমাদেরই বয়সী এক মহিলা এবং সম্ভবত তার হাজব্যান্ড…. দু’জনেই গভীর ভাবে কিছু আলোচনায় ব্যস্ত। উল্টো দিকের বেঞ্চ থেকে একজন উঠে গেলো, সম্ভবত এবার তার নম্বর। আমি আর দেরি না করে সেখানে গিয়ে কোনোরকমে বসলাম। বসেই আবার তাদের দিকে নজর গেলো। মহিলাকে খুব চেনা চেনা লাগছে। অথচ কিছুতেই মনে করতে পারছি না। এই হয়েছে আজকাল, প্রায়ই এমন হয় রাস্তায় ঘাটে। অতি পরিচিত মানুষকেও চিনতে পারিনা।
অনেকক্ষণ ভাবতে ভাবতে হঠাৎই মনে পড়লো, আরে, এতো আমাদের মধুমিতা। কতোদিন পর দেখা, বেশ মুটিয়েছে। অনেক পরিবর্তন, অবশ্য আমিও কিছু কম যাই না। যাই হোক, মনে পড়তেই আর না ডেকে পারি! যতোই হোক কিশোরী বেলার বন্ধু বলে কথা।
আরে, মধু না?….ভদ্রমহিলা চমকে তাকালেন এবং যথারীতি অবাক হয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে তারপরই, আরে সুমি না? বলেই একগাল হাসি। ঠিক সেই আগের মতোই, গজ দাঁত দুটো ঝিলিক দিয়ে উঠলো। শ্যামলা চেহারার ভারী মিষ্টি মেয়ে ছিলো মধু। হাসিটা খুব সুন্দর ছিলো, আজও তেমনিই। পাশের ভদ্রলোক জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে। মধু পরিচয় করালো ওর বরের সাথে আমার। অনিমেষ….. দু’জনেই নমষ্কার বিনিময় করলাম। অতঃপর সুযোগ বুঝে তাঁর সাথে আমার স্থান পরিবর্তন এবং নিজেদের কথায় বিভোর আমরা দুই বান্ধবী। মধুর এক ছেলে, বিএসসি ফার্স্ট ইয়ার আর মেয়ে ইলেভেন। আমার ছেলে মেয়ের কথাও হলো। আরো বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলতে বলতে, হঠাৎ আমি জিজ্ঞাসা করলাম, তোর কতো নং রে? ও বল্লো, ২২। আমার ১৭, আমি বললাম। আর তারপরই স্বাভাবিক ভাবেই জিজ্ঞাসা করলাম, তোর কি সমস্যা রে?
নাহ্, তেমন কিছু নয়, মুখটা হঠাৎই একটু অন্ধকার…. আমায় জিজ্ঞাসা করলো মধু, তোর কি হয়েছে? এখানে কেন? আর একলাই বা কেন এসেছিস? তোর বর সাথে আসেনি?
আমি বললাম, আরে না না। ওর আসার কি দরকার। আমি তো এনার কাছে প্রতি মাসেই আসি। আমার আসলে এখন…. খুব আস্তে করে কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে বলি, প্রি-মেনোপজাল প্রবলেম চলছে কিছু। ওই যা হয় আর কি এই বয়সে। বয়সটা তো আর থেমে নেই বল…!
মধু চুপচাপ শুনে, হঠাৎ বলে উঠলো, কেন..! কি এমন বয়স আমাদের? তোর কতো চলছে?
আমি কিছুটা অবাক হয়েই বলি, সেকি রে, বয়স হয়নি? তুই আর আমি তো একই বয়সি, এক সাথে হায়ার সেকেন্ডারি পাস করেছি আমরা….! আমার ৪৫ চলছে, তোর ও….
মধু তাড়াতাড়ি বলে উঠলো, না না, আমি তোদের চেয়ে ছোটছিলাম রে। মনে পড়লো, ঠিকই, ও যখন ইলেভেনে ভর্তি হয়, তখন ই বলেছিলো। ও ১৫ বছরে মাধ্যমিক দিয়েছে। আর এইচ.এস. এর ফর্ম ভরার সময়ও দেখেছিলাম, ও আমাদের চেয়ে সত্যিই এক বছরের ছোটো। যাই হোক, বললাম, হ্যাঁ হ্যাঁ, তুই তো একবছরের ছোটো ছিলিস আমাদের চেয়ে। তার মানে তুই এখন ৪৪, তাই তো। ও অন্যদিকে তাকিয়ে মাথা নাড়লো। হঠাৎ খুব ব্যাস্ত হয়ে জিজ্ঞাসা করলো, কতো নং চলছে, ১৭ পেরিয়ে যায় নি তো রে? আমি অবাক হয়ে বললাম, না না পেরোয় নি। সবে তো ১১ গেলো একটু আগে। ও যেন বেশ নিরাশ হলো।
আমি কিছু না বুঝেই ওকে আবার জিজ্ঞাসা করলাম, তোর সমস্যাটা কি? ও কেমন যেন চমকে উঠলো, আর সামনে বসে থাকা বরের দিকে তাকালো। ওর বর মুখটা অন্যদিকে ঘুরিয়ে নিলো। এতোক্ষণ ওর বর বেশ হাসি মুখেই আমাদের কলেজের গল্প শুনছিলো। কিন্তু হঠাৎ এমন পরিবর্তনের কারণ কিছুই বুঝে উঠলাম না। কিছুটা অবাক হয়েই আবার ওর দিকে তাকালাম। এতোক্ষণ যে মুখে ঝকঝকে হাসি মুক্তো হয়ে ঝরছিলো, এখন সেই মুখই আষাঢ়ের ঘন মেঘাচ্ছন্ন আকাশের মতোই অন্ধকার। আমি কিছুই বুঝলাম না, আবার ওর বরের দিকে তাকাতেই, হঠাৎই ওর বর ওখান থেকে উঠে চলে গেলো, সম্ভবত বাইরেই….
