গল্প- সোনালীর ফেসবুক

সোনালীর ফেসবুক
– অঞ্জনা গোড়িয়া

 

 

মেয়েটা ভালো থাকলেই “ওর” রাগ বাড়ে। মেয়েটা হাসলেই “ওর” ভয় করে। সব সময় আগলে আগলে রাখে। কেন এত রাগ আসে? কিসে এত ভয় পায়? কেনই বা আগলে রাখে? বুঝি না?
“ও” তো জানে, যতই শাসন করুক। যতই বকুক মেয়েটাকে। এ সংসার ছেড়ে কোথাও যাবে না।
তবু মেয়েটাকে এতটুকু ভালো থাকতে দেবে না। ভালো রাখতেও চায় না। সকাল পার হয়ে সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত হয়। মেয়েটা এখনো চোখের দু’পাতা এক করে নি। বিছানায় শুয়ে ছটফট করে।
নিজের কথা ভাবার সময় নেই। বরের কাছে  আদর খেতেও আর ইচ্ছে করে না।
মাথার মধ্যে ঘুরছে সকাল হলে কি কি করতে হবে? কোন কাজটা আগে কোনটা পরে করতে হবে? সাজিয়ে নিতে হবে আগামী কালের দিন পঞ্জিকা। সূর্য ওঠার আগেই জেগে উঠতে হবে। বাসি কাপড় ছেড়ে সূর্য প্রণাম করতে হবে। তুলসিতলায় গোবর নিকিয়ে শুদ্ধ করে শঙ্খ বাজাতে হবে। সব বাড়ি অবশ্য এসব আর করে না। মেয়েটা কিন্তু এক দিনও ভোলে নি। মায়ের আদেশ। সংসারের কল্যাণ করতে নিয়ম নিষ্ঠা মেনে চলতে হবে।
সকাল সকাল স্নান সেরে তুলসিতলায় ভিজে কাপড়ে জল ঢালতে হবে। নিত্য শিবপূজা করতে হবে। আরও কত আয়োজন । তারপর টিফিন চা জামাকাপড় পরিষ্কার করা রান্না তো আছেই। এ সংসারের সুখ শান্তি আর মঙ্গল কামনায় মেয়েটা অক্ষরে অক্ষরে পালন করে। রাতটুকু একটু জিরিয়ে নিয়ে আবার শুরু পরের দিনের রুটিন মাফিক কাজ। বিয়ের পর একটা মাস একটু রেস্ট পেয়েছিল মেয়েটা। তারপরই শ্বাশুড়ি মা তুলে দিল সংসারের চাবি। বয়স তখন কত আর হবে। সতেরো ছুঁই ছুঁই। উচ্চমাধ্যমিক পাশের রেজাল্টও বের হয় নি। বিয়ে দিয়ে দিল বাবা। নাকি সুপাত্র পেয়েছে। এমন জামাই হাত ছাড়া করা যাবে না।সোনার টুকরো ছেলে।
মেয়েটা খুব কেঁদেছিল। বলেছিল বাবাকে। আমি পড়ব বাবা। অনেক পড়ব। এখন বিয়ে নয়।
কে কার কথা শোনে?
পাড়া গাঁয়ের সুন্দরী মেয়ে। কোথায় কি ঘটে যায়? কিংবা ঘটনা ঘটে যাবে। বদনাম দিতে কতক্ষণ? তার চেয়ে একটু নিশ্চিন্ত হওয়া গেল। বাবা -মা কন্যাদায় মুক্ত। মেয়ের একটা পাহারাদার পাওয়া গেল। মানে মেয়ের বডিগার্ড। নিদেন পক্ষে মাথায় সিঁদুর পরা মেয়েদের নাকি বিপদটা একটু কম।
মেয়েটা সতেরো বছরেরই বউ হয়ে গেল। আঠেরো বছরে ‘মা” হলো। উনিশ বছরে সংসারের গিন্নী হয়ে গেল। বরের প্রবল আপত্তি গর্ভ- নিরোধক বড়ি খাওয়া যাবে না। যা হয় একটা হয়ে যাক। তারপর না হয় ব্যবস্থা নেওয়া যাবে। প্রথম সন্তান হবে বংশে স্বাস্থ্যবান সুন্দর। মায়ের আদেশ। কোনো ওষুধ খাওয়া যাবে না।
আসলে বরেরও ভীষণ ভয়। সুন্দরী বউ। যদি আবার কিছু করে বসে। কে সব সময় পাহারা দেবে? সোশ্যাল মিডিয়ার যুগ। সেই কবে থেকে বায়না করছিল একটা স্মার্ট ফোনের। পুরানো ফোনটা হারিয়ে যাওয়ার পর হারিয়ে গেছে সব অতীত। সব বন্ধুবান্ধব। মনটা খুব খারাপ হয়েছিল। ভেবেছিল নতুন একটা ফোন কিনে ফেসবুকের মাধ্যমে আবার সব খুঁজে নেবে। কিন্তু নানা অজুহাতে বর কিছুতেই দিল না কিনে নতুন ফোন।
মেয়েটা বলতে বলতে ক্লান্ত হয়ে বলাটাই বন্ধ করে দিল। এখন মন দিয়ে সংসার করছে। কোনো অভিযোগ নেই।
ফোন নেই। বন্ধু নেই। সবাই নিশ্চিন্ত। ছেলে পুলে হওয়া মায়ের বিপদটা একটু কম। মেয়ের বাবা, মেয়ের মা, মেয়ের বর। সবাই নিশ্চিন্ত।
