Site icon আলাপী মন

গল্প- রহস্যা

রহস্যা
– প্রদীপ দে

 

 

গ্রামে যেতে ভালো লাগে
কি অপরুপ তার ছবি
নদী পথঘাট চলে এঁকেবেঁকে
সাতরঙ ঢেলে দেয় তায় রবি !

অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে জানাই বর্তমান গ্রামের এই ব্যাহিক সুন্দরতার পিছনে আছে কিছু না পাওয়ার হাহাকার। গ্রামের প্রায় ছোটো বড় সবাই কর্ম্মের আশায় ভিনদেশে পাড়ি জমায়। মায়েরা, স্ত্রীরা দিন গুজরান করে ওদের উপার্জনের অর্থে, আর সজল নয়নে পথ চেয়ে থাকে তাদের ফিরে আসার অপেক্ষায়.. গ্রাম-ঘর যে ফাঁকা হয়ে গেছে।

গ্রামটার নাম আনন্দী। উলুবেড়িয়া থেক বেশ ভিতরে এক অজপাড়াগাঁ। আনন্দী নামটা গ্রামের লোকেরা ভালবেসেই ডাকে- খাতা কলমে কি আছে তা আমার জানা নেই। দু’দিনের জন্য ঘুরতে এসেছি। এক বন্ধুর আমন্ত্রণে- এইটুকুই জানি, বেশি জেনে লাভ কি?

না গ্রামটার প্রেমে পড়ে গেছি। নিঃসন্দেহে বলতে পারি আমার মতো বেকার বাউন্ডুলের কাছে এত সুন্দর সাজানো ছবির মতোনই এই গ্রামকে মনের মণিকোঠায় গেঁথে ফেলেছি।

মুলতঃ তিনটি জিনিস আমাকে এখানে দু’দিন আটকে রেখে দিল। প্রথম সুন্দর রূপী এই গ্রাম, দ্বিতীয় অনলের বৌদির সখ্যতা আর তিন নম্বর হলো রহস্যাবৃতা এক নারী।

গ্রামের একপ্রান্তে একটি পুকুরের পাড়ে একটা বড় ঝুড়িওলা বটগাছের নীচে ছিল এই ভাংগাচোরা খড়ের চালাটি। অনলের বৌদি প্রথম দিনের সখ্যতা বেশ মাখামাখা হলে, দ্বিতীয় দিনের দুপুরবেলা আমাকে তার মোহময়ী রূপ যৌবনের একটা আকর্ষণে এখানে টেনে আনলো। আমি বত্রিশ বছরের এক অবিবাহিত যুবক অন্য এক যুবতী বৌদির সান্নিধ্য লাভের জন্যই এই প্রস্তাব প্রত্যাখান করতে পারলাম না। আমার বন্ধু অনল কিছুই জানলো না। ওকে কিছুই জানালো হলো না। ও তখন ভাত-ঘুমে ব্যস্ত ছিল। ও আসলে দু’দিন এখানে বিশ্রাম নিতেই এসেছিল, আর আমি ঘুরতে।

ঘরটা আগোছোলা ছিল। একটা বাঁশ দিয়ে বানানো তক্তা পাতা ছিল। গাছের শুকনো পাতায় আর শিকড়ে আবর্জিত অবস্থা। বৌদি তাড়াতাড়ি একটা খেজুরের পাতা দিয়ে পরিস্কার করতে লাগলো। আমি প্রাকৃতিক দৃশ্যের সাথে এক নারীর লাস্যময়ী ব্যবহার তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করতে লাগলাম। যদিও আমার আদর্শে আমি কামনার বশবর্তী ছিলাম না তবে বাহ্যিকভাবে তার দৃশ্যতা আমাকে মোহমুগ্ধ করে রাখতো।

আমরা তক্তায় বসে দু’জনে পাশাপাশি। বিকেল পড়ন্ত প্রায়। বৌদি খুবই মিশুকে। একটা কামনার ভাব ওর শরীরে মাখামাখি করে অবস্থান করছে, কিন্তু এতক্ষণে বুঝে ফেলেছি – তা মোটেই ক্ষতিকারক নয় – বরং বেশ উপাদেয় আমাদের একঘেয়েমি দুঃখের জীবনে। গল্প আড্ডা চলছে আমি জিঞ্জাসা করলাম- আর কতোক্ষণ, অন্ধকার যে হয়ে এলো..এবার?

বৌদি বেশ চোখ নাচিয়ে জানালো- সব ব্যবস্থা আছে। আসছে। সে আসছে।

– দাদা কবে ফিরবেন?

– কি করে বলি। মাস ছয়েকের আগে তো নয়ই।

– এত দিন পরে আসে?

– ওখানে যে সেরেস্তার ম্যানেজার। ছুটি নেই।

– ওটা কি সুরাটে?

– হ্যাঁ গো, বৌদি কথাটা শেষ করতে পারলো না, ভাঙা দরজায় ঘড়ঘড় আওয়াজ তুলে যে ঘরে ঢুকলো সে একজন বছর কুড়ির নারী। যার হাতে একটা কেটলি আর কয়েকটা ভাঁড়।

ওই তো কন্যে এসে গেছেন — বৌদি হাসলো।

‘কন্যে’ কথাটা আমার বুকে বেশ বাজলো। ভাবার অবকাশ নেই। একটি সুন্দরী নারী আটপৌরে তাঁতের শাড়িতে যতোই আঁটকে রাখুক নিজেকে, তার প্রাকৃতিক রুপ সত্যিই অনস্বীকার্য। আমি দেখছি।

বৌদি আমার পরিচয় দিয়ে আলাপ করিয়ে দিলেন। ওর নাম বললো না। শুধু ধাক্কা মেরে বললো- নাম জেনে কি লাভ? প্রয়োজনে পরে জানবে। এখন শুধু পছন্দ কিনা তাই বলো।

আমি থতমত খেয়ে গেলাম। অনুমান করার চেষ্টা করলাম। বাইরে তাকিয়ে মেলাবার প্রয়াস করলাম, সত্যি কি এখন গোধুলী লগ্ন!

