নাইটমেয়ার
– বিশ্বদীপ মুখার্জী
‘মনে পড়ে সেই দিনগুলোর কথা?’ সায়ন্তিকা’র দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলো অর্ণব।
সায়ন্তিকা তাকিয়ে আছে শূন্যের দিকে। অর্ণবের কথায় যেন তন্দ্রাভঙ্গ হলো তার।
খানিক ভাবলেশহীন ভাবে অর্ণবের দিকে তাকিয়ে সে বললো- ‘না অর্ণব। ভুলে গেছি। নাইটমেয়ার মানে বোঝো?’
‘সে দিনগুলো এখন তোমার কাছে নাইটমেয়ার হয়ে গেছে? বাহ্, বেশ ভালো লাগলো শুনে।’
অর্ণবের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো সায়ন্তিকা।
‘সে দিনগুলোর কথা না বলাই ভালো অর্ণব। কিছু স্মৃতি এমন থাকে যেগুলো না মনে করাই বাঞ্ছনীয়।’
দুজনে কথা বলতে বলতে এগিয়ে যাচ্ছে। বেশ কিছুক্ষণ নীরবতার পর সায়ন্তিকা বললো – ‘সত্যি বলতে ভাবতে পারিনি যে এত দিনপর তোমার সাথে আবার দেখা হবে।’
‘হুম। চার বছর, দু’ মাস। ঠিক চার বছর, দু’ মাস আগে তোমার সাথে আমার শেষ কথা হয়েছিল, হোয়াটসঅ্যাপে। তারপর তুমি আমায় ব্লক করে দিয়েছিলে। এখনও লাস্ট কনভারসেশনের রেকর্ডটা রয়েই গেছে মোবাইলে।’
অর্ণবের কথায় আবারও হাসলো সায়ন্তিকা। বলল – ‘তাই নাকি? তুমি কি গত চার বছর ধরে একই মোবাইল ইউজ করছো নাকি?’
‘হ্যাঁ সায়ন্তিকা। কিছু কিছু জিনিসকে চট করে ফেলে দেওয়া যায় না। যেমন মানুষের সাথে স্মৃতি জুড়ে থাকে, তেমনই স্মৃতি জুড়ে থাকে জিনিসের সাথেও। প্রচুর লোকের সাথে প্রথম আলাপ হয়েছিল এই মোবাইলের মাধ্যমেই। কিছু লোকের সাথে যোগাযোগ এখনও আছে, আর কিছু লোকেরা ছেড়ে চলে গেছে।’
বিষাদের স্পষ্ট রেখা অর্ণবের মুখে ফুটে উঠলো। সায়ন্তিকার মুখটাও গম্ভীর হলো।
‘তোমাকে ব্লক করতে চাইনি অর্ণব। কিন্তু বাধ্য হয়েছিলাম ব্লক করতে। কিচ্ছু করার ছিল না আমার। নিজের অবহেলা আর সহ্য হচ্ছিলো না আমার দ্বারা।’ বললো সায়ন্তিকা।
‘কে তোমায় অবহেলা করছিল সায়ন্তিকা? আমি? কিছু ভুল ধারণাকে মনে পুষে রেখে একটা ভালো সম্পর্ককে নিমেষে শেষ করে দিলে তুমি। কে তোমাকে অধিকার দিয়েছিল? আমি তোমায় কথা দিয়েছিলাম যে নিজের শেষ নিঃশ্বাস অবধি তোমার সঙ্গ ছাড়বো না। আমাকে আমার কথাটাও রাখতে দিলে না। আমাকে আমার সামনেই মিথ্যুক প্রমাণিত করে দিলে তুমি।’ কথাগুলো বলতে গিয়ে অল্প উত্তেজিত হয়ে পড়েছিল অর্ণব।
সায়ন্তিকা একটুও উত্তেজিত হয়নি। ঠাণ্ডা মাথায় সে বললো- ‘অর্ণব, তোমার মধ্যে অনেক গুণ আছে। তুমি ভালো ছেলে, কেয়ারিং, মিশুকে.. আরও অনেক গুণ। কিন্তু একটা দোষও আছে তোমার মধ্যে। তুমি মানুষের মন বুঝতে পারো না। কারোর ফিলিংস বোঝার ক্ষমতা তোমার মধ্যে নেই অর্ণব।’
