অপরাধী
-অঞ্জনা গোড়িয়া
একা। বড্ড একা লাগছে আজ। বাড়িটা পুরো ফাঁকা । সবাই চলে গেল তাঁকে দেখতে । আমি পারি নি যেতে।বড্ড অসহায় লাগছে। দম বন্ধ হয়ে আসছে। কখন ফিরবে ওরা? কি জানাবে আমাকে? মনের মধ্যে প্রশ্ন গুলো দলা পাকাচ্ছে।কি যেন এক অজানা কষ্ট আমাকে তাড়া করে বেড়াচ্ছে।কি করলাম আমি? আমি কি অপরাধী হয়ে গেলাম ।
চোখে ভেসে উঠল সেই দিনগুলির ছবি। যেদিন প্রথম দেখি “ও”কে । মানে সুব্রতকে ।একটা প্রাণচঞ্চল ছেলে। মুখে মিষ্টি হাসি। চোখে বুদ্ধিদীপ্ত চাহনি।দেখে কার না ভালো লাগে।
আমার দিদির একমাত্র দেওর। বিয়ের দিন থেকেই আমার পিছনে লেগেছে। ইয়ার্কি মস্কারা করতেই থাকে। আমাকে দেখেই ওর খুব পছন্দ হয়েছিল। সম্পর্কে আমি যে শালী । মজা করার অধিকার একটু আছে বটে। তারপর আবার দাদার বিয়ে বলে কথা। আমি কিছু মনে করিনি।
ছেলেটি যেমন সরল। তেমন স্পষ্টবাদী । কয়েক মাস আলাপ করেই তা বুঝে ছিলাম। যখন দিদির বাড়ি যেতাম।আমাকে দেখেই চিৎকার করে বলত “মনিকা ,আই লাভ ইউ। বাড়িসুদ্ধ লোকের সামনে।
ইস্ কি লজ্জা। রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে ঘর থেকে বেরিয়ে আসতাম। পাগল একটা ছেলে।এমন করে কেউ বলে? সবার সামনে।
একদিন বলেই দিলাম, খবরদার এমন করে সবার সামনে বলবে না। তাহলে আর আসব না তোমার বাড়ি।
মনে মনে অবশ্য বেশ লাগত শুনতে। আমি তখন সবে মাধ্যমিক পাস করে ক্লাস ইলেভেনে পড়ি।
সুব্রত বলতো ,আরে রাগ করছ কেন দিদিমনি? তোমাকে তো আমিই বিয়ে করব? বর হিসাবে কেমন হবো, বলতো?
তোমার সব কাজ করে দেব।তুমি দিদিমনি হবে। আর যখন তুমি স্কুল করে বাড়ি ফিরবে। তোমার জন্য শরবত করে দেব। পাখার বাতাস দেব। চুলের বেণী খুলে দেব। আমি শুধু দেখব তোমায়।
আর তুমি আমাকে ভালোবাসবে । আদর করবে। তাহলেই হবে। কি গো পারবে না?
সব টাই ছিল ওর মজা। এসব বলেই আমার গোমরা মুখ দেখে খিলখিল করে হেসে উঠতো। দিদিমনি, তুমি কি ভয় পেলে?
সত্যি মাঝে মধ্যে ওর কথায় খুব রাগ হতো। আবার সরল স্পষ্ট কথা গুলি শুনে বেশ ভালো লাগত।
সেদিন উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা। হঠাৎ দেখি পরীক্ষা হলে হাজির। একটা ডাব আর এক খুড়ি দই নিয়ে । ডাবের জল পান করলে নাকি মাথা ঠান্ডা থাকবে আর দই খেলে নাকি ভালো ফল হবে।
মানে পরীক্ষা ভালো হবে। এমনই ধারনা পাগলটার । কোন দিন “ওর” কথাকে গুরত্ব দিয়ে গ্রহনই করি নি । মনে হত ,”ও” মজা করছে। সবটাই ওর ইয়ার্কি। সম্পর্কে শালী তো ।
এসে গেল সেই দিনটা। আমি দিদির বাড়ি আছি । ও হঠাৎ পেছন থেকে চেপে ধরল চোখটা । বলল, কে বলতো,দেখি?
খুব রাগ হল আমার। বললাম,ছাড়ো আগে।খুব বাড়াবাড়ি করছ। এমন করলে সবাই কে বলে দেব। আর আসব না কোন দিন ।
সুব্রত কেমন চুপ হয়ে গেল। চোখটা ছেড়ে বললো,রাগ করো না দিদিমনি। আমার একটা কথা আছে। খুব সিরিয়াস কথা। শুনবে একটু। আমি বললাম, কি বলার তাড়াতাড়ি বলো।
ধীর স্বরে বলল,একদিন আমাকে সময় দেবে ? শুধু একটা দিন যাবে আমার সাথে কোথাও?
আমি বললাম ,যা বলার আজই বলো? কোথাও যেতে পারব না।
“ও “বলল,এখানে নয়। অন্য কোথাও অন্য একদিন। আসবে দেখা করতে। প্লিজ দিদিমনি। একদিন আসবে?
আমি কিছু না ভেবেই বলে দিলাম। “হবে না” কোথাও যাবো না। যা বলার এখানে এখুনি বলো?
ও মুচকি হেসে বলল,থাক।আর নাই বা শুনলে। এসো এবার। আর কোনো দিন বিরক্ত করতে আসব না। ভালো থেকো দিদিমনি ।
বুকের ভেতরটা কেমন ধাক্কা লাগল। কেন এমন করে বলল? আমার ফেরার পথে কেমন হাঁ করে চেয়ে ছিল। তবু সাড়া দিতে পারি নি ওর ডাকে । চলে আসি বাড়ি ।
পরের দিন সকালেই এলো সেই খবর!সেই ভয়ঙ্কর সংবাদ।
বাড়িতে খবর এলো।দিদির দেওর সুব্রত একটা বাগানের আমগাছে গামছার ফাঁসে ঝুলিয়ে দিয়েছে দেহটা । সব শেষ।
বাড়ির সবাই চমকে উঠল। দল বেঁধে চলে গেল দেখতে । আমি বাদে। এখন বাড়িতে একা। বড্ড একা।
আমি নিশ্চুপ ! পাথরের মতো দাঁড়িয়ে । হাত কাঁপছে।বুকটা ধুকপুক করছে। দাঁড়িয়ে থাকার ও ক্ষমতা নেই । আমি কি তবে অপরাধী হয়ে গেলাম। কি বলতে চেয়ে ছিল সেদিন?কেন দেখা করলাম না আমি?হ্যাঁ আমি অপরাধী!একটা সরল ছেলের মৃত্যুর জন্য আমি অপরাধী !
একটা চিরকুটে লিখে গেছে, আমার মৃত্যুর জন্য আমিই দায়ী।