আলো
– শিলাবৃষ্টি
সে যুগের উকিল বাবার বড় মেয়ে রেণুকার বিয়ে হয়েছিল বারো বছর বয়সে এক মস্ত জমিদার বাড়ীতে। প্রথম কন্যার বিয়েতে কোনো কার্পণ্য করেননি খগেন চন্দ্র। মেয়ে ছিল তাঁর নয়নের মনি। তাই সোনা দিয়ে সাজিয়ে দিয়েছিলেন মেয়ের অঙ্গ। সাতনরি হারটা যে দেখলো মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে থাকলো। লোকে বলাবলি করলো, – মুকুটটা ছাড়া কি দিতে বাকি রেখেছেনখগেন বাবু!
নহবত বসিয়ে পাঁচ দিন ধরে লোক খাওয়ানো ! আবার জামাইকে হাতির পিঠে বরাসনে বসিয়ে শহরে ঘোরানো! একখানা বিয়েবাড়ি বটে ।
জামাইও ছিল শিক্ষিত, সুপুরুষ। আইনের ছাত্র।
ভট্টাচায্যি বাড়ির আদরের বধূ রেণুকার জীবন ভালোই কাটছিল । একে একে তিন সন্তানের জননী হয়েছে রেণুকা। বড় ছেলে অমিত ছোট ছেলে সুমিত আর মেয়ে সুমিত্রা। দুই দেওর, দুই জা আর তাদের সন্তানরা সবাই এক সংসারেই এখনো রান্না খাওয়া করে। এছাড়া ঝি চাকর ভাগচাষী তো আছেই। বিরাট বাড়ি। চারিধারে গাছগাছালি। দু’ খানা মস্ত পুকুর। বড় বড় ধানভর্তি মরাই। গোয়াল ভরা গরু, পুকুরে মাছ, গাছে গাছে আম, জাম নারকেল কিন্তু এ হেন অবস্থাপন্ন পরিবারেও অভাব দেখা দেয়!
সারা দেশে যখন হঠাৎ নেমে এল মন্বন্তর, ছিয়াত্তরের সেই নিদারুণ দুর্ভিক্ষে দেশ সাংঘাতিক সমস্যার সম্মুখীন হ’ল। সারা বাংলায় তখন হাহাকার। কত মানুষ খেতে পাচ্ছেনা, দরিদ্র লোকেরা ফ্যান খেয়ে পেট ভরাচ্ছে। সরকার থেকে ত্রাণ আসছে চারিদিকে। চুরি ছিনতাই বেড়েই চলেছে। সে এক ভয়াবহ অবস্থা। আতঙ্কে মানুষ দিশেহারা। আর কলেরা বসন্ত তো লেগেই আছে। মানুষ মরছে দিনরাত।
রেণুকার সংসারেও এমতাবস্থায় শ্বশুরমশায় বুঝে চলতে শুরু করলেন, শুরু হল নিকতি ধরে হিসেব। সব কিছু মেপে মেপে বের করে দেন ভাঁড়ার ঘর থেকে । তার বাইরে কোন কিছু চাইলেও পাওয়া যাবে না। তিন সন্তানকে নিয়ে একটু অসুবিধেতেই কাটাতে হচ্ছে; কত দিন এভাবে কাটাবে রেণুকা বুঝতে পারে না। অভাব কখনো দেখতে হয়নি তাকে। খুব অসুবিধায় দিন কাটলেও বাংলার এই পরিস্থিতিতে এত বড় একান্নবর্তী পরিবারে দু’ মুঠো ভাত মুড়ি জুটছে এই কতো না !
