ক্লেপটোম্যানিয়া
– লোপামুদ্রা ব্যানার্জী
‘সুমী দেখি দেখি, তোর হাতটা দেখি। ঘড়িটা বড়ো চেনা লাগছে।’ বড় জেঠিমার কথাগুলো শোনা মাত্রই সুমীর মুখটা কেমন শুকিয়ে গেল। জেঠিমাকে এড়িয়ে যেতে পারছে না আবার কোনো কিছু উত্তর করবে তার সাধ্যিও নেই। বড়’জার উচ্চস্বরে উচ্চারিত বাক্যগুলি সুমীর মার কানেও গিয়েছে। রান্না ঘরের দরজাটা ভেজিয়ে আঁচলে হাত মুছতে মুছতে ছুটে বেরিয়ে এসে সুমীকে আড়াল করে দাঁড়ায় অনিমা।
– কোন ঘড়ির কথা বলছো দিদি? সেবার আমার মামাতো বোন ডলি তো সুমীকে গিফট করেছিল। আমি আলমারিতে তুলে রেখেছিলাম। দামী জিনিস। ছোট মেয়ে কোথায় হারিয়ে ফেলবে তাই এতদিন পড়তে দিই নি।
– দ্যাখ ছোট, শাক দিয়ে আর মাছ ঢাকতে আসিস না। ঘড়িটা যে সুমীর নয় তা তুই ভালো ভাবে জানিস। এবার পূজোর সময় বড় বৌমার এই রকম একটা ঘড়ি চুরি হয়ে যায়। সেটা নিঃশ্চয় তুই জানিস। বাপু, ঠাকুরপোর তো মোটা মাইনের চাকরি। মেয়েকে তো একটা দামী ঘড়ি কিনে দিতে পারিস। শুধু শুধু তো ছোট ছেলের হাত টানের স্বভাব হয় না। এখনও সময় আছে। সুমীর এই হাতটান স্বভাবটার পরিবর্তন ঘটা। না হলে কিন্তু অনেক অপমান তোদের কপালে লেখা আছে।
অনিমা আর কথা না বাড়িয়ে সুমীকে টানতে টানতে রুমে নিয়ে গিয়ে সশব্দে বন্ধ করে দেয় রুমের দরজা। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে গেল তবু দরজা বন্ধই রইলো। সুমীর বাবা অমিয় অফিস থেকে ফিরেই বড় বৌদির কাছে সব কথা শোনে। অমিয় অনেক অনুনয় বিনয় করে অনিমাকে রুমের দরজা খোলায়। অমিয়কে দেখা মাত্রই সুনামীর মতো আছড়ে পড়ে বলে -‘হয় তোমার মেয়ে থাকবে না হয় আমি থাকবো এই বাড়িতে। তোমাকে আজ একটা সিদ্ধান্ত নিতেই হবে। আমি আর পারছি না এই অপমান সহ্য করতে।’ অমিয় অত্যন্ত শান্ত কন্ঠে বলে’ কি ছেলেমানুষী শুরু করেছো। নিজেকে সংযত করো।’ এরপর আস্তে আস্তে সুমীর মাথায় হাত খালি রেখে বলে -‘তোমার যা দরকার আমাকে বলবে কেমন। না বলে অন্যের জিনিস নিতে নেই মা। না বলে কারোর জিনিস নেওয়াকে চুরি করা বলা হয়। তাই না।’
সুমী লজ্জিত মুখে মেঝের দিকে চেয়ে থাকে।সে কাঁদতে কাঁদতে বলে ‘আমি বুঝতেই পারিনি কখন রিনি বৌদির ঘড়িটা নিয়ে নিয়েছিলাম।’ অনিমা আবার সুমীর দিকে তেড়ে যায়। ‘ন্যাকা, বুঝতে পারো নি। সেবার মামাবাড়ি গিয়ে অয়ন দাদার ইয়ার ফোনটা চুরি করিস নি? ছোট বেলায় ভাবতাম বড়ো হয়ে সব ঠিক হয়ে যাবে। আজ পনেরো বছরেও হাতটানের অভ্যাস বদলাতে পারলি না।’এই কথাগুলো বলে অনিমা পাগলের মতো কাঁদতে লাগলো। অমিয় চুপচাপ কাউকে কিছু না বলে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়।
পরের দিন সকালে অফিস থেকে অমিয় ফোন করে অনিমাকে বলে বিকেল পাঁচটা নাগাদ দমদম স্টেশনে আসতে সুমীকে নিয়ে। একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে সুমীর কাউন্সিলিং করানো হবে। বাড়ির অন্য জা’দের কাউকে কিছু না বলে অনিমা বিকেল চারটা নাগাদ ঘর থেকে বের হয়। যদিও বড় জায়ের চোখ এড়িয়ে যেতে পারে নি সে। বেরোবার মুখে বড়’জার শেল বাক্য ‘তাবিজ, মাদুলি কিছু একটা তো ব্যবস্থা করে আসিস। কী সর্বনেশে স্বভাব রে বাবা।’
মনোরোগ বিশেষজ্ঞের চেম্বারের বাইরেই দাঁড়িয়ে আছে। সুমীর জন্য একটা চকলেটের প্যাকেট নিয়ে এসেছে। সুমী অমিয়কে দেখে খুব খুশি হয়। ওরা তিনজন ভিতরে গিয়ে বসে অনিমা অবাক হয়ে দেখে চলেছে -‘এতো রোগী! হ্যাঁ গো, এদের সবার কী রোগ হয়েছে?’