বুঝলাম, সমস্যা যথেষ্টই গম্ভীর। কিন্তু সমস্যা যেমনই হোক, তার সমাধানও অবশ্যই আছে কিছু না কিছু। আর হয়তো আমি ওদের কিছু সাহায্য করতে পারি এ বিষয়ে, যতোই হোক, বাল্যবন্ধু বলে কথা। এইসব সাতপাঁচ ভেবে, আমি বললাম, কি রে অমন চুপ করে গেলি কেন রে? বল না তোর কি হয়েছে? আরে আমিও তো তোরই মতো একটা মেয়ে, আর তোর বন্ধুও তো। বল আমাকে কি সমস্যা তোর, হয়তো আমি কিছু সাহায্য করতে পারবো। বল না, কি হয়েছে?
না রে, সাহায্য করার কিছু নেই। তেমন কিছু.…. বলেই মধু মাথা নিচু করলো। আমি অবাক হয়ে ওকে দেখছিলাম, হঠাৎ ওর পেটের দিকে নজর গেলো। এতোক্ষণ ও কোলের মধ্যে একটা ব্যাগ নিয়ে দু’হাতে ধরে বসে ছিলো তাই নজর পড়েনি। এখন দেখলাম, বাঁ হাতটা ব্যাগের পেছন দিয়ে নিয়ে গিয়ে নিজের পেটে বোলাচ্ছে। আর মুখ নিচু করে সেদিকেই তাকিয়ে….
কি রে, পেটে কিছু হয়েছে তোর? আমি জিজ্ঞাসা করলাম…
হ্যাঁ, ওই আর কি, বলে মুখটা তুলে একটু হাসলো। বড্ড ক্লিশে লাগলো এ হাসি। ঠিক আগের মতো নয়।
কি হয়েছে পেটে? কোথায় কষ্ট? কতোদিন… এই প্রথম দেখাবি? আগে কেন আসিস নি? ইনি খুবই ভালো ট্রিটমেন্ট করেন রে। দেখবি, তোর যাই হয়ে থাকুক, তুই ঠিক ভালো হয়ে যাবি।
বলছিস…? মধু অদ্ভুত ভাবে তাকালো আমার দিকে, ওর চোখে কি যেন……
আমি বললাম, হ্যাঁরে, আমি বলছি, তুই দেখে নিস।
আবার হাসলো মধু…….. না রে, ঠিক ভুল কিচ্ছু আর হবার নয়। যা হবার হয়ে গেছে। কিচ্ছুই আর করার নেই কারুরই….
বড্ড ভয় করলো আমার, কি এমন হয়েছে মধুর? এমন ভাবে কেনো কথা বলছে? আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকি….
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে, বড় একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে মুখটা আবার আগের মতো নিচু করে পেটে হাত দিয়ে বিড়বিড় করে বললো, আমি প্রেগন্যান্ট…… বলে আস্তে করে আমার দিকে তাকালো। আমি অবাক হয়ে বড় বড় চোখ করে ওর দিকে তাকালাম, তারপর ওর পেটের দিকে ভালো করে লক্ষ্য করে দেখলাম, হ্যাঁ, সত্যিই তো, পেটটা তো অস্বাভাবিক রকম বড়। ঠিক মোটা হয়ে যাওয়া বা চর্বি জমার মতো তো নয়। একদমই অন্যরকম….
এখন? কি বলছিস তুই?…….
হ্যাঁ রে, ঠিকই বলছি…..
কিন্তু কতোদিন? মানে ক মাস চলছে?…
….. সাত পেরিয়ে গেছে….!
আমি অবাক…. কিছু করার কথা ভাবিস নি?