অর্ণব ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো সায়ন্তিকার দিকে। একটা জায়গায় তারা থেমেছে এখন। এখান থেকে সামনের দৃশ্যটা অপূর্ব। নিচে প্রায় অনেকটা খাই, ওপারে দাঁড়িয়ে আছে বিশাল পর্বতমালা।
‘পাহাড় আমার চিরকালই বড্ড প্রিয়।’ বললো সায়ন্তিকা।
‘জানি। খুব ভালো করেই জানি।’
‘দার্জিলিং বহুবার গেছি। হারিয়ে যেতে ইচ্ছে করে পাহাড়ের মধ্যে।’
সায়ন্তিকার কথাগুলো অর্ণবের কাছে নতুন কিছু না। সে বহুবার সায়ন্তিকার মুখে এমন কথা শুনেছে। ঠাণ্ডা হওয়া বইছে। গায়ের চাদরটা আরও ভালো করে জড়িয়ে নিলো সায়ন্তিকা।
‘কান ঢেকে নাও সায়ন্তিকা। তোমার তো অল্পতেই ঠাণ্ডা লাগে।’ বললো অর্ণব।
‘তোমার মনে আছে বুঝি?’ অর্ণবের দিকে তাকিয়ে সায়ন্তিকা প্রশ্ন করলো।
‘মনে আছে। কারণ পুরনো স্মৃতি আমার কাছে নাইটমেয়ার নয়।’
‘হ্যাঁ অর্ণব। আমার কাছে সেই স্মৃতিগুলো নাইটমেয়ার। ভালোবেসে কারোর হাত ধরার পর সেই হাত ছেড়ে চলে যাওয়ার কষ্ট তুমি বুঝবে না অর্ণব। কারণ সেই কষ্ট তুমি পাওনি। সেই কষ্ট পেয়েছি আমি। আমি ছিলাম মন্থকুপে ফেঁসে। সেখান থেকে উদ্ধার করে এনেছিলে তুমি আমায়। কিছু একটা আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চেয়েছিলাম আমি। তুমি নিজের দু’হাত বাড়িয়ে দিলে আমার দিকে। সেই দু’হাত ধরেই আমি আবার থেকে বাঁচতে শিখলাম। আঁকড়ে ধরতে চাইলাম তোমাকে। কী ভুল করেছিলাম আমি। দীর্ঘদিনের সাংসারিক জীবনে যা কিছু হারিয়েছিলাম, সেগুলো তুমি আমায় ফেরত দিলে। হারিয়ে গিয়েছিল আমার লেখা, হারিয়ে গিয়েছিল আমার কল্পনা শক্তি। সেগুলো তুমি ফেরত দিলে আমায়। তোমার হাত ধরেই পুনরায় আমার লেখা শুরু হলো। আমি এক নতুন জীবন, নতুন জগৎ পেলাম। দীর্ঘদিন ধরে ডিপ্রেশনে ভুগছিলাম আমি। তুমি সুস্থ করলে আমায়। এত কিছু করলে আমার জন্য, তবুও আমার ফিলিংসটা বুঝতে পারলে না? এটা বুঝতে পারলে না যে আমি তোমার কাঁধে মাথা রেখে শান্তি পাই? তোমার ওই কাঁধটা আমার বড় প্রিয় ছিল অর্ণব। আর তুমি নাকি সেই কাঁধটা অন্য কাউকে দিয়ে দিলে?’
সায়ন্তিকার কথাগুলো একাগ্রচিত্তে শুনছিলো অর্ণব। সায়ন্তিকার কথা শেষ হওয়ার পর সে বললো – ‘মানুষের মনে প্রত্যেকের আলাদা আলাদা স্থান হয় সায়ন্তিকা। সে তোমার স্থান কোনও দিন নিতে পারবে না, আর তুমি ওর স্থান কোনও দিন নিতে পারবে না। হ্যাঁ, এটা ঠিক যে একটা সময় ছিল যখন তোমার জীবন জুড়ে শুধু আমি ছিলাম। তুমি আমার অজান্তেই আমাকে ভালোবেসে ফেলেছিলে। তখনও কি তুমি নিজের জীবনে আমায় সেই স্থানটা দিতে পেরেছিলে, যে স্থানটা ঘিরে তোমার স্বামী আছে?’
