নাড়ির টান
-রাণা চ্যাটার্জী
“আমি কি ক্ষ্যাপা কালা যে ঘেরাটোপে রাখবি”- বলেই মুড়ির বাটিটা রেগে সরালেন মলিনা দেবী।
স্বামীর মৃত্যুর পর, বড্ড চোখে রাখা শুরু করেছে ছেলে বউ। যতবার, মেয়ের বাড়ি গেছে, ওদের সন্দেহবাতিক মন, এই বুঝি মা,মেয়ে-নাতনিকে টাকা, গয়না বিলিয়ে দেবে!” শুধুই আশঙ্কার কালো মেঘ মনে।
স্বামী প্রচুর গয়না বানিয়ে দিয়েছিলেন। বাড়ি, সম্পত্তি, ব্যাঙ্ক ব্যালেন্স সব ওনারই নামে।ইদানিং ‘মা অসুস্থ’,’মাথা খারাপ’,এসব রটনা ছড়ানো হয়েছে নিজেদের স্বার্থে।
বাবার তৈরি কারখানার মালিকও মা তাই, ভবিষ্যতের কথা ভেবে ছেলে টুবাই চঞ্চল হয়।”কি ব্যাপার মা, টিফিন করো নি, তুমি কাঁদছো”! সম্বিৎ ফিরলেও ফ্যাল ফ্যাল করে ক্যালেন্ডারের দিকে তাকিয়ে, চোখের জল মুছে জানালেন, “আজ মঙ্গলচণ্ডীর পূজা, গত বছরও তোর বাবা নিয়ে গেছিল,পুজো না দিয়ে খাই কি করে!” ওহ, এই ব্যাপার, দাঁড়াও রিকশা ডাকছি বলে, মোড়ের হারু রিকশাওয়ালাকে দায়িত্ব বুঝিয়ে দেয় মন্দিরে যাবার।
“আরে ও মাসিমা, এখানে নামছেন কেন, আপনার বাড়ি দূর আছে” বলে হারু যতই বলুক না কেন নাছোড়বান্দা উনি। “একটু আসছি দাঁড়া” বলে নেমে হাঁটতে লাগলেন। টুবাই বলে দিয়েছিল,”মায়ের মাথা খারাপ, হারু যেন কোন কিছুতে তর্ক না করে।” অগত্যা হারু চুপ করে রাস্তায় অপেক্ষা করে এই বুঝি মাসিমা ফিরবেন।
দরমা ঠেলে এক জীর্ণ রং চটা বাড়িতে মলিনা দেবী ঢুকে হাঁকতেই, জন শূন্য উঠোন পেরিয়ে এক মধ্যবয়সী মহিলা এসে পা ছুঁয়ে প্রণাম করলো। কত আপন জন যেন উভয়ে জড়িয়ে ধরল পরস্পরকে। মুহূর্তে এক অদ্ভুত আন্তরিকতায় দু’টি হৃদয় স্তব্ধ হলো।
পূজার পুষ্প পরম স্নেহে কানীন সন্তানের মাথায় ছুঁইয়ে, প্রসাদ খাওয়ালেন মলিনা দেবী, পুরুষতন্ত্রের লাল চোখ এড়িয়ে। আবার ধীর পদক্ষেপে বেরিয়ে এলেন। প্রায় পঞ্চাশ বছর আগে, বড়লোক প্রতিষ্ঠিত প্রেমিকের মিথ্যা ভালোবাসার প্রলোভনের ফসল এই কন্যা। প্রথম সন্তানের প্রতি মায়ের এই নাড়ির টান আজও যে অমলিন তা মঙ্গলচণ্ডীর পূজার পুষ্পের ছোঁয়ায় পুনরায় প্রাণ সঞ্চারিত হলো। মায়ের অপার স্নেহ বরাবর সন্তানদের জন্যই বরাদ্দ থাকে, সমাজ সংসারের নানা বাধা প্রতিবন্ধকতা যতই প্রাচীর তৈরি করে, মা তো মা’ই হয়।