শুধু মেয়েটা কেমন বোবা হয়ে গেল। স্বপ্ন ছিল কলেজে পড়বে। তারপর ইউনিভার্সিটি। আরও কত কি ভেবে ছিল। আর আসে না সে সব ভাবনা। চোখের ঘুম গিয়েছে হারিয়ে। স্বপ্ন গিয়েছে পালিয়ে।
নিজের কথা ভাবার আর সময় নেই। শুধু সংসার স্বামী আর সন্তান। সারাদিন কাজের মধ্যেই নাকি সে ভালো থাকে। খুঁজে পায় তার আনন্দ। ছকে বাঁধা একটা জীবন। এই নিয়েই বেশ ছিল।
সেদিন এক হাতে শাড়ি কাপড়ের ব্যাগ অন্য হাতে অন্য একটা ব্যাগে বাজার করে টানতে টানতে গাড়িতে উঠল।প্রচন্ড ভীড় বাস। পাশেই বসেছিল চেনা একজন। পল্লবী স্কুলের লাস্ট বেঞ্চের মেয়েটা। কোনো রকম ভাবে পাশ করে ছিল উচ্চমাধ্যমিক। তারপর আর দেখা হয় নি। কারোর সাথেই দেখা হয় নি। কি করে হবে? তারপরই তো বিয়ে হয়ে গেল।
নাম পল্লবী। মেয়েটাকে দেখেই চিনে ছিল। তবু না চেনার ভান করে অন্য দিকে মুখ ঘুরতে যাবে,পল্লবী চেঁচিয়ে ওঠে, আরে সোনালী, কেমন আছিস? কত দিন পরে দেখা।
গল্পের নায়িকার নাম সোনালী। এই মেয়েটা উত্তর দিল, ভালো আছি। তুই চিনতে পেরেছিস আমাকে? এই যথেষ্ট।
-কি যে বলিস! চিনবো না কেন? কি হাল করেছিস এই কদিনে? আর এত এত বাজার সব তোকেই করতে হয়? তুই কত সুন্দরী ছিলিস। ক্লাসের সেরা সুন্দরী। আর এখন? এত রোগা হয়ে গেছিস?
সোনালী যার সোনার বরণ রূপ। মিতভাষী সোনালী মুচকি হেসে বলল, থাক না আমার কথা। তুই কি করছিস রে? আগের চেয়ে বেশ লাগছে তোকে। এখনো বিয়ে করিস নি বুঝি?
দূর বাবা! এখুনি বিয়ে করব কি? জানিস তো আমি পড়াশোনায় গাড্ডুস, যা হোক করে বি এ টা পাশ করেই আমি বিউটিপার্লারের ট্রেনিং নিয়ে ছিলাম। একটা নতুন পার্লার খুলেছি। দারুণ মজায় আছি। নিজে সাজছি। অন্যকে সাজাচ্ছি। বেশ লাগছে। বিয়ের কনে থেকে আরম্ভ করে পুজার সাজ অনুষ্ঠানের সাজ সব পারি। সাজাতে দারুণ লাগছে। তুই একদিন আসিস। এই নে আমার ঠিকানা। যা হাল করেছিস চেহারার। একবার আয়। তোকে চিনতেই পারবে না কেউ।
-দূর! কি হবে আর রূপ চর্চা করে? এই বেশ আছি। সময় করে আসিস, সব দেখতে পাবি।
-এই সোনালি জানিস তো, আমাদের একটা ফেসবুক গ্রুপ আছে। সব পুরানো বন্ধুরাই আছে সেখানে। তোর নামটাই খুঁজে পাই নি রে? তোর ফেসবুক একাউন্টটা কি নামে রে? বল না? এড করে দেব তাহলে?
সোনালী মুচকি হেসে বলল, থাক না এসব। আমি না হয় তোদের হারিয়ে যাওয়া বন্ধুই থেকে গেলাম। কত ফুলই তো ফোটে, সবাই কি আর দেবতার পায়ে স্থান পায়? আবার কত কুঁড়ি ফুটে ওঠার আগেই ঝরে যায় মাটিতে। আমি না হয় তেমন একজন ঝরে যাওয়া কুঁড়ি। কোনো কাজে লাগব না।
পল্লবী বললো, কি যে হেঁয়ালি করিস। অন্তত হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরটা দে? ওখানেও একটা গ্রুপ আছে আমাদের। দারুণ মজা হয়। সবাই যখন গ্রুপে চ্যাটিং করি। তোরও খুব ভালো লাগবে।
এসে গেল সোনালীর বাস স্টপেজ। এই নামতে হবে রে। আসি। আবার কোনো দিন দেখা হলে কথা হবে।
আরে নম্বরটা দে?
হাসতে হাসতে বললো, আমার স্মার্ট ফোনটা হারিয়ে গেছে। তোদের স্কুলের বন্ধু সোনালীর মতো। সংসারী মেয়েদের আবার হোয়াটসঅ্যাপ, ফেসবুক? দু’হাতে বাজার ভর্তি দু’টো ব্যাগ নিয়ে নেমে গেল। ফিরে গেল সোনালী তার সংসারে।

Loading

One thought on “গল্প- সোনালীর ফেসবুক

Leave A Comment