– আমি সোজা কথায় তোমায় কতকগুলি কথা বলতে চাই। বলবো?

আমি মন্ত্রমুগ্ধের মত শুধু না বুঝে, ঘাড় নাড়লাম।

– মেয়টি গর্ভবতী। ওর প্রেমিক এই গ্রামেরই ছেলে। আয়ের জন্য মুম্বাই পাড়ি দিয়েছে। রুপার কাজ করে। মুম্বাইয়ে এই ব্যবসার ভাল কদর। প্রথম দু’মাস যোগাযোগ রেখেছিল। যখন শুনেছে ও গর্ভবতী তখন থেকে আর কোনো খবর নেই। যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে। একবারে গায়েব।

– সে কি? ওর বাড়িতে যোগাযোগ করো নি কেন? আমার অবাক হওয়ার পালা।

– কে বলেছে করিনি? ওর দাদা বৌদি কোনো দায়িত্ব নিতে চায়নি। ওদের কি দোষ?

– এ যে বড় বিপদ? এখন কি হবে?

– ওই জন্যই তোমাকে বলা। আমি একা মহিলা, যে সব জানি। দাদাও এখানে নেই কাউকে বলতে পারছি না। তার উপর মেয়েটির পাঁচ মাস চলছে। এমতাবস্থায় আমি একা কি করতে পারি। তোমাকে পেয়ে একজনকে পেলাম। অন্ততঃ তোমাকে জানাতে পারলাম। বৌদি বলে গেল।

– আমি কিভাবে সাহায্য করবো?

– দেখো, না যদি কেউ রাজী থাকে। অথবা নিজেও যদি রাজী হও এই বেচারী মেয়েটার জন্যে। দেখো না একটু ভেবে.. কাতর অনুরোধের গলা।

আমি হতচকিত। প্রস্তুত ছিলাম না এই পরিস্থিতির জন্যে। আনন্দ করতে এসে কি বিপদে জড়ালাম!
ভাবছি আর মেয়েটিকে মুখ তুলে দেখছি। মেয়েটি লজ্জায় অভিমানে কাঁদছে।

মেয়েটি তার কাঁপা হাতে ভাঁড়ে চা ঢেলে দিল। ভাঁড় হাতে ধরে রইলাম। চা মুখে উঠলেও গলাধঃকরণ হল না।

অন্ধকার হয়ে এলো। আনন্দ কিছু না থাকায় ওখানে আমাদের এই তিনজনের কাছেই পরিবেশ পরিস্থিতি খুব সুখকর ছিল না। ভাবার বিষয়, ভাবার অছিলায় আমি… দেখছি.. বলে বেড়িয়ে এলাম।

অনলকে কিছু বলিনি। পরের দিন ভোরেই আমরা দু’জন গ্রাম ছেড়ে শহরের উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে পড়লাম। ফেরার সময় বৌদির চাহনিতে আমার কাছ থেকে কিছু পাওয়ার আকুতি, আমার অসস্তির কারণ অতি অবশ্যই হয়েছিল, যা অন্য কেউ টের পায়নি।

এই কথা কি বাড়িতে আলোচনা করা যায়? নিজেও তেমন প্রতিষ্ঠিত হই নি, যে অন্যজনের সহায়তা করবো। মন দিয়ে মানতে পারলেও ভবিষ্যত কিন্তু অন্য কথা বলবে। সাত পাঁচ ভেবে, ঝুটঝামেলা এড়াতে বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে আড্ডায় নিজেকে ডুবিয়ে দিলাম। আপনি বাঁচলে বাপের নাম! এই যুগে কেউ যেচে অন্যর ফেলে দেওয়া ঝামেলা ঘরে তোলে- এই সব বলে, সহজ মনকে জটিল করে তুললাম।

মাস তিনেক বাদে একটা নিউ ইয়ারস গ্রীটিংস কার্ড পেলাম- অনলের হাত দিয়ে। বললে বৌদি তোকে দিতে বলেছে। আমার অস্বস্তি বেড়ে গেল। অনল জানালো বৌদি তোকে নববর্ষের শুভেচ্ছা জানিয়েছে।

নববর্ষের কার্ড খুলে অবাক! – এ কি এটার ভিতরে তো কোন শুভেচ্ছা লেখা কার্ড নেই, বদলে আছে মেয়েলী হাতে লেখা দু’টি চিঠি।

প্রথম চিঠি
—————-
সুধী,
পারলে ক্ষমা করবেন। আমি আপনাকে জড়াতে চাইনি। আমি নিরুপায় ছিলাম তাই!
এখন পথ খুঁজে নিলাম
আমি – রহস্যা।
——————————————-

দ্বিতীয় চিঠিঃ
—————–

প্রানের ভাই ,
ভাল থেকো। ভুল বুঝো না। আমিও নিরুপায় ছিলাম। ওকে ভালবেসে, বাঁচাতে চেয়েছিলাম, পারলাম না। ও এখন বহুদূরে, ওর নিজের খোঁজা ঠিকানায়। যাওয়ার আগে এই চিঠিটা ও লিখে রেখেছিল, যেটা আমি পরে ওর ঘর থেকে পাই। ওর শেষ ইচ্ছায়, আমি তোমাকে চিঠিটা পাঠালাম।

ইতি- তোমার বৌদি।

Exit mobile version