– সময় ছিলো না, গত সপ্তাহে হঠাৎই পেটে যন্ত্রণা শুরু হলো, অদ্ভুত যন্ত্রণা। পাড়ার ডক্টরকে ডেকে আনলো অনিমেষ, তিনি দেখেই কিছু সন্দেহ করেছিলেন। কিন্তু কিছু বলেন নি, হালকা একটা ওষুধ দিয়ে, এনার কাছে রেফার করেন। পরের দিনই এসেছিলাম এখানে। তখনই সব জানতে পারি। আর এতোটা দেরি হয়ে গেছে, কিছুই করার নেই। অগত্যা…. বলে আবার দীর্ঘশ্বাস ফেললো।
আমারও কিছুই বলার ছিলো না। এর মধ্যে আমার নম্বর এসে যাওয়ায় আমি ভেতরে চলে গেলাম। বেরিয়ে আর ওদের দেখতে পেলাম না। অনেক খুঁজলাম, অদ্ভুত তো। কোথায় চলে গেলো..? ফোন নং টাও নেওয়া হয়নি যে… ইসস, বড্ড ভুল হয়ে গেলো…. কি আর করা, ধীরে ধীরে বেরিয়ে এসে অটো ধরার জন্য স্ট্যান্ডের দিকে এগোলাম।
অটোতে বসে ভাবতে ভাবতে, কতো কথাই মনে পড়লো। তখন আমরা ইলেভেনে সদ্য ভর্তি হয়েছি। কি করে যেন আমাদের চারজনের খুব ভাব হয়ে গেছিলো, অল্পদিনেই প্রাণের বন্ধু…. নিজেদের বিষয়ে অনেক কথাই হতো। তেমনই একদিন আমরা কে কয় ভাইবোন জানা হচ্ছিলো। সবাই বলার পর, মধু ঠিক এমনই চুপ কিছুক্ষণ। তারপর বললো, ওরা তিন ভাইবোন। ও বড়, আর দুই ভাই ছোটো। স্বভাবতই ভাইরা কি পড়ে জানতে চাওয়াতে, মুখ নিচু করেই বললো, এক ভাই নাইনে পড়ে আর……. চুপ করে নখ খুঁটছে….. আমরা তো অবাক হয়ে অপেক্ষা করছি… রত্না বলে উঠলো, আর একভাই… কিসে পড়ে রে? ও যেন কুঁকড়ে গেলো…. একটুক্ষণ চুপ থেকে বললো, ছোটো ভাই ৫ মাসের…! আমরা ভীষণ অবাক হয়ে একে ওপরের দিকে তাকিয়ে….. হঠাৎ ভীষণ রেগে গিয়ে বলতে শুরু করলো….. হ্যাঁ, আমার ছোটভাই ব্যাস ৫ মাসের। সামনের মাসে তার অন্নপ্রাশন বুঝলি? কি করবো বল? এতো কিছু সহ্য করা….. আর পারছি না রে। তাই তো এতোদূরের কলেজে ভর্তি হয়েছি। আমাদের স্কুলেই তো ১১-১২ ছিলো। আমার তো এখন কলেজে আসার কথাই নয়। কিন্তু ওখানে তো সব্বাই আমাদের চেনে। সবাই জানে আমার ভাই হবার কথা, কি করে যাবো বল ওই স্কুলে? সবাই তো হাসবে আমাকে দেখে, তাই না? দেখলাম, এক চোখ ভরা জল…..
এরপর বেশ অনেকদিন পর, তখন আমরা অনেকটাই অন্তরঙ্গ হয়ে উঠেছি একে অপরের, বলেছিলো সব কথাই। ওর মা নাকি বুঝতে পারেনি আগে কিছুই। আর যখন বুঝেছিলো তখন প্রায় ন মাস চলছে। কিছুই করার ছিলোনা। তার মাত্র দিন পনের পরই ডেলিভারি হয়ে যায়। জানিনা ওর বাবা মা এ ব্যাপারে কতোটা লজ্জিত ছিলেন, ওনাদের কখনো দেখিনি আমরা। কিন্তু মধু যে ওই ভাইকে নিয়ে খুবই লজ্জিত সেটা বুঝতাম। কিন্তু আমাদের ১২ ক্লাস শেষ হতে হতে, ততোদিনে ভাই বেশ একটু বড় হয়েছে হাঁটতে, কথা বলতে শিখেছে অল্প। তখন যখন ও বাড়ী যেত, ফিরে এসে খুব খুশি হয়ে ভাইয়ের গল্প করতো দেখতাম। ভাইটা কতো বুদ্ধিমান, কতোটা দুষ্টু হয়েছে এই সব বলতো।
আমি শুধু একটাই কথা ভাবছিলাম, একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি একই মানুষের জীবনে, কিভাবে সম্ভব? শুধু পরিবেশ আর পাত্রের বদল ঘটেছে। ভাবছিলাম, মধুর ছেলে মেয়ে কি জানে ব্যাপারটা? মধু কি বলেছে ওদের? তারা কি ভাবে নেবে? তারাও কি লজ্জিত হবে বাবা মা এর এমন উদ্ভট অসংযমী আচরণে? তারা কি পারবে মেনে নিতে……. কি জানি কি করবে ওরা….
এইসব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে কখন আমার নামার জায়গা এসে গেছে, খেয়ালই করিনি। ভাগ্যিস অটোর ছেলেটা বললো, ও দিদি, নামবেন তো এখানে… আমি চমকে উঠে দেখেই তাড়াতাড়ি নেমে ওর ভাড়াটা দিয়েই বাড়ীর দিকে পা চালালাম…..
Ba chomotkar… Sundor
ধন্যবাদ, শুভেচ্ছা রইলো……
দারুণ গল্প এটা হয়ে যায় অনেকের ই।
হুম…..ধন্যবাদ