আমার শার্লক হোমস
– শান্তনু ব্যানার্জী
লম্বা চেহারার ভদ্রলোক। ছফুটের কাছাকাছি হবে। অদ্ভুত রকমের স্মার্ট। মেদহীন চেহারা। ফুলহাতা পিওর কটনের হালকা স্ট্রাইপের শার্ট। আকর্ষণীয় হাঁটার ছন্দ। এক হাত প্যান্টের পকেটে আর এক হাতে ছোটো সুদৃশ্য একটা কালো রঙের ডায়েরি। অথবা প্যান্টের দু’ পকেটেই হাত ঢোকানো থাকত। পরিভাষায় সুন্দর হাইলি স্লোপ শোলডার। ফটোক্রোম্যাটিক লেন্সের চশমায় আধুনিকতার ছোঁয়া। প্রথম পরিচয়ে মনে হয়েছিল প্রাথমিকভাবে সাইকোপ্যাথ। কারো জন্য আনুগত্য ছিল না। অন্যের আবেগের কোনো স্থান ছিল না ওনার মনে।
অফিসের কাজে কিছু দিনের জন্য রায়পুর এসেছি। কর্পোরেট লোকজন বেশি থাকে এমন হোটেলকে বেছে নিলাম। কাজের শেষে রাত আটটার পর হোটেলে ফিরে দেখি করিডোরে একজন সুদর্শন পুরুষ বাংলাভাষায় উত্তেজিত ভাবে কথা বলছে। বাংলা শুনে দাঁড়িয়ে গেলাম। ভদ্রলোকের ভাষায় ‘আমি আজ পর্যন্ত যা মাল খেয়েছি সেই জলে তোমরা স্নান করোনি। আমার পয়সায় মাল খাবে আর আমাকেই বলবে মাতাল!!’ উত্তেজনা কমাতে কোনো ভাবনা চিন্তা না করেই ওনাকে একাই আমার রুমে নিয়ে এলাম। প্রসঙ্গত যে দুজনের সঙ্গে কথা চলছিল তারাও বাঙালি। ব্যাস, তারপরেই রসায়ন শুরু হয়ে গেল। দিনে দু’ কাপ চা ছাড়া কোনো নেশা ছিল না। সিগারেট খেতাম কিন্তু প্রিয় বান্ধবীকে অসন্তুষ্ট করতে চাইনি বলে তাও ছেড়ে দিয়েছিলাম। ওনার কোনো কথা জড়ানো নয়। স্পষ্ট এবং কাটাকাটা।
জানলাম উনিও কোম্পানির প্রোজেক্টে মাস তিনেকের জন্য এসেছেন। ফেরার সময় হয়ে এসেছে। ফিরে যাবেন কোলকাতায়। অনেকক্ষণ কথা চলার পর মনে হলো আমি শার্লক হোমসকে পেয়েছি।
কলকাতায় ফিরে এক বছরের মাথায় দেখা হয়ে গেল এক রোববার নিউ কেনিলওয়র্থ হোটেল লাউঞ্জে। স্ত্রী এবং দুই পুত্রকে সঙ্গে নিয়ে এসেছেন ডিনার করতে। আমি গিয়ে ছিলাম কর্পোরেট বুকিং লিস্ট চেক করতে। আমাকে দেখেই চেঁচিয়ে ডাকলেন- সমীরণ.. পরিবারের সঙ্গে পরিচিত হলাম। বললাম আমার নাম কিন্তু ‘সমীরণ’ নয় । উনি আজীবন কিন্তু আমাকে সমীরণ বলেই ডেকে এসেছেন। আমিও ওনাকে শার্লক বলেই ডাকতাম। অন্য কাজ থাকায় ডিনারে যোগদানে অক্ষমতা জানিয়ে আমি চলে এলাম। সকলে মিলে আমাকে পরের রবিবার লাঞ্চ করতে ওনাদের সাদার্ন এভিনিউয়ের ফ্ল্যাটে নিমন্ত্রণ করলেন। অল্প সময়ে এটুকু বুঝেছিলাম উনি খুব ডমিনেটিং। বাড়ীর লোকজন সকলেই খুব তটস্থ থাকেন। ঘরে বাইরে একইরকম। মানে ‘আমিই শেষ কথা ‘ ভাবলাম এর সাথে আমার কোনোদিন বনিবনা হবে না। কিন্তু আমার ক্ষেত্রে পুরোপুরি উল্টো হয়ে গেল। সবসময় আমাকে প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে সন্তুষ্ট করতে চাইতো।
পরের রবিবার শার্লকের বাড়িতে লাঞ্চ করার পর ওনার স্ত্রীর অনুরোধে যমুনা সিনেমা হলে ইভনিং শোতে সিনেমা দেখতে বেরোলাম।
