Site icon আলাপী মন

গল্প- অভিশপ্ত রাত

অভিশপ্ত রাত

-অর্পিতা ঘোষ

 


বাড়ির বারান্দায় হাঁটু মুড়ে বসে এখনো কেঁদে চলেছে রমেশ |সেই দুর্বিষহ আমফান ঝড়ের তান্ডবের পর প্রায় দশদিন কেটে গেলেও সেই অভিশপ্ত রাতের ভয়াবহ পরিণতির কথা ভাবলেই কান্নায় বুক ফেটে যাচ্ছে তার। 
রমেশ মাঝি, পেশায় একজন চটকল কর্মী | লকডাউনে কারখানা বন্ধ তবে বাপ্-ঠাকুরদার আমলের দুইখানা পুকুর থাকায় এ যাত্রায় বেঁচে যাচ্ছিলো | পুকুরের মাছ বিক্রি করে যা রোজগার হতো তাতে মেয়ে বৌ নিয়ে কোনোরকমে সংসারটা চলে যাচ্ছিলো| কিন্তু সেইদিনের সেই সাংঘাতিক ঝড়ে যেন তার সব কিছু খড়কুটোর মতো ভেসে গেল। 
বাড়িটা তার পাঁকা তবে মাথার উপরে টিনের ছাউনি । বাড়ির মধ্যে রয়েছে বহু পুরোনো আম, জামরুল, কাঁঠাল, সুপারি, নারকেল গাছ। ঝড়ের দিন তাড়াতাড়ি বিক্রিবাট্টা শেষ করে রমেশ ঘরে সেঁধিয়ে পড়েছিল । কি তাড়াতাড়ি আবহাওয়ার পরিবর্তন হচ্ছিল তা চোখের সামনে দেখছিলো সকলে । সময় যত এগোচ্ছিল ঝড়ের দাপট ততই বাড়ছিল।  বাড়ির উঠোনের পুরোনো গাছগুলো হাওয়ায় সাংঘাতিক রকম দুলছিলো কি তার আওয়াজ ! শো শো করে মনে হচ্ছিলো যেন কোনো দানব সমগ্র পৃথিবীটা গিলতে আসছে আর সেই সঙ্গে ছিল অসম্ভব বৃষ্টির বেগ।  প্রকৃতি যেন উন্মাদ হয়ে নৃত্য করছিল, এক লহমায় সব কিছু ধ্বংস করে দেবে সে।  রমেশের ছোট্ট মেয়েটা একরকম ভয়ে কান্না জুড়েছে । অনেক চেষ্টা করেও তাকে তার মা কিছুতেই থামাতে পারছে না।  ওদিকে বাইরের পরিস্থিতি ক্রমশ খারাপ হচ্ছে দেখে সকলে করজোড়ে ঠাকুরের নাম জপ করতে শুরু করেছে।  ধরিত্রী মা কে শান্ত করার জন্য চারিদিকে উলু, শঙ্খ ধ্বনি দিচ্ছে সবাই।  রমেশের বৌ’ও শঙ্খ বাজানোর জন্য ঠাকুর ঘরে যায়,  মায়ের আঁচল ধরে ছোট্ট মেয়েটাও মায়ের পাশে এসে দাঁড়ায় । সবে শাঁখে একবার আওয়াজ হয়েছে এমন সময় বিকট আওয়াজ ! উঠোনের পুরোনো আমগাছের মোটা ডালটা ঝড়ের দাপটে হুড়মুড় করে ঠাকুর ঘরের টিনের চালে ভেঙে পড়ে, আর টিনটা ওই বড়ো আমের ডালের ভার রাখতে না পেরে ভেঙে পড়েছে মা মেয়ের মাথার উপর।  নিমেষের মধ্যে সব শেষ ! ঝড়ের তান্ডবের মধ্যে রমেশ একা কিছুই করতে পারলো না কেবল চোখের সামনে সংসারটা ভেসে যেতে দেখলো বন্যার মতো । কোথায় যাবে, কি করবে এসব ভাবতেই ভাবতেই যেন সব শেষ হয়ে গেল । ঝড় থামলে সবাই যখন সবার খোঁজ নিতে শুরু করেছে তখন রমেশের বাড়িতে ঢুকে ওই পরিস্থিতি দেখে সবাই হতবাক।  রমেশ দরজায় স্থানু হয়ে বসে আছে । কোনো সাড়া নেই, চোখের কোল শুকিয়ে গেছে । সবাই তাকে ডাকাডাকি করায় যখন তার হুশ ফেরে সে পাগলের মতো ছুটোছুটি করতে থাকে তার একরত্তি মেয়ে ও বৌটার প্রাণ ফিরে পাওয়ার জন্য।  এভাবে সব শেষ হয়ে যাবে প্রতিবেশীরা কল্পনাও করতে পারেনি। তাদেরও যেন রমেশকে সান্তনা দেওয়ার ভাষা ফুরিয়ে গেছে। 
সব কিছু মিটতে মিটতে পরদিন দুপুর গড়িয়ে গেল। রমেশ সেইদিন থেকে একই ভাবে বারান্দায় বসে বসে চোখের জল ফেলে চলেছে । সবকিছু ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হলেও সে পারেনি স্বাভাবিক হতে।  এই কদিনে অনেক সরকারি সাহায্য এসেছে, অনেক সমবেদনা, অনেক কিছু হয়েছে কিন্তু তার মেয়ে আর বৌ ফিরে আসেনি ! দুর্বিসহ আমফান ঝড় তার সুখের সংসারটা লন্ডভন্ড করে দিয়েছে।  রমেশ মনে মনে ভাবে বৌটা কত করে বলেছিলো ঘরের এত কাছের এই আমগাছটা কেটে দাও, কখন কি অঘটন ঘটে, কিন্তু সে কিছুতেই কাটেনি । সে বলতো এ গাছ তার ঠাকুরদার আমলের আর কি ভালো জাতের আম হয় ! তাছাড়া শুধু শুধু এত ফলন্ত একটা গাছ কাটলে যদি শাপ লাগে ! কিন্তু কে জানতে এই গাছটাই একদিন এভাবে তার সব কিছু শেষ করে দেবে।  রমেশ একদৃষ্টিতে গাছটার দিকে তাকিয়ে থাকে আর কাঁদতে কাঁদতে বলে, ‘ ফিরিয়ে দে আমায় আমার একরত্তি প্রাণটাকে, আমার জীবনে সুখ-দুঃখের সাথীকে, দে ফিরিয়ে… ‘ কিন্তু যারা না ফেরার দেশে পাড়ি দেয় তারা কি আর ফিরতে লারে ! পারে না। নীরব গাছটা কেবল মাটি আঁকড়ে দাঁড়িয়ে থাকে অপরাধীর মতো। 

Exit mobile version