গিনিপিগ
– শচীদুলাল পাল
গঙ্গা তীরবর্তী হুগলি জেলার রিষড়া শহর।এক আভিজাত্যপূর্ণ পরিবারের ধনশালী ব্যক্তি অরিন্দম রায়- বয়স প্রায় চল্লিশ। বিশাল ধনসম্পত্তির একমাত্র উত্তরাধিকারী। প্রমোটারী করেও প্রচুর টাকা, জমিজমা, পুকুর ও কয়েকটি ফ্ল্যাটের মালিক। মাফিয়া গুন্ডা বদমায়েশ পুলিশ প্রশাসন সব তার হাতের মুঠোয়।
পঁচিশ বছর বয়সে মালতি নামে এক সমবয়সী মেয়েকে ভালোবেসে বিয়ে করেছিল। ভোগ বিলাসের সমস্ত সামগ্রী ছিল। বেশ সুখেই থাকতো। বছর পাঁচেক বাদে সমস্যা। কোনো সন্তানের জন্ম দিতে পারেনি মালতি। সেই নিয়ে কলহ ঝগড়াঝাটি। অবস্থাপন্ন ঘরের মেয়ে ছিল মালতি। মায়ের কথা মত চলতো। ফলে মায়ের নির্দেশে একদিন বাপেরবাড়ি চলে গেলো। কিছুদিন ছাড়াছাড়ির পর বিবাহবিচ্ছেদ। মিউচুয়াল ডিভোর্স। বেশ কিছু টাকা অবশ্য লেগেছিল।
বছর খানেক পর একদিন মা বললো, “অরিন্দম। তুই আবার একটা বিয়ে কর। বংশে একটা সন্তান চাই। এতবড় বিশাল সম্পত্তির উত্তরাধিকার চাই। আমি তোর জন্য এক সুন্দরী মেয়ের সন্ধান পেয়েছি। গ্রামের মেয়ে। লেখাপড়া জানে। আমার খুব পছন্দ। একদিন গিয়ে দেখে আয়।”
অরিন্দম বললো, “হ্যাঁ মা ঠিক বলেছো। আমি এবার বিয়ে করবো তোমার পচ্ছন্দমতো।”
একদিন মামাকে নিয়ে মেয়ে দেখতে গেল। সাধারণ পরিবার। কুড়ি বছর বয়সী অতি সুন্দরী মেয়ে। ফর্সা, ত্বন্বী, সুনয়না। শান্ত নিরীহ। পটল চেরা চোখ। সুলক্ষণ যুক্তা।খোলা চুল কোমরের নীচ ছাড়িয়ে গেছে। আকর্ষণীয় দেহ সৌষ্ঠব।
সাধারণ পোশাক। এক দেখায় মেয়ে পচ্ছন্দ হয়ে গেলো। অরিন্দম বললো “মেয়ে আমার খুব পছন্দ। আপনাদের কিচ্ছু লাগবে না। এমনকি অতিথি আপ্যায়নের যাবতীয় খরচ আমার।”
নিদিষ্ট দিনে মহাধুমধামে বিয়ে করে বউ নিয়ে ঘরে এল। প্রীতি ভোজে বহু আত্মীয় স্বজন বন্ধুবান্ধব চেনা জানা লোকজনের সাথে নেতা মন্ত্রীরাও উপস্তিত ছিল।
অরিন্দমের নতুন বউ। নাম তার করিনা।