অমিয় বলে,’জানি না। সবার তো আলাদা আলাদা সমস্যা’
মিনিট দশেক পর একজন রিসেপশনের মেয়ে সুমীর নাম ধরে ডাকলে ওরা তিনজনই ডাক্তার বাবুর চেম্বারে যায়। একদম অল্প বয়সী একজন সুপুরুষ ডাক্তার। মিষ্টি একখানি হাসি দিয়ে ওদের অভ্যর্থনা জানায়।সুমীর সমস্যা শোনার পর উনি কিছু নার্ভের ওষুধ দেন এবং ছমাস পর আবার কাউন্সিলিং করানোর কথা বলে। ডাক্তারের সাথে কথা বলার সময় অনিমা বারবার কেঁদে ফেলছিল। ডাক্তার বাবু তা লক্ষ্য করেন এবং অনিমাকে বলেন আপনার সন্তানের একটা মানসিক অসুখ হয়েছে। যার নাম ‘ক্লেপটেম্যানিয়া’। আমরা যাকে হাতটান বলি তারা ডাক্তারি পরিভাষা হল ক্লেপটোম্যানিয়া। এক্ষেত্রে ওষুধের সাথে সাথে বাড়ির লোকজনদের সহমর্মিতা, বিশ্বস্ততা খুব দরকার। আপনি মা হয়ে হেরে গেলে আপনার সন্তান তো হেরে যাবেই। ধৈর্য্য ধরুন। আশাবাদী হয়ে বলছি একদিন আপনার সন্তান রোগমুক্ত হবেই।
মাঝখানে দশটা বছর পার হয়ে গেছে। সুমী এখন বিবাহিত। সুমীর বিয়ে নিয়ে অনিমার উদ্বেগ ছিল প্রচণ্ড। সৌমেনকে সুমী নিজেই পচ্ছন্দ করে।সৌমেনের সাথে বিয়ের কথা পাকা হয়ে গেলে অনিমা একদিন সৌমেনকে আলাদা একান্তে ডেকে পাঠায়। তাকে খুলে বলে সুমীর ক্লেপটোম্যানিয়া রোগটা সম্বন্ধে।’ কাউন্সিলিং চলছে এখনো। হাতটানের বদ অভ্যাস একদম চলে গেছে তা কিন্তু মোটেই নয়। এই তো সেদিন পাশের বাড়িতে বেড়াতে গিয়ে তাদের একখানা দামী শো পিস উঠিয়ে নিয়ে আসে। আমি আবার পরে ফিরিয়ে দিয়ে আসি’। কথাগুলো শুনতে শুনতে সৌমেন অনিমার চোখের কোনের জলটুকু খুব ভালো ভাবে লক্ষ্য করে ছিল।
সুমী -সৌমেনের ফুলশয্যার রাতেই সৌমেন সুমীর হাতে তুলে দেয় তার আলমারির চাবি, তার ওয়ালেট, কার এবং বাইকের চাবি। সুমীর হাত দু’টো নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে সৌমেন বলেছিল -‘তোমার যখন যেটা দরকার নিঃসংঙ্কোচে খরচ করো। মনে রেখো আমার মান সম্মান, মর্যাদা তোমার হাতে।’ প্রায় তিনটে বছর বিবাহিত জীবন অতিবাহিত করলো সুমী। স্বামীর পকেট মারা নাকি স্ত্রীদের নৈতিক অধিকারের মধ্যে পড়ে।এই নৈতিক কাজটুকুও সুমীর কাছে অনৈতিক মনে হয়। দিনরাত নিজের সঙ্গে নিরন্তর লড়াই করে আজ সে জয়ী। এমন কি সৌমেনের মা কোথাও বেড়াতে গেলে সোনা দানা,য়টাকা পয়সা সুমীর দায়িত্বে রাখাই শ্রেয় মনে করে। এই ভাবে সঠিক চিকিৎসা, অনুশাসন,সংযম, সহানুভূতি, ভালোবাসা এইগুলোর ওপর ভর করে সুমী ‘ক্লেপটোম্যানিয়া’ নামক কঠিন মানসিক অসুখ থেকে নিজেকে মুক্ত করে।