গল্প- পর্দার আড়ালে অভিমন্যু

পর্দার আড়ালে অভিমন্যু
– দ্যুতিপ্রিয়া বন্দোপাধ্যায়

 

 

অফিস থেকে আজ মেইল এসেছে- “ওয়ার্ক ফ্রম হোম” এ আজকের বিষয় “কারিকুলাম অ্যাক্টিভিটিস”… সব কর্মচারীদের আজ কিছু না কিছু করে তার ভিডিও কোম্পানির নিজস্ব ‘সাইটে’ এ ‘আপলোড’ করতে হবে। মেইলটা দেখে দু’মিনিটের জন্য হাসবে না কাঁদবে ভেবে পেলো না প্রিয়ংবদা ওরফে প্রিয়ংবদা দাসগুপ্ত। পেশাগত দিক দিয়ে গত পাঁচ বছর ধরে একটা মাল্টিনেশানাল কোম্পানিতে তে পরিবহন ডিপার্টমেন্টে আছে। চাকরি জীবনের ৮টা  থেকে ১০টা সময়টা বাদ দিলে তার পরিচয় দাঁড়ায় দাশগুপ্ত বাড়ির মেজো বৌমা, মি. দাশগুপ্তর বৌ। অবশ্য ওই বৌ কথাটা প্রিয়ংবদার নিতান্তই খেলো মনে হয়। তার থেকে বিনা মাইনের ‘পার্মানেন্ট’ কাজের লোক শব্দটা অনেক ভালো।’অ্যাটলিস্ট’  লোক দেখানো তো কিছু নেই! ও হ্যাঁ এখানেই শেষ না… বছর দু’য়েকের একটা ছেলেও আছে বটে, নাম প্রিয়াংশু… ওর আর ওর বর, অংশুর নামের মিলিয়ে রাখা। এখন এটাই নাকি ট্রেন্ড চলছে কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই ঠোঁটের কোনে একটা অবজ্ঞার হাসি ফুটে উঠলো প্রিয়ংবদার। উঠে গিয়ে আলমারিটা খুললো। তার ভিতরে লকারটাও, খুব সাবধানে বাপের বাড়ি থেকে দেওয়া গয়নার বাক্সটা বার করে আনলো। কলকাতার গড়িয়া হাটের মতো জায়গায় একটা তিনতলা সাবিকি আমলের শ্বশুর বাড়ী। নয় নয় করে বাড়িতে বারো জন লোক। যত দূর যা জানে বরের নামে সম্পত্তির পরিমাণও কম না। তাও বিয়ের তিন বছর পরেও যেন ওর কোনো কিছুতেই কোনো অধিকার নেই। নিজের ছেলের ওপরও সেই অধিকার নেই যতটা একজন মায়ের থাকে। অংশুর মতে ছেলেকে ওর হাতে দিয়ে ‘আনকালচার্ড’ মানুষ বানাতে পারবে না। এই ফাঁকে ঘাড় ঘুরিয়ে দরজার দিকটা একবার দেখে নেয় প্রিয়ংবদা- কেউ আসছে না তো..!! খুব সন্তর্পণে গয়নার বাক্সটা খোলে ও- ভিতরে বাবার দেওয়া কিছু গয়না আর বেশ পুরোনো রং উঠে যাওয়া একটা ভাঙা মাউথ অর্গান। প্রাণ ভরে দেখে মাউথ অর্গানটাকে। কত বছর বাজায় নি। চোখ দু’টো ছলছল করে ওঠে। বিয়ের আগে ওর নিত্য সঙ্গী ছিল এই মাউথ অর্গানটা। রাগ, দুঃখ, কষ্ট কিংবা আনন্দ সবেতেই ঢেউ তুলতো তার এই নিত্য সঙ্গীর সাথে। ছাদে একা একা, মনের অজান্তেই টপ টপ করে দু’ ফোঁটা জল পড়লো তার পুরোনো সঙ্গীর গায়ে। কোথাও যেন প্রিয়ংবদাও বুঝতে পারে তার সঙ্গীও তার বিরহে ব্যাকুল। নাহ্, এভাবে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে থাকার কোনো মানে হয় না।