করিনা সোনা-দানা গয়না-গাঁঠি বিলাসবহুল বাড়ি-গাড়িতে ভরপুর বাড়িতে এসে খুব খুশি। সে নিজেকে খুব ভাগ্যবতী মনে করলো। বর- ঘর পেয়ে তার আনন্দ আর ধরেনা। বাড়িতে ঝি চাকর, রান্না বান্নার লোক কোনো কিছুর অভাব নেই। বিশাল জমির উপর বাড়ির বাউন্ডারির ভিতরে গাড়ি রাখার গ্যারেজে ছোট বড়ো মিলিয়ে পাঁচ পাঁচটি গাড়ী। বাগান লন। অনেকরকম গাছ। বাগানে নানান দেশি-বিদেশি ফুলের গাছ।বাগানে বিদেশি ঘাসের গালিচা।
করিনার বেশ আনন্দেই কাটছিল। নিয়মিত শরীর চর্চা- রূপ চর্চা করতো। বাড়িতে বিউটিশিয়ান আসতো। করিনা সুন্দরী তো ছিল আরো দিনদিন রূপ লাবণ্যে আকর্ষণীয় হয়ে উঠতে লাগলো।
এভাবে তার বছর দশেক কেটে গেলো। কিন্তু তার গর্ভে সন্তান আর আসে না।
সন্তান কবে আসবে? শাশুড়ীও মাঝে মাঝে খোঁজ খবর নেয়। সন্তান কামনায় ব্রত উপবাস পূজা পার্বণ প্রায়ই করতো। তীর্থে তীর্থে অরিন্দমের সাথে ঘুরে বেড়াতে লাগলো। অনেক মানত করলো। যে যা বলে সবকিছু করলো। কিন্তু কিছুতেই কিছু হলো না।
আরিন্দমের সাথে গায়নোক্লোজিষ্টের কাছেও গেলো। নানান পরীক্ষা করালো। কিন্তু করিনার কোনো ত্রুটি ধরা পড়লো না। সবই নরম্যাল।
শাশুড়ী মা একদিন এক তান্ত্রিককে নিয়ে আসলেন। উনি নির্দেশ দিলেন “সুর্যোদয়ের পূর্বে গঙ্গাস্নান করে অশ্বত্থ গাছের তলায় জল ঢালতে হবে।”
শাশুড়ীমা ছেলেকে বললেন, “বাবা অরিন্দম, তোকে করিনাকে নিয়ে ভোরবেলা মাঝেমধ্যে গঙ্গায় যেতে হবে।” গঙ্গা বাড়ি থেকে প্রায় দু’ কিলোমিটার।
অরিন্দম বললো, সারাদিন ব্যবসার কাজকর্ম, হিসেব নিকেশ সেরে ঘুমাতে যেতে আমার অনেক রাত হয়ে যায় মা। আটটার আগে ঘুম থেকে উঠি না। আমি ভোরে উঠতে পারবো না।”
মা বললেন- “তা বললে কি হয় বাবা!”
অরিন্দম বললো “কাউকে সাথে নিয়ে গেলেই তো হয়।”
– ঠিক আছে তুই একটা ব্যবস্থা কর।
-ঠিক আছে। আমার ড্রাইভার মনোজকে বলে দেব। সে তো সামনের বস্তিতেই থাকে। যেদিন করিনা যেতে চাইবে সেদিন করিনাকে নিয়ে যাবে গঙ্গায়।
একদিন মনোজকে ডেকে বললো, “তোর বৌদি ভোর বেলা গঙ্গাস্নানে যাবে। তুই বৌদির ইচ্ছেমতো আমার গ্যারেজের যে কোনো গাড়িতে চাপিয়ে যেদিন বলবে সেদিন বৌদিকে নিয়ে যাবি।”
