নাম তার নিপীড়িতা
-পরিতোষ ভৌমিক
নামটাতেই একটা ভীষণ আকর্ষন । নিপীড়িতা নামটা কেমন করে হল ! বিশেষণ থেকে বিশেষ্য হওয়ার পেছনের যুক্তি বা বিশ্লেষণ তো একটা আছেই কিন্তু সেই ইতিহাসের দিকে এখন আর খুব বেশি কেউ ঘাটায় না । এছাড়াও ডাকনামটাই বেশি পপুলার হয়ে গেছে বলে অফিসিয়াল কাজ ছাড়া এই নাম খুব একটা বলতেও চায়না নীপা । তবুও প্রথম দিন থেকেই দীপেশকে এই নিপীড়িতা নামটাই বলেছে এবং দীপেশ এই নামেই তাকে চেনে । পশু চিকিৎসক দীপেশ বাবু অন্য পাঁচটা দিনের মতোই সেদিন কল পেয়েছিলেন ভিজিট করার জন্য , গরুর অসুস্থতার প্রাথমিক লক্ষণগুলো শোনে ফার্ষ্ট এইড বক্সটা হাতে নিয়ে আগে থেকে বলে দেওয়া লোকেশানের বাড়িটিতে প্রবেশ করেই ডাক্তার বাবুর আক্কেল গুড়ুম হয়েছিল । এত সুন্দর পরিপাটি ছিমছাম বাড়িতে কেউ গরু পোষে এ কথাটা মানতেই পারছিল না সে । অথচ নিজের কর্মপরিসরের মধ্যেই এই বাড়িটি । দুপুর বেলা , বাড়িতে মানুষজন বলতে গেটে নক্ করার সময় যে মহিলাটি গেট খুলে দিয়েছিল, একমাত্র সেই মহিলা ব্যতিত আর কাউকে দেখতে পেল না দীপেশ । লম্বা গড়নে শ্যামলা রঙের গৃহবধুটিকে দেখে ডাক্তারমশাই একবারের জন্য ভাবেনি যে এই মহি্লাই গরুর পরিচর্যা করে । এই সেই নিপীড়িতা । প্রথম দেখাতেই একটা নিস্পাপ ভাল লাগা এসেছিল দীপেশের মনে । কথা বলতে বলতে মুক্তোর মতো সাদা দাঁতের হাসি, ঝিলের জলে ঢিল পড়লে যেমন হয় ঠিক তেমনি প্রতিটি হাসিতেই একটা টোল পড়ে গালে ; কপালে সিঁদুরের বড় করে একটা ফোটা যেন পূর্ব দিগন্তে স্নিগ্ধ ভোরে সূর্য উদয় হচ্ছে , কথা বলার মাধুর্যে স্বল্পভাষী ডাক্তারবাবুর কথাও যেন আর শেষ হয় না । নিষ্পাপ ভাল লাগাটা বেশিক্ষণ থাকতে পারেনি মনে মনে । ধীরে ধীরে বুক থেকে গলা বেয়ে মুখ দিয়ে ফোঁস করে বেরিয়ে গেল ভালবাসা হয়ে । তবে প্রথম দিনেই কিন্তু নয় , বেশ কিছুদিন নিয়মিত যাতায়াত শেষে যখন দীপেশ জানতে পেরেছিল যে, নিপীড়িতা নামটা তার মায়ের ইচ্ছাতেই রেখেছিল বাড়ির সবাই, মায়ের নিপীড়নের সাক্ষী হয়ে নীপা যখন এক পৃথিবী সমান স্বপ্ন নিয়ে ধনে জনে পূর্ণ স্বামীর বাড়িতে পা রেখেছিল তখনকার দিনের কথা, দিনে দিনে গরীব হওয়ার কথা, স্বামীর দীর্ঘ্য দিনের অসুস্থতার কথা, একমাত্র মেয়েটার একটা বড় অপারেশানের আবশ্যকতার কথা ইত্যাদি সব খুব তাড়াতাড়িই জানতে পেরেছিল দীপেশ । কথা বলতে বলতে সুন্দর করে স্পন্দনে দোলা দিয়ে নিজের জীবনের গল্প করার সাবলীলতা যেন নিপীড়িতার অলঙ্কার । জীবনের যৌবন পেরিয়ে যখন প্রৌঢ় , এই মুগ্ধতা পাওয়ার কথা ছিল না , তবুও দীপেশের জীবনে একটু একটু করে মুগ্ধতা ছেয়ে গেল সকাল থেকে দুপুর, দুপুর থেকে বিকেল অতঃপর সন্ধ্যা, রাত এবং গভীর রাত পর্যন্ত । বর্তমানের এই দুঃসময়ে নীপার সংসারে দুটি গরুই যখন