কেউ জানতে পারলে আর রক্ষা থাকবে না। ঝটপট করে সব গুছিয়ে রাখে ঠিক আগের মত করে। গিয়ে বসে ল্যাপটপের সামনে, কি করবে এই বিষয়টার ভেবে পায় না। ওদিকে অফিসের ব্যাগে থাকা নতুন মাউথ অর্গানটা যেন ওকে হাত ছানি দিয়ে ডাকছে। যেদিন থেকে অফিসে ‘ওয়ার্ক ফ্রম হোম’ হলো ঠিক তার আগের দিন সেই মাসের মাইনে থেকে কিনেছিলো অফিসের কাছে একটা নাম করা দোকান থেকে। যদিও জানতো সেটা কোনো দিন বাজাতে পারবে না, তাও। অফিসের সবার একরকম চাপে পড়েই কেনে সেদিন মাউথ অর্গানটা। অফিস ছুটি হওয়ার পর সবাইকার বারবার অনুরোধে বহু বছর বাদে দু-একটা গানের দু-এক কলি শোনানোর চেষ্টা করেছিল। আগের মতো না পারলেও, যা শুনিয়েছিল তাতেই অফিসের সবাই ওর ফ্যান হয়ে যায়। আজ কি একবার ট্রাই করবে? নাহ্ সে উপায় নেই। বাপের বাড়িতে বাবা ঠাকুমার ইচ্ছাতেই পাঁচ বছরের জন্মদিনে হাতে পায় তার প্রাণের সঙ্গীকে। সেখানে কোথাও কোনো বাধ্যবাধকতা ছিলো না। বিংশ শতাব্দীর যুগে ছেলে মেয়ে সব সমান সেরকমই মানসিকতার লোকজন সব সেখানে। বিয়ের আগে অবশ্য দাশগুপ্ত বাড়িতে এই সব নিয়ে কেউ কোনো আপত্তি তোলেনি। বরং শাশুড়িমা তো ওর মাউথ অর্গানের সুর শুনে মন্ত্র মুগ্ধ হয়ে গেছিলেন। বিয়ের পর অষ্টমঙ্গলা শেষ করে যখন শ্বশুর বাড়ি যায় সেবার খুব শখ করে বাপের বাড়ি থেকে তার প্রাণের সঙ্গীকেও নিয়ে গেছিল প্রথমবার। সেদিন সন্ধ্যে বেলায় নিতান্তই অভ্যাসবশত শ্বশুর বাড়ীর তেতলা ছাদে বসে সুর তুলেছিল। সেদিন ছিল জোৎস্না রাত। সারা পাড়া যেন সেই মুহূর্তে থমকে গিয়েছিলো। হঠাৎই সব কিছু ছারখার হয়ে যায়, যখন শ্বশুর মশাই এসে ওর হাত থেকে মাউথ অর্গানটা নিয়ে ছুঁড়ে মাটিতে মেরে ভেঙে দেন। কিছু বুঝে ওঠার অবকাশ পায়নি সেদিন প্রিয়ংবদা। মাথা নিচু করে সব শুনেছিলো সব, দেখেও ছিলো। যে দাসগুপ্ত বাড়ির বৌরা নাকি এই সব বাজারু কাজ করে না। শ্বশুর বাড়ীর একটা মানসম্মান- সম্ভ্রম আছে। নাহ্ তারপরের কথাগুলো আর শুনতে পারেনি প্রিয়ংবদা। অজ্ঞান হয়ে গেছিলো। তবে জ্ঞান ফেরার পর তার মনে ছিল কিভাবে বাড়ির একজন সদস্যও তার পক্ষ নেয়নি। নিজের স্বামী অংশুর দিকে শুধু তাকিয়েছিলো একবার, ভেবেছিলো সেই গাছের আড়ালে দাঁড়ালে হয়তো এই ঝড় থেকে রেহাই পাবে। নাহ্ সেদিন সেই আশাটাও ভেঙে চুরচুর হয়ে গেছিলো।
বুঝেছিলো অংশুর কাছে শারীরিক সম্বন্ধটাই অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ- মনের মিল থেকে। পরে শাশুড়িমাকে এই নিয়ে জিজ্ঞাসা করতে গেলে শুনতে হয়েছিল, “শোনো মা, ওই সব বাউন্ডুলেপোনা এবার ছাড়তে হবে। যা বাপের বাড়িতে করতে, করতে‌..তাছাড়া আমরা তো আর তোমাকে তোমার ওই সব ছাইপাশ শুনে বিয়ে দিয়ে নিয়ে আসিনি। তোমার মোটা অঙ্কের মাইনেটা যাতে অন্য কোনো সংসারে পড়ে বেহাত না হয় সেজন্য নিয়ে আসা। নইলে কি আছে তোমার?”