মনোজ সামনের বস্তিতে বিধবা মায়ের সাথে থাকে। মায়ের নাম সরলা দাস। মনোজ বেশ ভালো। তার ডাক নাম মনা। অরিন্দমের কথায় ওঠবোস করে। যা বলে তাই শোনে।একজন ভালো সেবক। সুন্দর সুঠাম চেহারা। কর্মঠ। বয়স ছাব্বিশ। অবিবাহিত যুবক। মা অন্যের বাড়িতে রান্নার কাজ করে পড়াশোনা করিয়েছে। মনা গ্র্যাজুয়েট পাশ করেছে। কিন্তু চাকরি কোথায়! অগত্যা অরিন্দম বাবুর গাড়ির ড্রাইভারের চাকরি করে। বেতন বেশ ভালো। যখন গাড়ী চালানোর কাজ থাকে না তখন অন্য ফাইফরমাশ খাটে। সেজন্য আলাদা বাড়তি কিছু আয় হয়।
একদিন মনা এলো খুব ভোরে। গ্যারেজ থেকে গাড়ি বের করে করিনাকে গাড়িতে চাপিয়ে গঙ্গাতীরে নিরিবিলি এক ঘাটে নিয়ে গেল। করিনার বয়স ত্রিশ, মনা ছাব্বিশ।
মনা গঙ্গাতীরে গাড়ি রেখে দাঁড়িয়ে রইলো। বেশ গাছগাছালি পূর্ণ গঙ্গাতীর। পাখিদের ডানা ঝটপটানির আওয়াজ। বড়োই নিরালা। কলকল গঙ্গা বয়ে চলেছে। ভাটার টানে জল অনেক নীচে চলে গেছে। করিনা স্নানের উপযুক্ত বস্ত্রে কাদায় পা টিপে টিপে জলে নামলো। ডুবে স্নান করলো। ওঠার সময় এক হাতে জলপূর্ণ ঘড়া নিয়ে আসতে গিয়ে পা পিছলে কর্দমাক্ত ঘাটে পড়ে গেলো।
ব্যথায় সে কঁকিয়ে উঠলো। মনোজকে ডাকলো– “ম– না– আমি পড়ে গেছি। আমাকে ওঠা।”
মনা তাড়াতাড়ি এসে করিনাকে ওঠালো। পঙ্কিল পথ বেয়ে সোপানে উঠতে গিয়ে দুজনেই আবার পড়ে গেলো। এবার সে মনার বুকের উপর। দুজনেই কাদায় মাখামাখি। মনা করিনাকে ধরে নিয়ে ধীরে ধীরে অশ্বত্থ গাছ তলায় নিয়ে গিয়ে বসালো। ব্যথায় কাতর করিনা মুখ দিয়ে আহ্ উহ্ করতে লাগলো।
সূর্যের প্রথম প্রকাশে এক রক্তিম আভায় সুন্দরী করিনাকে আরও রমনীয় লাগছিল। শরীরের যন্ত্রণা সত্ত্বেও মনার হাতের স্পর্শে করিনা শরীরে উত্তেজনা বোধ করলো। মনাও বিহ্বল হয়ে গেল মোহময় পরিবেশের মধ্যে। ভোরের পাখিদের কলতানে, সূর্যের মায়াবী আলো, নদীর স্নিগ্ধ হাওয়ায় তারা বাস্তব, পরিচিতি, সম্পর্ক সব ভুলে গেল। সমাজ- সংস্কার সব ভুলে আকৃষ্ট হলো দুজনেই। দু’টি শরীর মিলনে উন্মুখ হলো।তারপর তৃপ্ত মনে জলপূর্ণ ঘড়া নিয়ে একসাথে অশ্বত্থের গোড়ায় জল ঢেলে, গাড়িতে বেশভূষা পরিবর্তন করে বাড়ি ফিরে এলো। প্রথম দিনের গঙ্গাস্নানের রেশ থেকে গেল সারাদিন দুজনের মনেই।
পরদিন ভোরবেলায় আবার মনাকে ফোন করে ডেকে নিল।