উপার্জনের একমাত্র সম্বল তখন সেগুলির দিকে বিশেষ নজর তো থাকবেই, সেবাযত্ন যতটা করা যায় প্রতিদান ততটুকুই পাওয়া যায় । দিনে দিনে দীপেশ এই পরিবারের সাথে একাত্ম হতে শুরু করেছে বটে, নিজের আপ্রাণ চেষ্টায় কিভাবে গরুগুলির থেকে প্রতিদান আরেকটু বেশি পাইয়ে দেওয়া যায় সেই প্রচেষ্টা থেকেই যেন নিপীড়িতার পরিবারের সঙ্গে আষ্টে পৃষ্টে জড়িয়ে গেল ডাক্তার বাবু । অথচ ডাক্তার বাবু দিনের শেষে নানান পশুপাখির সঙ্গে দিন গোজরান করে ক্লান্ত শরীরটাকে নিয়ে যখন ঘরে ফেরেন, নিয়ম করে প্রতিদিন প্রথম দশ মিনিট সাত বছরের ফুটফুটে পরীর মতো নিজের মেয়েটির সঙ্গে কথা বলে, আদর করে, একটু হাসি খুশীর খেলা খেলে, স্কুলের খবর নেয় তার পরে ডানাকাটা ফুল পরীর মতো দশ বছর আগে শহর থেকে ধরে আনা স্ত্রীর সাথে সময় দিয়ে সবশেষে মায়ের ঘরে গিয়ে রাতের ঔষধ খাইয়ে তবেই নিজে শোবে । ইদানিং রুটিন এ কিছু খামতি পড়ছে, সপ্তাহের দু একদিন একটু রাত হয়ে যায় ঘরে ফিরতে, ততক্ষণে মেয়েটা ঘুমিয়ে পড়ে , চোখের অচেনা ভাষা দেখে স্ত্রী দূরে সরে যায়, কোন দিন মায়ের ঘরে যায় আবার কোন দিন তার আগেই শুয়ে পড়ে ।
নিপীড়িতার স্বামী মানুষটাও বেশ প্রাণ চঞ্চল, একটা লম্বা হাসি মুখে লেগেই থাকে, পুরুষের মতোই দেহের গড়ন , শ্রম দিতেও খামতি নেই তার কিন্তু তবুও একটা বিরাট হতাসা ভাব চেহারায় । গল্পের ছলেই নিপীড়িতা বলেছিল, “মরদ আছে মরদাঙ্গী নাই” । চমকে উঠেছিল দীপেশ, চোখের ভাষা আর মুখের ভাষার মধ্যে কোনই পার্থক্য ছিলনা তার, “ আমি নারী, ডাক্তার বাবু আমার চিকিৎসা আছেনি !” নিপীড়িতার এই কথাগুলোর মধ্যে কত রকমের ইঙ্গিত ছিল সেটা পরতে পরতে টের পেয়েছিল দীপেশ, টের পেয়েছিল বলেই আজকের দিনে দীপেশ এই রোগীর বাড়িতে যখন তখন নানান বাহানায় কখনো সখনো আড্ডার দৌলতে আসা যাওয়া করে । নিপীড়িতার স্বামীর সঙ্গে এখন তার বেশ বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছে ।স্বামীটা কিন্তু মোটেই হাবাগোবা না, দীপেশ আর নিপীড়িতার সম্পর্কের কথা বুজতে পারেনি এমনটা হতেই পারেনা ।তবে এই বিষয়ের উদাসীনতাই দীপেশকে আরো অনেক বেশী ভাবিয়েছে বা সম্পর্ক আরো ঘনিষ্ট করেছে এটাও বলা যায় । নিপীড়িতার মেয়েটাও আজকাল বেশি বেশি ‘আঙ্কেল আঙ্কেল’ করে, কখনো সখনো বাবার মতো বায়না করে বসে ‘আঙ্কেল আজকে কিন্তু সিঙ্গারা আনবে না, চিকেন চপ খাবো’ । সে সময়ে ডাক্তারবাবুর নিজের মেয়েটার কথা খুব বেশি মনে পড়ে, ফুটফুটে মেয়েটার প্রতি অবিচার হচ্ছে বলেও মন খারাপ করে, মনে মনে ঠিক করে আজকে থেকে আর হবে না, সন্ধ্যায় বাড়িতে গিয়েই আগে মেয়েটাকে বেশি বেশি করে আদর করবে । কিন্তু বিকেল নামতেই যখন নিপীড়িতার স্বামী ফোনে জানিয়ে দেয় “ বস, আজকে কিন্তু আপনের পছন্দের ব্র্যান্ড আনছি, নীপা কইছিল আপনে বাড়িতে শুয়োরের মাংস খাইতে পারেন না, এর লাইগাই আজগা ভর্তাও বানাইছি”।