সন্ধে থেকে সেদিন ঝড় বৃষ্টি শুরু হয়েছে। আকাশ কালো মেঘে আচ্ছন্ন। মাঝে মাঝে ভয়ংকর বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। রেণুকার চার বছরের মেয়ে আলোর আগের দিন থেকেই গা’টা মাঝে মাঝে গরম হচ্ছে। তাড়াতাড়ি খাওয়া দাওয়া সেরে নিতে চায় রেণুকা। কাজ সব শেষ হলে মেয়ের কাছে গিয়ে একটু বসবে। মনীন্দ্রকেও তাড়া দেয় সে।
বোধহয় আজ অমাবস্যা তিথি। পাশের পাড়ার হরিখুড়ো, আর গোবিন্দর বৌ দুপুরে মারা গেছে “বলো হরি হরিবোল” ধ্বনি উঠলো। শ্মশানে যাচ্ছে ওরা। স্বামী মনীন্দ্র বোধহয় ঘুমিয়ে পড়েছেন পালঙ্কে। দুই ছেলে বাবার কাছেই শোয়। পাশের চৌকিতে মেয়ে নিয়ে রেণুকা। মেয়েটার গায়ে এখনো বেশ জ্বর। কাল হোমিওপ্যাথি ডাক্তার বাবুকে একবার দেখিয়ে নিতে হবে। দুই ছেলের পরে এই মেয়ে। চার বছর বয়স। সবাই বলে ও খুব সুন্দরী। ওর গায়ের রং খুব ফরসা বলে দাদু নাম দিয়েছেন আলো।
সারাদিন বকবক করে বাড়ির সকলের মাথা খেয়ে নেয় যেন। দাদুর তো নাতনি অন্ত প্রাণ। কাল থেকে বাড়িটা বড্ড চুপচাপ। মেয়েটার মুখে আর কথা নেই। খুব শান্ত হয়ে গেছে। রেণুকা মেয়ের দিকে তাকিয়ে থাকে। বড় মায়া জড়ানো ওর মুখখানা ।
আলো ঘুমিয়ে পড়েছে, কিন্তু সারাদিন এত খাটাখাটনির পরেও রেণুকার চোখে আজ ঘুম নেই …ঘরে রাখা হ্যারিকেনটায় বোধহয় তেল শেষ হয়ে আসছে। তিন চার বার দপ দপ করে নিভে গেল।
উঃ কী অন্ধকার। রেণুকা অন্ধকারকে বড় ভয় পায়। বোধহয় বৃষ্টি শুরু হল। মেঘ ডাকছে। বাড়ির সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। এখন শ্বশুরের কাছে তেল চাইতেই বা কী ভাবে যাবে সে। বয়স্ক মানুষ ঘুমিয়ে পড়েছেন। রাতে আর বিরক্ত না করাই ভালো রেণুকা ঘুমানোর চেষ্টা করে, কখন ঘুমও ধরে যায়।
…আলো, আলো…ও মা আলো জ্বালো – ও বাবা…আলো … আলো … আলো কৈ … ও মা … আলো …
চিৎকারে ঘুম ভেঙে যায় রেণুকার।
-কি হয়েছে মা, আলোটা নিভে গেছে। এই তো আমি।
কিন্তু মেয়ে তো আর কথা বলছে না!
– ওগো শুনছো। শোনো না, মেয়েটা আর নড়ছেনা… কথা বলছেনা। আলো জ্বালো না, একটা আলো জ্বালো না।
মনীন্দ্রর ঘুম ভেঙে যায়। হাতড়ে হাতড়ে বেটারির প্রায় মশলা ফুরিয়ে যাওয়া টর্চটা ঘরের তাক থেকে বের করে।
নাঃ ততক্ষণে সব শেষ। আলো স্থির হয়ে গেছে। চিৎকার করে আর্তনাদ করে ওঠে রেণুকা।
আলো, আমার আলো সোনা, কথা বল মা, কথা বল। ওগো বলো না আমার আলো নড়ছে না কেন? কথা বল মা।
না না এ হতে পারেনা । কিছুতেই হতে পারেনা । আলো ও আলো ! আলো …
ছিয়াত্তরের দুর্ভিক্ষের করাল গ্রাসের বলি হল এক চার বছরের শিশু। হা ঈশ্বর!
অমাবস্যার ঘোর অন্ধকারে- ভয়ে “আলো” আলো” চিৎকার করতে করতে – হার্টফেল করল এক সদ্য ফোটা কুঁড়ি। সবাইকে অন্ধকারে নিমজ্জিত করে আলো চলে গেল অন্যলোকে।