আবার সেই গঙ্গা ঘাট সেই অশ্বত্থ তলে জল ঢালা। ফুল পাখি নদী ঘাস লতা পাতার প্রকৃতির বিস্ময়ের মতো দুই যুবক যুবতীর মুগ্ধ হওয়া, একের মাঝে অন্যের সমর্পণ।
করিনা মনাকে জড়িয়ে ধরে বললো, “তোকে পেয়ে আমি ধন্য। তুই আমাকে অজানা নৈসর্গিক সেরা সুখের জগতে পৌঁছে দিয়েছিস।”
মনা ভয়ে বলে “লোক জানাজানি হলে, বাবুর কাছে কথাটা পৌঁছালে আমার চাকরি থাকবে না বৌদি। আমি চাকরি হারাবো, ঘরে আমার বিধবা মা, অনেক কষ্ট করে আমাকে বড়ো করেছে।”
– কেউ জানবে না, শুধু আমাদের মাঝে থাকবে। আমি তোকে প্রচুর টাকা দেব। তোর সব ইচ্ছা আমি পূর্ণ করে দেব।
– না তা হয় না। আপনারা বড়লোক। ধনীর কলঙ্ক হয়না। আমি সহায় সম্বলহীন। বাবু আমাকে বিশ্বাস করেন। তিনি যা বেতন ও বকশিশ দেন তাতে আমি বেশ ভালো আছি। তাছাড়া আপনি বিবাহিতা,আপনার স্বামী আছে।
করিনার চোখ দুটো বিস্ফোরিত হলো চীৎকার করে উঠলো ” না—-। সে শুধু কাগজে কলমে, সমাজে। আমাকে কখনো দেহ সুখ দিতে পারেনি। কয়েক বছর থেকে ইমপোটেন্সিতে ভুগছে। এরপর বল আমি কি ভুল করছি? পাপ করছি? ঈশ্বর তোকে আমার কাছে পাঠিয়েছেন। আমি এই দান কেন গ্রহণ করবো না? উত্তর দে…
– প্লিজ বৌদি আমাকে ক্ষমা করবেন। আমি পারবো না।
বিষণ্ণ মনে করিনা ঘরে ফিরে এলো। মাঝ রাতে মোবাইলে অনেক মেসেজ করলো। মনা কোনো উত্তর দিল না। এভাবে বেশ কয়েকদিন কাটলো। একদিন মেসেজে করিনা লিখলো, “আই লাভ ইউ। আমি তোকে ছাড়া বাঁচবো না। তুই যদি কাল ভোরে না আসিস আমি গঙ্গায় ডুব দিয়ে আত্মহত্যা করবো।”
মনা বিচলিত হলো। সেও তো করিনাকে ভালোবেসে ফেলেছে।
সে অনেক ভাবলো। এক বঞ্চিতা রমণী তাকে কামনা করে। এই মিলনে পাপ নেই। হয়তো প্রত্যাখ্যান করে মনে আঘাত করায় পাপ।
মনা লিখলো- “আমি কাল আসবো। তৈরি থাকবেন।”
সময়ের আগেই মনা এলো। আজ অন্য বড়ো গাড়ির চাবি মনার হাতে তুলে দিয়ে বললো, “চল আজ দূরে অন্য কোথাও।”
আজও করিনা সামনের সিটে। গাড়ি চলছে। শুনশান রাস্তা ভোরের বেলা। ফাঁকা রাস্তা। জনমানবহীন।
অন্য ঘাটে গাড়ি পার্ক করলো। করিনা মনার হাতে তুলে দিল এক লাখ টাকার বান্ডিল।
মনা ইতস্তত করে বলল “একি! এত টাকা। বাবু জেনে যাবে!”