হাউস ফুল চলছে। শার্লক বললো, কুছ পরোয়া নেই। হলের সামনে ওর পরিবারকে আমার কাছে রেখে সোজা সিনেমা হলের মধ্যে ঢুকে গেল। মিনিট পনেরো বাদে বেরিয়ে এসে ভেতরে আসতে বললো। গিয়ে দেখি আমাদের জন্য গোটা পাঁচেক খুব ভালো গদিআটা চেয়ার আলাদা করে ব্যবস্থা করা আছে। আমাকে দেখেই ম্যানেজার খুব খাতির করতে শুরু করল। সিনেমা শেষে বাইরে বেরিয়ে জানতে পারলাম শার্লক নিজেকে পুলিশ ডিপার্টমেন্টের লোক বলেছিল আর আমার পরিচয় দিয়েছিল ওনার উপরওয়ালা হিসেবে।
ব্যক্তিত্ব ও কঠিন গলার স্বরে সব জায়গাতেই নিজের কাজ করে নিত। হার না মানাটাই ছিল স্বভাব।
একবার আসানসোল থেকে ব্ল্যাক ডায়মন্ড এক্সপ্রেসে হাওড়া ফেরার পথে দুর্গাপুরে সামনে কোনো ট্রেন লাইনচ্যুত হয়। ট্রেন কখন যে ছাড়বে তার ঠিক নেই। অগত্যা আমাকে বসিয়ে রেখে কিছু ট্রেনের লোকজন সঙ্গে স্টেশন মাস্টার অফিসে গিয়ে হাজির। আধঘণ্টা বাদে ফিরে এলো। ট্রেনটা পিছনের দিকে ব্যাক করে থার্ড লাইন ধরে হাওড়ার দিকে এগোতে শুরু করলো। এরকম তো কখনো কেউ দেখেনি। সকলে শার্লকের দিকে তাকিয়ে ছিল। পরে জানলাম উনি নিজেকে সেন্ট্রাল মিনিস্টারের ভাই বলে পরিচয় দিয়েছিলেন। যাই হোক এখনকার সময়ে এসব করে পার পাওয়া যায় না।
গলার স্বর এবং ব্যক্তিত্বকে খুব ভালো ব্যবহার করত শার্লক। একবার ট্রেনে এসি থ্রি টায়ারের জায়গা দখল করেছিল দুজন। নিজেদের সেন্ট্রাল গভর্নমেন্টের লোক বলে পরিচয় দিয়ে সবাইকে ট্রেন থেকে নামিয়ে দিয়েছিল।
শার্লক সম্বন্ধে ঘটনা বলে শেষ করা যায় না। মোটা বই তৈরি হতে পারে। সিনেমা হতে পারে।
যাই হোক কাজের চাপে আমিও বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেরাচ্ছিলাম। মাঝ খানে সাত বছর যোগাযোগ ছিল না। একদিন সকালে দেখি আমার বাড়ি খুঁজে খুঁজে এসে হাজির। এই প্রথম আসা আমাদের বাড়ি। চেহারা খারাপ হয়ে গেছে। বাঘ যেন বিড়াল হয়ে গেছে। স্ত্রী কেন্দ্রীয় সরকারের অফিসে উচ্চ পদস্থ অফিসার ছিলেন। রিটায়ার হবার অনেক আগেই মারা গেছেন। ফোন নম্বর হারিয়ে যাওয়ায় আমাকে যোগাযোগ করতে পারেন নি। ক্যালকাটা ক্লাবে নাতির জন্মদিন পালন হবে, তার জন্য নিমন্ত্রণ।
জন্মদিনে গিয়েছিলাম। মনে হলো দুই ছেলে তাদের বন্ধু বান্ধব এবং পরিবার নিয়েই আছে। শার্লক এখন অনস্তিত্ব। বাঘ থেকে বিড়াল এবং এখন যেন ইঁদুর। কিছুক্ষণ সঙ্গ দিয়ে ফিরে এলাম।
এর কিছুদিন বাদে আমি ভুবনেশ্বর থাকাকালীন বড় ছেলের ফোন পেলাম। শার্লক মারা গেছে। খুব কষ্ট পেলাম। বললাম দু’দিন বাদে কলকাতায় ফিরে ওদের বাড়িতে যোগাযোগ করবো। তবে ফোন করে যাব।
কলকাতায় ফিরে এসে ওদের বাড়িতে ফোন করলাম। আধঘণ্টা কেউ ল্যান্ড ফোন তুললো না। তারপর ফোনটা তুলে নামিয়ে রাখলো। জানতেও চাইলো না কে ফোন করছেন। ঘরের মধ্যে উৎসবের আমেজ। হৈ হৈ রৈ রৈ ব্যাপার। কত রকমের আলোচনা রিসিভার দিয়ে ভেসে আসছে।
আমি আমার ফোন বন্ধ করলাম। মনে হলো, আজকের দিনে রূদালিদেরও কোনো মার্কেট নেই।