দীপেশ নিজেকে ধরে রাখতে পারে নি, পারে না নিজের কথামতো সন্ধ্যে বেলায় বাড়িতে ফিরতে । নিপীড়িতার মেয়েটা পড়ার টেবিলে মন লাগিয়ে বসে যায়। তারপরেই রান্নাঘরে ‘আমি, তুমি ও সে’ এর মত করে তিন জনে একসাথে প্রাণ ভরে গল্প করা, খাওয়া দাওয়া। এক সময় নিপীড়িতার স্বামীটা নেশায় বুঁদ হয়ে নিস্তেজ সূর্যের পশ্চিম দিগন্তে ডুবে যাওয়ার মতো এলিয়ে পড়া, তারপরে নিপীড়িতার মুখে একপ্রস্থ সুখের কথা, কষ্টের কথা, ছেলেবেলার কথা শোনাতে শোনাতে আসুস্থতার কারণে বর্তমানে নপুংসক স্বামীটার প্রতি একরাশ ক্ষোভ উগরে দিয়ে নিজের দেহের জ্বালা জুড়াতে, পাল্টে যাওয়া জীবনের প্রতি যেন প্রতিহিংসার আগুন জ্বালিয়ে দেয় সে, নিংড়ে নিতে চায় দীপেশের সমস্ত পুরুষত্ব। চলছিল বেশ । ছক বাঁধা জীবনের ছন্দ যখন পাল্টে যায়, সহজ সরল সুন্দর সংসার আস্তে আস্তে মলিন হতে থাকে । দীপেশের মায়ের অসুখ এখন চরম, শেষ দিনের প্রতিক্ষার পালা । পুত্রের অমনযোগ এই অসুখ বাড়ার মূল কারণ বলাই বাহুল্য । এই সময়ে এসে দীপেশের মনে উপলব্দি হয়, মা হল তার শেষ কথা, বাবা যখন মারা গেলেন তখনো পড়াশোনার কোর্স শেষ হয় নি তার, ভাই বোন বলতে আর কেউ নেই, একমাত্র কাকা বিলাসী উন্নত জীবনের সোপান ধরে সুদূর লন্ডনে। এমন সময়ে মা একা ঘর সামলেছেন, উৎসাহিত করেছেন, দায়িত্ব নিয়ে খরচ পাতি সব জোগাড় করে ছেলেকে পশু চিকিৎসক বানিয়েছেন বটে । সুতরাং মা’কে এত সহযে হারানো যায় না । খুব তড়িঘড়ি সিদ্ধান্তে কাকার সঙ্গে যোগাযোগ করে স্ত্রী কন্যাকে সঙ্গে নিয়ে লন্ডনের উদ্দেশ্যে পাড়ি দিলেন । নিপীড়িতার কথা মনে হয়, খুব খুব বেশি করে কিন্তু মায়ের এই অসুখের সময়ে নিপীড়িতা আটকে রাখতে পারেনি তাকে । এন্ড্রয়েড মোবাইল নেই বলে নিপীড়িতার সঙ্গে কথা হয় না, কথা বলা সম্ভব হয়ে ঊঠে না তার । একদিন দুপুর বেলা একটা অচেনা নাম্বার থেকে ভিডিও কল এসেছিল, নিপীড়িতার মুখটা ভেসে উঠেছিল কয়েক সেকেন্ডের জন্য বটে কিন্তু হাসপাতালে ব্যস্ত থাকায় কথা বলা হয়ে উঠেনি । মাস দেড়েকের চিকিৎসা ভ্রমণ সেরে সুস্থ মা’কে নিয়ে যখন দেশে ফিরলো দীপেশ তখন আকাশে চাঁদ সূর্য সবই ছিল আগের মতো ছিল না শুধু তার বিগত মাস ছয়েকের জীবন বৃত্তের সঠিক ছন্দ । খবরটা রাতেই পেয়েছিল সে, দিন দশেক আগে স্বামী স্ত্রী এর ঝগড়ার পরিনামে নিপীড়িতা নিজের গায়ে আগুন দিয়েছে, বাঁচার কোনো আশা নেই মৃত্যুর প্রতীক্ষায় প্রহর গুনছে সে হাসপাতালের বিশেষ শয্যায় । দীপেশ মনে মনে ঠিক করেছে আগামীকাল সকালেই হাসপাতালে যাবে সে । এখন বিছানায় শুয়ে শুয়ে ভাবছে, নিপীড়িতা চিনতে পারবে তো, কথা বলবে কি ? যদি বলে, তবে কি বলবে সে !