করিনা বললো,”না না এগুলি আমার টাকা। এর কোনো হিসেব দিতে হয় না। আমাকে যা টাকা দেয় আমি তো খরচ করতেই পারি না। আরোও দেব। তুই না চাইলেও দেব। আমি তোকে খুব ভালোবাসি, শুধু তুই আমাকে ভালোবাসিস।”
টাকাগুলো মনার হাতে জোর করে ধরিয়ে দিয়ে মনাকে গাঢ় চুম্বন করলো।
আবেগে মনার হৃদয় তন্ত্রীতে বেজে উঠলো সুরের ঝংকার।
পূর্ণ র্জোয়ারের গঙ্গা। একটু নামতেই এক গলা জল। এক অভিনব জলকেলির সাথে এক কোমর জলেই দু’জনেই দেহ মিলনে লিপ্ত হলো। ধীরে ধীরে জোয়ারের জল বাড়তে বাড়তে গলা অব্দি ঢেকে দিল।
দিন দুই পর। রাতভর মুষলধারে বৃষ্টি। ভোরবেলা গাড়িতে যেতে যেতে গাড়ি আটকে গেলো। পথঘাট জলে টইটম্বুর। রাস্তায় এক হাঁটু জল। জল নামার অপেক্ষায় তারা এক নির্মিয়মান ফ্ল্যাটের ঘরে আশ্রয় নিতে গিয়ে ভিজেই গেলো। তীব্র বিদ্যুতের ঝলকানি। তার সাথে সামনেই কোথাও কড় কড় কড়াৎ শব্দে বাজ পড়লো। করিনা ভয়ে মনাকে জড়িয়ে ধরলো। প্রকৃতির এই তান্ডবের মাঝেই এই অদ্ভুত পরিবেশে ওদের দেহমন দুই অস্থির হলো মিলন আকাঙ্খায়।
মনা বললো, ‘আমি আপনার দেওয়া টাকায় একটা দামি মোবাইল কিনেছি আজ আপনার ছবি তুলবো। আমি ছবি আঁকতে জানি। আপনার ছবি আঁকবো।”
করিনা বললো, “আমাকে দেখাবি।”
এভাবে ওরা নিরিবিলি স্থানে প্রায়ই দেখা করতো, সঙ্গসুখ উপভোগ করতো। ঈশ্বরের অসীম কৃপায় তারা কখনো কারো নজরে পড়েনি।
করিনা প্রায়ই অগুনতি টাকার বান্ডিল মনার হাতে জোর করে ধরিয়ে দিত। মনা মায়ের একাউন্টে সরলা দাসের নামে সেগুলি জমা করে দিত।
মাস ছয়েক পর শাশুড়ী মা লক্ষ্য করলো বউমা বমি করছে। একদিন মাথা ঘুরে পড়ে গেলো। ছেলেকে ফোন করে জানালো মা। অরিন্দম নিজে ড্রাইভ করে করিনাকে নিয়ে স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে নিয়ে গেলো। পরীক্ষা করে ডাক্তার অরিন্দমকে বললো, “আপনি বাবা হতে চলেছেন।”
খুশিতে অরিন্দমের মন ভরে গেলো। বহুদিনের তার বাসনা পূর্ণ হতে চলেছে। ডাক্তারের সামনেই স্ত্রীকে আলিঙ্গন করে অভিনন্দন জানালো।
ডাক্তার বললেন “এই সময় একদম রেস্ট।” কোনো ভারী কাজ করা চলবে না।”
ঘরে এসে মাকে জানালো। মা’র তো আনন্দ আর ধরে না। এতদিনে ঈশ্বর মুখ তুলে চেয়েছেন। করিনা শাশুড়ী মাকে প্রণাম করলো। শাশুড়ী মা বউমাকে জড়িয়ে ধরে কপালে চুমু দিল। তারপর নিয়মিত চেক আপ। পুষ্টিকর খাওয়া দাওয়া।
এদিকে মনা নিয়মিত মেসেজ করেই যায়। কিন্তু কোনো উত্তর পায় না।
একদিন করিনা লিখলো “আমি তোর ঔরসজাত সন্তানের মা হতে চলেছি।”