ঘাড় নিচে করলো সায়ন্তিকা। জবাব নেই তার কাছে।
‘সায়ন্তিকা, আমি চিরকাল তো তোমার পাশে থাকতে চেয়েছিলাম। কিন্তু তুমি আমায় চিরকালের মত নিজের চোখেই অপরাধী বানিয়ে দিলে। এখন কী মনে হয় জানো? হয়তো আমি তোমার সাথে বিরাট বড় কোনও অন্যায় করে ফেলেছি। হয়তো উচিত ছিলো না তোমার পাশে দাঁড়ানো। আমার এটা বোঝা উচিত ছিলো যে অথৈ জলে ডুবতে থাকা মানুষ যেটা হাতের নাগালে পায় সেটাকেই আঁকড়ে ধরে রাখতে চায় সে। সায়ন্তিকা, আমিও হাড় মাংসের একটা প্রাণী। অন্যদের মত আমারও কিছু ইচ্ছে হয়, কিছু আহ্লাদ হয়। নিজের একটা পরিবার হোক, সংসার হোক সেটা কে না চায় সায়ন্তিকা? আমিও চেয়েছিলাম। পল্লবীকে দেখে মনে হয়েছিল যে এর সাথে আমি নিজের সারাটা জীবন কাটিয়ে দিতে পারি। আমরা যখন রিলেশনে এলাম, তখন সেই খবরটা খুশি মনে তোমাকে দিতে গেলাম ফোন করে। তুমি তখন আমার মুখের উপর ফোন কেটে দিলে। তোমাকে আমি নিজের ভাবতাম সায়ন্তিকা। ভেবেছিলাম তোমার থেকে সাংসারিক জীবনের অনেক টিপস নেবো। কিন্তু সেটা আর হয়ে উঠলো না। আস্তে আস্তে তুমি দূরে চলে গেলে আমার থেকে। পুরনো ঘটনাগুলো সব স্মৃতি হয়ে জমা রয়ে গেল মনের এক কোণায়। না সায়ন্তিকা, আমার জন্য পুরনো স্মৃতি কোনও নাইটমেয়ার নয়। সেগুলো সযত্নে রাখা আছে আমার কাছে। চিরকাল সেগুলো আমার কাছেই থাকবে, আমার আপন হয়ে।’
সায়ন্তিকা গভীর দৃষ্টিতে তাকালো অর্ণবের দিকে।
‘আমি আবার ডিপ্রেশনে চলে গিয়েছিলাম অর্ণব। অনেক কষ্টে আবার আমাকে সুস্থ করা হয়েছে। আমার লেখা বহুকাল আগেই মরে গিয়েছিল। তুমি সেটাকে পুনর্জীবিত করেছিলে। তোমাকে হারানোর পর ভাবতে পারিনি যে আবার কোনও দিন লিখতে পারবো।’ সায়ন্তিকা বলল।
‘কিন্তু এখন লিখেছ তুমি। আমি আজও পড়ি তোমার লেখা। পড়াই পল্লবীকে। আজ পর্যন্ত তোমার যটা বই বেড়িয়েছে, সবগুলো আমি পড়েছি। এমন করেই লিখে যাও সায়ন্তিকা।’
‘প্রতি বছর কোনও না কোনও পাহাড়ে ঘুরতে আসি আমি। এবার এখানে আসার আগে ভাবতেও পারিনি যে তোমার সাথে দেখা হবে।’
সায়ন্তিকার দিকে তাকিয়ে অর্ণব বললো- ‘যে কারণেই হোক আবার আমাদের দেখা হলো। এটাই হওয়ার ছিলো সায়ন্তিকা। সায়ন্তিকা, আমায় ভুল বুঝো না। আমি আগেও বলেছি, এখনও বলছি.. I am always with u. আর এটাই সত্যি।’
কথা বলতে বলতে তারা হোটেলে ফিরে এলো। সায়ন্তিকা দেখলো, হোটেলের পার্কে এক মহিলা কোলে বাচ্চা নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। মহিলাটির নজর গেল অর্ণবের দিকে। অর্ণবের দিকে এগিয়ে এসে সে বললো- ‘কিছুতেই ঘুমোচ্ছে না। জ্বালিয়ে মারে ছেলেটা।’
হঠাৎ তার নজর গেল সায়ন্তিকার দিকে।
‘পল্লবী, একে চিনতে পারছো? ছবি দেখেছ অনেকবার।’ বললো অর্ণব।
পল্লবী অবাক হয়ে বলল – ‘সায়ন্তিকাদি না?’
সায়ন্তিকা ছোট্ট বাচ্চাটাকে পল্লবীর কোল থেকে নিজের কোলে নিয়ে বললঝ- ‘একে আমাকে দাও। আমিও ঘুম পাড়িয়ে দেবো জুনিযার অর্ণবকে।’