সেদিনের পর থেকে প্রিয়ংবদা বুঝে গেছিলো ওর আসলে জায়গাটা কি এই স্বনামধন্য দাশগুপ্ত পরিবারে। “কই গো এদিকে একবার শুনবে…” বর অংশুর গলা। কি একটা ভিডিও বানাবে, “হাউ টু বিকাম বেস্ট হাসবেন্ড ” বিষয়ের ওপর। তারপর ইউটিউবে এ দেবে। সেখানের ওর অনেক ফ্যান ফলোওয়ার। ভেজা চোখগুলো মুছে রান্না ঘরের দিকে এগোলো প্রিয়ংবদা! তাকেও যে প্রমাণ দিতে হবে…” দে আর  ভেরি হ্যাপিলি ম্যারিড কাপল্‌…!!”

গত চব্বিশ দিন আগে- দীর্ঘ ছয় মাস চেষ্টার পর প্রিয়ংবদার আবার ওয়ার্ক ফর্ম অফিস হয়েছে। আজকাল একটু দেরি করেই ফেরে।কি হবে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে! সেদিন রাতে খাবার টেবিলে শাশুড়িমা এই নিয়ে ওকে প্রশ্ন করতে, শাশুড়িমাকে স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে সে মোটা মাইনের বৌ ঘরে নিয়ে এলে তার ওপর অফিসের কাজের চাপ অনেক থাকে। তাই এই সব নিয়ে কোনো অবাঞ্ছিত প্রশ্ন তাকে না করাই ভালো। মাস গেলে সংসারে টাকাও আগের থেকে অনেক বেশি দেয়। তাই কেউ কিছু বলতেও পারে না। অবশ্য সবারই চোখে মুখে সব কিছুই প্রকাশ পায়।সেদিকে দৃষ্টিপাত না করে, রাতের খাবারটা কোনোরকমে গলাধঃকরণ করে সিঁড়ির দিকে পা বাড়ালো প্রিয়ংবদা। কাল সকালে আবার অফিসে বেরোনো আছে। অবাঞ্ছিত কথায় কথা বাড়িয়ে যে নিজের শক্তি ক্ষয় ছাড়া আর কিছু হয় না সেটা এতদিনে ও বুঝে গেছে। হঠাৎ পিছন থেকে কানে এলো শ্বশুর মশাই ওর ভাসুরের দশ বছরের ছেলে রেহানকে বলছে, “দাদুভাই, গান শিখতে হলে কিন্তু তোমাকে এই অভিমন্যুর মতো মাউথ অর্গান বাজানো শিখতে হবে। আহা কি সুন্দর বজায় ছেলেটা। বাংলার নতুন আওয়াজ কে বলবে! এই কদিন হলো রেডিওতে বাজাচ্ছে কিন্তু শুনলে পুরো বোঝা যায় যে পোক্ত হাত।এতদিন যে এই সব প্রতিভা কোথায় লুকিয়ে ছিল কে জানে! দাদুভাই তুমি, পারবে তো আমার মুখ উজ্জ্বল করতে?”

কোনো কথা না বাড়িয়ে নিজের ঘরের দিকে পা বাড়ায় প্রিয়ংবদা। মুখে একটা জয়ের হাসি। আড়চোখে দেখে নেয় দাশগুপ্ত পরিবারের সম্ভ্রমশীলতার চক্রবুহ‍্যকে…

পিছনে তখন রেডিওতে অভিমন্যু ঝড় তুলেছে তার সঙ্গীর সাথে…
“কারার ঐ লৌহকপাট,
ভেঙ্গে ফেল কর রে লোপাট,
রক্ত-জমাট শিকল পূজার পাষাণ-বেদী।
ওরে ও তরুণ ঈশান,
বাজা তোর প্রলয় বিষাণ
ধ্বংস নিশান উড়ুক প্রাচীর প্রাচীর ভেদি….”

Loading

Leave A Comment