ডাক্তারের দেওয়া নিদিষ্ট তারিখে করিনা নার্সিং হোমে ভর্তি হলো। কোল আলো করে এক পুত্র সন্তানের জন্ম দিল।
সুস্থ শরীরে সবল পুত্র সন্তানকে নিয়ে ঘরে এলো। অরিন্দম ও মায়ের আনন্দে শিশু পুত্র স্নেহ আদরে বড়ো হতে লাগলো।
(২)
সাত মাসে দিনক্ষণ দেখে অন্নপ্রাশনের আয়োজন করা হলো। নিমন্ত্রণ পত্রের কার্ডে লিখলো কোনো উপহার আনবেন না। প্রায় সাতশো লোকজন আত্মীয় স্বজন বন্ধুবান্ধব নিমন্ত্রিত অতিথিদের উপস্থিতিতে মহাসমারোহে রাজকীয়ভাবে অন্নপ্রাশন অনুষ্ঠিত হলো। সেই অনুষ্ঠানে মনাও এসেছিল। সে সবার অলক্ষ্যে শিশুটিকে চুমু খেয়ে করিনার হাতে দিল। করিনা খুব আস্তে মনার কানের কাছে গিয়ে বললো, “এই বংশের সেরা উপহার তুই দিয়েছিস।”
শিশুটিকে দেখার পর মনার পিতৃত্ব বোধ শিশুটির প্রতি দুর্বল করে দিলো।
মনা পরদিন থেকে নানা কাজের অছিলায় দিনে দুপুরে অন্দরমহলে যাওয়া আসা শুরু করে দিল।
বেশ কয়েকদিন পর, ঘুমন্ত শিশু পুত্রের সামনেই একদিন ওরা আবার দুর্বল হয়ে পড়লো দেহ-মনে। ভুলে থাকা স্মৃতিগুলো নড়াচড়া শুরু করলো। দ্বিধা- দ্বন্দ্বের অবসানে ওরা আবার মিলিত হলো, বারবার- প্রায় দিন।
অরিন্দম ভালোভাবে জানতো সে বাবা হবার যোগ্য নয়। কলকাতার নামী ডাক্তারের ডায়াগনোসিসে বারবার টেস্ট রিপোর্টে ফেল। স্পার্ম কাউন্টের সংখ্যা ডেড। ফার্টাইল করার ক্ষমতা নাই। ওষুধ পত্র খেয়েও লাভ হয়নি। সে জেনেছিল তার ঔরসে কোনো সন্তানের জন্ম হবেনা। এ কথা সে ছাড়া অন্য কেউ জানত না এবং সে আন্দাজ করেছিলো- শিশুটির বাবা কে।
তাই করিনা হাসপাতালে থাকাকালীন অরিন্দম সিসিটিভি ( হিডিন) ক্যামেরা লাগিয়ে দিয়েছিল বেডরুমে। তার কানেকশন ছিল তার আই ফোনে। অরিন্দম একদিন চেক করতে গিয়ে চমকে গেলো। মনোজ- করিনার সম্পর্ক সন্তানের জন্মের জন্য, নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্য, নিজের পৌরষত্বহীনতার লজ্জা গোপন রাখার জন্য মেনে নিয়েছিল। কিন্তু সন্তানের জন্মের পর আর মানতে পারলো না।
সে এক পরিকল্পনা করলো। একদিন রাতে তার ড্রয়িংরুমে মনাকে ডেকে জোর করে মদ খাওয়ালো। মনা প্রতিবাদ করেছিল। কিন্তু মনিবের রুক্ষ মেজাজের কাছে হার মেনে নিত্য মদ খেতে খেতে মদ্যাসক্ত হয়ে গেলো। প্রতিরাতে সে ছুটে আসতো বাবুর কাছে। আর বাবুর দেওয়া মদ গিলতো। দামি বিলাতি মদের পেগ বাড়িয়ে দিল। একদিন ৭৫০ মিলির বোতল একাই সাবাড় করে দিল। টলতে টলতে উঠতে গিয়ে পকেট থেকে দামি মোবাইলটা বারবার পড়ে যেতে লাগলো। অরিন্দম বাবু আচ্ছা করে ধমকে বললেন “সুইচ অফ করে পাশের ঘরে আমার চেম্বারের ড্রয়ারে রেখে দিয়ে আয়।কাল এসে নিয়ে যাবি।” মনা তাই করলো।
পরদিন গঙ্গার ঘাটে লোকজনের প্রচুর ভীড়। গঙ্গায় এক জায়গায় এক ‘দ ‘এর মতো যেখানে জল স্থির থাকে। সেইস্থানে দেখলো মনার মৃতদেহ জলে ভাসছে। রহস্যজনক মৃত্যু। পুলিশ এলো। মৃতদেহ পোষ্টমর্টেম হলো। রিপোর্টে লেখা অত্যধিক মদ্যপান ও জলে ডুবে মৃত্যু। মনার মা সরলা দাস নিখোঁজ পুত্রের সন্ধানে গিয়ে বুকফাটা আর্তনাদ করে শোকাহত হয়ে সনাক্ত করলো। বললো, “আমার ছেলে নাম মনোজ রায়, ডাক নাম মনা।” অন্ত্যেষ্টি ক্রিয়ার যাবতীয় খরচ ও ব্যবস্থা সব অরিন্দম করলো।
করিনা বাক স্তব্ধ হয়ে গেলো। দু’ তিন রাত বিনিদ্র কাটলো। ধীরে ধীরে মানসিক রোগগ্রস্ত হয়ে গেলো। নিশ্চুপ থাকে। একদৃষ্টিতে জানালার দিকে তাকিয়ে থাকে। ধীরে ধীরে এক জড়বস্তুতে রূপান্তরিত হয়ে গেলো। এখন সে বিখ্যাত সাইক্রাটিস্টের অধীনে চিকিৎসারতা।
অরিন্দম মনার মাকে সান্ত্বনা দিয়ে বললো, “মনা আর নেই। কিন্তু আমি আছি। আজ থেকে আমাকেই তোমার ছেলে বলে মনে করবে।”
মনার মা সরলাকে নিজের বাড়ির অন্দরমহলে শিশুপুত্রের দেখভালের জন্য নিযুক্ত করলো।
সরলা এক অদৃশ্য মায়ার টানে আবদ্ধ হয়ে গেলো। শিশুটি কারোর কোলে যেত না। কিন্তু কান্নাকাটি করলে আশ্চর্যভাবে সরলার স্পর্শ পেলেই চুপ করে যেত। সরলা রাতে ঘুম পাড়িয়ে বস্তিতে ঘরে চলে আসতো। মাঝরাতে ঘুম ভেঙে এদিক ওদিক তাকিয়ে সরলাকে না দেখতে পেয়ে সারারাত শিশুটি কান্নাকাটি করতো।
অরিন্দমের নির্দেশে ও শিশুটির টানে পাকাপোক্ত ভাবে অরিন্দমের সুবিশাল বিলাসবহুল বাড়িতে আশ্রয় নিল ছেচল্লিশ বছর বয়সী মনার বিধবা মা সরলা।
সরলার অনুরোধে একদিন গাড়িতে করে সরলাকে নিয়ে বস্তির ঘরে গেলো কিছু জিনিষ পত্র আনতে। সেই ঘরের এক তালামারা ঘরে গিয়ে অরিন্দম তালা ভেঙে দেখলো একটাই মাত্র পেন্টিং। পেন্টিং দেখে চমকে গেলো। সরলা তখন অন্য ঘরে ব্যস্ত। সাথে সাথে কাগজে মুড়ে অরিন্দম বললো “মাসিমা এই পেন্টিংটা আমি আপনার কাছ থেকে কিনে নিতে চাই।যত দাম লাগে দেব।”
আমি বাবা ওঘরে কখনো ঢুকি না। তুমি একটা পেন্টিং নেবে, তার জন্য দাম! তুমি আমার জন্য মনার জন্য অনেক উপকার করেছো। আমি কোনো দাম নিতে পারব না।”
অরিন্দম সরলা আর তার কিছু জিনিসপত্র সমেত ঘরে এলো। অরিন্দম এসে সটান ভিতরে গিয়ে এক অতি গোপন আন্ডারগ্রাউন্ড কক্ষে পেন্টিংটা ঢাকা দিয়ে রেখে দিল। ঢাকা দিলো সন্তানের জন্মের কথা- নিজের অক্ষমতার কথা।
সরলার কাছে কোলে পিঠে মানুষ হতে লাগলো অরিন্দম রায়ের ছেলে। বিশাল সম্পত্তির উত্তরাধিকারী।